নিয়তি ( পর্ব–১৫ বা শেষ পর্ব)

0
1872

নিয়তি ( পর্ব–১৫বা শেষ)
.
.
লাল- গোল্ডেন পর্দার ছোট- ছোট ফাঁক দিয়ে, ভোরের অর্ক যখন রৌদ্রের মেলা বসিয়েছে, ঠিক তখনি তার সামান্য তম স্পর্শে ইমাদের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কচলাতে- কচলাতে উঠতেই কি যেনো একটা মনে করে ছেলেটির মুখটা ভারী হয়ে যায়। বিছানার ওপাশে তাকিয়ে একটু মলিন হেসে বলে উঠলে— মেয়েটি আজ পাশে নেই তাই ফজরের নামাজটা ও পড়তে কেউ আজ আমায় ডাকলোনা। ছেলেটির মনের ভিতর একটা শূন্যতা কাজ করতে লাগলো। ইমাদ বুঝতে পারছেনা তার মন কি চায়।। আসলে আমার এমন কেন লাগছে? আমি কি চাচ্ছি,,, আমার কি করা উচিত আমি কেন বুঝতে পারছিনা। ছেলেটি উপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো— প্লিজ আল্লাহ আমাকে এরকুম দোটানায় রেখো না। আমার কেন নাজিফার জন্য ও কষ্ট হয়। কেন ওর জন্য চোখ জল টপটপ করে। ছেলেটি মাথায় হাত দিয়ে চিৎ হয়ে অনেকক্ষন শুয়ে থাকে। হঠ্যাৎ কি মনে করে বিছানার ডান দিকের টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই একটি চিঠি পেলো,,,, আচমকা চিঠিটা হাতে নিতেই ছেলেটির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।। বুকের বা পাশে হাহাকার শব্দের আনাগোনা হতে লাগলো। চিঠিটা খুলতেই তার ভিতরে লিখা—- তুমি অনেক ভালো থেকো, এন্ড প্লিজ নিজের খেয়াল রেখো।
.
.
ইমাদ দুই লাইনের এই চিঠি টা পড়ে, থরথর করে কাঁপতে লাগলো,, বাহিরের দিকে চেয়ে দেখে আকাশটা হঠ্যাৎ মেঘে ছেয়ে গেছে, আর ইমাদের চোখ দুটো ও জলে ঝাপসা হয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠে সোজা গেস্ট রুমে চলে যায় গিয়ে দেখে সেখানেও নাজিফা নেই। শুধু বিছানার উপরএকটি লাল খাম। ইমাদ তা হাতে নিয়ে খুলতেই দেখে তা তে লিখা—– চলে যাচ্ছি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আসলে আমারেই বুঝা উচিত ছিলো আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য নয়, আর ভালোবাসা চার অক্ষরের এই শব্দটি সবার কপালে জুটেনা। আমি হয়তো আনলাকি ব্যক্তি তাই এ জীবনে আর কারো ভালোবাসা পেলাম না কিন্তু তাতে কি আল্লাহর তো ভালোবাসা পেয়েছি, নিজে তো তোমার মতো একজন মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছি এটাই আমার কাছে অনেক বড়। আর হ্যা শুনো ঠিক মতো খাওয়া – দাওয়া করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে আর পারলে মাঝেমধ্যে প্রাণ খুলে হাসবে জীবনটাকে সহজ ভাবে ভাববার চেষ্টা করবে, তাহলে দেখবে সবকিছুই তোমার কাছে সহজ লাগবে।
আর আমি তোমায় ভালোবাসি, এই বাক্যটার গভীরতা আমি তোমার থেকে বুঝতে পেরেছি। সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসবো আর ভালোবেসে যাবো।
আল্লাহ হাফেজ…………..
.
.
মানে কি শুধু তুমি ভালোবাসো এই কথাটি বলে চলে গেলে অথচ আমাকে বলার সামান্য তম সুযোগ দিলেনা। আমাকে একটু বুঝতে পারলে না। না আমি তোমাকে যেতে দিবোনা। ইমাদ চিঠি টা রেখে চোখের জল মুছতে- মুছতে নিচে এসে দেখে বাড়ির সবাই বিষন্ন মুখে বসে আছে।
.
.
ইমাদ —— মা নাজিফা কোথায়???
সালেহা গম্ভীরমুখে বসে রইলেন, ইমাদের প্রশ্নের কোনো উওর দিলেন না।
— কি ব্যাপার মা কথা বলছো না কেন?
সালেহা চেঁচিয়ে – চেঁচিয়ে, —– কি বলবো হ্যা তুই চেয়েছিস ও যেনো চলে যায় তাই চলে গেছে আবার কি???? আবার কেন ওর খোঁজ নিচ্ছিস??

ইমাদ কাঁদো স্বরে — মা প্লিজ এভাবে বলোনা, ওর সাথে যে আমার অনেক কথা আছে।
— কি কথা থাকতে পারে আর?
ইমাদ কিছুটা রেগে—মা ওকে আমি……
— কি? কি তুই ওকে?

ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
— মা প্লিজ সময় নষ্ট করোনা বলো ও কোথায়?
— নাজিফা ওর মায়ের কাছে চলে গেছে চিরকালের জন্য ।
..
ইমাদ অবাক হয়ে গেলো — মা কি বলছো তুমি?
,—- আমি ঠিকেই বলছি ১০.৩০ টার ট্রেনে ও গ্রামে যাবে।
নাবা ইমাদের কাছে গিয়ে আলতো করে ওর হাতটা ধরে কাঁদো স্বরে বললো—– বাবা মামুনি তলে গেলো।
ইমাদ হাঁটু গেড়ে বসে, নাবার কপালে চুমু দিয়ে —- না মা তোমার মামুনি কোথা ও যাবেনা। আমি তাকে ফিরিয়ে আনবোই।
৷ নওরিন ইমাদের কাছে এসে—- বাবাই প্লিজ তুমি মামুনি কে নিয়ে আসো, প্লিজ বাবাই।।।
.
.
.
ইমাদ চোখের জল গুলোকে মুছে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মাএ ৯ টা বাজে। ছেলেটির মনে একটু আশার সঞ্চার হলো — না এখন ও ট্রেন আসেনি আমি এখন ওকে স্টেশনে গেলে নিশ্চয় পাবো ও আমাকে এভাবে একা করে যেতে পারেনা।
.
.
ইমাদ বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে, লাল- নীল সবুজ বাতির এই শহরের, ব্যস্ততা আর জ্যাম, ও দূষণ পরিবেশকে উপেক্ষা করে ইমাদ চলতে লাগলো নাজিফার খোঁজে। মাঝেমাঝে শরতের আকাশ থেকে সামান্য তম বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে এই ভেবে যে যদি ওকে খুঁজে না পাই , যদি ও চলে যায়। তাহলে তো সারাজীবন ও আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।
.
.
সিএনজি টা যখন কমলাপুর রেল স্টেশনের সামনে এসে থামলো, ড্রাইভার তখন ইমাদের দিকে তাকিয়ে — স্যার ও স্যার কি হলো নামবেন না?
ইমাদ তার ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে, —- অ্যা ও হ্যা চলে এসেছি।
এই বলে ইমাদ সিএনজি থেকে নেমে এক দৌড় দিলো।
ড্রাইভার ভ্রু কুঁচকে —-আরে স্যার ভাড়া না দিয়ে চলে যাচ্ছেন কেন????
ইমাদ বিরক্তিকর ভাব নিয়ে আবার পিছু ফিরে আসলো ড্রাইভারে হাতে টাকা দিয়ে,,,, আবার দৌড় দিতেই,,,
ড্রাইভার ভ্যাবাচ্যাকা চোখে — স্যার টাকা ফেরত নিবেন না।
ইমাদ দৌড় দিতে- দিতে— ওটা তুমি রেখে দেও আর দোয়া করো তার বদলে যেনো আমার বউটা চলে না যায়।
— ও এখন বুঝলাম ব্যাপারটা। স্যার যেতে দিন অসুবিধা নেই আরেকটা করে ফেলেন পরে।
ইমাদ চেঁচিয়ে – চেঁচিয়ে,—– ভাই তোমার গেলে তুমি বুঝতা এখন তো আমার গেছে তাই মজা নিচ্ছো। এটাই হচ্ছে বাঙালির স্বভাব।
.
.
ইমাদ স্টেশনের কাছে যেতেই দেখলো ট্রেন চলে যাচ্ছে ইমাদ তাড়াতাড়ি ট্রেনটির পিছনে দৌড়াতে- দৌড়াতে — এই থামো ।
জানালা দিযে একজন প্রবীন লোক মাথা বের করে — কি হয়েছে বাবা তোমার?
ইমাদ হাঁপাতে হাঁপাতে — আরে দাদু আমার বউ চলে যাচ্ছে….
লোকটি একটু হেসে—- তো যেতে দাওনা, আরামে কয়েকদিন ঘুমাও, তারপর ফিরে আসবে তো যাও বাড়ি যাও।তোমার দিদা ও এমন ছিলো আর আমি ও তোমার মতো পাগল ছিলাম।
ইমাদ ভ্রু কুঁচকে — দাদু দোহাই লাগে ট্রেন থামাতে বলেন আরে আমার বউ অভিমান করে আমায় ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
৷ কথাটি বলতে- বলতে ইমাদ নিচে পড়ে যায় আর ট্রেনের পিছু ছুটতে পারলোনা। প্রবীন লোকটা একরাশ হাসি নিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে বললো–দাদুভাই প্রেমের মরা জলে ডোবে না।।।। হা,হা, চালিয়ে যাও।

ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
.
ইমাদ কিছুটা রেগে—- আমি মরছি আমার জ্বালায় আর এনি….. কিন্তু নাজিফা তো চলে গেলো,,,, ও কি সত্যিই আর আসবেনা। এই ভাবতেই ইমাদের চোখ জলে ছলছল করতে লাগলো, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ একজন কাঁধে হাত দিতেই ইমাদ, নাজিফা ভেবে একমুখ খুশী নিয়ে পিছু তাকাতেই দেখে একটি নয় কি দশ বছরের বাচ্চা৷ রুক্ষ চুল, গায়ের ছেড়া ও নোংরা কাপড় দেখে ইমাদের বুঝতে বাকি রইলো না,,, এটি পথশিশু। ইমাদ সহানুভূতির সাথে মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে—- কিছু বলবে মা?
আঙ্কেল তুমি এভাবে মেঝেতে বসে আছো কেন????
—- ও কিছুনা এমনেই।।।।
—- তোমার বুঝি খুব কষ্ট আমার মতো?
ইমাদ মেয়েটির কথায় একটু অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলে— তোমার কষ্ট কিসের মা?
মেয়েটি খিলখিল করে হেঁসে —- তুমি জানো না বুঝি যাদের দুনিয়াতে মা- বাবা নেই তাদের কত কষ্ট তাদের কেউ খাবার দেয়না, তারা স্কুলে যেতে পারেনা, আর তারা কেউকে মা কিংবা বাবা বলে ও ডাকতে পারেনা। ইমাদ সাথেসাথেই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরলো, ওর কপালে চুমু খেয়ে চোখের জল মুছে বললো—- খুব ক্ষুদা লেগেছে বুঝি।
— হুম।
— চল আজকে সারাদিন আমি তোমাকে নিয়ে ঘুরবো, খাবো।।।
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে— সত্যি বলছো?
— হ্যা তো।।।।
.
.
ইমাদ সারাদিন মেয়েটিকে নিয়ে এই ব্যস্ত শহরের অলিতে- গলিতে ঘুরেছে, , হয়তো মেয়েটিকে একটু আনন্দ দিতে গিয়ে নাজিফার চলে যাওয়ার বিয়োগ বেদনা ভুলে গিয়েছে।। কিন্তু দিনশেষে যখন রাতের আধারে বাড়ি ফেরার দিকে অগ্রসর হতে লাগলো,,,, তখনি বুকের বা পাশে হাহাকার করতে লাগলো।।৷ আচ্ছা আমার কেন কষ্ট হচ্ছে আমি তো এটাই চেয়েছি এটাই তাহলে।।
এই বলে ছেলেটি জোরে- চিৎকার দিয়ে কাঁদতে লাগলো,,, এই যন্ত্রনা, কান্না আজ থেকে কয়েকবছর আগে, মিতুর চলে যাওয়াতে বুকে বাসা বেধেছিল। আজ আবার নতুন করে।
.
.
ইমাদ বাসায় ফেরতেই সালেহা ওর সামনে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো— আজকে সারাদিন কোথায় ছিলিস??
ইমাদ কান্নামাখা মুখে— মা নাজিফা আমায় ছেড়ে চলে গেছে।।।
সালেহা তখন একটু হেসে বললো— ভালো হয়েছে তো তুই তো তাই চেয়েছিস।।।
ইমাদ মায়ের এমন আচরণ দেখে অবাক হয়ে গেলো, নাবা আর নওরিন বললো— এতে কান্নার কি আছে।।।
—- মানে কি তোদের মা চলে গেছে,,, এমন আচরণ করছিস কেন তোরা।।
এই বলে ইমাদ রেগে উপরে চলে যায়, সালেহা খিলখিল করে হেসে বলতে লাগলো—- পাগল ছেলে….৷

ফেসবুক পেজ: নিঃস্বার্থ ভালোবাসা


ইমাদ ঘরে এসে খাটের সামনে বসে রইলো,,, কিছুসময় পর- পর ফুপিয়ে – ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। হঠাৎ ফোনের ক্রিং,ক্রিং আওয়াজ,,, ইমাদ কিছুটা বিরক্তিকর ভাব নিয়ে ফোনটা বিছানার উপর ফেলে দিলো। প্রায় আদাঘন্টা ফোন বেজেই চললো এক প্রকার রাগ নিয়ে ফোন ধরতেই ফোনের ওপাশ থেকে—- এই তুমি ফোন ধরলা না কেন? কি হয়েছে, এতো শোক পালন করার তো কিছুই হয়নি,,, তাড়াতাড়ি ছাদে আস ও তো।।।
ইমাদ কন্ঠ টা শুনেই বুঝে ফেললো এটা নাজিফা,,, হাসতে- হাসতে উপরে চলে গেলো।
বাহিরে হিমহিম বাতাস বইছে,,, ছাদের একপাশে বাসন্তী রং য়ের শাড়ি পড়ে মেয়েটি চিপস হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।।।
ইমাদ কে দেখতে পেয়ে নাজিফা মিটমিট করে হেসে — কই ছিলা আজকে সারাদিন???
ইমাদ,নাজিফার প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে দৌড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো, আষ্টেপৃষ্ঠে ওকে আকড়ে ধরলো।
নাজিফা একটু হেসে— বাবা ইমাদ সাহেব আমায় জড়িয়ে ধরেছে!
— কেন চলে গেছো তুমি আমায় ছেড়ে?
— এ মা কই আমি চলে গেছি,,,এইতো আমি।
ইমাদ তখন নাজিফার কপালে চুমু খেয়ে— আইম স্যরি, প্লিজ আমায় ছেড়ে চলে যেওনা,,, আর তাছাড়া তুমি চলে গেলে কে আমকে নামাজ পড়ার জন্য বকবে, কে আমার বকাগুলো শুনবে।
— মানে কি তোমার বকা শুনার জন্য আমি তোমার কাছে থাকবো। অবশ্য তোমাকে আর কি বলবো, এই বকাগুলো,এই রাগী ছেলেটাকে মিস করবো বলেই তো টিকেট টাকে অর্ধেক রাস্তায় ছিড়ে ফেলে সোজা বাসায় চলে আসলাম, এসে শুনলাম তুমি নাকি আমায় খুঁজতে গেছো। ব্যস বুঝো তুমি কত কষ্ট আমার হয় যখন তুমি আমায় দূরে ঠেলে দেও তাইতো আমি ও মাকে বললাম তোমাকে যেনো না জানায় আমি বাড়ি ফিরে এসেছি।
ইমাদ নাজিফার হাতটা শক্ত করে ধরে— আমায় ছেড়ে চলে যাসনা পাগলি।
— কেন যাবোনা আমি তোমার কে লাগি?
— তুই আমার বউ লাগিস।
সহসা নাজিফা মৃদু হাসিতে ইমাদের বুকে মাথা রাখলো। এতোদিনে অবশেষে মেয়েটি শান্তির একটা স্থান পেলো, এমন কাউকে পেলো যার বুকে মাথা রেখে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
আকাশের সুখতারাগুলোর দিকে চেয়ে ইমাদ মলিন হাসিতে বলে উঠলো— শুকরীয়া রব, শুকরীয়া,এতো সুন্দর একটা নেয়ামত উপহার দেওয়ার জন্য।
( সমাপ্ত)
লিখা- আসমা আক্তার পিংকি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে