#নীলপদ্ম
#১০ম_পর্ব
দিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বালা জোড়া টেবিলে ফয়সালের দিকে এগিয়ে বললো,
– ফয়সাল, তুই নিশ্চয়ই একজন বিবাহিত মেয়েকে বিনা তালাকে বিয়ে করবি না।
– মানে?
অবাক হয়ে ফয়সাল প্রশ্ন করলে দিশা বলে,
– আমার বিয়ে আড়াই বছর আগে হয়ে গেছে, এ কথাটা আমার পরিবার আর সায়মা ব্যাতীত কেউ জানে না। আমি চাই না আমার সাথে নিজের জীবন জড়িয়ে তুই তোর জীবনটা নষ্ট হোক। লোকটার সাথে আমি সংসার হয়তো করছি না কিন্তু তার জায়গা অন্য কাউকে দেয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, একটু ভেংগে বলবি প্লিজ?
দিশা একটু পানি খেয়ে, ছোট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে সব বলতে শুরু করলো। ফয়সাল চুপ করে তার কথাগুলো শুনছে, আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দিশাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। তার সামনে বসে থাকা মেয়েটি তার ছোটবেলার বান্ধবী নয়, সামনে বসে থাকা মেয়েটির সাথে সেই মায়াবী মেয়ের কোনো ও মিল নেই। এই মেয়েটি কেবল একটি রক্ত মাংসের মানুষ মাত্র যে কিনা তার হৃদয়ের গহীনে কিছু অব্যক্ত কষ্টের ফর্দ নিয়ে ঘুরছে। একটা কথা আছে,
“যা পাওয়া যায়না তার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়।“
____হুমায়ুন আহমেদ
ফয়সালের ও একই অবস্থা। ইচ্ছে করছে এক ঝটকায় হৃদইয়ের থেকে দিশাকে কেড়ে নিতে। সে তো ভালোই আছে মেয়েটার বুকে দুঃখের বোঝা দিয়ে। কিন্তু এটা সে পারবে না, কখনোই না। কারণ তাহলে সেটা আর ভালোবাসার পর্যায়ে পড়বে না। ভালোবাসা তো সবসময় পাওয়াতে সীমাবদ্ধ থাকে না। আর এটা ফয়সাল চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না যে দিশার চোখে ওই মানুষটার প্রতি লুকানো ভালোবাসাটা স্পষ্ট। হয়তো তার অবাদ্ধ মনটা এখন ওই মানুষটার অপেক্ষায় ব্যাকুল হয়ে আছে। দিশার কথা শেষ হলে ফোস করে একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়ে ফয়সাল। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর জানাটা খুব দরকার। কফির কাপে একতা ছোত চুমুক দিয়ে দিশাকে জিজ্ঞেস করে,
– তোরা আলাদা হয়ে গেলি কেনো? যতদূর আমার মনে হচ্ছে ছেলেটি তোকে অসম্ভব ভালোবাসে। তাহলে? কি এমন হয়েছিলো যে আজ তোদের বিয়েটা একটি স্মৃতির ছেড়া পাতার মতো হয়ে আছে?
ফয়সালের প্রশ্নে আলতো ঠোঁটে হাসে দিশা। এই চাপা হাসির মাঝে হাজারো বেদনা লুকিয়ে আছে। গলা কাঁপছে তার, তবুও বলতে শুরু করে,
– আমার খারাপ ভাগ্য বুঝলি, জানিস তো তুই ততোটুকুই পাবি যা তোর জন্য জীবনে বরাদ্ধ রয়েছে। এর চেয়ে বেশি চাইলেও পাবি না। আর পেলে সেটার জন্য তোকে মূল্য দিতে হবে। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। আমাদের দুজনের মাঝে কোনো সমস্যা ছিলো না জানিস, ভালোবাসার একটা গুপ্তধন ছিলো আমাদের মাঝে। যার ভান্ডার অফুরন্ত। ওর মাঝেই আমার বিস্তার ছিলো, আর মাঝে ওর। কিন্তু একটা দমকা হাওয়া সব পালটে দিলো। যেদিন ওর অপারেশন ছিলো সেদিন পুরো শহর খুজে আমি ওর জন্য নীলপদ্ম জোগাড় করে বাসায় রেখেছিলাম। অপারেশন সাক্সেসফুল হয়েছে শুনে বাসায় ছুটে আসছিলাম। ভেবেছিলাম ওই পাঁচটা নীলপদ্ম নিয়ে ওর সাথে দেখা করবো সব সময়ের মতো। কিন্তু হলো কোথায়। হঠাৎ একটা জিপ আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলো। তারপর একের পর এক হুমকি। যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না তখন ওরা বাবার এক্সিডেন্ট করিয়ে দিলো। আমাকে এবং ফুপুকে বাধ্য হয়ে দেশে ফিরতে হলো। একটা শর্তেই আমাকে তারা ছেড়ে দিয়েছিলো আমি যেনো কখনো ওর সামনে না আসি। আমরা ঢাকা থেকে চিটাগং শিফট করলাম। ততদিনে হৃদয় হন্নে হয়ে আমাকে খুজছিলো। আমার একটা ক্লু ও সে পেয়ে গিয়েছিলো। সেই সুত্র ধরে হৃদয়ের মা আমার কাছে আছেন। তার ছেলের জীবনটা নাকি আমার জন্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই আমার কাছে নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ ভিক্ষে চাচ্ছিলেন তিনি। তার ছেলের এক্সিডেন্টের আগেই নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। আর আমাদের তো আইনী বিয়েটাই হয় নি। সুতরাং শুধু ছয় মাসের রেশ ধরে তার ছেলের জীবনটা যাতে নষ্ট না করি আমি। আমি যতটাকা চাই তিনি দিবেন। বাবার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিলো। আমার কাছে কোনো উপায় ও ছিলো না। টাকাটা আমার খুব দরকার ছিলো। প্রথমে ভেবেছিলাম যদি হৃদয় আমাকে খুজে পায় তাহলে নিজেকে আড়াল করবো না। কিন্তু ওর মাকে কথা দেবার পর আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে কথা রাখতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আর আমি তো নিজের ভালোবাসাকে বিক্রি ই করে দিয়েছি। সুতরাং এই অহেতুক ভালোবাসার দোহায় দিয়ে কি লাভ বল__
ঠোঁট চেপে কান্না আটকালেও চোখ যে কারো কথাই শুনে না, নিজের মতো বইছে। অশ্রুগুলোকে মুক্তি দিয়ে যেনো নিজের ভার কমাচ্ছে। সায়মার চোখ ও ছলছল করছে। এসবের সাক্ষী যে সে নিজেও। ফয়সাল অবাক চোখে দিশাকে দেখছে। শান্তনা দেবার ভাষাটুকু নেই। ছোট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলে,
– আংকেল এবং তোর এই অবস্থা যার জন্য সেই মানুষটাকে? হৃদয়ের মা যদি হৃদয়ের ক্লু দিয়ে তোর কাছে পৌছায় তবে এটা বলাই যায় যে তিনি এই ঘৃণ্য কাজ গুলো করেন নি।
– না না উনি এমন কাজ করার মতো মানুষই নন
– তাহলে?
দিশা কোনো কথাই বলে না। দিশার নীরবতা ফয়সালকে বুঝিয়ে দেয় সে এই ব্যাপারটা তার একান্ত নিজের মধ্যেই রাখতে চাচ্ছে। তারমানে এই ব্যপারটা কেউ ই জানে না। রাগের চোটে টেবিলে একটা থাবা মেরে দেখান থেকে চলে যায় ফয়সাল। ওই ব্যক্তিটিকে পেলে হয়তো জ্যন্ত কবর দিতো সে। যে দিশাকে এতোটা কষ্ট দিয়েছে সে মানুষটা ঠিক তার মতো ভালোই আছে। তার স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেছে। মাঝে একটা ভালোবাসাকে দাফন করে দুজন মানুষ অভিনয়ে নেমেছে।
রাত ৯টা,
নূর বেগম ইচ্ছেমতো বিয়ের শপিং করে এনেছেন। নিশাত এবং সে নিশাতের অনুষ্ঠান অনুযায় শাড়ি ভাগ করতে ব্যাস্ত বসার ঘরে। নূর বেগম আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তার এতোদিনের পছন্দের মেয়েটি তার ছেলের বউ হতে যাচ্ছে। ছেলের সুখের জন্য হয়তো নিজের ছেলেটির কাছে দায়ী হয়ে থাকবেন তিনি। কিন্তু একবার ছেলেটা নিশাতের সাথে সংসার শুরু করে দিলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না তার। দিশা মেয়েটি খারাপ নয় কিন্তু সবচেয়ে বড় যেই সত্যতা, মেয়েটাকে অসম্ভব লোভী মনে হয়েছে তার কাছে। কিছু টাকার লোভ দেখাতেই মেয়েটি তার ছেলেকে ছেড়ে দিলো। ভালো হয়েছে মেয়েটা তার ছেলের জীবনে নেই। তবে হৃদয় যদি এই কথাটা জানতে পারে তবে হয়তো তার মুখটি ও দেখতে চাইবে না। এসব যে নূর বেগমকে ভাবাচ্ছে না সেটা না। তবে নিশাতের উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে, মেয়েটা ঠিক হৃদয়কে মানিয়ে নিবে। একটা শাড়ির আঁচল উলটাতে উলটাতে কথাগুলো ভাবছিলেন নূর বেগম। হৃদয় খেয়াল করলো তার মা বেশ অন্যমনস্ক। বসা থেকে উঠে মায়ের সামনে হাটু গেড়ে বসে সে। মায়ের হাতজোড়া ধরে শান্ত কন্ঠে বলে,
– মা আমি তো তোমার কথাতেই সব করছি, তবুও কেনো তোমার মুখে চিন্তার রেখা?
– কিছু না বাবা, ভয় হচ্ছে। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস? ভাবছিস আমি স্বার্থপর। কিন্তু আমি তোর ভালোর জন্যই করছি রে সব।
– আমি জানি, আমার মা ভুল হতেই পারে না।
হৃদয়ের কথা শুনে তার কপালে চুমু একে দেন নূর বেগম। মনটা তবুও খচখচ করছে। ছেলেটাকে যদি তার ভালোবাসার আসল রুপটা দেখাতে পারতেন তাহলে হয়তো এই খচখচানিটা দূর হতো।
মাকে বলে নিজের রুমে আসে হৃদয়। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। খুব ক্লান্ত লাগছে, মনের বিরুদ্ধে অভিনয় করাটা খুব কঠিন একটা কাজ। হঠাৎ টুং করে মোবাইলটা বেজে উঠে হৃদয়ের। ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে মোবাইলের লক খুললে দেখে একটা আননোন ইমেইল এদ্রেস থেকে একটা মেইল এসেছে। মেইলতা ওপেন করতেই…………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি