নিভৃত পূর্ণিমা পর্ব-০২

0
540

নিভৃত পূর্ণিমা – ২
সিকিউরিটি বুলেভার্ডের একটা শপিং মলে গাড়ি পার্ক করে কথা বলছিল নাদিম। যায়গাটা বাল্টিমোরে হলেও অনেক নিরাপদ এলাকা। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। দুইটা ছেলেমেয়ে গাড়ি পার্ক করে গল্প করছে, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।
হিজাব পরা না থাকলেও যেভাবে ঘাগরা-চোলি-ওড়না পরেছে সায়রা বানু, তাতে মুখ এবং হাতের কবজিটুকু ছাড়া আর কিছু দেখার উপায় নেই। মেয়েটা দেখতে শুনতে কেমন বোঝার উপায় নেই। নিজের সমস্যা নিয়ে মেয়েটা এত চিন্তিত ছিল যে নাদিমের দিকে তেমন একটা তাকায়নি। অন্য দিকে দূরে কোথাও তাকিয়ে ছিল। কি যেন চিন্তা করছিল। শুধু মাত্র নাম বলার সময় নাদিমের চোখে চোখ রেখেছিল। এই টুকুতেই মেয়েটা কতটা সুন্দরী হতে পারে, আন্দাজ করতে পেরেছে নাদিম।
পাঞ্জাবী মেয়েদের মতো বড় বড় মায়াবী চোখ। শুধু কাজল দিয়েছে, এর বেশি কোনো মেকআপ নেই। কিন্তু তাতেই অদ্ভুত সুন্দরী লাগছিল মেয়েটাকে। মেয়েটা শুধু ফর্সা না, হালকা গোলাপি ফর্সা। কিছুক্ষণ বাইরে ছিল বলে সামান্য গরমে মুখে রক্ত জমেছে, সে কারণে মুখ থেকে গোলাপি আভা আসছে।
সায়রা বানুর ঘাগরা-চোলি-ওড়না সবই ক্রিম রঙের, তবে উপরে হালকা সোনালী কাজ করা। ভারতীয় সিনেমাগুলোতে নায়িকাদের ঘাগরা-চোলি-দোপাট্টা পরিয়ে মরুভূমিতে নিয়ে গেলে যেমন লাগে, মেয়েটা দেখতে সে রকম সুন্দর লাগছে। খুব সহজ সরল চাউনি। মুখ দেখে মনে হয় বয়স উনিশ বা কুড়ি হবে। কিন্তু গড়ন একটু বাড়ন্ত, সেদিক থেকে বিশ বা বাইশ মনে হয়।
মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করেছে নাদিম, নাম বলে পাল্টা প্রশ্ন করেনি। নাদিমের নাম জানতে চায়নি। অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। নিজের পরিচয় দেয়ার দরকার মনে করল নাদিম। ড্রাইভার’স লাইসেন্স সায়রা বানুর সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার নাম নাদিম আখতার।
একবার মেরিল্যান্ডের ড্রাইভিং লাইসেন্সের দিকে তাকাল, পর মুহূর্তে কেমন যেন একটু শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল সায়রা বানু, তুমি পাকিস্তানি? ফ্রম করাচী?
সায়রা বানুর মতো থেমে থেমে অল্প শব্দের ইংরেজি বলল নাদিম, নো। ফ্রম বাংলাদেশ।
সায়রা বানু যখন কথা বলে, তখন শব্দ খুঁজে খুঁজে কথা বলার চেষ্টা করে। পূর্ণ বাক্য গঠন করতে পারে না। কখনো এক শব্দ দুই বার বলে, তারপর পরের শব্দে যায়। কথাবার্তা খুব ধীর গতিতে আগায়। শুনতে শুনতে নাদিম চিন্তা করে মেয়েটা কী বলতে চাইছে। তারপর সবচেয়ে সম্ভাব্য অর্থটা বেছে নেয়। ডেন্টিস্টের কাছে যেয়ে আক্কেল দাঁত তোলা যেমন কষ্ট সাধ্য কাজ, সায়রা বানুর সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে নেয়া অনেকটা সে রকম ব্যাপার। বাধ্য না হলে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না।
এদিকে সায়রা বানুর যা অবস্থা, সে তো মুখই খোলে না। প্রয়োজন না হলে নাদিমের দিকে তাকায়ও না।
কিন্তু নাদিমকে পাকিস্তানি ভাবায়, ও করাচী থেকে এসেছে নাকি জিজ্ঞেস করায়, বিশেষ করে পাকিস্তানি সন্দেহ করে ওর মুখে শঙ্কার ছায়া দেখে প্রশ্ন করল, আমাকে পাকিস্তানি মনে হলো কেন?
খুব ধীরে ধীরে বাক্যটা শেষ করল নাদিম।
আবার ফিরে তাকাল সায়রা বানু। একই ভাবে ধীরে ধীরে কথা বলে, কথার মাঝে কখনো হাতের ইশারার সাহায্য নিয়ে সায়রা বানু বলল, তোমার উর্দু নাম। উর্দুতে নাদিম মানে “বিশ্বস্ত বন্ধু”। “আহ-তার” মানে নক্ষত্র, আরবি-ফার্সি থেকে শব্দটা এসেছে। তুমি তোমার নাম সহিহ্‌ উচ্চারণে বলতে পারো না। “আকতার” না, কিংবা “আখতার” না, শব্দটার সঠিক উচ্চারণ “আহ্‌-তার”। “আহ্‌-তার” ভারতে, পাকিস্তানে মুসলিম ছেলেদের খুব প্রচলিত একটা নাম।
এত অবাক হলো যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পাড়ল না নাদিম। সায়রা বানু ওর মানের অর্থ ঠিক বলেছে, কিন্তু ওর উচ্চারণ একদম ভিন্ন। নাদিম শব্দটা সামান্য একটু ভিন্নভাবে এবং আখতার শব্দটা পুরাপুরি অন্য ভাবে উচ্চারণ করল। সায়রা বানুর মুখে “আখতার” নামটা ভিন্ন একটা নাম বলে মনে হয়। রাজস্থানি মেয়ে ওর নামের অর্থ এত ভালো করে কী করে জানল বুঝে উঠতে পাড়ল না। সায়রা বানুর শব্দ সিলেকশন অন্য রকম। শুদ্ধ উচ্চারণ বোঝাতে যেয়ে বলল কিনা সহিহ্‌ ।
নাদিম মন্তব্য করল, বাংলাদেশে নাদিম আখতার আন-কমন নাম না। তারপর প্রশ্ন করল, বাংলাদেশে কোথায় জানো?
— জানি, স্কুলে পড়েছি। হোম অফ দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ফরমার ইষ্ট পাকিস্তান, একাত্তর সনে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী লিবারেটেড বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ইতিহাস এক কথায় প্রকাশ করে দিল সায়রা বানু। খুব সম্ভব স্কুলে যেভাবে পড়ানো হয় সেভাবেই বলেছে।
এদিকে খিদেতে জান বের হয়ে যাচ্ছে। নাস্তার পর আর কিছু খাওয়া হয়নি। সেই কখন দেড়টায় জুম্মার নামাজ শেষ হয়েছে। এখন বিকেল চারটার মতো বাজে। মসজিদ থেকে যে দুই প্যাকেট খাবার কিনেছিল নাদিম, তার একটা সায়রা বানুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, লাঞ্চ।
লাঞ্চের প্যাকেটে একটা “ল্যাম্ব জাইরো” এলুমিনিয়ামের ফয়েলে পেঁচানো আছে। সাথে কিছু ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ। একবার নাদিমের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল সায়রা বানু। বিন্দু মাত্র খাওয়ার আগ্রহ দেখাল না। নাদিম নিশ্চিত যে মেয়েটা লাঞ্চ করেনি। কিন্তু দুশ্চিন্তায় খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। লাঞ্চের প্যাকেটের সাথে একটা করে কোকাকোলার ক্যান দিয়েছিল। লাঞ্চের প্যাকেট এবং কোকাকোলা দুই সিটের মাঝে রেখে গাড়ির পিছনে এলো। এতে সায়রা বানু একটু প্রাইভেসি পাবে। যদি খায়।
সায়রা বানু প্যাসেঞ্জার সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকল। নাদিম তার প্যাকেট ও কোকাকোলা গাড়ির ট্রাঙ্কের উপর রেখে খেতে শুরু করল। খুব ধীরে ধীরে খেয়ে, খাবারের প্যাকেট একটু দূরে ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দিয়ে এলো। ড্রাইভারের দরজার কাছে এসে দেখল একই ভাবে বসে আসে সায়রা বানু। খাবার ছুঁয়ে দেখেনি।
এখন কোথায় যাব? সিটে বসে খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করল নাদিম।
ফিরে তাকাল সায়রা বানু। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কথা বলার ইচ্ছে নেই। সংক্ষেপে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, আমাকে মসজিদে ফেলে রেখে আসো।
এমন করে বলল যেন পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এভাবে একটা মেয়েকে ফেলে দেয়া যায় না। বিশেষ করে সিট পিছিয়ে এমন করে হেলান দিয়ে রেস্ট নিচ্ছে যে বোঝা যাচ্ছে গাড়িতে সে নিশ্চিন্তে আছে।
বুঝতে পারছে সায়রা বানুর কথা বলার মতো মন নেই। তবু কিছু প্রশ্ন করতে হবে। নাদিম বলল, এক্সকিউজ মি ফর আস্কিং, তুমি কী মাইনর?
আবার ফিরে তাকাল সায়রা বানু। জিজ্ঞেস করল, মানে?
— বয়স কী আঠারো? না আরো কম?
— উনিশের একটু বেশি।
— কোনো আইডি দেখাতে পারবে?
এই প্রশ্নে কেন যেন মোটেই বিরক্ত হলো না, কিংবা রাগ করল না সায়রা বানু। হয়ত এই প্রশ্ন আগেও কেউ করেছে। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পাসপোর্ট বের করে দেখাল। পাকিস্তানি পাসপোর্ট, নাম সায়রা বানু। বয়স উনিশ বছর আট মাস। বসবাসের শহর করাচী।
ভারতের রাজস্থানের মেয়ের পাসপোর্ট পাকিস্তানি কেন? বুঝে উঠতে পাড়ল না নাদিম। কিন্তু এগুলো জিগ্যেস করার মতো পরিস্থিতি এখন নেই। মেয়েটা একজন এডাল্ট, আমেরিকার আইনে নিজের সিদ্ধান্ত সে নিজে নিতে পারবে। অভিভাবকের প্রয়োজন হবে না। এটা একটা ভালো দিক।
বলল, আমি একা একা একটা এপার্টমেন্টে থাকি। একটু বিশ্রাম নিয়ে, মাথা ঠাণ্ডা করে, যা ভালো মনে হয় তাই করা যাবে। এখন আমার বসায় যাই?
কথাটা শুনল সায়রা বানু, কোনো জবাব দিলো না। সিট আরো পিছিয়ে হেলান দিয়ে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকল। এখন হাতের আঙ্গুলে কপাল টিপে ধরে আছে, মনে হয় মাথা ধরেছে।
আর কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো না নাদিমের। সিকিউরিটি বুলেভার্ড থেকে টাউন এন্ড কান্ট্রি বুলেভার্ডে নিজের এপার্টমেন্টে এলো। জায়গাটা এলিকট সিটিতে কিন্তু একটু উত্তর দিকে। বাল্টিমোর পাইক বা হাইওয়ে ফরটির উত্তর পাশে। এখান থেকে হেঁটে হেঁটে আশেপাশের কয়েকটা দোকানে বাজার সদাই করতে যাওয়া যায়।
এপার্টমেন্টের মালিক একজন বয়স্কা শ্বেতাঙ্গ মহিলা। মহিলার হাজব্যান্ড অনেক আগে মারা গেছে। এতদিন বড় ছেলে সাথে থাকত। ছেলেটার জন্য গ্রাউন্ড লেভেলে এক বেডরুমের আলাদা একটা ইউনিট করা হয়েছিল। ছেলেটা চাকরি পেয়ে চলে গেছে, এখন ওই ঘরটাই ভাড়া দিচ্ছে। সিঙ্গেল কেউ অথবা হাজব্যান্ড ওয়াইফ থাকতে পারবে। পুরো এপার্টমেন্ট ফারনিশড। পারকিং এর সুবিধা অনেক। তাছাড়া রাস্তার পাশেও গাড়ি পার্ক করা যায়।
এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করে বলল, প্লিজ, কাম।
একটু দ্বিধা করে পিছন পিছন এলো সায়রা বানু। দরজা খুলে ভিতরে এলো নাদিম। আবার দ্বিধা করল সায়রা বানু কিন্তু পায়ে পায়ে ভিতরে এলো, চারিদিকে তাকাল।
বসার ঘরটা সাজানো গোছানো। একটা বড় সোফা। সামনে কফি টেবিল। সোফার সামনে অনেকটুকু জায়গা ফাঁকা তারপর দেয়ালের গায়ে টেলিভিশন সেট করা। বসার ঘরের এক কোনে একটা ছোট পড়ার টেবিল ও চেয়ার। টেবিলে কয়েকটা বই রাখা, একটা ল্যাপটপ খোলা আছে। দরজার পাশে ডান দিকে ছোট একটা কিচেন, পাশে একটা ডাইনিং টেবিল। কিচেনের পাশে বাথরুম।
সোফা দেখিয়ে নাদিম বলল, তুমি বসো।
বসল সায়রা বানু।
বেডরুমে যেয়ে বিছানা গুছিয়ে ফেলল নাদিম। নিজের কিছু কাপড়চোপড়, বইপত্র এবং রাতে ঘুমানোর প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস বের করে পড়ার টেবিলের পাশে ফ্লোরে স্তূপ করে রাখল।
এদিকে এখনও কপাল টিপে ধরে চুপচাপ বসে আছে সায়রা বানু।
নাদিম বলল, বেডরুমটা তোমার। রেস্ট নিতে পার।
কথাটা বলে দরজা খুলে বাইরে এলো। গাড়ি থেকে ব্যাগ, সুটকেস, লাঞ্চ বক্স এনে সব জিনিস বেডরুমে রাখল। মনে একটু ভয় ছিল কে না কে, কিন্তু আমেরিকাতে দুজন এডাল্ট ছেলেমেয়ে একসাথে থাকতে পারে। খারাপ কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম। কোনো কারণে থানা-পুলিশ হলেও সুবিচার পাওয়া যায়। কে দোষ করেছে এটা বের হয়ে আসে। মেয়েটার চোখের সরলতা এতটাই প্রকট যে খুব বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। একটু স্থির হয়ে নিশ্চয়ই কাউকে ফোন করবে, কেউ এসে নিয়ে যাবে। সায়রা বানুর থাকার ব্যবস্থা করে কোনের টেবিলে ল্যাপটপের সামনে বসল। সায়রা বানুর উদ্দেশ্যে বলল, এখন আমি কিছুক্ষণ কাজ করব। ওকে?
সবচেয়ে জরুরি কাজ এখন আরেকটা চাকরি পাওয়া। নূতন করে আবার বায়ো -ডাটা লিখতে বসল নাদিম। আমেরিকাতে বায়ো-ডাটাকে রেজুমে বলে। আজকাল রেজুমে এমন হতে হয় যেন প্রথম দেখায় চোখে পড়ে। ইন্টারনেটে কয়েকটা উদাহরণ দেয়া আছে। একটাকে বেছে নিয়ে রেজুমে আপডেট করতে শুরু করল। জেমস ওয়ার্ডের অফিসে যে সব কাজ করেছে, সেগুলো ভালো করে লেখা সবচেয়ে জরুরি। এর উপর ভিত্তি করেই নূতন চাকরি হবে।
জেমস ওয়ার্ডের কথা মনে হতেই ভাবল, ওকে একটা থ্যাংক ইউ নোট দিতে হবে। যদিও হঠাৎ করে গলাধাক্কা দিয়ে বেড় করে দিয়েছে, তবু কাজের ব্যাপারে নাথিং পারসোনাল।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে জেমস ওয়ার্ডকে লিখল, ওর সাথে দেড় বছর কাজ করে অনেক কিছু জানতে পেরেছে। অনেক কিছু শিখেছে। ওর কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ হলে, কিংবা কোথায় কোনো ওপেনিং হলে, ওকে জানালে খুব খুশি হবে। তারপর আবার ধন্যবাদ জানিয়ে ইমেইল পাঠিয়ে দিল।
বুধবার বিকেলে ফায়ার হয়েছে, শুক্রবার বিকেলে নাদিম ইমেইলে থ্যাঙ্ক ইউ নোট পাঠাল। খুব বেশি দেরি হয়নি। নাদিম জানে বস ফোনে ইমেইল দেখতে পায়। সাধারণত সাথে সাথে জবাব দেয়, কিন্তু আজ জবাব পেল না। জবাবের আশা করে থ্যাঙ্ক ইউ দেয়নি। একটা প্রফেশনাল কার্টেসি দেখানো মাত্র।
এমন সময় সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল সায়রা বানু। নাদিমকে “থ্যাঙ্ক ইউ” বলে বেডরুমে ঢুকে গেল। ভিতর থেকে দরজা লক করার শব্দ পেল নাদিম।
অনেকক্ষণ লাগিয়ে রেজুমে লিখল নাদিম। তারপর “যিপ রিক্রুটর”, “ইনডিড”, “লিঙ্কড ইন” এসব ওয়েবসাইটে নিজের প্রোফাইল আপডেট করল। যারা হায়ার করবে, এখন যে কোনো সময় তাদের ইমেইল, ফোন আসতে শুরু করবে। নামাজের সময় হলে কাজ বন্ধ রেখে টেবিলের পাশে নামাজ পড়ে নিলো নাদিম।
যেহেতু হাতে সময় আছে, সাইবার সিকিউরিটি সার্টিফিকেশন কোর্স করার সিদ্ধান্ত নিল। কোরসেরা, গুগোল, ইউডেমি ওয়েবসাইটে নূতন কয়েকটা বিজ্ঞাপন দিয়েছে। কোর্সগুলোর ফি দেখল, কোর্স শেষ করতে কত মাস লাগবে আন্দাজ করার চেষ্টা করল।
প্রোফাইল আপডেট, ইমেইল লিখে, ওয়েবসাইট দেখতে দেখতে কখন সন্ধ্যা রাত হয়ে এসেছিল খেয়াল করেনি। বেডরুমের দরজা খুলতেই সম্বিৎ ফিরে এলো। ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়েছে সায়রা বানু। সোজা বাথরুমে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে আবার বেডরুমে ঢুকে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর বাইরে এলো। সোফায় বসে কয়েক মিনিট নাদিম কী করছে দেখল। কাজ বন্ধ করে তাকাল নাদিম। সায়রা বানুর জামাকাপড় খেয়াল করল। সেই একই পোশাক পরেছে। ঘাগরা-চোলি-দোপাট্টা, কিন্তু ঘরে পরার জন্য সাধারণ মানের কাপড়ের তৈরি। হিজাব না পরেও কড়া পর্দা বজায় রাখে, চোখ মুখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। এখন ঘরে মোজা না পরায় পায়ের পাতা একটু উন্মুক্ত আছে। কিন্তু এপার্টমেন্ট এত ছোট যে প্রাইভেসি রেখে চলা ভীষণ কষ্টকর হবে।
শান্ত, মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, খেয়েছ?
– না। তুমি কী ব্যস্ত? প্রশ্ন করল সায়রা বানু।
– না।
– এখন কয়েকটা কথা বলা যাবে?
– যাবে। কিন্তু তুমি আগে খেয়ে নাও।
— আগে কথা শেষ করে নেই।
— আচ্ছা, বলো।
থেমে থেমে শব্দ খুঁজে অনেকক্ষণ কথা বলল সায়রা বানু। মন দিয়ে চুপচাপ শুনে গেল নাদিম। কথা শেষ হতে যা বুঝতে পাড়ল তা হল, সায়রা বানুর যৌথ ফ্যামিলি থাকে জার্সি সিটি নামে নিউ জার্সি রাজ্যের এক শহরে। ওর বাবা নেই, মায়ের সাথে থাকত। পরিবারের কয়েকজন মুরুব্বী এবং এক খালাত ভাই সায়রা বানুকে বিয়ে দেয়া চেষ্টা করছিল। কিন্তু সায়রা বানু বিয়ে করতে চাচ্ছিল না। সে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে এদেশে এসেছে, এখানে কিছু একটা পড়তে চাচ্ছিল। শুধু তাই না, পাত্রকে সায়রা বানুর মোটেই পছন্দ নয়। কিন্তু পরিবারের সবাই এত চাপ সৃষ্টি করেছিল, মনে হচ্ছিল জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। উপায় না পেয়ে সায়রা বানু মেরিল্যান্ডে এক দূর সম্পর্কের খালার কাছে পালিয়ে আসে। ভদ্রমহিলা সায়রা বানুকে একটা কাজ জোগাড় করে দেয়। কাজের যায়গায় এক আফ্রিকান আমেরিকান মহিলার সাথে থাকার ব্যবস্থা হয়। সায়রা বানু গাড়ি চালাতে জানে না। আফ্রিকান আমেরিকান মহিলার সাথে কাজে যেত, ওর সাথে ফিরে আসত। কিন্তু কিছুদিন আগে আফ্রিকান আমেরিকান মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে এসেছে। লোকটা সারাদিন বাসায় থাকে, ড্রিঙ্ক করে। এমন করে সায়রা বানুর দিকে তাকায় যে কলজে তে পানি থাকে না। সায়রা বানু আফ্রিকান আমেরিকান মহিলাকে বলে দিয়েছে, সে বাড়ি ছেড়ে দেবে। আজ শুক্রবার মেয়েটা সায়রা বানুকে মসজিদে নামিয়ে দিয়ে যায়। নামাজের পর মেরিল্যান্ডের সেই খালাম্মা এসে সায়রা বানুকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খালা তাকে নিতে মসজিদে আসেনি। ফোন করে বলছে, একটা ইমারজেন্সি হয়েছে, সায়রা বানুকে নিতে মসজিদে আসতে পারবে না। খুব সম্ভব নিউ জার্সির আত্মীয়েরা খালাম্মাকে ভীষণ চাপে ফেলেছে। সায়রা বানু বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে দায়ী করেছে। মহিলা আর কোনো ঝামেলায় যেতে চায়নি। সায়রা বানু ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল, কিন্তু দূর সম্পর্কের খালা না আসায় মসজিদের বারান্দায় বসে ছিল। তখন নাদিম তাকে দেখতে পায়। এই হল ঘটনা।
সায়রা বানুর কথাগুলো পুরোটাই বিশ্বাস করল নাদিম। এই মেয়ের চোখের দিকে তাকালে মনে হয় না সে মিথ্যা কথা বলার ক্ষমতা রাখে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে পরিস্থিতিটা আত্মস্থ করার চেষ্টা করল নাদিম। এক সময় জিজ্ঞেস করল, তুমি বলেছিলে, রাজস্থান থেকে এসেছ। তোমার পাসপোর্ট পাকিস্তানের কেন? থাকার শহর করাচী লেখা কেন?
প্রায় সাথে সাথেই কারণ জানাল সায়রা বানু, আমার জন্ম, বেড়ে উঠা সব রাজস্থানে। আজমিরের কাছে নিজের বাসা ছিল। একদিন আব্বাজান অসুস্থ হয়ে পড়েন, কয়েকদিন পর মারা যান। আব্বু মারা যাওয়ার পর আম্মু এবং আমার ওখানে থাকা নিরাপদ ছিল না। খুব অল্প দামে এলাকার প্রভাবশালী একজন হিন্দু লোকের কাছে জায়গা জমি বিক্রি করে করাচী পালিয়ে এসেছিলাম। করাচীতে আমাদের কিছু আত্মীয় স্বজন ছিল, ওরাই বর্ডার ক্রস করতে সাহায্য করেছিল। করাচী বেশিদিন থাকতে হয়নি, আম্মুর সাথে আমেরিকা আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। আর ফিরে যাইনি।
এরপর আর কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছে হলো না নাদিমের। বলল, অনেক কথা হয়েছে। এখন খেয়ে নাও?
বেডরুম থেকে খাবার প্যাকেট এনে ডাইনিং টেবিলে বসল। খেতে খেতে বলল, একটা ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তোমার এখানে থাকতে পারি? আমি ভাড়া শেয়ার করব।
— ভাড়া দিতে হবে না। তোমার যে কয়দিন দরকার থাকো। আমার অসুবিধা হবে না।
— তুমি কী কর? তোমার এত মন খারাপ কেন?
রাতে থাকার সমস্যা মিটে যাওয়াতে একটু সহজ হতে পেরেছে সায়রা বানু। এবার নাদিম সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে। প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলো নাদিম। নিজের এত সমস্যার মধ্যেও নাদিমের মন খারাপ, এই জিনিসটা চোখে পড়েছে। তার মানে আরো একটু হাসিখুশি থাকতে হবে, না হলে সবাই বুঝে ফেলবে নাদিমের কিছু একটা হয়েছে।
— আমি কম্পিউটার সাইন্সে ব্যাচেলর্স করেছি। একটা চাকরি করছিলাম, বুধবার চাকরি চলে গেছে।
— ওহ, খুদা! আঁতকে উঠে সাথে সাথে বলল সায়রা বানু।
– এখন চাকরি খুঁজছি।
এরপর আর কথা হলো না। খেয়ে বেডরুমে ঢুকে গেল সায়রা বানু। দরজা লক করার শব্দ পেলো নাদিম।
চাকরির ওয়েব সাইটে প্রোফাইল আপলোড করা মানে বঁড়শি ফেলে তাকিয়ে থাকা। কখন মাছে ঠোকর দেবে সেই অপেক্ষা।
এক সময় একটা ইমেইল পেলো। রঘুনাথ রেড্ডি নামে একজন যোগাযোগ করেছে। সে মনে করে তার হাতে একটা জব ওপেনিং আছে যেখানে নাদিমের ভাল সম্ভাবনা আছে। কয়েকটা ফর্ম পাঠাল। এগুলোতে সাইন করে দিলে সে কাজ শুরু করবে। দেড়ি না করে ফর্মগুলো ফিলাপ করে পাঠিয়ে দিল। মনে হয় রঘুনাথ রেড্ডি অন লাইনে ছিল। সে বলল, নাদিমের রেজুমে টা একটু রিফাইন করতে হবে।
জানতে চাইল রঘুনাথ রেড্ডি নিজেই রেজুমে ঠিক করে দেবে, নাদিমের সম্মতি আছে কিনা?
সম্মতি দিল নাদিম। রঘুনাথ রেড্ডি বলল, রেজুমে ঠিক করে, আরো কিছু ফর্ম সহ পরে আবার যোগাযোগ করবে। এত তাড়াতাড়ি একটা সম্ভাবনা তৈরি হওয়াতে খুশি হলো নাদিম। আম্মার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। একটু কথা বলেই আম্মা জিজ্ঞেস করল, সব সময় তো বেডরুমে শুয়ে শুয়ে কথা বলিস, আজ টেবিলে বসে কথা বলছিস যে?
— কাজ করছি, এই টুকুই বলতে পাড়ল নাদিম। বেডরুমে আরেকজন আছে, এটা বলা সম্ভব না।
আম্মার সাথে কথা শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। আগামি কাল শনিবার, এলার্ম অফ করল। সকালে দেরি করে উঠবে। অনেক দিন পর ফজরের নামাজ কাজা হবে। দেব-দেবীর পা ছুঁয়ে এসে হিন্দুরা চাকরি করে, ওদের চাকরি যায় না। আর রেগুলার নামাজ-রোজা করে তার কিনা চাকরিটা গেল।
খুব ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল নাদিমের। বেডরুম থেকে হালকা ভাবে আজানের শব্দ শোন যাচ্ছে। দুই লাইন হওয়ার পর আজান থেমে গেল। খুব সম্ভব ওভাবেই এলার্ম দেয়া ছিল। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকল নাদিম। একটু পর হালকা পায়ে হেঁটে কেউ বাথরুমে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার হেঁটে বেডরুমে ফিরল। সায়রা বানু উঠে অজু করল, এটা বুঝতে পাড়ল নাদিম। নিঝুম, নিস্তব্ধ ভোর, বেডরুমের নাড়াচাড়ার শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
আরো কিছুক্ষণ পর শুনতে পেল খুব মিষ্টি স্বরে কেউ কোরআন শরীফ পড়ছে। আরবি পড়ার নিয়ম, উচ্চারণ মসজিদের ইমামদের মতো। যেভাবে সুর করে পড়ে নামাজ পড়ায় সে রকম। একটা সুরা দুই বা তিনবার পড়ল সায়রা বানু। খুব পরিচিত সুরা, কোথায় যেন শুনেছে। প্রথম দুই আয়াত স্পষ্ট শোনা যায়,
“সাব্বি হিসমা রাব্বিকাল আ-লা,
আল্লাজি খালাক্কা ফাসাও আ।“
তারপর এত মৃদু গলায় পড়ে যে সুর ছাড়া আর কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু শেষ দুই আয়াতে আবার একটু জোরে পড়ে,
“ইন্না হাজা লাফিস সুহু ফিল উ-লা,
সুহু ফি ইব্রাহিমা অয়া মুসা।“
একই সুরা তিনবার পড়ল মনে হলো। পড়া শেষ হতেই আবার সব চুপচাপ। আলো বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়েছে বোধ হয়। এমন করে তেলাওয়াত করে, মনে হয় কথাগুলো যেন কাউকে বলছে। মনে ভয় ধরে যায়। স্তব্ধ হয়ে থেকে এই সুরা কোথায় শুনেছে মনে করার চেষ্টা করল নাদিম। এবার মনে পড়ল। জুম্মার নামাজের প্রথম রাকাতে প্রায়ই এই সুরাটা পড়ে। “সুহু ফি ইব্রাহিমা অয়া মুসা“ বলে ইমাম সাহেব রুকুতে যায়। সুরার নাম জানে না নাদিম। কেন সায়রা বানু তিন বার এই সুরাটা পড়ল?
এখন নামাজ না পড়ে আর ঘুম আসবে না। উঠে অজু করে নামাজ পড়ে আবার ঘুম দিলো নাদিম। এবার অনেক দেরি করে উঠল। হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পরে যখন তৈরি হলো, তখন বেডরুম থেকে বের হলো সায়রা বানু। অন্য এক সেট ঘাগরা-চোলি-ওড়না পরেছে। রেডি হয়ে বোধ হয় অপেক্ষা করছিল কখন নাদিম উঠবে। আজ চোখে মুখে কোনো ভয় বা দুশ্চিন্তা নেই। যেন আত্মবিশ্বাসী নূতন একটা মেয়ে।
নাদিমকে বলল, তোমার কিচেনে অনেক কিছু নেই। একটু কেনাকাটা করতে হবে। বাইরে যেতে পারবে?
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে