#নিয়তি
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন
#পার্ট১
নিজ হাতে প্রিয় মানুষটার বাসর ঘর সাজাচ্ছে হৃদি।বুকে পাথর চাপা দিয়ে মামাতো ভাই সাম্যের বিয়ের সব কাজ করেছে হৃদি।তো এই কাজটা বাদ যাবে কেন?সিঁথি যে এভাবে হৃদির প্রিয় জিনিসটায় ভাগ বসাবে হৃদি কল্পনাও করতে পারেনি।অবশ্য সবটাই হয়েছে পরিস্থিতির চাপে।নেশাখোর ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় সিঁথি।পরিবার উপায় না পেয়ে তড়িঘড়ি করে সাম্য আর সিঁথির বিয়ে দিয়ে দেয়।সাম্যর যে এই বিয়েতে মত ছিলো তা নয়।সে কৈশোর থেকেই হৃদিকে ভালোবাসে।কিন্তু হৃদি জানে তার মামী মানে সাম্যের মা তাকে কিছুতেই মেনে নেবে না।কারণ সে সাম্যদের বাড়ির আশ্রিতা।এম্নেতেই সে তার মামীর চোখের বালি।সে কোনোদিনও হৃদিকে নিজের পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করবেন না। তাই নিজে সাম্যকে বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজী করায় হ্রদি।মাস দুয়েক আগে কাবিন হয়ে গেছে।আজ ঘটা করে অনুষ্ঠান করে সিঁথিকে তুলে আনা হচ্ছে।সিঁথি সাম্যের মামাতো বোন।দুর্সম্পর্কের আত্মীয় হলেও হৃদির খুব ভালো বন্ধু ছিলো সে।এতটাই ভালো বন্ধু যে নিজের প্রিয় জিনিসটাকেই সে সিঁথির হাতে তুলে দিলো।পুরো বাসা খালি। খালিও বলা চলে না।বাসায় শুধ হৃদি আর সাম্যের মা আছেন।বাসর ঘর সাজানো হয়ে গেলে রান্না ঘরে যায় হৃদি।নববধুকে বরণের জিনিসপত্র গুছাতে হবে তো!
হৃদি আর সাম্য পরস্পর মামাতো ফুফাতো ভাই বোন।হৃদির মা হৃদির চৌদ্দ বছর বয়সে অগ্নিদুগ্ধ হয়ে মারা যায়।মা মারা যাওয়ার তিন মাসের মাথায় হৃদির দাদা তাকে নতুন মা এনে দেয়।কিন্তু পর তো কখনো আপন হয় না!সৎমা হৃদির ওপর চালাতে থাকে নির্মম অত্যাচার। বোনঝির মধ্যেই নিজের বোনকে খুঁজে পেতেন সাম্যের বাবা।হৃদির কষ্ট তার সহ্য হলো না।তাই নিয়ে আসেন নিজের কাছে।কিন্তু এখানেও তার স্ত্রীর চোখের বিষ হয়ে যায় হৃদি।কিন্তু যতক্ষণ সাম্যের বাবা বাসায় থাকতেন তখন সাম্যের মা হৃদিকে ফুলের টোকা দেওয়ার সাহস অব্দি পেতো না।
হাতের কাজ গুলো সেরে ফ্রেশ হতে যায় হৃদি।ঠিক সেই সময় গাড়ির হর্ণের আওয়াজ শুনোট পায় হৃদি।নিশ্চয়ই সাম্যদা সিঁথিদি কে নিয়ে এসেছে।কোনো রকমে ওড়না দিয়ে মুখ মুছে বেরোয় হৃদি।বধুবরণের নিয়ম কানুন শেষে সিঁথিকে বাসর ঘরে রেখে নিজের ঘরে যেতে নেয়।ঠিক সেই সময়ই সাম্য হৃদির পথ আটকায়। হৃদি সাম্যকে এড়িয়ে যেতে চায়।কিন্তু সে ব্যর্থ হয়।
-আর কত চোখের জল লুকাবি আমার থেকে ?
হৃদির চোখের জল আর সবার চোখ এড়ালেও সাম্যের চোখ এড়ায় নি।তাই তো পথ আটকে হৃদিকে জিজ্ঞাস করে সাম্য।হৃদি হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বলে,,,
-পথ ছাড়ো সাম্যদা।কাজ আছে আমার।
-আর কত দূরে থাকার বাহানা দিবি।
-বাহানা মানে?আমার সত্যিই কাজ আছে।তুমি সিঁথি দির কাছে যাও।ও তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
কথাটা বলেই হৃদি চলে যায়।অন্যান্য দিনের মতো আজ হৃদির ওপর জোর খাটানোর অধিকার সাম্যের নেই।বিয়ের কাবিন নামায় সই করে সেই অধিকার হারিয়েছে সাম্য।
পহেলা বসন্তে মিসেস হেনার কোল জুড়ে আসে হৃদি।সাম্য তখন পাঁচ বছরের এক চটপটে বাচ্চা।হাসপাতাল থেকে ফুপি একটা পুতুল নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে।সাম্য ছুটে যায় সেই পুতুলকে কোলে নেবে বলে।বিছানায় বসিয়ে দেওয়া হয় ছোট্ট সাম্যকে। পুতুল কোলে নিয়ে সাম্য কী খুশী!খেলার সাথী এসেছে সাম্যের। এখন আর একা একা থাকতে হবে না।সাম্যের বাবা বোনের সাথে মিলিয়ে পুতুলের নাম রাখেন হৃদি।সেই হৃদি হয়ে ওঠে সাম্যের কৈশরের প্রেম।আর যৌবনের অপুর্ণ ভালোবাসা।সেই অপুর্ণ ভালোবাসা যে বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিজ হাতে সাম্যের বিয়ের সব কাজ সামাল দিয়েছে।মেয়েরা বড়ই অদ্ভুত জাত।ছোট বেলায় যে মেয়েটি হোঁচট খেয়ে পড়ে ব্যাথা পেয়ে কান্নায় সারা বাড়ি মাথায় তুলতো আজ সেই মেয়েটি ই দিনে বুকে পাথর চাপা দিয়ে হাসি মুখে ঘুরে বেড়ায় আর রাতের আধারে আয়নার সামনে কেঁদে নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দেয়।
সব কাজ গুছিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় হৃদি।কানে ইয়ারফোন গুজে প্লে করে অনুপম।রায়ের গান।অনুপম রায়ের গান যেন কেমন করে হৃদির কষ্টে ভাগ বসায়।
তুমি যাকে ভালোবাসো,,,,, স্নানের ঘরে ভাসবে ভাসো,,,তার জীবনে ঝড়,,,,…..তুমি অন্য কারও সঙ্গে বেঁধো ঘর..,,,
গান শুনতে শুনতে হৃদির গাল বেয়ে অশ্রু পড়ে।সবে আঠারো পড়েছে হৃদির।এখনো টিনেজার এইজেই আছে।ভীষণ খারাপ সময় এটা।এই সময় সব ছেলে মেয়েরাই খুব আবেগপ্রবণ হয়।হৃদির ক্ষেত্রেও হয়তো তার ব্যতিক্রম হয় নি।হতে পারে সাম্য তার বয়সের আবেগ।কিন্তু হৃদি?হৃদিও কী সাম্যের কাছে বয়সের আবেগ?কে জানে?হৃদির এখন একটাই চাওয়া।সাম্য সিঁথিকে নিয়ে সুখে থাকুক।
★★
সময় নদীর স্রোতের মতো বহমান।কেটে গেছে প্রায় ছয়টা মাস।এই কয়েক মাসে হৃদি সাম্যের সামনে খুব একটা দরকার ছাড়া যায় নি।কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছে সাম্যের সাথে।যাতে পুরোনো ক্ষতটা আবার দগদগে না হয়ে ওঠে।
সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে সোফায় গা এলিয়ে দেন সাম্যের বাবা সালাম সাহেব। শ্বাস নিতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে তার।বসন্তের শুরু সবে।শীত এখনো পুরোপুরি যায় নি।এই অবস্থায়ই তার গা হাত পা ঘেমে পুরো কাক ভেজা হয়ে গেছেন।বুকের বা পাশটায়ও কেমন যেন ব্যাথা করছে।তিনি হৃদির কাছে এক গ্লাস পানি চান।ডাইনীং থেকে হৃদি গ্লাসে করে পানি এনে দেখে মামার এই অবস্থা।অস্থির হয়ে পানির গ্লাসটা সালাম সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দেয়।কাঁপা হাতে হৃদির হাত থেকে গ্লাসটা নেন সালাম সাহেব।তড়িঘড়ি করে ফ্যান অন করে হৃদি।মামার এই অবস্থা দেখে হৃদি ঘাবড়ে যায়।চিৎকার করে সাম্যকে, সিঁথিকে আর মামিকে ডাকে হৃদি।বিলকিস বেগম স্বামীকে দেখে ভয় পেয়ে যান।সিঁথি বালতি করে পানি আনে।মাথায় পানি ঢালা হয়।সাম্য এম্বুল্যান্স ডাকে নিয়ে যাওয়া হয় সালাম সাহেবকে হাসপাতালে।
ডাক্তার জানায় তিনি হার্টেএট্যাক করেছেন।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সার্জারী করা দরকার।এঞ্জিওগ্রাম করে জানা যায় তার হার্টে মোট ১৭টা ব্লক ধরা পড়েছে।সেগুলোর বেশীর ভাগ ব্লকেরই পার্সেন্টেজ ৯০এর ওপরে।তাই বাইপাস সার্জারি ছাড়া উপায় নেই।সাম্য টাকা যোগার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সার্জারী করিয়ে নেয়।সালাম সাহেবের সেবার জন্য বিলকিস বেগম আর হৃদি হসপিটালে থেকে যায়।সাম্য চাকরি সামলিয়ে যতটা সম্ভব হাসপাতালে থাকে।আর সিঁথি ঘর সামলায়।
-ভাইয়া জানো তুমি যখন আমার রাগ ভাঙাও না আমার তখন খুব ভাল্লাগে।
-আচ্ছা এর পর থেকে আমি আর তোর রাগ ভাঙাবো।আমি বুঝতে পেরেছি তুই কারণ ছাড়া রাগ করিস।
আহ্লাদী কন্ঠে সাম্য ছোট্ট হৃদির কথার জবাব দেয়।হৃদি উঠে দাঁড়ায়।দৌড় দেয় সন্ধ্যার কুয়াশার দিকে।হারিয়ে যায় কুয়াশার আড়ালে।
সাম্য চিৎকার করে ডাক দেয়,,,
-পুতুললল!
চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে যায় সাম্য।সাম্যের চিৎকার শুনে সিঁথিও উঠে পড়ে।ঘুম মাখা চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,,,
-কী হলো সাম্য?
-ক..ক..কিছু না।
খাটের পাশে টেবিলে থেকে গ্লাস নিয়ে পানি ঢগঢগ করে খেয়ে ফেলে সাম্য।তারপর চোখ বুজে।
সকালে বাসায় যাওয়ার সময় আচমকা একটা ছেলের সাথে হৃদির ধাক্কা লাগে।ছেলেটা তখন হসপিটালে ঢুকছিলো আর হৃদি বেরুচ্ছিলো।ধাক্কা লাগায় একে অপর মেঝেতে পড়ে যায়।হৃদি কোনো রকমে উঠে কাপড় থেকে ময়লা ঝাড়তে লাগে। ছেলেটাও নিজের জামা থেকে ময়লা ঝেড়ে বলে,,
-আই এম এক্সট্রেমলি সরি।দেখতে পাই নাই।
-না না ঠিক আছে।
শান্ত গলায় ছেলেটার কথার জবাব দেয় হৃদি।তারপর গন্তব্যে দিকে হাঁটা লাগায়।ছেলেটা অপলক দৃষ্টিতে হৃদির যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।
চলবে,,,