নীলকমল পর্ব-০৪(শেষ পর্ব)

0
1809

#নীলকমল
#ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

আসলে আমি বুঝতে পারিনি এমনটা হবে। এখন কি করবো বা কি বলবো তাই বুঝতে পারছি না। ঘরে কোনো খাবারও নেই। আমি মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ” আপনার কি ক্ষুধা লেগেছে? আসলে বাড়িতে কোনো খাবার নেই। আমি কয়েকদিন রিকশা চালাতে পারিনি তাই কিছু কিনতেও পারিনি।”

মিথিলা ও-র ঘাড়ে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো, ” না আমার ক্ষুধা লাগেনি। আপনি এগুলো খেয়ে নিন। মা বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে দিয়ে দিয়েছিলো। আমার আর ওদের দেওয়ার কিছু মুখে উঠবে না। ”

আমি কোনো কথা না বলে ও-র হাত থেকে বক্সটা নিয়ে বললাম, ” আপনি খাটে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি বাইরে ঘুমাবো। ”

মিথিলা আমার কথায় মুচকি হাসলো। তারপর বললো, ” বিয়েটা নাটক সিনেমার মতো হলেও আমি আপনাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছি। আপনি খাটে ঘুমাতে পারেন। নিজেরা ঠিক থাকলে একখাটে ঘুমালে কিছু হবে না। আর নিজেদের যদি সমস্যা থাকে তাহলে আলাদা বাড়ি দিলেও সমস্যা হবে। ”

–” আপনি কিন্তু বড়দের মতো জ্ঞান দেন। ”

মিথিলা মুচকি হাসলো কিন্তু কিছু বললো না। এরপর থেকেই আমাদের পথচলা শুরু। মিথিলা নিয়মিত পড়াশোনা করেছে। আমার বাড়িটাও সামলে রেখেছে। এতো টুকু মেয়ে যে এতো ভালো রান্না করতে পারে তা মিথিলাকেই প্রথম দেখা। সামান্য ডাল-ভাতও মিথিলা খুব ভালো রান্না করতো। প্রথম দিকে আমরা বন্ধুর মতো থাকলেও কখন যে তা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে নিজেও বুঝতে পারিনি।


অতীতের চিন্তা বাদ দিয়ে মিথিলাকে ডেকে বললাম রেডি হতে। আমার প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে পেরেছি তা তো দেখাতে হবে। মিথিলা আমার কথামতো রেডি হয়ে আসলো। ও-র সাজপোশাকে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগের মতোই কালো বোরকা হিজাব পরেছে। আমিও রেডি হয়ে নিলাম। শশুর বাড়ি যাব একটু না সাজলে হয় নাকি!

দুইজনে রেডি হয়ে রওনা দিলাম। যাওয়ার সময় মিথিলাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ” আচ্ছা তুমি কি উনাদের মা করে দিবে?”

মিথিলা জবাবে বললো, ” জানো তো আকাশ মা বাবার উপর রাগ করে থাকতে হয় না। উনারা সবসময় সন্তানের ভালোই চায়৷ সেদিন হয়তো চাচা চাচির কথায় দামটা উনাদের কাছে বেশি ছিলো কিন্তু না চাইতেও উনারা আমার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেদিন উনারা আমার বিয়েটা না দিলে আমি তোমার মতো একজন স্বামী পেতাম না৷ টাকা পয়সা রূপ যৌবন সবসময় থাকে না রে। ভালো মনের একজন জীবন সঙ্গী পাওয়াই সব থেকে বড় ভাগ্যের ব্যাপার৷ হ্যা আমার অনেক বড় চাকরি করে সরকারি কর্মকর্তা এমন ছেলের সাথে বিয়ে হতে পারতো কিন্তু তাদের থেকে কি আমি এমন সাপোর্ট পেতাম? হয়তো পেতাম হয়তো বা পেতাম না। দামী গহনা শাড়ির আড়ালে কষ্ট লুকিয়ে রাখতে আমি পছন্দ করি না আকাশ। আমি যেমনটা পেয়েছি তেমনটাই আলহামদুলিল্লাহ। এতোটা সুখও হয়তো অনেকে পায় না। ”

মিথিলার কথা শোনার পর আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। সত্যি বলতে বিয়ের পর থেকে মিথিলা কখনোই আমাকে নিয়ে আফসোস করেনি। বরং আজীবন গর্ব করে এসেছে। কখনো কখনো ও-কে যদি কেউ বলেছে, তোর আরো ভালো বর হতো। তোর আব্বু একজন রিকশাওয়ালার বউ করে দিলো তোরে।

মিথিলার উত্তরটা হতো এমন, ” আসলে কি জানিস আমার বরের রোজগারটা হালাল। কখনো কারো কষ্টের টাকা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিজেকে বড় করতে চায় না। হ্যাঁ আমি অনেক বড় চাকরি করে এমন ছেলেও আমার বর হতে পারতো তবে আকাশকের সাথে থেকে আমি যতটা সুখী এতটা সুখী হয়তো হতে পারতাম না৷ ”

সত্যি আমি অনেক ভাগ্যবান যে মিথিলাকে নিজের করে পেয়েছি। আল্লাহ মানুষকে কখনো তার সহ্য ক্ষমতার বেশি কষ্ট দেন না। তা আমি নিজেকে দেখলেই বুঝতে পারি। মিথিলা আবারও বলে উঠলো, ” আকাশ তোমার ব্যবহার দিন দিন পরিবর্তন হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কারণটাও জানি কিন্তু জানো তো অন্যের কথায় কান দিয়ে নিজের সংসারে অশান্তি করতে হয় না। তোমাকে লোকজন অনেক ধরনের কথা বলে আমি বুঝতে পারি তার মানে এইটা না যে তাদের কথা ঠিক। সবাই পরিবর্তন হয় না আকাশ। কেউ কেউ আজীবন পাশে থেকে সবকিছুকে মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। আমি তোমাকে এটা বলছি না যে আমি তেমার সাথেই থাকবো। শুধু আমার কবরে যেদিন মাটি দিবে সেদিন স্বীকার করে নিও মিথিলা তোমাকে ছেড়ে যায়নি। কোনো সরকারি চাকরি তোমার আর আমার মাঝে ফাটল ধরাতে পারেনি। ”

আমি রাস্তার মাঝেই মিথিলাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর বললাম, ” তোমাকে এসব বলতে বলেছি নাকি আমি? আমাকে ছেড়ে যাওয়ার খুব ইচ্ছে তাই না? ”

মিথিলা কিছু না বলে নিজেকে আমার থেকে ছাড়িয়ে নিলো তারপর আস্তে করে বললো, ” এইটা রাস্তা।। ”

আমি কিছু না বলে ও-র হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের ভিতর মুষ্টি বদ্ধ করে নিলাম। তারপর আমাদের গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। শশুর বাড়িতে যাওয়ার পর যখন সকলে মিথিলার বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করার কথা জানতে পারলো তখন কেউ তেমন কোনো কথা বললো না। শুধু শশুর মশাই আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, ” আমি সঠিক ছেলের হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে পেরেছিলাম। এইভাবেই আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো। ”

শাশুড়ি মা মিথিলাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করলেন। তারপর ভাঙা গলায় বললেন, ” আজ কিন্তু তোরা যেতে পারবি না। ”

মিথিলা প্রতিত্তোরে শুধু মুচকি হাসলো। সব মেয়েই তার মা বাবাকে ভালোবাসে। কিছুটা অভিমান হয়তো এই ভালোবাসার উপর কুয়াশার চাদরের মতো আস্তরণ ফেলতে পারে কিন্তু মুছে ফেলতে পারে না। আমি মিথিলার চাচাতো ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ” আমার বউ কিন্তু বিসিএস ক্যাডার তবে আপনি কলেজের গন্ডিও টপকাতে পারলেন না। অন্যকে হিংসা করলে জীবনে কখনো বড় হওয়া যায় না৷ তবে আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার মিথ্যা সাক্ষ্য না পেলে হয়তো আমি মিথিলার মতো জীবনসাথী পেতাম না৷

ও-র চাচাতো ভাই রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। তারপর কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আসলে আমরা অন্যকে ছোট করে যে কি আনন্দ পাই বুঝতে পারি না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম মিথিলা কোথাও নেই। কতদিন পর নিজের বাড়িতে এসেছে হয়তো সকলের সাথে দেখা করতে গেছে। যাই আমিও শশুরবাড়ি ঘুরে দেখি। কখনো তো আসা হয়নি। ( ফারহানা কবীর মানাল)
মিথিলাদের বাড়িটা বেশ সুন্দর। দোতলা বাড়ি, বাড়ির সামনেই রাস্তা, পিছনের দিকে পুকুর, সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর। বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছি এমন সময় চোখে পড়লো মিথিলা একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। কি বলছে কি জানি! আমি ওদের দিকে একটু এগোতে শুনতে পেলাম, মেয়েটা মিথিলাকে বলছে, ” হ্যাঁ রে তোর বর তো শুনেছি রিকশাওয়ালা। জানিস আমার বর সরকারি কর্মকর্তা। মাস গেলে মোটা টাকা বেতন পায়। আমাকে কত শাড়ি গহনা উপহার দেয়। ”

মিথিলা মুচকি হেসে বললো, ” খুব ভালো তো। আচ্ছা তোর তো স্কুলের শিক্ষিকা হওয়া স্বপ্ন ছিলো। ছোট বেলায় এমনটাই শুনেছি। সেবার নাকি পরীক্ষাও দিয়েছিলে। তো এখন কি করিস?”

মেয়েটার হাসি মুখটা কালো হয়ে গেলো। তারপর মন খারাপ করে বললো, ” আসলে আমার উনি চান না আমি চাকরি করি। তাই ওইসব আর হয়নি। ”

মিথিলা শান্ত গলায় বললো, ” কিন্তু জানিস আমার উনি আমাকে নিজের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা টাকায় পড়িয়ে এতেদূর এনেছে। আমার বই কেনার টাকা জোগাড় করতে দুপুরে খাবারটা পর্যন্ত খায়নি। জানিস তো সুখটা টাকায় সীমাবদ্ধ থাকে না। সুখ জিনিসটা নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে খুঁজে নিতে হয়। যদি তুই ডাল-ভাত থেয়ে সুখে থাকতে পারিস তাহলে তুই সুখী। যদি তুই বিরিয়ানি খেয়েও সুখ খুঁজে না পাস তাহলে তুই অসুখী। আর বললি না আমার স্বামী রিকশা চালায়। হ্যাঁ উনি রিকশা চালায় তাতে সমস্যা কিসের? বরং আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি আমার স্বামীর সব টাকা হালাল। উনার কোনো অবৈধ রোজকার নেই৷ যা অনেক বড় চাকরিজীবীর স্ত্রীরাও বলতে পারে না৷ ”

মেয়েটার মুখটা একদম ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছে এটা ভেবে যে আমার স্ত্রী আমার পরিচয় নিজে লজ্জাবোধ করে না। বরং অন্যকে বুঝিয়ে দেয় যে তার স্বামীর অপমান সে সহ্য করবে না। মেয়েটা চুপ করে আছে দেখে মিথিলা আবারও বলে উঠলো, ” আমরা সবাই বইয়ের পাতায় একটা লাইন পড়ে এসেছি যে সকল পেশার লোকরা মানুষ। কোনো কাজই ছোট নয়। কিন্তু এ কথাগুলো যেন বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। বাস্তবে কোনো মানুষই হয়তো সব কাজকে সমান চোখে দেখতে পারে না। ”

কথাগুলো বলে মিথিলা ওই জায়গা থেকে চলে গেলো। কিন্তু আমি সেই পুকুর পাড়েই দাঁড়িয়ে আছি। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করছি যে মিথিলার মতো একটা মেয়েকে আমার স্ত্রী রূপে পাঠানোর জন্য। ভবিষ্যতে মিথিলা বদলে যাবে কিনা আমি এখন বলতে পারছি না। তবে এই পৃথিবীতে আমার থেকে সুখী মানুষ আর একটাও নেই। সকলে আমার জন্য দোয়া করবেন যেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমি এতোটা সুখে থাকতে পারি।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে