#নীলপদ্ম
#২য়_পর্ব
মিটিং রুমে প্রজেক্ট ডিরেক্টরের দেরি হওয়াতে বিগত পনেরো মিনিট বসে থাকার পর সবার উপর ইচ্ছে মতো রাগ ঝেড়েই বেরিয়ে যেতে নিলেই এক চেনা কন্ঠ শুনতে পায়,
“মে আই কাম ইন?”
কন্ঠটি শুনে যেনো স্তব্ধ হয়ে যায় হৃদয়। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে কালো কুর্তি এবং ব্লু কালারের জিন্স পড়া একটি মেয়ে দরজায় দাঁড়ানো। মেয়েটি দেখতে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, গোলগাল মুখ, সবথেকে আকর্ষণীয় মেয়েটির পাতলা ঠোটজোড়া এবং তার নিচের গাড় তিলটি। ওড়নাটি মাফলারের মত গলায় পরে রয়েছে, মাজা অবধি চুলগুলো বেনুনি করে একপাশে করে রাখা, চোখের কাজল এবং ঠোঁটজোড়ায় হালকা লিপস্টিক দেয়া। কালো কুর্তিটা মেয়েটার শ্যামবর্ণের সাথে বেশ মানিয়েছে। হৃদয় খুতিয়ে খুতিয়ে মেয়েটির পা থেকে মাথা অবধি দেখতে লাগলো। মেয়েটির কন্ঠস্বরের সাথে তার প্রেয়সীর কন্ঠস্বর অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। এটাই যেনো অবাক করে দিচ্ছে হৃদয়কে। দু বছর কেটে গেলেও প্রেয়সীর কন্ঠস্বর চিনতে তার ভুল হতে পারে না। এটা কি মনের ভুল নাকি বাস্তব! মেয়েটি মুখে ইতস্তত হাসি ফুটিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
– মে আই কাম ইন স্যার?
মেয়েটির কথায় ধ্যান ভাঙ্গে হৃদয়ের। নিজেকে সামলে বললো,
– আপনি কে জানতে পারি?
– স্যার আমি এই প্রজেক্টের ইনচার্জ। আমি এতোদিন ছিলাম না বিধায় আপনার সাথে আপনার পরিচয় হয় নি।
মেয়েটির উত্তর শুনে হৃদয় তার এসিসটেন্ট রাসেলের দিকে তাকায়। এই কোম্পানিটির শেয়ার হৃদয় দিন সাতেক হয়েছে কিনেছে। তাই এই কোম্পানির স্টাফদের অনেককেই চিনে না সে। হৃদয়ের চাহনি বুঝতে পেরে তার এসিস্ট্যান্ট রাসেল বলে,
– স্যার উনি মিস জান্নাতুল ফেরদৌস, কোম্পানি বিক্রির আগে উনি এই প্রজেক্টের ইনচার্জ ছিলেন। আজ উনার সাথেই আমাদের মিটিং। উনি এই কয়দিন চিটাগং ছিলেন। কাল এসেছেন; তাই উনার সাথে আপনার পরিচয় হয় নি।
এসিস্ট্যান্টের কথা শুনে হৃদয় বলে,
– প্লিজ কাম ইন, বাট ইউ আর লেট। আপনার জন্য বিগত পচিশ মিনিট আমি এখানে বসে রয়েছি।
– সরি স্যার আমি ট্রাফিকে আটকে গিয়েছিলাম। বাট আমি পনেরো মিনিট লেট করেছি, ফর ইউর কাইন্ড ইনফোরমেশন। দশ মিনিট আপনি আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।
মেয়েটির কাট কাট কথায় অবাকের চরম সীমায় পৌছে যায় হৃদয়। মেয়েটির কথাবলার স্টাইলের সাথে তার প্রেয়সীর কোনো মিল নেই। মেয়েটির কন্ঠস্বরটাই খুব ভাবাচ্ছে হৃদয়কে। মিটিং এর সবার মাঝে কিছু বলাটা বোকামী ছাড়া আর কিছুই হবে না। মানুষ তাকে পাগল বলবে যদি বিনা খোঁজ খবব নিয়ে মেয়েটিকে প্রেয়সী বলে দাবি করে। উপরে মেয়েটি যেভাবে বিহেভ করছে মনে হচ্ছে হৃদয়কে সে চিনেও না। এখন চুপ থেকে মেয়েটিকে চোখে চোখে রাখতে হবে হৃদয়কে, সাথে তার খুটিনাটি ডিটেইলসগুলোও জানতে হবে। মেয়েটি মিটিং শুরু করে, সে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে কিন্তু হৃদয়ের মনোযোগ প্রেজেন্টেশনে নয়। সে শুধু তার প্রেয়সীকে খুজে বেড়াচ্ছে মেয়েটির মাঝে। কন্ঠস্বর ব্যতীত কোনো মিল খুজে পাচ্ছে না হৃদয়। প্রেয়সী ছিলো খুব চঞ্চল প্রকৃতির একটি মেয়ে। যার চঞ্চতা হৃদয়ের অন্ধকার জীবনের আলোর ন্যায় ছিলো। অপরদিকে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি খুব স্টিফ, গম্ভীর পার্সোনালিটির একটি মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে হৃদয়ের কাছে। মিটিং শেষ হবার পর সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখন হৃদয় মেয়েটিকে সম্বোধন করে বলে,
– মিস. জান্নাতুল
– জ্বী স্যার, কিছু বলবেন?
– আপনার সাথে আমার আগে কথা হয় নি, যেহেতু আমি এই কোম্পানির নতুন এম.ডি আর এই ডিলটা আমি নিজে হ্যান্ডেল করবো সেহেতু আপনার সাথে পরিচয় হওয়াটা খুব দরকার। হ্যালো, আই এম শেখ হৃদয় আহসান। আপনাকে তুমি করে বললে কি কোনো আপত্তি আছে?
বলেই হাত এগিয়ে দেয় হৃদয়। হৃদয়ের এপ্রোচ দেখে মেয়েটিও ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা টেনে হাত মিলাতে মিলাতে বলে,
– না না, তুমি করে বলতে পারেন। আই এম জান্নাতুল ফেরদৌস, ইউ ক্যান কল মি দিশা। বিগত দু বছর আমি এই কোম্পানির সাথে আছি। নাইস টু মিট ইউ স্যার
হ্যান্ডশেক করার সময় হৃদয়ের মনে হয় এই হাত সে আগেও ধরেছে। আগেও অনুভব করেছে এই হাতের উষ্ণতা। হঠাৎ যখন দিশা বলে সে দু বছর ধরে চৌধুরী গ্রুপের সাথে আছে, খটকাটা আরো জোরদার হতে লাগে হৃদয়ের কাছে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– দু বছর? তাহলে বলতে হবে তোমাদের আগের এম.ডি তোমাকে অনেক ভরসা করেন। এতো বড় প্রজেক্ট হ্যান্ডেল করতে দিয়ে দিয়েছে। কারণটা কি জানতে পারি?
– একচুয়ালি, উনি আমার কাজের উপর অনেক সন্তুষ্ট ছিলেন। কোম্পানির জন্য বেশ কিছু ইস্যু আমি হ্যান্ডেল করাতে উনি নিজ থেকেই আমাকে এই প্রজেক্টে এপোয়েন্ট করেছেন। স্যার আপনি যদি আমার কাজে অসন্তুষ্ট থাকেন তো আপনি আমাকে প্রজেক্ট থেকে সরিয়ে দিতে পারেন।
হৃদয়ের হাত থেকে নিজ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কথাগুলো বলে দিশা। হৃদয়ের যেন হাত ছাড়ার নাম নেই। দিশা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে, বাঁকা হাসি হেসে হ্যাচকা টানে নিজের খানিকটা কাছে নিয়ে আসে হৃদয় তাকে। হৃদয়ের এমন আচারণে অনেকটাই ভেবাচ্যাকা খেয়ে যায় দিশা। সে হৃদয়ের খানিকটা কাছাকাছি অবস্থান করছে, হৃদয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখে আছড়ে পরছে। চোখ বিস্ফোরিত করে তাকাতেই হৃদয় বলে,
– আমাদের কি আগে দেখা হয়েছে? তোমাকে কেনো জানে খুব চেনা চেনা লাগছে।
– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, আমাদের এটাই প্রথম দেখা। এটাই আমাদের ফার্স্ট মিটিং। হাতটা ছাড়ুন। কাজ নিয়ে কোনো কথা না থাকলে আমাকে যাবার পারমিশন দিন।
দিশার ঝাঝালো কন্ঠের কথা শুনে হাতটি ছেড়ে দেয় হৃদয়। তার সন্দেহ বীজ কেবল বড় হচ্ছে, গাড় হচ্ছে। দিশা এক মূহুর্ত দেরি না করে মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে যায়। খুব অস্বস্তিকর একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো। সে যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। হৃদয় এমন কোনো কাজ করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবে নি সে। হৃদয় এতো কাছাকাছি আশায় খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলো সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিজের কাজে গেলো দিশা। মিটিং রুম থেকে বের হয়েই রাসেলকে ফোন করে কেবিনে ডাকে হৃদয়। রাসেল হৃদয়ের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট। বিগত পাঁচ বছর ধরে ছেলেটি তার সাথে আছে। হৃদয় ছেলেটিকে খুব ভরসা করে, তাই নিজের সব কনফিডেনসিয়াল ইস্যুগুলোও ওকে নিয়ে হ্যান্ডেল করায়। রাসেল নক করলে হৃদয় তাকে রুমে ঢুকার পারমিশন দেয়।
– স্যার ডেকেছিলেন?
– মিস.জান্নাতুল ফেরদৌসের সব ডিটেইলস আমার চাই।
– স্যার উনি খুব সাধারণ ইমপ্লোই। দু বছর উনি এই কোম্পানির সাথে আছেন। কিন্তু উনার পারফোরমেন্স খুব ভালো। তাই উনাকে এই প্রজেক্টের ইনচার্জ করা হয়েছিলো।
– এগুলো আমি জানতে চাচ্ছি না রাসেল। আমি তার খুটিনাটি জানতে চাচ্ছি।
– অকে স্যার আমার এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
– তিন দিন
– জ্বী স্যার
– তুমি যেতে পারো
– জ্বী স্যার
বলেই রাসেল বেরিয়ে গেলো। হৃদয়ের চোখে এখনো দিশা নামক মেয়েটির প্রতিচ্ছবি ভাসছে। মেয়েটি যখন তার কাছে এসেছিলো তখন খুব চেনা মানুষের অনুভুতি পেয়েছিলো হৃদয়। কিন্তু মেয়েটির মুখোশ্রির কোনো পরিবর্তন হয় নি। যেনো সে সত্যি চিনে না হৃদয়কে। এইটা যেনো গোলকধাঁধা, যার সমাধান করতে হবে হৃদয়ের______
রাত ৯টা,
অফিস অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে দিশার। কিন্তু প্রজেক্টের কাজ করতে করতে দেরি হয়ে গেছে তার। এখন অফিস থেকে বের হয়ে বাড়ি যাবে সে। আজ অনেক ধকল গেছে শরীরের উপর। নতুন এম.ডি কাজের লোড যেনো দ্বিগুণ করে দিয়েছে। স্যালারি ভালো বিধায় কোনো আপত্তি দেখায় না দিশা। বাসায় ইনকাম করার ব্যাক্তি বলতে সে একাই। দিশার বাবা খুব ই অসুস্থ, তাই কষ্ট হলেও জবটা করতে হয়। বাবার জন্য ঔষধ কিনে দোকান থেকে বেরিয়ে রিক্সা খুজতে থাকে সে। রাত অনেক হয়ে গেছে। তাই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ও কোনো রিক্সার খোঁজ পায় না। বাসায় পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে যাবে বলে ঐষধের দোকান থেকে বেরিয়ে ওই গলি থেকে বের হবার জন্য হাটতে লাগে দিশা। গলিটা বেশ অন্ধকার। অন্ধকার গলিতে হাটতে হাটতে হঠাৎ মনে হতে লাগে কেউ পিছু নিচ্ছে দিশার। মনের মাঝে লুকানো ভয়টা যেনো বেড়েই যাচ্ছে। তাই দ্রুত পা চালিয়ে হাটতে থাকে সে। পিছু নেওয়া লোকটি খুব কাছে চলে আসায় একরকম ছুট লাগায় দিশা। গলি যেনো শেষ হবার নাম নেই। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি