#নীলকমল
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-২
হঠাৎ মিথিলার গলা শুনতে পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম, মিথিলা নীল শাড়ি পরে খোঁপায় গোলাপ ফুল আর বেলিফুলের মালা জড়িয়ে অপরাধীর মতো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ও-কে দেখেই আমার ঘৃণা হতে লাগলো। ভালো করে লক্ষ্য করলাম এটা আমার আনা সে-ই নীল শাড়িটা। মিথিলা ভাঙা গলায় বললো , ” রাতে আমার খুব মাথা ব্যাথা করছিলো তাই ঘুমিয়ে গেছিলাম। তুমি তো জানো ঘুমালে আমি কি বলি আমার কিছু মনে থাকে না। তুমি আমাকে একটু জোর করে ডেকে তুলতে পারলে না? জানো শাড়িটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তোমার সব পছন্দই দারুণ সুন্দর। ”
মিথিলার কথায় আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা সত্যি বুঝতে পারছি না। মিথিলাকে কিছু না বলে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটা ধরলাম। চোখে মুখে পানি দিলে হয়তো মস্তিষ্কটা কিছুটা পরিষ্কার হবে। চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘরে ফেরার সময় পাশের এক কাকি আমাকে ডেকে বললেন, ” কি রে আকাশ তোর বউ কাল সরকারি চাকরি যোগদান করলো আর তুই আমাদের মিষ্টিমুখও না করিয়ে পারলি কি করে বল তো? ”
আমি কাকির কথার প্রতিত্তোরে শুধু হাসলাম। মিথিলা চাকরি পেয়েছে অনেকদিন আগে আর এখন কিসের মিষ্টি খাওয়াবো! চারদিকে ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম এখন সবেমাত্র সকাল হয়েছো তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখেছি? কাকির কথাই ঠিক। মিথিলা কালকেই চাকরিতে জয়েন্ট করেছে! তারপর বাড়িতে গিয়ে তারিখ দেখে বুঝতে পারলাম মিথিলা কালকেই জয়েন্ট করছে। রাতের বেলা মিথিলার সাথে কথা বলে বারান্দায় চলে গেছিলাম। তারপর রাতে এসব স্বপ্ন দেখেছি! আলহামদুলিল্লাহ! মিথিলা এখনও আমারই আছে। তবে আমি এমন স্বপ্ন কেন দেখলাম? হয়তো এসব নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি তাই। পুকুর ঘাটে যাওয়ার আগে মিথিলার বলা কথাগুলো মনে করতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু সবকিছু স্পষ্ট মনে করতে পারছি না। হয়তো তখনও স্বপ্নের ভিতর ছিলাম। রোয়াকে ঝুলিয়ে রাখা গামছাটা দিয়ে হাত মুখ মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করলাম। মিথিলা আমার কাছে দৌড়ে এলো। তারপর প্রশ্ন করলো, ” আমাকে দেখে বলো না আমার সুন্দর লাগছে। একদম নীল আকাশের মতো? ”
আমি নির্জীব কন্ঠে বললাম, ” আমাকে দেখানোর কি আছে? ”
মিথিলা হয়তো আমার কথায় কষ্ট পেয়েছে। এতো সময় হাসিতে ভরে থাকা মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেছে। আমি কিসব বলছি ও-কে! আসলে স্বপ্নটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। শুনেছি সকালের স্বপন নাকি সত্যি হয়। তাহলে কি মিথিলাও পরিবর্তন হয়ে যাবে? আচ্ছা আমার মাথাটা হয়তো খারাপ হয়ে গেছে কবে কি হবে না হবে এসব ভেবে আমি কেন বর্তমানকে খারাপ করছি, মিথিলা ঘুম পড়লে কি বলে মানে ঘুমের ঘোরে কি কথা বলে তা ও-র মনে থাকে না এটা আমি বিগত নয় বছর ধরে দেখে আসছি। এই ব্যাপারটা নিয়ে রাগ করা হয়তো অনুচিত হবে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগে মিথিলা মুচকি হেসে বললো, ” তাহলে কাকে দেখাবো জানতে পারি কি? তুমি আমার স্বামী আমাকে এইভাবে দেখার অধিকার শুধু তোমারই আছে। শুধু শুধু রেগে যাচ্ছেন কেন শুনি?”
আমি মুচকি হেসে বললাম, ” রাগ করবো কেন। আসলে আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। কাল দুপুরে বা রাতে খাওয়া হয়নি তো তাই এখন আর থাকতে পারছি না। ”
মিথিলা আমার হাত ধরে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো আর বললো, ” আমিও কাল রাতে খেতে পারিনি তোমার জন্য। কথা না বাড়িয়ে চলো এখন আমাদের বড্ড ক্ষুধা লেগেছে। ”
আমি হেঁসে বললাম, ” আমাদের? তুমি না খেয়ে ছিলে নাকি কালকে?”
মিথিলা আমার কথায় চরম বিরক্ত হলো। তারপর বিরক্ত গলায় বলে উঠলো, ” তুমি কি আমাকে নতুন দেখছো নাকি যে এইভাবে কথা বলছো? আমি তোমাকে ছাড়া কোনো দিন রাতে ভাত খেয়েছি? আগে পরে দেখছেন নাকি আপনি? ”
মিথিলা রেগে গেলে আপনি তুমি তুই সব মিশিয়ে কথা বলে। আসলে মিথিলা প্রথম থেকেই এমন ঘুমালে অনেক উল্টো পাল্টা বলে তারপর ঘম ভাঙলে সরি বলে বা মাফ চেয়ে নেয়৷ কালকের ব্যবহার আমি কাছে বেশি মনে হয়েছে কারণ আমাকে বাইরের লোকেরা ও-র বিরুদ্ধে নানান কথা বলেছে। ব্যাপারটা এমন যে সবাই মিলে কেরোসিন, লাঠি সব জোগাড় করে দিয়েছে আর মিথিলার কথা সেখানে জলন্ত দিয়াশলাই এর কাঠির মতো কাজ করেছে। যাইহোক সব কিছু ভুলে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলাম। মিথিলাকে সামান্য কিছু কথা আর একটা দুঃস্বপ্নর জন্য ভুল বোঝা মোটেও উচিত হবে না৷ আমি ও-কে এক দুইদিন না নয় নয়টা বছর ধরে দেখছি। মেয়েটা সত্যি অনেক ভালোবাসে আমাকে।
(ফারহানা কবীর মানাল)
দুইজনে মিলে সকালের খাবার খেতে বসলাম। খাওয়ার সময় আমি বলে উঠলাম, ” আচ্ছা তুমি এতো আদর করে আমাকে খেতে ডেকে আনলে যে খাবারে কি বিষ মিশিয়ে দিয়েছো নাকি?”
মিথিলা আমার কথার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না৷ শুধু বললো, ” কেউ কি তার সুখের পৃথিবী নিজের হাতে নষ্ট করতে চায়? ”
আমি মুচকি হেসে বললাম, ” মানুষ কিন্তু নিজের হাতেই তার সুখের পৃথিবী নষ্ট করে। যখন সে সাফল্য নামের হাতিয়ারের দেখা পায়। এই হাতিয়ার দিয়েই পুরনো পৃথিবী নষ্ট করে নতুন পৃথিবী গড়তে চায়। ”
মিথিলা আমার কথায় প্রচন্ড রেগে গেলো। তারপর কর্কশ গলায় প্রশ্ন করলো, ” তোমার কি সমস্যা? সেই সকাল থেকে তুমি অদ্ভুত ব্যবহার করছো। গতকাল সকালেও তো ঠিক ছিলে। কি হয়েছে কি তোমার? ”
আমি শান্ত গলায় বললাম, ” এখন তুমি আর আমি এক রকম নেই। গতকালকের আগেও তুমি ছিলে একজন রিকশাওয়ালার বউ আর এখন তুমি একজন বিসিএস ক্যাডার। আমাদের মাঝে আকাশ পাতাল তফাত তৈরি হয়েছে। ”
মিথিলা মুচকি হেসে বললো, ” জানো তো মানুষ তার নিজের মনের বিষে যতটা মরে অন্যকিছুতে এতোটা মরে না। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কেন এতেদূর পড়াশোনা করেছি। কেন আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি। তবুও তুমি এসব কথা বলছো। আমি আগের মিথিলা আছি কিনা জানি না তবে তুমি আর আমার আকাশ নেই। এই আকাশকে বড্ড অচেনা লাগছে আমার৷ ”
মিথিলা কথাগুলো বলে খাবারের প্লেটের ভিতর পানি দিয়ে রেখে উঠে চলে গেলো। কিন্তু আমি কি করলাম এমন তা-ই বুঝলাম না। আমার কথায় কি অনেক বেশি কষ্ট পেলো নাকি! কি যে হয়েছে আমার কে জানে। আসলে আমার আর মিথিলার মাঝে একটা অদৃশ্য দেওয়াল সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে প্রচলিত উঁচু নিচু শ্রেণির ভেদাভেদের দেওয়াল। যেখানে মিথিলা উঁচু শ্রেণির লোকদের মাঝে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা আর আমি নিচু শ্রেণির একজন রিকশাওয়ালা। রিকশাওয়ালার বউ বিসিএস ক্যাডার এ যেন সকলের কাছে সোনার পাথর বাটির মতোই অবাস্তব। আচ্ছা এই উঁচু নিচু শ্রেণির ভেদাভেদে আমার আর মিথিলার সম্পর্কটা হারিয়ে যাবে না তো?
এসব কথা না হয় পরে চিন্তা করবো। এখন দেখি মিথিলা কি করছে। ঘরে গিয়ে দেখলাম মিথিলা বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলে পারি ও কাঁদছে। আমি ও-র পাশে বসলাম তারপর ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, ” ভুল হয়ে গেছে আমার। ”
নয় বছরের ভালোবাসার স্ত্রীর চোখে কি কোনো পুরুষ পানি দেখতে পারে? কেউ পারে কিনা জানি না তবে আমি পারি না। সারা দুনিয়ায় মিথিলা ছাড়া আপন বলতে কেউ নেই আমার। আমার সুখদুঃখ সবকিছুই ও-কে ঘিরে। আমার স্পর্শ পেয়ে মিথিলা উঠে বসলো। চোখে মুখে তখনও পানি লেপ্টে আছি। আমি ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিবো বলে ডান হাতটা ওর দিয়ে বাড়াতেই মিথিলা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ” তুমি কি জানো না আকাশ তোমার সাথে কি করে বিয়ে হয়েছে আমার? বিনা কারণে কতটা অপমানিত হয়েছিলাম আমরা দুইজন। সকলে খুব আক্ষেপ করে বলেছিলো যে আমি নাকি তাদের পরিবারের মতো নই। তাদের পরিবারের সবাই বিসিএস ক্যাডার আর আমি রিকশাওয়ালার সাথে প্রেম করেছি। রিকশাওয়ালার বউ কি আর বিসিএস ক্যাডার হতে পারে? সেদিন বিয়ের পর তুমিই তো প্রতিজ্ঞা করেছিলে তোমার বউকে তুমি বিসিএস ক্যাডার বানিয়ে দেখাবে। তাহলে আজ কেন এই ক্যাডারশিপ এর নাম করে আমার সাথে আমার স্বামীর দূরত্ব সৃষ্টি করছো? ”
আমি ও-র কথার কোনো জবাব দিতে পারলাম না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই নয় বছর আগেকার কথা। সেদিন আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো। বাইরে ঝড়ো হওয়া বইছে। আমি ঘরে বসে ভাবছি আজ আর রিকশা নিয়ে বের হবো না। কিন্তু ঘরে কোনো খাবারও ছিলো না। মা বাপ মরা ছেলে নিজে রোজগার না করলে এক দানা খাবারও পেটে পড়তো না। হঠাৎ করে আমার বন্ধু সজীব দৌড়ে এসে বললো, ” ভাই একটা বিপদে সাহায্য করতে পারবি। আমার মা অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আবহাওয়ার এই অবস্থায় কেউ হাসপাতালে যেতে চাইছে না। তুই একটু সাহায্য কর। আমি তোর পায়ে ধরি। ”
মা হারা সন্তান ছিলাম। মায়ের টান খুব ভালো করেই বুঝতাম তাই সেদিন ওদের নিয়ে হাসপাতালে যাই। ফিরে আসার পথে শুরু হয় প্রচন্ড বর্জ্যপাত আর সেই সাথে বৃষ্টি। রিকশা নিয়ে এগোনোর কোনো উপায় নেই বলে একটা দোকানের পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে দোকানের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে যাই। সেখানেই বইয়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সতেরো বছরের কিশোরী মিথিলা।
চলবে