#নীরা
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৩
নীরা চিৎকার করে কাঁদছে,
_আমি যাবোনা মা,আমি যাবোনা।
আমাকে দিয়ে দিও না মা,আমাকে দিয়ে দিও না।
হঠাৎ করেই আমার ঘুমটা ভেঙে যায়।
আমি কিছু টা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
আমি এত ক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম।
দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।
নীরার কিছু হয়নি।কেউ নিয়ে যায়নি নীরাকে আমার থেকে।
নীরাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরি আমি।
না না আমি নীরাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।
কিছুতেই না।
নীরা আমার মেয়ে,আমিই ওর মা।
ওর উপর অন্য কারো অধিকার নেই।অন্য কারো না।
সকাল হয়ে যায়।
_মা ও মা,আমি বাবার কাছে যাবো।
_তোমার কোথাও যেতে হবেনা।
তুমি আমার কাছেই থাকবে।
কেউ নেই তোমার।
_আমি বাবার কাছে যাবো।
_বাবার কাছে কিভাবে যাবা?
_কেউ নেইতো তোমার মা।
_কেউ নেই,কিচ্ছু নেই,বাবা আছে।
_বাবা আছে?
নীরা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বল্লো।
এখন আমার বুক কাঁপছে।নীরা যদি ওর বাবার কাছে চলে যায় তাহলে আমি নীরাকে ছাড়া থাকবো কি করে?
আম্মু দেখোনা,নীরা বলছে ও ওর বাবার কাছে যাবে।
_তোকে আগেই বলেছিলাম,এত মায়া বাড়াস না।দিয়ে আয় ওকে।
এখন যদি ও ওর বাবার কাছে চলে যায়।
কিভাবে থাকবি তুই?
_জানিনা আমি কিচ্ছু জানিনা।
_এত দিন তো বাসা কই,মা কে বাবা কে,নাম কি কিছুই বল্লোনা।
এখন বাবার কাছে যেতে চাইছে যখন,তাহলে জিজ্ঞেস কর,নাম কি ওর বাবার।
বাসা কোথায়।
আর দিয়ে আয় গিয়ে।
এখনো সময় আছে।
নয়তো এ মায়া কাটানো কষ্ট সাধ্য হয়ে যাবে।
_আম্মু আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।
_দেখ ন্রিতা,বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
তোর এই কয়দিনে যেমন খারাপ লাগছে।ওর বাবা মা ওকে জন্ম দিয়েছে,ওদের কেমন লাগছে একবার ভেবে দেখ।
মা না ভালো,এমন করিস না।
নাম ঠিকানা দেখ বলে কিনা,তারপর দিয়ে আয় ওকে ওর বাবা মায়ের কাছে।
_কেমন বাবা মা এত দিনেও মেয়ের খোঁজ করেনা?
আর তুমি আসছো ওদের কষ্ট নিয়ে।
ধুর ভাল্লাগেনা কিছু।
আমি চলে এলাম আম্মুর কাছ থেকে।
_মা ও মা,আমি বাবার কাছে যাবো।
_তুমি আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে মা?
_নাতো।
_তাহলে বাবার কাছে যেতে চাও যে?
_আমি বাবার কাছে যাবো।
নীরা বার বার ওর বাবার কাছেই যেতে চাচ্ছে।
হয়তো ওর বাবার কথা খুব মনে পড়ছে ওর।
কি করবো আমি এখন?
আমি ওকে ওর বাবার কাছে দিয়ে আসলে, আমি কিভাবে থাকবো?
নীরাকে অন্য কিছু দিয়ে ওর বাবার কথা ভোলানোর চেষ্টা করলাম।
কিন্তু নীরা কিছুতেই ওর বাবার কথা ভুলছেনা।
বার বার একই কথা বলে যাচ্ছে আমি বাবার কাছে যাবো।
সকাল গড়িয়ে বিকেল,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা,
এখন রাত হয়ে গেছে।
নীরা এখন কান্না শুরু করে দিয়েছে।
ও ওর বাবার কাছে যাবে।
আমার নীরার কান্না সহ্য হচ্ছেনা।
আমি মনস্থির করলাম,
নীরাকে ওর বাবার কাছে নিয়ে যাবো।
তা যেভাবেই হোক।
_কান্না করেনা মা, কান্না করেনা।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমায় তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবো।
প্লিজ থামো।
সকাল হোক,সত্যি নিয়ে যাবো তোমার বাবার কাছে আমি তোমায়।
নীরা এবার কান্না থামিয়ে ছোট্ট করে একটা হাসি দিয়েছে।
ওর হাসি টাও যেন আমার খুব চেনা।
_আচ্ছা মা,তুমি যে তোমার বাবার কাছে যেতে চাও,তোমার বাবাকে আমি পাবো কই?
আর তোমার বাবার নাম কি?
_আমার বাবা বাসায়।
_বাসায় তো,কিন্তু তোমার বাসা কই?
নীরা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে।
_আচ্ছা ঠিক আছে,মন খারাপ করতে হবেনা।
বাসার ঠিকানা খুঁজে নিবোনে যেভাবে হোক।
এখন বলো,তোমার আব্বুর নাম কি?
মানে তোমার বাবার নাম।
_আমার আব্বুর নাম হচ্ছে,
রাজ রাহমান।
আর আমি নীরা রাহমান।
নীরার কথা শুনে আমার বুকের ভেতর যেন আচমকা এক ঝড় বয়ে গেলো।
_তোমার আব্বুর নাম কি বললে মা?
রাজ রাহমান?
_হুম।
_তুমি রাজের মেয়ে?
আর তোমার নাম নীরা রাহমান?
_হুম।
_তাহলে আগে বলোনি কেন?
নীরা চুপ করে আছে।
আর এদিকে আমার বুকের ভেতর তুফান বইছে।
যেই মানুষ টাকে এক সময় পাগলের মত ভালবাসতাম আমি।
যাকে নিয়ে ছিলো আমার হাজারও স্বপ্ন বুনা।
নীরা কিনা তারই মেয়ে।
আমার দেয়া নামটাও আছে।
শুধু মায়ের জায়গায় আমার নাম টাই নেই।
যেই মানুষটার জন্য আজো আমি একটা মুহূর্ত ভালো থাকতে পারিনা।
সেই মানুষটারই মেয়ে এই নীরা।
অথচ আজ আমি কই আর সে কই।
নীরা তো ঠিকি আছে।
শুধু আমিই নেই তার জীবনে।
আমি নীরাকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলাম।
চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়ছে আমার।
_রাজের মেয়ে তুমি মা?
তাকাও তো আমার দিকে।
চোখ দুটো একদম বাবার মত হয়েছে তোমার।
আর হাসিটাও।
চুলও বাবার মত।
কিন্তু নাক আর ঠোঁট আমার মত হলো কিভাবে হুম?
আর তিল টা?
আচ্ছা বাদ দেই।
আল্লাহ হয়তো আমার ইচ্ছে টাই পূরণ করে তোমাকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন।
আমার স্বপ্নের মত করে।
আমি নীরাকে দেখছি আর ওর সারা মুখে চুমু খাচ্ছি।
আমার গর্ভে না হোক,রাজের সন্তান তো।
কেন যেন রাজের সন্তান জানার পর থেকে নীরার জন্য মায়াটা আরো বেড়ে যাচ্ছে।
ভালবাসা বুঝি এমনই হয়।
রাজ আমার জীবনের অন্যতম এক অধ্যায়ের নাম।
যাকে ভালবেসে আমি বুঝেছিলাম,ভালবাসা কি।
ভালবাসলে কেমন অনুভূতি হয়।
যাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত আমি কল্পনা করতে পারতাম না।
যে অন্য কারো হবে তা আমি একটা মুহূর্তের জন্য মানতে পারতাম না।
যে আমায় শিখিয়েছিলো,কাউকে ভালবাসলে অন্তর আত্মা উজাড় করে ভালবাসতে হয়।
সেও আমাকে ভালবাসতো।
শুধু বাসতোনা,খুব বেশিই ভালবাসতো।
তার অস্তিত্ব জুড়েও একটা সময় শুধু আমিই ছিলাম।
কিন্তু ওই যে বলেনা,
কখন কি হয়ে যায়,কেউ বলতে পারেনা।
তাই তো আজ সে কোথায় আর আমি কোথায়।
এখন কেউ কারো মুখ টাও দেখতে চাইনা।
অথচ রাজের মুখ টা আমার চোখের সামনে ভাসছে।
ও তো শুধু আমার ভালবাসা ছিলোনা,ও তো আমার…
_মা,ও মা সকালে নিয়ে যাবে তো বাবার কাছে?
_হুম নিয়ে যাবো।
কিন্তু তোমার বাবাকে আমি পাবো কই?
নীরা কাঁদতে কাঁদতে বল্লো,আমি বাবার কাছে যাবো,আমি বাবার কাছে যাবো।
আমি নীরাকে বললাম,
নিয়ে যাবো আমি কাল তোমায় তোমার বাবার কাছে।
যেভাবেই হোক।
এখন ঘুমাও মা।
অনেক রাত হয়েছে।
নীরা আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো।
আমার চোখের জল বাঁধ মানছেনা।
আমি যে নীরাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা।
সকাল হলো,
আম্মুকে বললাম,নীরাকে ওর বাবার কাছে দিয়ে আসতে যাচ্ছি।
_ওর বাবাকে তুই পাবি কই?
_জানিনা।
আম্মু নীরাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়ে বল্লো,
নানুকে দেখতে এসো কিন্তু।
নীরা আম্মুকে চুমু খেয়ে বল্লো,আসবো।
আমি নীরাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
সেই জায়গাটায় গেলাম,যেখানে নীরাকে আমি প্রথম পেয়েছিলাম।
ওখানে গিয়ে দাঁড়াতেই নীরা আমার হাত ধরে পাশে থাকা কে.জি স্কুল টাতে নিয়ে গেলো।
আমি অবাক হলাম।
ও আমাকে এখানে নিয়ে এলো কেন।
নীরা আমাকে আস্তে আস্তে হাত ধরে একটা ক্লাসে নিয়ে গেলো।
ক্লাসে নিয়ে যেতেই ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চা নীরা নীরা করে নীরাকে জড়িয়ে ধরলো।
বুঝতে পারলাম,নীরা হয়তো এই ক্লাসে পড়ে।
কিন্তু ও আমাকে আগে কখনো বলেনি এ কথা।
আমি নীরাকে নিয়ে ওদের স্কুলের টিচারের কাছে গেলাম।
ওর টিচার ওকে দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করে,কে হোন আপনি ওর?
ও এত দিন স্কুলে আসেনি কেন?
প্লে এর ক্লাস ভালো ভাবে না করলে উপরের ক্লাসে উঠবে কি করে?
আমি ওর টিচারকে বললাম,ওর বাসার নাম্বার টা আছে আপনাদের কাছে?
ও এত দিন আমার কাছে ছিলো।
হারিয়ে গিয়েছিলো ও।
আমি ওকে পেয়েছি।
_কি বলেন?
আমি দেখি ওর বাসায় কল করেছিলাম,
_তারপর?
_তারপর আর কি?আমি এই জিজ্ঞেস করতে ফোন দিয়েছিলাম,ও কেন স্কুলে আসেনা।
ওর বাবা ফোন রিসিভ করে বল্লো ও বেড়াতে গেছে।
অনেক দিন আসবেনা ক্লাসে।
সামনের বছর আবার ভর্তি করাবে।
ও যদি হারিয়েই গিয়ে থাকে,তাহলে ওর বাবা কেন এই কথা বল্লো যে ও বেড়াতে গেছে?
স্যারের কথা শুনে আমিও বোকা বনে গেলাম।
আর প্রশ্নের অতল সাগরে হারিয়েও গেলাম।
কিন্তু উত্তর নামক কোন কূল কিনারা ভেবে পেলাম না।
আমি নীরার টিচারকে বললাম,
আমাকে ফোন নাম্বার টা দিন তো প্লিজ।
_এক মিনিট ওয়েট করুন।
স্যার একটা রেজিস্টার খাতা বের করলেন।
ওখানে সব স্টুডেন্ট এর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখা।
স্যার আমাকে খাতার একটা পেইজ বের করে দেখিয়ে বললেন,
এই যে নাম্বার টা।
আমি নাম্বার টা ফোনে তুলতে গিয়ে অবাক হয়ে ফোন নাম্বারের উপরের লিখা গুলো পড়তে লাগলাম।
নাম-নীরা রাহমান।
পিতা-রাজ রাহমান।
মাতা-ন্রিতা রাহমান।
আমার হাত কাঁপছে।
আমি নাম্বার টা ফোনে তুলবো যে সেই শক্তি টা পাচ্ছিনা।
মাতা কিভাবে ন্রিতা রাহমান?
নীরার মায়ের জায়গায় আমার নাম কিভাবে?
রাজ নীরার মায়ের জায়গায় আমার নাম কেন দিলো?
কোন রকম ফোন নাম্বার টা তুলে,আমি স্যারকে ধন্যবাদ বলে নীরাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম।
বাইরে এসেই নাম্বার টাতে ফোন দিলাম।
রিং বাজছে,
রিং বাজছে,
অপর পাশ থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ফোন টা রিসিভ করে,
আমি সালাম দিয়ে মেয়েটাকে বললাম,
রাজ আছে?
মেয়েটি আছে বলে, রাজ রাজ এই রাজ বলে রাজকে ডাকতে লাগলো।
আমি ভাবতে লাগলাম,
তবে কি এই মেয়েই নীরার মা?
এই মেয়ে নীরার মা হলে,
স্কুলের খাতায় নীরার মায়ের নামের জায়গায় ন্রিতা রাহমান লিখা কেন?
চলবে,