নীলপদ্ম ৬ষ্ঠ পর্ব

0
1717

#নীলপদ্ম
#৬ষ্ঠ_পর্ব

ফোন রিসিভ করার পাঁচ মিনিট পর দিশার মুখের রঙ বদলে যায়।
– আমি আসছি এখনই।

বলে ফোন কেটে দেয় দিশা। সায়মা কিছু জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে দিশা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। সায়মার বুঝতে বাকি নেই দিশার মুখের রঙ কেনো পালটে গেছে। দিশা এক মূহুর্ত দেরি না করে ট্যাক্সি চড়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। সায়মা তাকে একা ছাড়ে নি, সেও দিশার সাথে হাসপাতালে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পর পর দিশা ট্যাক্সিওয়ালাকে তাড়াতাড়ি চালাতে বলছে। একটা পর্যায়ে সায়মা বাধ্য হয়ে দিশাকে বলে,
– এটা ট্যাক্সি দিশা, কোনো রকেট না। শান্ত হ আংকেলের কিছু হবে না।
– দোস্ত তুই বুঝতেছিস না,
– আমি বুঝছি, তুই শান্ত হ। বললাম তো আংকেলের কিছু হবে না।

সায়মার কথায় দিশা কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়। আজ তার কাজের কর্মফল তার বাবাকে ভোগ করতে হচ্ছে। আবেগের কবলে পড়ে হৃদয়কে ভালো তো বেসে ফেলে সে কিন্তু তার মূল্য এভাবে দিতে হবে এটা তার জানা ছিলো না।

বিকেল ৫টা,
দিশার সাথে ওভাবে আচরণ করা মোটেই যে ঠিক হয় নি তা হৃদয় খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। কিছুক্ষণ আগে যখন পিওনকে দিশার কাছে একটি ফাইল পাঠাতে বলে তখন সে জানায়,
– দিশা ম্যাডাম অনেক আগেই বের হয়ে গেছে হাফ ডে নিয়া।

হৃদয় আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে না পিওন কে। দিশার সাথে কেনো যেকোনো মেয়ের সাথে এমন আচারণ করলেই তাদের রিয়েকশন যে এমন ই হবে এটাই স্বাভাবিক। হৃদয় কোনো সময় এতোটা আবেগী ছিলো না, কিন্তু প্রেয়সী তার কাছে অনেকটা দৈত্যের সেই তোতাপাখির মতো যার মাঝে দৈত্যের প্রাণ আটকে থাকে। প্রেয়সীর কথা ভাবলেই কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। তাই আজকে বোকার মতো এমন কাজ করে ফেললো। না জানি দিশা তার সম্পর্কে কি ভাবছে। তার চিন্তাগুলো সিগারেটের ধোয়ায় উড়ছে, হঠাৎ একটা চিন্তা হৃদয়ের মাথায় জেকে বসলো। চোখ জোড়া বন্ধ করে দিশার বলা কিছু লাইন বারবার তাকে ভাবাতে লাগলো তা হলো,
“আপনি তার আসল নামটি কি সেটাও জানেন না, আর চোখে দেখা সেটার কথা তো বাদ ই দিলাম। তাহলে কেনো এই প্রিয়তমাকে হন্যে হয়ে খুজছেন আপনি? বলি কি আজ বাদে কাল আপনার বিয়ে, জীবনের এই সময়টাতে অহেতুক একটা ছায়াকে ধরার চেষ্টা ছেড়ে জীবনটাকে সাজানোর কথা ভাবুন”

দিশার সাথে তার পরিচয় কেবল কয়েকদিনের সে কি করে জানলো হৃদয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, হৃদয় প্রেয়সীকে চোখে দেখে নি, তার আসল নামটি ও হৃদয়ের অজানা। উফফ আর ভাবতে পারছে না হৃদয়। মাথার শিরাগুলো দপদপ করে লাফাচ্ছে। মেয়েটির মাঝে যেনো রহস্যপুরী বিদ্যমান। একটা রহস্যের উম্মোচন করতে না করতে যেনো আরেকটি হাজির হয়। তখন এগুলো একবারো ভেবে দেখি নি হৃদয় কিন্তু এখন যেনো সব কিছু পাজেলের মতো লাগছে। একবার তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে কিন্তু এখন আর সেটা করলে হবে না। খুব ধীর স্থির ভাবে আগাতে হবে। সিগারেট না এসট্রে তে নিভিয়ে কোটটা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে।

রাত ৯টা,
আলতাফ সাহেবকে ওয়ার্ডে শিফট করা হয়েছে। হঠাৎ পড়ে গিয়ে মাথায় অসম্ভব ব্যাথা পেয়েছেন তিনি। মা-বাবা ব্যাতীত আপন বলতে কেউ নেই দিশার। ফুফু যা একটু ছিলেন তিনিও ইন্তেকাল করেছেন এক বছর হয়েছে। আলতাফ সাহেবের পা দুটো প্যারালাইজড, সারাটাক্ষণ তার সীমা হুইলচেয়ার অবধি। দিশা এবং সায়মা যা টাকাই ইনকাম করে, তারা দুজন মিলে সেটা আলতাফ সাহেবের চিকিৎসাতেই ব্যয় করে। একজন নার্স যে সারাটাক্ষণ আলতাফ সাহেবকে দেখাশুনা করবে সেতা অনেক ব্যয়বহুল একটা ব্যাপার। রেহনুমা বেগমের বয়স হয়েছে তিনি চাইলেও সারাটাক্ষণ স্বামীর পেছনে থাকার মতো শারীরিক সুস্থতা তার নেই। আজকের কথাই ধরা যাক। রান্নাঘরের কাজে তিনি ব্যস্ত ছিলেন, আলতাফ সাহেব তখন বিছানায় বসে পেপার পড়ছিলেন। হঠাৎ পানি পিপাসা লাগায় নিজে নিজে পানির গ্লাস নিতে যেয়েই এই অঘঠন ঘটেছে। তিনি ভেবেছিলেন তার বুড়ো সঙ্গিনীকে এতোটা কষ্ট না দিয়ে নিজেই এই কাজটি করবেন। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেছে। আলতাফ সাহেব এখন ঘুমোচ্ছেন, রেগনুমা বেগম এতোক্ষণ নিজেকে দোষারোপ করে গেছেন। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করেছে দিশা। দিশা আজ রাতটা হাসপাতালেই থাকবে, সায়মাকে সে বলে,
– আমি বাবার কাছে আছি, তুমি মাকে নিয়ে বাসায় যা।
– তুই কি এখানেই থাকবি?
– হুম, আর কাল আমি অফিসে যাবো না। আমি ফোন করে জানিয়ে দিবো।
– সাবধানে থাকিস।
– ফিআমানিল্লাহ।

সায়মারা চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিশা। আজ একজন ডাক্তার তার বন্ধু বিধায় সুব নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে কিন্তু যদি এই সাহায্যটুকু না পেতো কি হতো তবে!! ঠোঁটের কোনায় মলিন হাসির রেখা টেনে নিজেকে নিজে শান্তনা দেয়,
– ভেঙে পড়লে যে চলবে না দিশা, এখনো যে অনেক লড়াই বাকি রয়েছে তোর। এখন ভেঙে পড়লে লড়বি কিভাবে তুই? সামনে যে আরো তুফান আসতে চলেছে। হৃদয়ের সামনে প্রতিনিয়ত অভিনয় করে কাটাতে হবে যে তোকে। এতো তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। না কিছুতেই না

বাবার বেডের পাশে চেয়ার নিয়ে সেখানেই বসে থাকে দিশা। চোখে যেনো রাজ্যের ঘুম তার, আজ খুব ক্লান্ত সে। একটু ঘুমোতে পারলে মন্দ হতো না। বাবার ক্যানোলা পড়ানো হাতটি নিজের হাতের মুঠোতে নিয়ে ভাবতে লাগে, একটা সময় কতোটা সুখী না ছিলো তারা। অথচ আজ এই সুখ যেনো তাদের ভাগ্যে নেই। বাবাকে সেদিন কষ্টটুকু না দিলে বোধ হয় এমন হতো না তার সাথে। কি পেলো ভালোবাসা নামক মিথ্যে ছায়ার পেছনে ঘুরে? কিছু না। জীবনের অংক কষতে লেগে হয়তো শুন্যটি তার ভাগ্যে জুটেছে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে তা জানা নেই তার।

সকাল ১১টা,
মিটিং রুমে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হৃদয়ের। প্রজেক্টটা শেষ হবার সময় আর বেশি নে। অথচ এখন প্রজেক্ট ডিরেক্টর অফিস কামাই করে বাড়ি বসে রয়েছে। তাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে রাসেল, অথচ ফোনটুকু ধরছে না সে। এদিকে ক্লাইন্টের সামনে বসে রয়েছে হৃদয়। রাসেল ধীর গলায় তাকে বলে,
– স্যার, মিস দিশা আজ ছুটি নিয়েছে
– কারণ?
– তার নাকি ব্যাক্তিগত কিছু ইস্যু আছে

এটুকু শুনেই যেনো রাগে মাথা গরম হয়ে গেলো হৃদয়ের। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রাসেলকে বললো,
– মানুষের দায়িত্ববোধটুকু এতোটা কম জানলে এই মেয়েকে কখনোই এতো বড় প্রজেক্ট সামলাতে দিতাম না। যদি কাজ করতে ভালো না লাগে ছেড়ে দিলেই পারে
– স্যার উনি সব এগিয়ে রেখেছেন অবশ্য। উনি আমাকে কাল আপডেটকরা ফাইলটি ও দিয়েছিলেন।
– কিন্তু আজ ওর উপস্থিতিটা ইমপোর্টেন্ট ছিলো রাসেল যাক গে আমি এটা হ্যান্ডেল করে নিচ্ছি।

মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে মিটিং শুরু করে হৃদয়। যদিও কোনো ঝামেলা হয় নি, তবুও তার মাথায় একট জিনিসই ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো আজ দিশা কেনো আসে নি। সে কি নিজেকে আবার হৃদয়ের কাছ থেকে লুকোচ্ছে নাকি অন্য কোনো কারণ আছে। কি এমন ব্যাক্তিগত কারণ যা অফিসে বলা যায় নি_____

দুপুর ১টা,
হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে হৃদয়। প্রথমে রাগ হলেও মিটিং শেষে সায়মার কাছ থেকে দিশার অফিস কামাই এর কারণ জানতে পেরে এখানে ছুটে এসেছে সে। একটা জিনিস হৃদয়কে ভীষণ ভাবাচ্ছে তা হলো দিশার প্রতি তার দূর্বলতা। কেন জানে দিশা মেয়েটাকে বাকি পাঁচটা মেয়ের অতো সে ট্রিট করতে পারছে না। কারণটা জানার ইচ্ছে নেই, থাক না কিছু রহস্য। থাক না কিছু অনুভূতি। না হলো সে তার প্রেয়সী তবুও কেনো যেনো মেয়েটার প্রতি দূর্বলতা কাজ করছে তার। দিশার মোবাইলে কনটিয়াসলি ফোন করে যাচ্ছে সে। মানুষ ফোন যদি নাই ইউজ করে, সাথে রাখার কি মানে এটা বুঝে পাচ্ছে না হৃদয়। হঠাৎ তার পা জোড়া থমকে গেলো। সামনে………

চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে