নীলপদ্ম ১৩তম পর্ব

0
1832

#নীলপদ্ম
#১৩তম_পর্ব

ঘুমন্ত প্রেয়সীকে নির্দ্বিধায় একটা ফুটন্ত নীলপদ্মের থেকে কম কিছু লাগছে না। সূর্যের স্নিগ্ধ কিরণে তাকে আরোও সুন্দর লাগছে। এও নেশা যে যে সে নেশা নয়। এটা নেশার কালোনদ। কিন্তু পরমূহুর্তে মুখটা কালো হয়ে গেলো হৃদয়ের। অবচেতনার চেতনায় কাছে টেনে আবার দূরে সরে যাবে না তো দিশা। দিশার কপালের চুলগুলি কানে গেছে আলতো ঠোটের পরশ দিয়ে জোরালো কন্ঠে বলে হৃদয়,
– এবার চাইলেও তোমাকে নিজের চেয়ে দূর হতে দিবো না। তুমি তাতে রাগলে রাগবে তবে তুমি কেবলই আমার। আমার একান্ত নীলপদ্ম।

দিশার গায়ে কম্বলটুকু টেনে বিছানা ছাড়ে হৃদয়। দিশার মায়ামাখা মুখটুকু দিয়ে প্রতিদিনের সকালের সূচনা করতে চায় সে। ফ্রেশ হয়ে এসে দিশার পছন্দের ভুনাখিচুরী আর ডিমভুনা ওর্ডার করে হৃদয়। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিতেই ভাবে এই নিকোটিনের নেশা হয়তো তার প্রেয়সীর নেশার রেশটুকু নষ্ট করে দিবে। বাঁকা হাসি দিয়ে প্যাকেটটা রেখে দেয় হৃদয়। তার প্রেয়সী এখনো ঘুমন্ত। এই রকম নেশার কালোনদ থাকতে নিকোটিন কি আদৌ নেশা করাতে পারবে! হৃদয় এগিয়ে গিয়ে দিশার পাতলা ঠোঁট জোড়ায় আলতো ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া দিতেই নড়ে উঠলো দিশা। জ্বর নেই তবুও মাথা ব্যাথাটুকু রয়েই গেছে। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখলো হৃদয় তার দিকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে। চেতনা এখনো শতভাগ ফিরে আসে নি দিশার। তার মনে হচ্ছে খুব সুখময় স্বপ্নে বিস্তার করছে সে। এই স্বপ্ন প্রতিদিন দেখতে চায় সে। মুখে অটোমেটিক হাসির রেখা ফুটে উঠলো দিশার। মন চাইছে এই স্বপ্নের যেনো অন্ত না হয়।
– তুমি ফ্রেশ হয়ে নেও, খিচুরী আসছে। খেয়েই বের হতে হবে আমাদের।

হৃদয়ের কথায় ধাতস্থ হতে কিছুসময় লাগলেও খুব ভালো করে বুঝতে পারলো এটা স্বপ্ন নয়। কথাটা ভাবতেই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে বসতে গেলো দিশা। মাথার শিরা গুলো দপদপ করছে তার। রাতের ঘটনাগুলো চোখের সামনে ঝিরঝিরে অবস্থা ভাসছে। এবার নিজের দিকে তাকালো সে, এক বিন্দু কাপড়ের চিহ্ন নেই তার শরীরে। এর একটা অর্থই হতে পারে, কাল রাতের অন্তরঙ্গ মূহুর্ত গুলো কোনো স্বপ্ন ছিলো না তার। সেই মূহুর্তের প্রতিটি বিন্দু ছিলো বাস্তবতা। নিজেকে কম্বলে ঘিরে হৃদয়ের দিকে তাকাতেই দেখলো বেশ স্বাভাবিক আচারণ তার। লজ্জায় রাগে গাল দুখানা টমেটোর রঙ নিতে লাগলো দিশার। নিজের উপর ও সমান রাগ লাগছে তার। আবেগের তাড়নায় পুনরায় ভুল করে বসলো সে। এটা কিভাবে করতে পারলো সে। নিজের মনের ঝড় শুরু হয়েছে, ঠিক ভুল নিয়ে যুদ্ধ। একবার মনে হচ্ছে, এটা তো ভুলের কিছু না। স্বামী স্ত্রী তারা, ভালোবাসে একে অপরকে। অপরদিকে মনে হচ্ছে এটা শুধু ভুল নয় অপরাধ হয়েছে। কারণ মানুষটা এখন আর তার নয়। আর যখন তাকে ফিরে পাবার সকল আশা জ্বলাঞ্জলি দিয়েই দিয়েছে তবে কিসের ভালোবাসা। নিজেকে নিজে ইচ্ছে মতো ধমকে বকে দিলো দিশা,
“ তুই এতোটা নিচে নামতে পারিস না দিশা, তোদের সম্পর্কের যখন কোনো গন্তব্য ই নেই তবে এই মিলনের কোনো মানেই হয় না। কেনো ভুলে যাচ্ছিস লোকটা অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে। নিজের আত্নসম্মানের উপর কোনো কথা নেই দিশা। নিজেকে সামলে নে। “

নিজেকে কঠিন হতে হবে, কঠিন হতে হবে এটা বুঝিয়ে চোয়াল শক্ত করে নিলো দিশা।
– তুমি কি বসেই থাকবে? ফ্রেস হয়ে নাও।

হৃদয়ের কথায় অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকায় তার দিকে দিশা। নিজেকে কম্বলের ভেতর ঢেকে হৃদয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নিজের কান্নাকে দমিয়ে বেশ করা কন্ঠে বলে উঠে দিশা,
– আমার সব শেষ করে শান্তি হয় নি আপনার? আপনি এতোটা নিচে নেমে যাবেন এটা কল্পনার বাহিরে ছিলো আমার
– তুমি ভেবে বলছো কি বলছো?

হৃদয়ের পালটা প্রশ্নে আরো তেজ দেখিয়ে বলে,
– একজন অসুস্থ মানুষের উপর নিজের কামুকতা নিবারণ করাটা বোধ ভদ্রলোকের কাজ না। আপনি কি ভেবেছিলেন আমার জ্বরের ঘোরে ফায়দা লুটবেন। তাই তো বলি কেনো আপনি আমাকে একরুমে রাখতে চেয়েছেন! আপনার থেকে আমি এটা আশা করি নি স্যার।
– তুমি বলতে চাচ্ছো আমি এতোটা পশুর কাতারে পরি যে নারীদেহের জন্য আমি তোমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়েছি?
– তা নয়তো কি? কেনো আপনি কাল রাতে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন? বলুন? কেনো নিজেকে আটকান নি? কারণ আপনি সেটা চান নি।
– কিন্তু
– কি কিন্তু? আমার সর্বস্বটুকু শেষ করে দিয়েছেন আপনি। আমি আপনার মুখটুকু দেখতে চাই না। এই প্রজেক্টটুকু শেষ হলেই আমি জব ছেড়ে দিবো।

দিশার কথাগুলো আংশিক হলেও সত্যি, হৃদয় চাইলেই নিজেকে হয়তো আটকাতে পারতো। কিন্তু ঐ যে এতোদিনের বিরহের যন্ত্রণার মলম খুজতে চেয়েছিলো সে। তার এই যন্ত্রণাগুলো যে অতিশয় ঘা তে পরিণত হচ্ছিলো। তবে দিশা এভাবে তাকে না বললেও তো পারতো। দিশার কথাগুলো যেনো ভোঁতা ছুরির মতো হৃদয়ের কলিজাটাকে আঘাত করে রক্তক্ষরণ করছে। রক্তক্ষরণ তীব্র হতে লাগলে মাথা নিচ করে বলে হৃদয়,
– তুমি আমাকে ভুল বুঝছো প্রেয়সী।
– আমি আপনার প্রেয়সী নই, বারবার এক কথা বলতে ভালো লাগে না আমার। নই আমি আপনার প্রেয়সী।

বলেই ওয়াশরুমে ছুটে চলে যায় দিশা। অপরাধ না করেও অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে হৃদয়। একবার মনে হচ্ছিলো ভয়েস মেইলটা শুনিয়ে দিশাকে এখনই সব উগলে দেবার জন্য বাধ্য করবে । পরমূহুর্তে ভাবলো, এটা মোটেই করবে না সে। তাহলে এতোদিনের সব প্লান ধ্বংস হয়ে যাবে। দিশাকে একেবারে নিজের করে পেতে হলে শুধু দিশা নয় আরো দুটো মানুষকে হ্যান্ডেরল করতে হবে তার। কোনো রকম শার্টটা গায়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়লো হৃদয়। দিশার মুখোমুখি হলে কষ্ট বাড়বে বই কমবে না তার। আফসোস আজ দিশা তাকে এতোটা ভুল বুঝলো_____

অপরদিকে,
মাথাটা ঝিনঝিন করছে ফয়সালের। হয়তো নেশার পরিমাণটা বেশী হয়ে গেছিলো। দিশাকে না পাবার কষ্টটুকু যেনো দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। যে ছেলে নেশা জতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকতো, আজ বন্ধুদের সাথে দুঃখ ভুলাতে নেশাতে ঢুব দিয়েছে সে। কালরাত ও পাবে কাটিয়েছে। সেখানে টাল হয়ে পড়েছিলো। চোখ কচলে আশেপাশে ভালোভাবে তাকালে দেখে এটা তার রুম। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। তার যতটুকু মনে পড়ে পাবে ছিলো সে। তার বন্ধুরা এতোটা ও ভালো নাযে তাকে পাব থেকে তার বসায় নিয়ে আসবে। তাহলে?
– ঘুম ভাঙ্গছে তোর? নাকি আরো মহিষের মতো ঘুমাবি?

একেই মাথাটা ধরে আছে উপর থেকে এরুপ কর্কস আওয়াজ যেনো মাথার উপর হ্যামার প্যাটানোর মতো লাগলো ফয়সালের কাছে। রাগের বশে ফুসতে ফুসতে পাশে তাকাতেই হা হয়ে গেলো সে। সায়মা মাজায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি নেশার জন্য নাকি এটা মনের ধাধা। ভীষণ রুপবতী লাগছে তাকে। এমনেই মেয়েটা নিঃসন্দেহে রুপবতী কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রচুর ঝগরাটে। সেকারণে মেয়েটির প্রতি কখনো ফিলিংস আছে নি ফয়সালের। কিন্তু আজকে কেমন বউ বউ টাইপ লাগছে সায়মাকে। নিজের মাথাটাকে ঝাকুনি দিয়ে নিজেকে বললো,
“ সায়মাকে এতো সুন্দরী লাগছে কেনো? ওর শাসনটাও বেশ ভালো লাগছে? এটা কি তবে আমার মনের সুপ্ত অনুভূতি নাকি নেশার আফটার ইফেক্ট”

ক্যাবলাকান্তের মতো ফয়সালকে বসে থাকতে দেখলে সায়মা বলে,
– এখনো বসেই থাকবি?

সায়মায় প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফয়সাল বেকুবের মতো জিজ্ঞেস করে,
– আমি এখানে?
– মনটা চাইতেছে তোরে আছাড় মারি। একে আবলতাবল খাইয়ে টাল হবি, আর তারপর নিজের ব্রেইনটারেও কাউকে দিয়ে আসবি। আন্টি তোরে কেমনে সহ্য করে? শোন লাস্ট বার বলতেছি, যদি আরেকবার এমন দেবদাসের মতো কাম করছো তো দেখবি। মাথায় ঘোল ঢেলে দেবদাসগিরি বের করে দিবো।

সায়মার সুন্দর বাক্যের ঝুড়ি শুনে নিজের মনে নিজেই হাসে ফয়সাল। সে ভুল ছিলো না এই মেয়েকে ভালোলাগাটা কেবলই নেশার আফটার ইফেক্ট। বিছানা ছাড়তে ছাড়তে হাসতে হাসতে বলে,
– আমাকে আবার ঠিক প্রমাণ করার জন্য ধন্যবাদ।

বলেই ওয়াশরুমে চলে যায় সে। সায়মার মাথার উপর নিতান্ত প্রজেকটাইলের মতো ফয়সালের কথাগুলো গেলো। ফয়সালে কথার সারমর্ম অনুসন্ধানে ধপ করে বিছানাতেই বসে পড়লো সে_____

বিকেল ৫টা,
এখনো রুমে আসে নি হৃদয়। কোথায় গেছে বলেও যায় নি। তখন ওভাবে কথাগুলো বলা বোধহয় উচিত হয় নি দিশার। নিজেকে নিজের ই বকতে ইচ্ছে করছে। কেনো এমন কাজ করতে গেলো। আর লোকটা এমন কেনো? দোষ ও তারও ছিলো তাই বলে দিশার উপর রাগ দেখিয়ে এভাবে চলে যাবে সে!! মনের মাঝে নানান বাজে চিন্তাগুলো দলা পাকাতে লেগেছে। মনে মনে একটাই চাওয়া, হৃদয় যাতে ফিরে আসে সুস্থ ভাবে, দরকার হলে ক্ষমা চেয়ে নিবে সে। রুমের মাঝে পায়চারি করছিলো ঠিক তখন………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে