#নীলকমল
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩
কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করার মন মানসিকতা না থাকলেও সে বয়সে মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ ছিলো প্রচুর। তাদের সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করতো তবে ইচ্ছেটাকে মনের মাঝে কবর দিয়ে রেখেছিলাম। মিথিলার পরনে ছিলো কালো বোরকা হিজাব। মুখটা কোনো রকম দেখা যাচ্ছিল। সম্পূর্ণ শরীর ঢাকা থাকলেও যে মেয়েদের এতো সুন্দর দেখায় মিথিলাকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। মনের মাঝে নানান ইচ্ছে উঁকি দিতে লাগলো। তবুও এসব ব্যাপারকে পাত্তা না দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলাম৷ মিথিলাও কোনো প্রকার কথা বলেনি আমার সাথে।
সময়ের সাথে সাথে বৃষ্টি বেড়েই চলছে। এতো সময় দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া সন্ধ্যা হয়ে আসছে৷ অন্যদিকে ক্ষুধাও লেগেছিলো। কিন্তু বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। এমন অবস্থায় বাড়িতে ফিরলে তিনদিন আর বিছানা থেকে ওঠা লাগবে না। সময়ের সাথে সাথে বৃষ্টি বেড়েই চলছে। মিথিলা আর আমি দুইজন দুইদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো প্রকার কোনো কথা বলিনি আমরা। হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম মিথিলা কাঁপছে। ভয়ে নাকি শীতে ঠিক বলতে পারবো না।
আমি ও-কে প্রশ্ন করে বসলাম, ” আপনার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে? ”
মিথিলা ভয়ার্ত গলায় জবাব দিলো, ” আসলে সন্ধ্যা হয়ে আসছে কিন্তু বৃষ্টি কমছে না। আমি কি করে বাড়ি যাবো তাই বুঝতে পারছি না। ”
মেয়েদের প্রতি ছেলেদের অশেষ দরদ থাকে। আমারও ছিলো না এমনটা নয়। আমি হিরো হিরো ভাব দেখিয়ে বললাম, ” ভয় নেই, আমি আপনাকে পৌঁছে দিবো। তবে বৃষ্টি একটু কমলে। কিন্তু আপনি এখানে আটকে গেলেন কি করে?”
–” আমি স্কুল থেকে ফিরছিলাম তখন বৃষ্টি শুরু হলো। ভেবেছিলাম একটুপরেই বৃষ্টি কমে যাবে কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে এলো এখনও বৃষ্টি কমছে না। আমি একা বাড়ি যাবো কি করে এখন! আমার অনেক ভয় করে। সকলে হয়তো অনেক চিন্তা করছে আমার জন্য। ”
কথাগুলল বলেই কান্না শুরু করলো। এই মেয়েরা কথায় কথায় কাঁদতে পারে। যাইহোক সেদিন হিরোর পাঠ নিতে গিয়ে মিথিলাকে রিকশায় করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। ও বাড়ি অনেকটা দূরে ছিলো বলে আমাদের যেতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। ভেবেছিলাম মেয়েকে সুস্থ পেয়ে ও-র বাড়ির লোকেরা আমাকে যত্ন করে খাইয়ে দিবে। কিন্তু না! মিথিলা বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে অতি-আবেগপ্রবণ হয়ে আমার দিকে একটা চকলেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ” আপনাকে সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ! ”
আমিও খুশি মনে ওর হাত থেকে চকলেটটা নিতে গেলাম। কিন্তু তার আগেই মিথিলার গালে কেউ প্রচন্ড জোরে চড় মারলো। এতো জোরে চড় মেরেছে যে মিথিলা মাটিতে পড়ে গেলো। তারপর কয়েকজন লোক মিলে আমার শার্টের কলার ধরে রিকশা থেকে নামাতে নামাতে বললো, ” ছোটলোক তোর এতো সাহস আমার বাড়ির মেয়ের দিকে হাত বাড়াস। তোরে আজ খুন করে ফেলবো। ”
এরপর কোথা থেকে একজন লোক এসে সাক্ষ্য দিলো যে, ” আমাদের নাকি কিসব করতে দেখেছে। ”
।
।
মিথিলার ডাকে বাস্তবে ফিরে আসলাম। মিথিলা চিৎকার করে বলছে, ” কি হলো কি এতো চিন্তা করছো তুমি? ”
(ফারহানা কবীর মানাল)
আমি শান্ত গলায় বললাম, ” কিছু চিন্তা করছি না। আসলে ভাবছিলাম কি করে বিয়ে হয়েছিলো আমাদের। তুমি আজ অফিসে যাবে না? ”
মিথিলা রাগী গলায় বললো, ” আজ শুক্রবার। বাংলাদেশের কোনো অফিস আজ খোলা থাকে না। ”
আকাশ মুচকি হাসলো। তারপর বললো, ” আসলে রোজই তো রিকশা নিয়ে বের হতে হয় তাই বুঝতে পারি না কোনদিন ছুটি। তুমি তো সরকারি কর্মকর্তা। তুমিই ভালো জানবে। ”
মিথিলা আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। শুধু চোখের পানি মুছে বললো, ” জানো তো আকাশ কেউ যদি নিজের মনের ভিতর বিষ ঢুকিয়ে রাখে তাহলে তার কাছে পুরো পৃথিবীই বিষাক্ত মনে হয়। তুমি আমাকে বারবার সরকারি কর্মকর্তা বলে কি বোঝাতে চেষ্টা করছ? দয়া করে একটু পরিষ্কার করে বলবে? ”
আমি মিথিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, ” আমি কিছু মনে করতে চাই না রে পাগলী! এই সমাজটা এমনই রে। রিকশাচালকের বউ বিসিএস ক্যাডার হতে পারে না। আর পারলেও তারা মেনে নিতে চায় না। এরা সমাজকে দুইভাগে ভাগ করে নিয়েছে। যাইহোক চলো আজ তোমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো। তুমি চাকরি পেলে মা বাবাকে মিষ্টিমুখ করাবে না?”
মিথিলা দৃঢ় কন্ঠে বললো, ” যারা নিজের মেয়ের উপর ভরসা করতে পারে না। অন্যলোকের কথায় একটা অচেনা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তারা কি আদো বাবা মা হতে পারে? ”
আমি মিথিলার কাঁধে হাত রেখে বললাম, ” যা হয়েছে ভুলে যাও। চলো দেখা করে আসি। ”
–” হ্যাঁ দেখা করতে নিশ্চয়ই যাবো। তাদেরও দেখা দরকার আমিও বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করতে পারি। পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমি কোনো প্রেম করে বেড়াচ্ছিলাম না। সেদিন শুধুমাত্র বিপদে পড়েই রাত করে বাড়িতে ফিরে ছিলাম। ”
আমি আর কিছুই বললাম না। এখনও হয়তো অভিমান কমেনি ও-র। আর কমবেই বা কি করে। সারাদিন পর বাড়িতে ফিরলে যদি মা বাবা কোথায় কেমন অবস্থায় ছিলো জানতে না চেয়ে চরিত্রের উপর আঙুল তোলে। অন্যলোকের কথায় একটা অপরিচিত ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় তাহলে যে কারোরই রাগ থাকবে।
।
সেদিন রাতে,,
মিথিলা হাত জোড় করে ও-র বাবার কাছে বলেছিলো, ” আব্বু বিশ্বাস করো এই ছেলের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমাকে শুধু উনি বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন আর কিছু নয়। ”
ও-র আব্বু কিছু বলার আগেই ও-র এক চাচাতো ভাই বলে উঠলো, ” কাকা এই বেয়াদব মেয়ের কথা আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমি নিজে ও-র স্কুল শেষে ও-কে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু মিথিলা বললো ওর নাকি কোন বন্ধু ও-র সাথে দেখা করতে হবে। আমি ভেবেছিলাম মেয়ে হয়তো কিন্তু এতো একদম রিকশাওয়ালা। ”
ও-র চাচাতো ভাইয়ের কথা শেষ হতেই ও-র চাচা বলে উঠলো, ” ভাই তোর মেয়েকে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দে। এসব করে বেড়ালে এলাকায় আমাদের কোনো মানসম্মান থাকবে না। ”
মিথিলা ও-র আব্বুর পা ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো, ” বিশ্বাস করো এই ছেলেকে আমি চিনি না। আমাকে তোমরা বিয়ে দিয়ে দিও না৷ আমি অনেক পড়াশোনা করতে চাই। ”
কিন্তু সেদিন ও-র কোনো আকুতি মিনতি ও-র বাবা শোনা না বরং ও-র মা বলে, ” তোর মতো মেয়েকে জন্মের সময় লবন খাইয়ে মেরে ফেললে ভালো করতাম। ”
আমিও হাজারবার ওদের বোঝানোর চেষ্টা করি যে আমি মিথিলাকে চিনি না। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেদিন রাতে কাজি ডেকে মিথিলার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। একা নিজে ঠিকমতো খেতে পারতাম না তার উপর আর একজনের দায়িত্ব। নিজের উপরই অনেক রাগ হচ্ছিল কেন যে মরতে ওই দোকানে দাঁড়াতে গেলাম। আল্লাহ আমাকে উদ্ধার করো। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় ও-র চাচাতো ভাই মিথিলাকে ডেকে বললো, ” তোর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন শেষ মিথিলা। আর কখনো তুই আমার পিছনে লাগতে আসবি না। পড়াশোনায় একটু ভালো বলে তোর পা মাটিতে পড়তো না। এখন হলি তো রিকশাওয়ালার বউ। রিকশাওয়ালা বউ নাকি বিসিএস ক্যাডার হবে! হা হা হা! ”
ছোট থেকে আমি অপমান খুব একটা সহ্য করতে পারতাম না৷ কেউ আমাকে খোঁচা দিয়ে কোনো কথা বললে তার জবাব দিয়ে দিতাম মুখের উপর। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ও-র ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ” দেখে নিবেন এই রিকশাওয়ালার বউই একদিন বিসিএস ক্যাডার হবে। আমি আকাশ আপনাকে বলছি আমার বউকে আমি ঠিক আপনাদের যোগ্য জবাব দেওয়া উপযুক্ত করে গড়ে তুলবো। ”
ও-র ভাই হো হো করে হেসে বললো, ” মিথিলা তোর বর রিকশাওয়ালা হলে কি হবে অনেক সাজিয়ে সুন্দর করে কথা বলতে পারে। হয়তো পরীক্ষায় ফেল করেছে বলে বাপ রিকশা কিনে দিয়েছে। ”
মিথিলার ওনার কথার জবাব না দিয়ে আমার হাত ধরে বললো, ” চলেন। এদের কথায় নয় কাজে জবাব দিবো। ”
আমি হা করে মিথিলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা যে বড্ড জেদি তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেদিন আমি মিথিলাকে নিয়ে আমার বাড়িতে আসলাম। মিথিলা ফাঁকা বাড়ি দেখে আমাকে প্রশ্ন করলো, ” আপনার মা বাবা কি বেড়াতে গেছে?”
আমি ভাঙা গলায় বললাম, ” নাহ্! ওরা আমাকে রেখে চলে গেছে। আর কখনো আসবে না। আমি এতিম। এই সম্পূর্ণ দুনিয়ায় কেউ নেই আমার। ”
মিথিলা মন খারাপ করে বললো, ” সরি আমি বুঝতে পারিনি। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। ”
আমি মুচকি হেসে বললাম, ” আমি দুঃখিত আপনাকে এমন বিপদে ফেলার জন্য। আমি বুঝতেই পারিনি এমনটা হবে। কোন জায়গা থেকে কোথায় নিয়ে এলাম আপনাকে। ”
–” আপনি কি করবেন বলেন! আপনি তো আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন কিন্তু অন্যরকম হয়ে গেল। আল্লাহ নানান ভাবে আমাদের পরীক্ষা নেয়। আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেছেন, ” নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি। ” ( সূরা ইনশিরাহ, আয়াত ঃ ৬)
আমি আমার তকদির মেনে নিয়েছি। আপনিও মেনে নেন।
চলবে