নীলকমল পর্ব-০১

0
1994

#নীলকমল
#ফারহানা_কবীর_মানাল
সূচনা পর্ব

আমার বউ বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করার পর থেকে রাস্তাঘাটে চলাচল করা আমার জন্য দায় হয়ে গিয়েছে। সারাদিন কাজ করার পর রিকশাটা নিয়ে সবে বাড়ির দিয়ে রওনা দিয়েছি। এমন সময় এলাকার এক ভাই আমাকে ডেকে বললেন,

–” কি রে আকাশ সারাজীবন কষ্ট করে রিকশা চালিয়ে বউকে বিসিএস ক্যাডার বানিয়ে ফল কি অন্য কাউকে খাওয়াবি নাকি? তোর বউ তো তোকে রেখে চলে গেলো বলে। আমাদের কথা মিলিয়ে দেখিস। ”

সারাদিন রোদের ভিতর রিকশা চালিয়ে এখন শরীরে বিন্দুমাত্র বল শক্তি নেই। তাই কারো সাথে তর্ক করতে গেলাম না। মুচকি হেসে বললাম, ” আমাকে রেখে চলে গেলে আর কি করবো ভাই বলেন। আমি না হয় আর একজনকে বিয়ে করে সুখে থাকবো। ”

কথাগুলো বলে সোজা বাড়ির রাস্তা ধরলাম। আজ সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছি। আজ মিথিলা প্রথম চাকরিতে যোগদান করেছে। ও-র অনেক শখ ছিলো একটা নীল শাড়ির। অভাবের সংসারে কখনো ও-র শখ আল্লাদ পূরণ করতে পারিনি। তাই আজ অনেক কষ্ট করে বেশ কিছু টাকা রোজগার করেছি৷ আজ মিথিলার সব থেকে বড় ইচ্ছেটা পূরণ হয়েছে। আজ ও-র ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোও আমি পূরণ করে দিবো। বড় বাজার থেকে বেলিফুলের মালা আর ছয়টা গোলাপ কিনে এনেছি। আর সাথে দুই প্যাকেট বিরিয়ানি। সব মিলে প্রায় হাজার দুই টাকা লেগেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দুপুরে খাওয়ার টাকাটা জমিয়ে এসব কিনতে পেরেছি। আজকাল একদিনে এতো টাকা রোজগার করা প্রায় অসম্ভব। খুব খুশি মনেই ঘরে ফিরছিলাম কিন্তু মাঝ পথে মনটা বিষিয়ে গেলো। মনের ভিতর না চাইতেও নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। আচ্ছা মিথিলা চাকরি করতে গিয়ে বদলে যাবে না তো? তখন কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমাদের এই নয় বছরের সংসার জীবন ভুলে যাবে? না না এসব আমি কি ভাবছি! মিথিলা আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার জন্য কত শখ আল্লাদ মাটিতে পুঁতে ফেলেছে তা আমার অজানা নয়। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির সীমানায় চলে এসেছি নিজেই বুঝতে পারিনি। রিকশাটা জায়গা মতো রেখে উপহারগুলো হাতে নিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম। মিথিলা এসব দেখলে কতটা খুশি হবে ভাবতেই খুব আনন্দ লাগছে। আমাদের বাড়িটা কাঠের তৈরী উপরে টিনের চাল। মা বাবা অনেক আগেই মারা গেছে তবে আব্বার বাড়িটা ছিলো তাই থাকার তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। ঘরে ঢুকে দেখলাম মিথিলা ঘুমিয়ে আছে। আগে-পরে কখনো মিথিলা আমি বাড়িতে না আসলে ঘুমাতো না৷ তাহলে আজ হঠাৎ! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাত্র আটটা বাজে। হয়তো অফিসে গেছিলো তাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাড়ি ফিরেছে সেই বিকেলে এখনও ঘুমিয়ে আছে তাহলে তো অনেক ঘুমিয়েছে। উপহারগুলো সাথে সাথে দিতে না পারলে কি উপহার দেওয়ার মজা থাকে নাকি!. আমি আস্তে করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, ” মিথিলা অনেক ঘুমিয়েছ তো। এখন ওঠো। ”

মিথিলা চোখ বন্ধ রেখেই বললো, ” কোথায় অনেক ঘুমিয়েছি? মাত্রই শুয়ে পড়লাম। তুমি রাতে খেয়ে নিও। ”

খুব কষ্ট পেলাম ও-র কথাগুলো শুনে। আগে পরে কখনো এমন ব্যবহার করেনি তাই মানতে একটু কষ্ট হচ্ছে। তবুও নিজেকে সংযত করে বললাম, ” দেখো আমি তোমার জন্য নীল শাড়ি, বেলি ফুলের মালা আর গোলাপ এনেছি। এগুলো দেখে তারপর ঘুমিয়ে যেও। ”

মিথিলা বেশ বিরক্ত হয়ে বললো, ” দেখো এমন হাজার হাজার নীল শাড়ি, সস্তা ফুল কিনতে পারবো আমি এখন। তুমি আমাকে বিরক্ত করো না তো। চাকরি তো করোনি কখনো তাই জানো না ঠিক কতটা কষ্ট করতে হয়। ”

মিথিলার কথার উত্তর দেওয়ার মতো কোনো ভাষা আমার জানা নেই। ওর সাথে ঝগড়া করতে আমার ভালো লাগে না তাই চুপচাপ জিনিসগুলো টেবিলের উপর রেখে দিলাম। এতো সময় ক্ষুধায় পেট চো চো করলেও এখন যেন তা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। যে মেয়ে নয় বছরের বিবাহিত জীবনে কখনো আমাকে রেখে খাবার খায় না সে আজ এতো সকালে আমাকে রেখে খাবার খেয়ে নিলো। কি জানি হয়তো ক্ষুধা লেগেছিলো অনেক। ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বারবার মাথায় কি সব উল্টো পাল্টা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এক গ্লাস পানি খেয়ে গর থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘরের সামনে বারান্দার মতো করা। মাটি দিয়ে তৈরী আর কি। এই বারান্দায় বসে কত গল্প করেছি আমরা দুইজন। সেবার মিথিলার পরীক্ষার ফি দিতে হবে আর বই কিনতে হবে বলে তিন হাজার টাকার দরকার ছিলো। কিন্তু কিছুতেই টাকা জোগাড় করতে পারছিলাম না। অবশেষে এক লোকের কিছু জিনিস শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিলে এক হাজার টাকা দিবে বললো। তখন রাত দশটা বাজে৷ বাড়িতে ফিরে আসবো বলে সব গুছিয়ে রাখছি। কিন্তু ও-র পরীক্ষার ফি দিতে হবে বলে রাজি হয়ে গেলাম। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতে প্রায় তিনটে বেজে গেছিলো, সেদিন মিথিলা এই বারান্দায় বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। আমি বাড়িতে আসলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলেছিলো, ” আমি আর পড়বো না তুমি ঠিক সময়ে বাড়ি চলে আসবে এরপর থেকে৷ আমার খুব ভয় হয় তোমাকে হারানোর। ”

অতিতের কথা মনে করতে করতে কখন যে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে বুঝতেই পারিনি। হাত দিয়ে চোখ আর কপল মুছে নিলাম। হয়তো আমি বেশিই ভাবছি। এটাও তো হতে পারে মিথিলা অনেক ক্লান্ত বা শরীর খারাপ। না জেনে এই ভাবে ওকে দোষ দেওয়া একদম উচিত হচ্ছে না আমার। নয় বছরের ভালোবাসা নয় মিনিটে যাচাই করা কি উচিত?


চাকরি পাওয়ার পর থেকেই মিথিলার ভিতর পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। এখন ও আমার সাথে খুব একটা কথা বলে না। বাড়িতে ফিরেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। আমি নিজে থেকে কথা না বললে খুব একটা কথা বলে না। চুপচাপ ফোনে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আগে মিথিলার স্মার্ট ফোন ছিলো না। চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে একটা স্মার্ট ফোন কিনে নিয়েছে। বাড়িতে থাকলে সাধারণত কোন নিয়ে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে মুচকি মুচকি হাসে। কখনো কখনো সুন্দর করে সেজে ছবি তোলে। প্রথম প্রথম ভাবতাম হয়তো আমাকে দেখানোর জন্য সাজে কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম সাজটা আমার জন্য নয়।
এইতো সেদিন আমি সবে মাত্র বাড়ি ফিরেছি। মিথিলা সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘরের ঢোকার আগে থেকেই ওকে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু আমি ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ও সব সাজ নষ্ট করে দিচ্ছে মানে মুখের মেকআপ তুলে ফেলছে। আমি ওর এমন কাজ দেখে ও-কে বললাম, ” আমার জন্য সাজলে আর আমাকেই দেখতে দিচ্ছো না। রাগ করে আছো নাকি আমার উপর?”

মিথিলা হেসে জবাবে বলেছিলো, ” কি যে বলো না তুমি! আমি তোমাকে দেখাতে সাজতে যাব কেন। আমি তো ছবি তুলবো বলে সেজেছি। ”

মিথিলার এসব অবহেলা আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিলো কিন্তু ও-কে কিছু বলতেও পারছিলাম না। কার কাছে অভিযোগ করবো আমি! যে নিজেই আমাকে দিনদিন অবহেলা করছে তার কাছে? হয়তো মিথিলা ভুলে গেছে আমি কতটা ভালোবাসি তাকে বা আমাকে ভুলে যেতে চাইছে। আমি না চাইতেও অনেক কিছু বুঝতে পারি। একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার স্বামী একজন রিকশাওয়ালা এই পরিচয়টা দিতে হয়তো দ্বিধা বোধ করে। কে সমাজে নিজেকে ছোট করতে চাইবে?

জীবনের সব থেকে বড় ধাক্কা খেলাম যেদিন মিথিলাকে আমি ওর অফিসের সামনে নামিয়ে দিতে গেছিলাম। মিথিলা রিকশা থেকে নামতেই একটা ছেলে এসে মিথিলাকে জড়িয়ে ধরলো৷ একজন স্বামীর সামনে অন্য কেউ তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলে তার কেমন লাগতে পারে এটা হয়তো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি খুব বেশি রেগে লোকটার গায়ে হাত তুলবো এমন সময় মিথিলা আমার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বললো, ” তোমাকে তো ভাড়া দিয়ে দিয়েছি তাহলে কেন এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছো? বেশি ভাড়ার দরকার? ”

আমি কিছু না বলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভাঙা গলায় বললাম, ” আমি ভাড়া..

কথা শেষ হওয়ার আগে মিথিলা আমার হাতে একশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললো, ” যাও তো এখান থেকে। ”

তারপর ওই লোকটার হাত ধরে বললো, ” তাড়াতাড়ি চলো অফিসে অনেক কাজ পড়ে আছে। ”

লোকটাও মিথিলার হাত ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেলো। আমার তখন মনে হচ্ছিল আমি কোনো ভয়ংকর দূরস্বপ্ন দেখছি। আমার মিথিলা এমন করতে পারে না। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো রকমভাবে বাড়িতে ফিরে এলাম। রাস্তায় থাকলে একটা বড় এক্সিডেন্ট হতে পারতো তাই বাড়িতেই চলে এলাম। জীবনের প্রতি আমার মায়া শেষ হয়ে গিয়েছে তবুও আমি মিথিলার থেকে উত্তর চাই। এতোটা ভালোবাসার এই প্রতিদান দিলো আমাকে? ও-র কি একটুও বুক কাঁপলো না আমাকে এতোটা কষ্ট দিতে! হঠাৎ মিথিলার গলা শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে