#নিয়তি
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন
#পার্ট২
যে কয়েকদিন সালাম সাহেব হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সে কয়েকদিন প্রায়ই ছেলেটার সাথে হৃদির দেখা হতো।ছেলেটা যে চে হৃদির সাথে কথা বলতে আসতো।হৃদিও ভদ্রতার খাতিরে ছেলেটার সাথে কথা বলতো।বিষয়টা বিলকিস বেগম খেয়াল করেন।তিনি হৃদিকে ডেকে বলেন,,
-বাইরের ছেলের সাথে এত কথা কিসের তোর?
-মামী আমি তো আর যে চে উনার সাথে কথা বলতে যাই নাই।উনিই আসছেন আমার সাথে যে চে কথা বলতে।তো ভদ্রতার খাতিরে…
-বলতে হবে না ভদ্রতার খাতিরে কথা।এরপর যদি দেখি তো তোর একদিন কী আমার একদিন।
হৃদির কথা শেষ হওয়ার আগেই ধমকের সুরে হৃদিকে কথা গুলো বলেন বিলকিস বেগম।বিলকিস বেগম প্রায়ই হৃদির সাথে কর্কশ গলায় কথা বলেন।তবে আজ যেন কর্কশতার মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছিলো।তাই মামীর কথা শুরুর সাথে সাথে হৃদি কেঁপে ওঠে।প্রায় বিশ দিন হাসপাতালে অবস্থানের পর সালাম সাহেবকে বাসায় নেওয়া হয়।ছেলেটাও সেদিন হৃদিকে অনুসরণ করে হৃদির মামার বাসা চিনে যায়।রিসিপশনের মেয়েটার কাছ থেকে হৃদির মামার বাসার টেলিফোন নাম্বার নেয়।প্রথম দিন ফোন দিতেই সিঁথি কল রিসিভ করে।
-আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?কাকে চাই?
-ওয়ালাইকুম আস সালাম।আমি হৃদির বন্ধু বলছি।হৃদিকে ফোনটা কী দেওয়া যাবে?আসলে আমি ওর নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি।
-হৃদি তো বাসায় নেই।বাহিরে গেছে।খুব আর্জেন্ট?
-জ্বী।
-তাহলে আপনি ওর নাম্বার নিয়ে নিন।
ছেলেটা সিঁথির কাছ থেকে হৃদির ফোন নাম্বার নেয়।আর তৎক্ষনাৎ হৃদিকে ফোন দেয়।হৃদি তখন রাস্তায় ছিলো।প্রায় ৩-৪বার কল দেওয়ার পরে হৃদি কল রিসিভ করে।
-জ্বী আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
-ওয়ালাইকুম আস সালাম।হৃদি না?
-জ্বী কিন্তু আপনি কে?আর আমার নামই বা জানলেন কিভাবে?
-আমি আলভি।মনে আছে?হসপিটালের আলভি
-ওহ আচ্ছা।কেমন আছেন ভাইয়া? আর আমার নাম্বার পেলেন কোথায়।
-তুমি ভাইয়া বলার আগ পর্যন্ত ভালো ছিলাম।কিন্তু এখন নেই।
-ওমা কী হলো?
-ভাইয়া ডাকটা পুরো কলিজায় লাগে বুঝলা?কষ্ট লাগে খুব
-ওহ আচ্ছা।তাহলে আমি আপনাকে কী বলে ডাকবো?
-নাম ধরেই ডাকতে পারো।প্রবলেম নাই।
-আচ্ছা আলভি।এখন আমি রাখি।রাস্তায় আছি তো!
-আচ্ছা।তাহলে রাতে কথা হবে।
-জ্বী আল্লাহ হাফেজ।
হৃদি কল কেটে দেয়।বাজারের ব্যাগটা ফুটপাত থেকে তুলে বাসার দিকে হাঁটা লাগায়।এম্নেতে বাজার ঘাট সালাম সাহেবই করেন।তিনি অসুস্থ থাকায় সাম্য বাজারঘাট করতো।কিন্তু আজ দুইদিন যাপত সাম্য বাসায় নেই।অফিসের কাজে বাইরে গেছে।তাই হৃদিকেই বাজার ঘাট করতে হচ্ছে দুইদিন যাপৎ হৃদিই বাজার করছে।বাসায় গিয়ে সিঁথির হাতে হাতে কাজ গুলো গুছিয়ে দেয়।আগে বাসায় রান্না বান্নার দায়িত্ব ছিলো বিলকিস বেগমের ওপর।এখন তিনি স্বামীর সেবায় ব্যস্ত। শ্বাশুড়ির পরে তো ছেলের বউয়ের ওপর সংসার সামলানোর দায়িত্ব আসে।সেই সিঁথি রান্নার দায়িত্বে আছে।
দুপুরের খাবার শেষে বাসন গুলো মেজে হৃদি বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঘুম ঘুম পাচ্ছে খুব।আস্তে আস্তে হৃদি চোখ বুজে।হারিয়ে যায় অতল ঘুমের দেশে।
-তোরা দুজনে আমায় পাগল করে দিবি।কতক্ষণ ধরে তোদের পেছন ঘুরছি।খেয়ে নিলেই তো ঝামেলা শেষ হয়ে যায়।
হাঁপাতে হাঁপাতে কথাটা হৃদি সাম্যকে বলেন মিসেস হেনা।সাম্য আর হৃদি হাসতে হাসতে বলে,,
-হি হি হি আমাদেল ধলতে পালে না।
-তোরা খাবি না?
-নাহ খিতুলি আমাল ভাল্লাগে না ফুপ্পি।
আহ্লাদী কন্ঠে মিসেস হেনার কথার জবাব দেয় সাম্য।সাম্য তখন দশ বছরের বাচ্চা।কিন্তু বাচ্চামি স্বভাবটা তখনও সাম্যের মধ্যে ছিলো।আর সারাক্ষণ হৃদির সাথে থাকতে সেও আধো আধো কথা বলতো।হৃদি সাম্যর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে,,
-সাম্যদার ভাল্লাগে না তো আমালও ভাল্লাগে না।
-ওরে দুষ্টু।দুটোকে আজ এক সাথে বেঁধে খাওয়াবো।
কথাটা বলেই মিসেস হেনা আবার দুইজনের পেছন ছুটতে লাগেন।এবং ধরেও ফেলেন।দুজনকে নিয়ে সোফায় বসান।জোর করে খাইয়ে দেন দুজনকে।খেতে খেতে হৃদি সাম্যকে বলে,,
-সাম্যদা আজকে আমাল পুতুলের সাথে তোমাল পুতুলের বিয়ে দেবে না?
-আমি পড়া গুলো শেষ করে নেই।বিকেলে দেবো বিয়ে।
-আম্মু তুমি পায়েস লান্না কলে দিয়ো।পুতুলের বিয়েতে
-আচ্ছা।এখন খান আম্মাজান।
-হৃদি!এই হৃদি ওঠ।আসরের আজান দিয়েছে।নামাজ পড়বি না?
সিঁথি হৃদিকে ধাক্কা দিছে আর ডাকছে।বিকেল হয়ে গেছে।নামাজ পড়তে হবে না!এই বাসার নিয়ম সবাইকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে।অনেক কিছু ছাড় দেওয়া গেলেও এই ব্যপারে ছাড় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।সিঁথির ডাকে হৃদি চমকে উঠে।এতক্ষণ তাহলে হৃদি স্বপ্ন দেখছিলো!
-হ..হ..হ্যা যাই সিঁথি দি।
চোখ কচলাতে ওয়াশরুমে যায় অজুর উদ্দেশ্যে।ইদানীং ছোট বেলা নিয়ে স্বপ্ন খুব বেশিই দেখছে হৃদি।কিন্তু কেন তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।কারণ আল্লাহ সর্বশক্তি মান।তিনি সব জানেন,শুনেন দেখেন।
★
খাওয়া শেষে বাসন গুলো মেজে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়।কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে যায় অতল ঘুমের দেশে।রাত ১২টা নাগাদ হৃদির ঘুম ভাঙে তাও ফোনের শব্দে।ঘুম মাখা চোখ নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায় সে।নাম্বারটা সেভ করা নেই কিন্তু পরিচিত পরিচিত লাগছে নাম্বারটা….আরেহ এটা তো আলভির নাম্বার।কিন্তু এত রাতে আলভি হঠাৎ ফোন দিলো কেন?নিশ্চয়ই কোনো দরকার আছে বা থাকতে পারে।ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করে ক্লান্তিকর কন্ঠে হৃদি বলে,,
-জ্বী বলুন
-ঘুমায় পড়ছিলা নাকি?
-রাত বাজে বারোটা।এই সময় ঘুমানো কী স্বাভাবিক নয়?
-অহ আচ্ছা।তাহলে ডিস্টার্ব করলাম।সরি
-না না ঠিক আছে।কী জন্যে ফোন দিয়েছিলেন সেটা বলুন
-এম্নি। কথা বলতে মন চাইলো তাই ফোন দিলাম।
-হোয়াট?এমনি?মানে কী এগ্লার?
-তোমার মিষ্টি ভয়েজ শুনতে মন চাইলো তাই ফোন দিলাম।
-মশাই রাত বিরাতে এইভাবে অন্য মেয়েকে ফোন দিলে আপনার গার্লফ্রেন্ড রাগ করবে।
কথাটা বলেই হৃদি হেসে দেয়।হৃদির হাসির আওয়াজ ফোনের ও পাশেও যায়।হৃদির হাসি শুনে আলভীও মুচকী হাসে।আর বলে,,
-ও হ্যালো মেডাম।আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।আমি পিউর সিঙ্গেল।By the way আপনার বফ কেমন আছে?
-বফ নাই।
-কেন?
-ডোন্ট নো।আমার ঘুম পাইতেছে।
-আচ্ছা।আর ডিস্টার্ব করবো না।গুড নাইট মেডাম।
প্রতিদিন রাতেই প্রায় হৃদিকে আলভী ফোন দিতো।হৃদিও আলভীর সাথে কথা বলাটা খুব উপভোগ করতো।কোনো দিন ফোন দিতে দেরি হলে হৃদি খুব চিন্তায় পড়ে যেত।এত দিনে ছেলেটার প্রতি মায়া জন্মে গেছে হৃদির।মেয়েদের মায়া বরাবরই বেশি থাকে।তারা আঠা নষ্ট হওয়া টিপ,ভাঙা চুড়ি,জোড়া হারানো কানের দুলটাও যত্ন করে রেখে দেয়।এই জন্য তাদের মায়াবতী বলা হয়।মায়াবতীর কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই।(হুমায়ুন আহমেদ)
মায়া ভয়ংকর সুন্দর।এই জিনিসটা একটা মেয়ের জীবনে যেমন সুখের জোয়ার বয়ে আনে।ঠিক তেমনই দুঃখ কষ্টও বয়ে আনে।ঠিক যেমনটা হয়েছিলো বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রীর সাথে।তিনি প্রথমে নবাবের মায়ায় পড়েন।পরে ভালোবেসে বিয়েও করেন। কিন্তু সুখ তার কপালে বেশিদিন সয় না।দুঃখ কষ্টের ভাটা পড়ে তার জীবনে।হত্যা করা হয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে।বেগম লুৎফান্নেছা এতটাই বাংলার শেষ নবাবের মায়ায় পড়েছিলেন যে পরবর্তী জীবন সে নবারের কবরে প্রদীপ মোমবাতি জ্বালিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন।
চলবে,,,