#নীলপদ্ম
#৫ম_পর্ব
দাঁত দিয়ে ঠোট চেপে নিজের কান্নাটুকু থামালো দিশা। নিজেকে সামলে বেশ স্পষ্টভাবে হৃদয়কে বললো,
– ভালোবাসা মানুষের বুদ্ধিলোপ করে দেয় শুনেছিলাম আজ নিজ চোখে দেখছি। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি একজন বুদ্ধিমান ব্যাক্তি, ভুল ভেবেছিলাম। আপনি নিতান্ত ইমোশোনাল একজন মানুষ। যাক গে, আমি শেষবারের মতো বলছি আমি প্রেয়সী নই, আমি এই জবে আছি কারণ এটা আমার নিড। যদি সেটা না হতো আজ আমি জব ছেড়ে দিতাম। প্লিজ স্যার, এভাবে আমাকে অস্বস্তিতে ফেলবেন না। বুঝছি আপনি একজনকে খুব ভালোবাসেন কিন্তু যেকারোর মাঝে তাকে এভাবে হন্যে হয়ে খুজাটা বন্ধ করুন। মরীচিকা থেকে বাস্তবে আসুন।
হৃদয় চুপ করে দিশার কথা শুনছে। হয়তো আসলেই আবেগের তাড়নায় ভুল করে ফেলেছে। তার প্রেয়সী তাকে ফেলে চলে গেছে, এই নির্মম ভালোবাসার দাহনে তাকে জ্বলতে হবে। দিশার জায়গায় অন্য কেউ হলেও বুঝি এটা করতো। নিজেকে সামলে শান্ত কন্ঠে বললো হৃদয়,
– তুমি যেতে পারো।
দিশা এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। পকেটে হাত ঢুকিয়ে থাই গ্লাসের বিশাল দেয়ালের সামনে দাঁড়ালো হৃদয়। তার অনুভূতিগুলো ও আজ প্রেয়সীর মতো তাকে ধোকা দিচ্ছে। মন এখোনো মানতেই চাচ্ছে না দিশা প্রেয়সী নয়। এতোদিন না পাওয়ার কষ্টগুলো তাড়া করতো আজ আশা ক্ষুন্ন হবার যন্ত্রণা কলিজাটাকে আঘাত করছে। হয়তো এটাই তার প্রাপ্য ছিলো। বোকার মতো শুধু মেয়েটিকে সে অপ্রস্তুত করলো। এই ক্ষত বিক্ষত হৃদয় নিয়ে কতদিন অভিনয় করা যায়! মলিন হাসি টেনে নিজে নিজেই আওড়াতে লাগলো সে,
“কেন চলে গেলে দূরে
ভাসায়ে মোরে সুরে,
কেন ফিরে এলে আবার
বাড়াতে দুঃখের ভার”
অপরদিকে,
দিশা ছুটে অফিসের ওয়াশ্রুমে চলে যায়। হাউমাউ করে কাঁদতে মন চাইছে। আর কিছুক্ষণ ঐ রুমে থাকলে হয়তো নিজেকে সামলানো দায় হয়ে যেত। অতীতের স্বর্ণালি মুহূর্তগুলো এভাবে তাকে আকড়ে ধরবে সেটা যে তার কাছে অজানা ছিলো। দুবছরের স্মৃতি এখনো আকড়ে রেখেছে হৃদয়। দিশা ভেবেছিলো হৃদয় হয়তো ভুলে গিয়েছে দু বছর আগের সব কথা। কিন্তু এখনো এই মানুষটা তাকেই নিজের মনে রেখে দিবে এটা যেনো কল্পনাতীত দিশার জন্য। এক সপ্তাহ পূর্বে যখন শুনেছিলো কোম্পানির আগের মালিক কোম্পানির শেইয়ার বিক্রি করে দিয়েছে তখন দিশা জানতো না নতুন এম.ডি কে হতে চলেছে। সেদিন মিটিং রুমে প্রবেশ করে হৃদয়কে দেখে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলো দিশা। মানুষটিকে সুস্থ দেখে যত না খুই হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি এটা ভেবে দুশ্চিন্তা করে যাচ্ছিলো যদি হৃদয় তাকে চিনে ফেলে তখন কি হবে। বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়, দিশার ক্ষেত্রে যেনো সেটাই হয়েছিলো। আজ এভাবে তাকে কোনঠাসা করে জবারদিহির মুখোমুখি হতে হবে এটা কখনোই ভাবে নি দিশা। বেসিনের কল ছেড়ে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদলো দিশা। এরপর মুখ ধুয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমাদের পথচলা এতোটুকুই ছিলো হৃদয়, তুমি আমাকে কোনোদিন দেখো নি, চেনো নি। চিনবেও না। আমি চাইলেও তোমার জীবনে ফেরত যেতে পারবো না। আমার হাত পা বাধা, অনেক কিছু হারিয়েছি, ভালোবাসা, আবেগে অন্ধ হয়ে পুনরায় কিছু হারাতে চাই না আমি। আমাকে ক্ষমা করে দিও হৃদয়। মনে করো তোমার প্রেয়সী তোমাকে ধোকা দিয়েছে। সে তার কথা রাখে নি, সে তোমার যোগ্য নয়।
মানুষ যেটা চায় সবসময় ভাগ্যে সেটা থাকে না, কেউ ভাগ্যের সাথে লড়ে সেটা আদায় করে নেয় তো কেউ ভাগ্যের নির্মমতার কাছে পরাজিত হয়। আজ দিশা একজন পরাজিত সৈনিক। সব জেনে বুঝে তাকে এটা করতে হচ্ছে, তার হাত যে বাধা। নিজেকে সামলে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ডেস্কে গেলো সে। চোখ মুখ এখনো খানিকটা ফুলে আছে, যে কেউ দেখলেই বলবে এতোক্ষণ বেশ কেঁদেছে সে। ডেস্কে এসে কাজ করা আরম্ভ করলো দিশা। কিছুতেই মন বসাতে পারছে না দসে, হৃদয়ের করুণ মুখটা চোখে ভাসছে তার। প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পড়েছে সে। হঠাৎ কাঁধে কারোর হাত পড়তেই খানিকটা চমকে উঠলো দিশা।
– রিলাক্স আমি
পেছনে ফিরে দেখে তার বান্ধবী সায়মা দাঁড়িয়ে আছে। সায়মা দিশার অনেক পুরোনো বন্ধু। দেশে ফিরে সায়মা দিশাকে অনেক সাহায্য করে। সেও দিশার সাথে চিটাগাং এর অফিসে ছিলো। দিশাকে এখানে শিফট করার পর সায়মার জন্য দিশা রিকুয়েস্ট করে। মেয়েটি কলেজে উঠা থেকে দিশাদের সাথেই থাকে। সায়মার মা মারা যাবার পর তার বাবা আব্দালি সাহেব দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এক পর্যায়ে যখন সৎ মায়ের অত্যাচার যখন অনেক বেশি হতে থাকে বাধ্য হয়ে ঘর ছাড়ে সায়মা। তখন থেকে দিশাদের সাথেই সে থাকতো। দিশা বিদেশে যাবার পর ও তার সাথে বন্ধুত্ব কমে নি তার। দিশা এবং হৃদয়ের ব্যাপার সব নখোদর্পনে সায়মার। দিশার চোখ মুখের অবস্থা ভালো নয় বিধায় তার খোঁজ নিতে আসে সে। দিশা অফিসে কিছু বলতে পারবে না বিধায় সে বলে,
– চল হাফ ডে নিবো
– আমার অনেক কাজ আছে সাম্মা, এখন না।
– থাপড়া খাবি, চোখ মুখের অবস্থা দেখছিস। ওই খাচ্চর বেটা তোকে আবার জ্বালাইছে না? আমি জানতাম। যে কেউ দেখলেই বুঝে যাবে তোর অবস্থা ভালো নেই। চল
– আর হাফ ডে নিলে বুঝবে না?
– না বুঝবে না, সেটা আমার উপর ছেড়ে দে। চল
সত্যি এখন কাজ করতে ভালো লাগছে না দিশার। একটু ব্রেক পেলে মন্দ হতো না। হৃদয়ের চত্রছায়া থেকে দূর হতে চায় দিশা। তাই সায়মার আব্দারেও রাজী হয়ে যায় সে। সায়মা মেয়েটি বেশ চতুর। সুন্দর অসুস্থতার বাহানা দিয়ে নিজের এবং দিশার হাফ ডে নিয়ে নিয়েছে। মেয়েটি দিশার আশেপাশে থাকলে অটো দিশার মন ভালো হয়ে যায়।
দুপুর ২টা,
একটা রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছে দিশা এবং সায়মা। দিশা খাবার গুলো শুধু ঘেটেই যাচ্ছে। খাবার গলা দিয়ে নামছে না। মস্তিষ্কের আর মনের লড়াই এ নিজে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে বারবার।
– এখনো ওই লোকটাকে তুই ভালোবাসিস তবে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস কেন?
সায়মা এমন প্রশ্নে কিছুক্ষণ থেমে যায় দিশা। দীর্ধশ্বাস ফেলে বলে,
– তোর তো অজানা কিছুই নেই সাম্মা, তবুও একথা কেনো জিজ্ঞেস করছিস?
– তোর বা তোর পরিবারের সাথে যা হয়েছে তাতে কি হৃদয়ের বিন্দুমাত্র হাত আছে?
– না, ওর কোনো দোষ নেই, ও তো আমাকে ভালোবেসেছে। হয়তো এটাই ওর দোষ
– তাহলে একজন অপরাধ করলে অপরজনকে শাস্তি দেবার কি মানে?
– ……………
– তুই নিজেই বলছিস সে তোর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত স্বযত্নে আগলে রেখেছে তাহলে সমস্যাটা কোথায়? দু বছর আগে যা যা হয়েছে সব বলে দে হৃদয়কে। তাহলে তো আর ঝামেলা হবে না। ও যদি জানতে পারে ওর মা তোর কাছে কান্নাকাটি করে তোদের আলাদা করিয়েছে ও ও বুঝে যাবে। আর নিজের কথাটুকু তো ভাব? এজন্য আমার এই শ্বাশুড়ি প্রজাতিকে মোটে সহ্য হয় না
– তুই ব্যাপারটাকে যতোটা সোজা ভাবছিস এটা তার থেকেও বেশি জটিল। এর থেকে এটাই ভালো হবে আমরা দুজন দুজনকে ভুলে যাই। আমি তো ওকে ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ যদি হৃদয় আমাকে আবার কাছে ঢেকে না নিতো তবে আমি কখনোই দূর্বল হতাম না আমি ঠিক সামলে নিবো দেখিস।
– যা ভালো মনে করিস
সায়মা জানে দিশাকে বুঝিয়ে লাভ নেই, সে কখনোই মা-ছলের মাঝে বাধ হয়ে দাঁড়াবে না। খাবারের বিল দিয়ে উঠতে দিলেই দিশার মোবাইলে একটি ফোন আসে। ফোন রিসিভ করার পাঁচ মিনিট পর দিশার মুখের রঙ বদলে যায়।
– আমি আসছি এখনই।
বলে ফোন কেটে দেয় দিশা। সায়মা কিছু জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি