#নীলপদ্ম
#৯ম_পর্ব
বাসায় পৌছেই দিশার মুখে মিষ্টি পুড়ে দিতো দিশার মা, রেহনুমা বেগম। অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন,
– একটা সুসংবাদ আছে রে, যা যা তাড়াতাড়ি কাপড় ছেড়ে তৈরি হয়ে আয়।
– কি সুসংবাদ?
দিশাকে টেনে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ধীর কন্ঠে রেহনুমা বেগম বলেন,
– সুমনা ভাবী আজ ফয়সালের আর তোর বিয়ের পাকা কথা বলতে এসেছেন, তোকে সে নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চান তার ছেলের বউ করে
– মানে কি? তোমরা কি বলেছো তাকে?
– আমি তো রাজী কিন্তু তোর বাবা তোর মতামত চাচ্ছেন, আমি জানি তুই ও ঠিক রাজী হয়ে যাবি। এখন দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আয়।
– মা, সব জেনে শুনে এ কাজটা কেনো করছো? তুমি তো জানো আমি বিবাহিত
– তোর বাবার এই অবস্থা হবার পর ও ওই ছেলের হয়ে কথা বলবি দিশা?
– কিন্তু মা………
– আমি কিছু জানি না তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়
বলেই রেহনুমা বসার ঘরের দিকে চলে গেলেন। দিশার ইচ্ছে করছে সব কিছু ছেড়ে সেখান থেকে চলে যেতে। মার সাথে তার এই জন্য বাধে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমে চলে যায় দিশা। এওবশ্য এখানে মার ও দোষ নেই সে তো তাই করবে যা তার সঠিক মনে হয়েছে, মাঝে দিশাকে শোকাতাপের অনলে দহন হতে হবে। আচ্ছা তার সাথেই এমন কেনো হয়! সে কখনোই ফয়সালকে তার হাসবেন্ডের অধিকার দিতে পারবে না, সে কখনোই হৃদয়ের জায়গা তাকে দিতে পারবে না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু উপায়ন্তর পাচ্ছে না। এখন কাঠের পুতুলের মতো সেজে তাদের সামনে দাঁড়াতে হবে তার। ওয়াশরুমে ঝরণাটা ছেড়ে টুপ করে বসে পড়ে দিশা। ঝরণার পানি চোখের অশ্রুগুলোকে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ইশশ যদি সেও সময়ের গহবরে তলিয়ে যেতে পারতো। এতো দোটানার মুখোমুখি তাকে হতে হতো না। মানুষ খুব অদ্ভুত নিজেই ভুল করে, আবার সেই ভুলের মাশুল দেবার বেলা নিজেই শোকাতাপ করে___
সায়মা মুখ কালো করে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। এক তরফা ভালোবাসার ফল পাচ্ছে। এক দৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার অন্তরের খুশির জোয়ার মুখে স্পষ্ট। বুঝাই যাচ্ছে দিশাকে বিয়েতে তার মত আছে। সুতরাং নিজের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে লাভ নেই। আর যার নিজের বাবা তাকে কখনো খোঁজ নেই নি, অন্যের বাসায় আশ্রিতা হিসেবে রেখেছে তাকে কি ফয়সালের মতো ছেলে পছন্দ করবে! নিজের ভাগ্যের পরিহাসের উপর নিজেরই হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এই বিয়েতে কি দিশা সুখী হতে পারবে ? দিশা কি কখনো হৃদয়কে ভুলতে পারবে? কারোর সামনে এই কথাগুলো বলতেও পারছে না সায়মা। রেহনুমা বেগম যেভাবে হাসি খুশি অবস্থাতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেছেন তাতে এখন কিছু বলাটা বোকামি হবে। আচ্ছা হৃদয়কে যদি দু বছর আগের কথা বলা যেতো তাহলে দিশাকে এই বিয়েটাও করতে হতো না সাথে হৃদয় ও আসল কালপ্রিটকে শাস্তি দিতে পারতো। কিন্তু, এই কিন্তু শব্দটা বড় অদ্ভুত। সব কাজে যদি এই কিন্তুটা না থাকতো তবে হয়তো সমস্যাগুলো এতো জটিল হতো না, আর জীবনধারাতেও কোনো ঝামেলা থাকতো না,,,,, হয়তো____
একটা লাল সুতির শাড়ি পরে রুম থেকে বের হলো দিশা। ঝাকড়া দোল খেলানো চুল গুলো হাফ পাঞ্চ করে রেখেছে। হালকা সাজে সজ্জিত সে, কানের ঝুমকো গুলো চুলের সাথে দুলছে। ঠোঁটে হালকা লাল লিপ্সটিক, চোখে কাঁজল, যেনো পুরো বাঙ্গালী একটি মেয়ে। দিশা অফিসে সব সময় শার্ট এবং জিন্স পড়ে। কিন্তু ওকে শাড়িতেও সে এতো সুন্দর লাগে তা যেনো জানা ছিলো না ফয়সালের, শ্যামবর্ণের মেয়েটির লাল শাড়িতে কোনো ফুটন্ত লাল গোলাপের থেকে কম লাগছে না। ঠোঁটের নিচের তিলটা যেনো তার চোখে ধাধার মতো লাগছে। সময়টা থমকে গেলে যেনো খারাপ হতো না। মনে মনে বলতে লাগলো,
“শ্যমলী তুমি কি সত্যিই শ্যামলী
নাকি সুন্দরী, না রুপসী
নাকি শিল্পীর মধুর কন্ঠস্বর, হাতের আঁচড়
হয়তো বা তার গানের উর্বশী “ – (রিপন রায়)
ফয়সালের দৃষ্টি অনুসরণ করে সুমনা বেগম দরজার দিকে তাকালো। আজ সত্যি দিশাকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। মিটিমিটি হেসে তিনি নিজে উঠে গিয়ে দিশাকে নিজের পাশে বসালেন। কপালে চুমু দিয়ে বলতে লাগলেন,
– মা তোকে আমার ঘরে নেবার ইচ্ছে অনেকদিনের ছিলো, আজ আমার গবেটটা আমার আশা পূরণ করছে। কি যে শান্তি লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না।
দিশা চুপ করে দুমনা বেগমের কথা শুনে যাচ্ছিলো। ঠোঁট চেপে নিজের কান্না আটকাচ্ছে সে। পারছে না এখানথেকে পালিয়ে যেতে। সুমনা বেগম দিশার হাতে নিজের বালাজোড়া খুলে পড়িয়ে দিলো। আর ধীর কন্ঠে বললেন,
– আজ থেকে আমার ছেলে এবং এই বালাজোড়া তোর কাছে দিলাম, তুই ই তাদের দেখিস মা।
সুমনা বেগমের কথাগুলো পাথর সমান বোঝার মতো তার কাছে লাগছে। আলতাফ বেগম তার মেয়ের মনের অবস্থা ঠিক বুঝেছেন, মেয়েটা যে এই বিয়ের খবরে যে একেবারেই খুশি নয় সেতা তার বুঝতে বাকি নেই তার। আজ যদি তার পা দুটো অবশ না হতো তাহলে মেয়েটাকে এতোকিছু সহ্য করতে হতো না। এখন তিনি কিছু না বললে মেয়েটা বোঝার চাপে বিলীন হয়ে যাবে। তাই একটু শক্ত কন্ঠেই বলে উঠলেন তিনি,
– ভাবী আমার মেয়েটার ও ইচ্ছে অনিচ্ছের একটা ব্যাপার আছে। এখনই এসব তার উপর জোর করে চাপিয়ে দিবেন না প্লিজ
– মানে? ভাই আমি তো
– এই তুমি কি বলছো? ভাবি কি খারাপ কিছু করেছে নাকি? (রেহনুমা বেগম)
– আমি যা বুঝছি তাই বলছি, ফয়সাল দিশাকে পছন্দ করে বলে এই না যে দিশাও ফয়সালকে পছন্দ করবে। ও অফিস থেকে এসেছে, ওকে এই বিয়েটা নিয়ে চিন্তা করার সময় টুকু দাও। ওর মুখ দেখেছো? কতোটা চুপ হয়ে আছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এই বিয়েটা ও এখনো দোটানায় আছে। মেয়েটাকে অনেককিছু চাপিয়ে দিয়েছো রেহনুমা আর না।
বলেই নিজের রুমের দিকে রওনা দিলেন তিনি। সুমনা বেগম একেবারেই চুপসে গেছেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে বেশ লজ্জিত তিনি। ফয়সাল ও বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে, যদি সত্যি দিশার এই বিয়েতে অমত থাকে তখন! একতা থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে দিশার বাসায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই____
পরদিন বিকেল ৫টা,
কফিশপে মুখোমুখি বসে রয়েছে দিশা এবং ফয়সাল। দিশা সায়মাকেও নিয়ে এসেছে। ফয়সালকে সব কিছু খুলে বলাটা খুব দরকার, কারোর স্বপ্ন ভাংগাটা খুব দোষের কিন্তু কাউকে মিথ্যের আড়ালে রাখাটা বোধ হয় পাপের সমতূল্য। ফয়সালের মনে একটা ভয় দলা পেঁকে আছে, কেনো জানে মনটা খুব কু ডাকছে। কালকে ফয়সালের মা তার বালাজোড়া নিয়ে যান নি। বলেছিলেন,
– এটা তোর কাছে রাখ, যদি তোর এই বিয়েতে আপত্তি থাকে তবে ফয়সালকে ফেরত দিয়ে দিস
দিশা দীর্ধশ্বাস ফেলে বালা জোড়া টেবিলে ফয়সালের দিকে এগিয়ে বললো,
– ফয়সাল, তুই নিশ্চয়ই একজন বিবাহিত মেয়েকে বিনা তালাকে বিয়ে করবি না।
– মানে?
অবাক হয়ে ফয়সাল প্রশ্ন করলে দিশা বলে,
– আমার বিয়ে…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি