#নীলপদ্ম
#১২তম_পর্ব
নিজের চুল নিজের টানতে ইচ্ছে করছে দিশার। কেনো যে এই কোম্পানিতে চাকরি করতে হলো তার। এসব চিন্তায় যখন মগ্ন সে তখন অনুভব করলো তার ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে। সাথে সাথে পেছনে ফিরতেই দেখে হৃদয় ঘাড় কাত করে তার দিকে ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয়কে এভাবে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দু পা পিছিয়ে যায় দিশা। দিশার এমন আচরনে হো হো করে হেসে উঠে হৃদয়। খুব কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে,
– ভয়নেই, আমি কোনো বাঘ কিংবা ভাল্লুক নই। আকাশ পাতাল চিন্তা না করে যাও করে নেও। ঠান্ডা লেগে যাবে। পরে কাজ তো হবেই না উলটো তোমাকে নিয়ে আমায় ছুটতে হবে।
বলেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। লোকটা এমন কেনো এতাই চিন্তায় সমাধান করতে পারে না দিশা। গাঢ় নজরে দিশা তার ভালোবাসার মানুষটিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। ছোট ছোট চুলগুলো থেকে এখনো পানি পড়ছে। একটি ব্লাক টিশার্ট এবং গ্রিন থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে রয়েছে। ভেজা চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে, চুলের পানিতে টিশার্টটা বেশ খানিকটা ভিজে বুকের সাথে যেন লেগে আছে। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ায় পায়ের খানিকটা দেখা যাচ্ছে, ভেজা পায়ের পশম গুলো লেপ্টে আছে। হৃদয় দেখতে সিনেমার হিরোদের মতো নয় তবে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি লম্বা, ফর্সা; বেশ কিউট দেখতে ছেলেটা। অনেকটা চকলেট বয় টাইপ। কাউকে না বললেই বুঝতে পারবে না তার বয়স আছে। এখনো কলেজ স্টুডেন্ট বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। লোকটাকে দেখলে যেকোনো মেয়েই ফ্লাট হয়ে যাবে। দিশার চোখ যেনো আটকে গেছে সামনে থাকা পুরুষটির দিকে। আয়নার মধ্য থেকেই হৃদয় বলে উঠে,
– আমি আজ এই রুমেই থাকবো, তুমি ফ্রেশ হয়ে আসলে আমি ঘটা করে তোমার সামনে বসবো। তখন ইচ্ছে মতো দেখো। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার দরকার নেই।
হৃদয়ের কথায় বেশ লজ্জা পেয়ে যায় দিশা। গালগুলোতে রক্ত জমে লাল হয়ে যায়। হড়বড় করে একটা জামা নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। এই লোক লজ্জা দিতে এক্সপার্ট একটা মানুষ। ধুমধাম এমন কথা বলে, তাই কেঁটে পড়াই শ্রেয় বলে মনে করে দিশা।
রাত ৯.৩০টা
অঝর ধারায় বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। থাই গ্লাসের জানালায় পানির অতল স্রোত দেখতে মন্দ লাগছে না হৃদয়ের। আজ প্রকৃতি যেনো বিদ্রোহ করছে। বছরের এই সময়টা এমন অঝর বৃষ্টি কিছুতে কাম্য নয়। শুধু বৃষ্টি নয়, বেশ ঝড় ও হচ্ছে। ঝড়ের সাথে সাথে আশেপাশের গাছগুলো পেন্ডুলামের মতো দুলেই যাচ্ছে। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে প্রকৃতির এই খেলাগুলো মুগ্ধ নয়নে দেখে যাচ্ছে হৃদয়। হঠাৎ খট করে ওয়াশরুমের দরজা খুললে পেছনে ফিরে তাকায় সে। ভাবনায় একটা ছেদ করে একটা সাদা সালোয়ার কামিজ পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় দিশা। ভেজা চুলের রমনী নাকি যেকোনো মনে হানা দিতে পারে। মুক্তোদানার মতো পানির বিন্দুগুলো তার স্নিগ্ধ মুখখানায় লেগে আছে, পাতলা গোলাপি অধরজোড়ার দিকে তাকাতেই হৃদস্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো হৃদয়ের। খুব ইচ্ছে করছে দিশার হাতদুটো নিবিড় ভাবে ধরে বলতে,
তুমিহীনা জীবন, তুমিহীনা পৃথিবী কিভাবে মানায়
এই কথা মনে এলে দু’চোখ ভাসে অশ্রুর বন্যায়
তোমার হৃদয়ে কখনও কি মনে হয়?
তুমিহীনা আমি বেঁচে থাকবো এই দুনিয়ায়।
ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায়
জীবনের প্রতিটি পাতায় পাতায়
আমার চোখ আর হৃদয়ের ভাষায়
বুঝে নিও কতোটা ভালোবাসি আমি তোমায়।
________________ রেদোয়ান মাসুদ
কিন্তু এসব হয়তো কল্পনাতেই আটকে রাখাটাই উত্তম হবে এখন যদি নিজের ভালোবাসার অধিকার নিয়ে আবার ও তার কাছে দাঁড়ায় খালি হাতেই ফিরতে হবে। হৃদয় জানে তার প্রেয়সী যে সামনে থাকা সাসা স্নিগ্ধ রমনী। সেদিন মেইলটার সূচনা এমন ছিলো,
“ আমার খারাপ ভাগ্য বুঝলি, জানিস তো তুই ততোটুকুই পাবি যা তোর জন্য জীবনে বরাদ্ধ রয়েছে। এর চেয়ে বেশি চাইলেও পাবি না। আর পেলে সেটার জন্য তোকে মূল্য দিতে হবে। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। আমাদের দুজনের মাঝে কোনো সমস্যা ছিলো না জানিস, ভালোবাসার একটা গুপ্তধন ছিলো আমাদের মাঝে। যার ভান্ডার অফুরন্ত…………”
মেইলটা শুনে নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারে নি সে। চেয়েছিলো মার কাছে জবাবদিহি চাইবে কিন্তু পরে ভাবলো দিশা নিজেই তো তার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে। তাই এই চিটাগাং এ আসার প্লান তার। এভাবে একটু কাছে আসার প্রচেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই।
– আমরা কি খাবো? আপনি কি কিছু ওর্ডার করেছেন?
দিশার প্রশ্নে হৃদয়ের ধ্যান ভাঙ্গে। মেকি হাসি হেসে বলে,
– আসছে খাবার, তুমি আজ বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ো। আমি সোফায় এডজাস্ট করে নিবো।
হৃদয়ের প্রস্তাবে মাথা কাত করে সম্মতি দেয় দিশা। হৃদয় তখন বাহিরের দিকে শুণ্য দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে কিছুতেই গোছাতে পারছে না। বারংবার দিশার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। তার মাঝে বিস্তার করতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের বউকে ছুয়ে দেবার অদম্য ইচ্ছেকে কি পাপ বলে গণ্য করা হবে? এটা কি খুব অপরাধ হবে যদি দিশাকে ভালোবাসতে চায় সে। হয়তো হবে, কে জানে_____
রাত ১টা,
কারোর কুহানিতে ঘুম ভেঙে যায় হৃদয়ের। চোখ মুখ খিচে উঠে বসলো সে। একে সোফাতে তার খুব আসতেই চাচ্ছিলো না। যা একটু এসেছে আবার ভেঙ্গে গেলো। চোখ কচলে দিশার দিকে তাকালে দেখতে পায় রীতিমতো কম্বলতা জড়িয়েও কুহাচ্ছে সে। দেরি না করেই দিশার কাছে গেলো হৃদয়। কপালে হাত দিতেই চোখ বিস্ফোরিত রুপ ধারণ করলো, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। একটু আগে তো ঠিক ই ছিলো সে। অথচ এখন এতো জ্বর। রিসিপশনে ফোন করে একটি থার্মোমিটারের ব্যাবস্থা করলো সে। এই ঝড়ের রাতে কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না খুব ভালো করেই জানে। তাকেই দিশার দেখভাল করতে হবে। রাত বাড়ার সাথে সাথে দিশার জ্বর ও বাড়তে লাগলো। সাথে রীতি মতো কাঁপছে সে। গায়ের অসম্ভব ব্যাথায় কুহাচ্ছে রীতিমতো। হৃদয় তাই কখনো জলপট্টি দিতে লাগলো তো কখনো দিশার গায়ে মালিশ করতে লাগলো। একটা সময় যখন কম্বলেও তার কাপনি কমাতে অসক্ষম তখন উপায়ন্তর না পেয়ে সে কিছু না ভেবেই একই কম্বলে ঢুকে পড়লো হৃদয়। হৃদয়ের দেহের উষ্ণতায় দিশাও বিড়ালের ছানার মতো তার দেহের সাথে লেপ্টে রইলো। যেমনটা লেপ্টে থাকতো দু বছর আগে। দিশার গরম নিঃশ্বাস যেনো হৃদয়ের পুরুষত্বকে বারংবার দূর্বল করে পরাজিত করে দিচ্ছে। নিজেকে আয়ত্বে রাখা একপ্রকার দুষ্কর কাজে পরিণত হয়েছে হৃদয়ের জন্য। একটা সময় নিজের কাছে নিজের হেরে গিয়ে নিবিড় ভাবে দিশাকে জড়িয়ে ধরলো সে। দিশা তখন চেতন অবচেতনের মাঝামাঝিতে অবস্থিত। একটা সুখময় স্বপ্নের হাতছানি ভেবে সেও নির্লিপ্ত হলো ভালোবাসার উম্মাদনায়। ঝড়ের তীব্রতার সাথে সাথে দুটি দেহের মিলনের তীব্রতাও বাড়তে লাগলো। কিছু যন্ত্রণা, কিছু ভালোলাগা পূর্ণতা দিলে লাগলো দুজনের ভালোবাসাকে। আজ হয়তো কিছু সুখ কুড়ানোর পালা, আজ হয়তো তাদের মিলনের পালা____
সকাল ৬টা,
সূর্যিমামা বেশ নির্লজ্জের মতো খিলখিল করে হাসতে হাসতে সমগ্র প্রকৃতিকে আলোকিত করছে। কে বলবে কাল সারাদিন মেঘের ঘনঘটার জন্য তার টিকি অবধি পাওয়া যায় নি। পাখিরা কিচিরমিচির করে জানান দিচ্ছে তারা আছে। এদিকে দুটি দেহ এখনো নিজেদের মধ্যে নির্লিপ্ত অবস্থাতে আছে। রুমে সূর্যের তীর্যক আলো পরতেই হৃদয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। দিশা তখন ও ঘুম। এখন আর জ্বর নেই। তবে খুব ক্লান্ত সে। হৃদয় এক নজরে তার প্রেয়সীকে দেখেই যাচ্ছে। ঘুমন্ত প্রেয়সীকে নির্দ্বিধায় একতা ফুটন্ত নীলপদ্মের থেকে কম কিছু লাগছে না। সূর্যের স্নিগ্ধ কিরণে তাকে আরোও সুন্দর লাগছে। এও নেশা যে যে সে নেশা নয়। এটা নেশার কালোনদ। কিন্তু পরমূহুর্তে………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি