#নীলপদ্ম
#৮ম_পর্ব
হৃদয় দাঁড়িয়ে আছে সবার সামনে। খুব মলিন মুখে সে বলতে লাগলো,
– আমি মাত্র সপ্তাহ কয়েক এই কোম্পানিটি কিনেছি কিন্তু আপনারা আমার ফ্যামিলির মতো। সো আমার কোনো খুশির মোমেন্টে আপনাদের আগমণটি খুব কাম্য আমার। আগামী সপ্তাহে শুক্রবার আমার বিয়ে। আমি আশা করবো আপনারা প্রতিটি মানুষ সেখানে উপস্থিত থাকুন। এটা তে দু পরিবারের সাথে সাথে দুটি কোম্পানি ও একত্রিত হচ্ছে। নিশাত প্লিজ
বলেই নিশাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো হৃদয়। নিশাত ও হৃদয়ের হাত ধরে সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। হৃদয়ের পাশে নিশাতকে দেখে হুহু করে উঠলো দিশার হৃদয়। এটাই তো ভবিতব্য ছিলো তাদের। তবে কেনো এতোটা কষ্ট লাগছে, কেনো চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। না চাইতেও চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। হৃদয়ের চোখে চোখ পরতেই চোখ সরিয়ে নিলো দিশা। খুব নিপুন ভাবে নিজের অশ্রুদের আড়াল করলো সে। হৃদয় খানিকটা দিশাকে দেখিয়েই নিশাতের কোমড়ে হাত রাখলো আর মিষ্টিভাবে বললো,
– আমার বেরং জীবনকে পুনরায় রঙিন করতে তোমাকে আমার খুব দরকার। কারণ তুমি যে আমার নীলপদ্ম। আজকে তাই সবার সামনে আমি আমার নীলপদ্মকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিতে চাই। আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটি আমার উড বি ওয়াইফ, মিস নিশাত চৌধুরী। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
দিশা পারছে না পালিয়ে যেতে। মনে হচ্ছে কেউ ভোঁতা ছুরি দিয়ে বারংবার হৃদয়ে আঘাত করে যাচ্ছে। এটাই তো বারংবার চেয়েছিলো দিশা তবে আজ কেনো এতো খারাপ লাগছে। কেনো নিজের ভালোবাসা হারাবার ক্ষতগুলো তাজা অয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সেদিন যখন হৃদয় তার প্রেয়সীর প্রতি অনুভূতিগুলো ব্যাখা করছিলো তখন একবারের জন্য ও মনে হয় নি সে আবেগে কথাগুলো বলছে তবে এই দুদিনে তার প্রেয়সীর স্থান নিশাত কিভাবে নিয়ে নিলো। অবশ্য একটা মানুষ তার অতীতে কতোদিন আটকে থাকবে। এটাই শ্রেয় হয়তো তাদের দুজনের জন্য____
অফিসরুমে,
গ্লাসের দেয়ালে বাহিরের দিকে একনাগারে দৃষ্টিপাত করে যাচ্ছে হৃদয়। মাথায় অজস্র চিন্তারা দলা পাকিয়ে আছে। কেউ একজন রাঘব বোয়াল তার জীবনে রয়েছে যে কিনা তার জীবনটাকে চরকি নাচন দিচ্ছে। সে মানুষটা ধরতে পারলে জ্যান্ত কবর দিতো হৃদয়। কিন্তু সে মানুষটা ডালে ডালে চলছে। প্রতিটি কাজ এতো নিপুনভাবে করছে যার কোনো হদিস হৃদয় পাচ্ছে না। হঠাৎ পেছন থেকে নিশাত তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– থ্যাংক উ সো মাচ, আমাকে এতোটা সম্মান দেবার জন্য। তোমার মনে আমার জন্য এতোটা অনুভূতি আছে সেটা আমার জানাই ছিলো না। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমাকে আন্টির কথায় বিয়ে করতে রাজী হয়েছো
– প্রথমে সেটাই ভেবেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার মুভ অন করা প্রয়োজন। কতোদিন একমেয়ের আশাতে বসে থাকবো বলো। তবে নিশাত আমার সময় প্রয়োজন।
নিশাতকে নিজের থেকে আলাদা করে ধীর গলায় বললো,
– আসলে কি বলোতো, এতোদিন একজনকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি।বিনিময়ে শুধু একরাশ প্রতারনা বাদে কিছুই পাই নি। এখন তাদের নিজের মন থেকে একেবারে সরাতে হলেও আমার কিছু সময়ের প্রয়োজন। আই হোপ ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড।
– তোমার যত সময় প্রয়োজন আমি দিতে রাজী আছি। তবুও তুমি তোমার ওই প্রেয়সীকে ভুলে যাও
– অবশ্যই, আমি চেষ্টা করবো।
বলেই নিশাতকে জড়িয়ে ধরে হৃদয়, হৃদয় খেয়াল করে দরজার কাছ থেকে একটা ছায়া নিরবে সরে পড়েছে। ছায়াটি সরে যাওয়ার পর পর ই হৃদয় নিশাতকে ছেড়ে দেয়। খুব আদুরে গলায় বলে,
– যাও, মার সাথে শপিং করো। আমি আংকেলের সাথে দেখা করে নিবো।
– ওকে, আসি
নিশাত বেরিয়ে গেলে বাঁকা হাসি হেসে সিগারেটে সুখ টান দেয় হৃদয়, যা অনুমান করেছে সেটাই হচ্ছে। যে ছক কেটেছিলো সেটা অনুযায়ী সব প্লান আগাচ্ছে। এখন শুধু ক্লাইমেক্সের অপেক্ষা।
অপরদিকে,
নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না দিশা, সকল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে সে। তবুও তার কোনো আক্ষেপ থাকত না যদি না আজ হৃদয় তাকে প্রতারক না বলতো। পারছে না হৃদয়ের সামনে সব সত্যিগুলো বলে দিতে। পারছে না আসল দোষীর মুখোশ ছিড়ে ফেলতে। যার কারণে আজ তার এতোটা খারাপ অবস্থা, তাকে শাস্তি দিতে পারছে না। হৃদয়ের মুখে নিজের সম্পর্কে এমন কথাগুলো যেনো কিছুতেই কাম্য ছিলো না দিশার। হৃদয় কি করে প্রতারক বললো! সে কি জানে তাকে ভালোবাসার দাম দিশা কিভাবে দিয়েছে? না সে জানে না আর কখনো জানবে ও না। কখনো নিজের অধিকার নিয়ে তার সামনে দাঁড়াবে না দিশা। থাকুক না সে প্রতারক হয়ে। এখানে একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলোও তো আর বাকিগুলো ঠিক থাকবে। ডেস্কে বসে ফাইল গোছাতে গোছাতে চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো দিশার। নিজেকে সামলে আবার কাজে মনোযোগ দিলো সে। তার বাবা মাকে ঠিকমতো বাঁচিয়ে রাখতে হলে এগুলো তার করতেই হবে।
সন্ধ্যা ৭টা,
কাজের চাপে, মানসিক যন্ত্রণার কারণে বড্ড বেশি ক্লান্ত দিশা। সায়মা অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে। মেজাজ খুব খারাপ তার, দিশা কেনো সব মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে এটা তার মাথায় আসছে না। হৃদয়ের উপর আরোও মেজাজ খারাপ হচ্ছে সায়মার। সে কিভাবে দিশাকে ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলো। সব মিলিয়ে মেজাজ খারাপ করে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছে সে। দিশাকেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে সে হৃদয়ের বিয়েতে যাবে না সাথে দিশাকে ও যেতে দিবে না। দিশা অবশ্য নিজেও যেতো না। নিজের ক্ষত আর বাড়াতে চায় না সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাস্তায় হাটছে সে। হঠাৎ একটা বাইক এসে সামনে দাঁড়াতেই খানিকটা ভড়কে গেলো সে। হেলমেট খুলতে খুলতে ফয়সাল বলতে লাগলো,
– কি রে ভাই মরার প্লান করছিস নাকি?
ফয়সালের এমন অদ্ভুত কাজ গুলো বেশ চমকে দেয় দিশাকে। ছেলেটা এমন কেনো! বেশ তিক্ষ্ণ গলায় বললো,
– চোখ কি পকেটে রাখিস নাকি কাউকে দিয়ে এসেছিস? ফুটপাতে বাইক তুলে দেয়া কোন জায়গার নিয়ম শুনি? আর একটু হলে তো জান পাখি উড়াল দিতো আমার?
– যা বাবা, আমি কি করলাম? অন্য মনস্ক হয়ে রাস্তায় অন্ধের মত তুই হাটছিস, আর দোষ কিনা আমার?
– আলবত
– ক্ষ্যামা দে, চল বাইকে উঠ। এখন বাইকে? কোথায় যাবি?
– কোথায় আবার? তোর বাড়ি। মা ওখানেই আছে। সায়মা তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ায় আমাকে তকে নিয়ে যাবার হুকুম পড়েছে।
– ওহহ
– একটা কথা বলি?
– বল
বাইকে উঠতে উঠতে দিশা বললো। তখন শান্ত ভাবে ফয়সাল বললো,
– কফি শপ হয়ে বাড়ি যাই? তর চোখ মুখ ফুলে আছে। আংকেল দেখলে সন্দেহ করবে।
ফয়সাল এবং সায়মাকে কখনো মুখ ফুটে নিজের খারাপ লাগার কথাগুলো বলতে হয় নি। কিভাবে জানে মুখ দেখলেই বলে দেয় তারা যে দিশার মন ভালো নেই। অপরদিকে দিশার এভাবে ফয়সালের বাইকে উঠে চলে যাওয়ার দৃশ্যটি একজনের চোখ এরালো না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সংবরণ করলো সে।
বাসায় পৌছেই দিশার মুখে মিষ্টি পুড়ে দিতো দিশার মা, রেহনুমা বেগম। অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি বললেন,
– একটা সুসংবাদ আছে রে………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি