নিভৃত পূর্ণিমা পর্ব-০১

0
871

নিভৃত পূর্ণিমা – ১
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের মেডিকেয়ার এবং মেডিকেইড সার্ভিসের হেড অফিস বাল্টিমোরের সিকিউরিটি বুলেভার্ডের শেষ মাথায়। ইংরেজিতে এই অফিসের সংক্ষিপ্ত নাম সিএমএস, বাৎসরিক বাজেট প্রায় দুইশ কোটি ডলার। মেডিকেয়ার এবং মেডিকেইডের মাধ্যমে সরকারি খরচে “বয়স্কদের” এবং “স্বল্প আয়ের লোকজনকে” স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। সরকারিভাবে এই সেবা পাওয়ার জন্য যে “যোগ্যতা” অর্জন করতে হয় সে ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞানের অভাবে অনেকে এই সেবা থেকে বঞ্চিত হন। অনেকে মেডিকেয়ার বা মেডিকেইড বিষয়ে খুব কম জানে অথবা এ দুয়ের পার্থক্যও বোঝে না। কেউ কেউ মেডিকেইড বা মেডিকেয়ার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেও নিয়ম কানুন না জানার কারণে এই সেবা পান না। সেবা প্রাপ্তদের নাম, ঠিকানা, যোগ্যতা, বিভিন্ন রকমের বিল মিটানোর তথ্য সহ সব ধরণের অফিসের কাজের জন্য আধুনিক কম্পিউটার এবং সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়।
সিএমএস’র বিশাল বাজেটের একটি অংশ খরচ হয় কম্পিউটার এবং আনুষঙ্গিক সফটওয়ার ঠিকঠাক রাখতে। এই অফিসে ঠিকাদারি কাজের জন্য আশেপাশে কয়েকটা ইনফরমেশন টেকনোলজির অফিস গড়ে উঠেছে। সিএমএসকে কম্পিউটার সম্পর্কিত সব রকমের সাহায্য সহযোগিতা করা এদের কাজ। এরকম একটি অফিসে সাইবার সিকিউরিটি স্পেসিয়ালিস্ট হিসাবে কাজ করে নাদিম আখতার। চাকরির বয়স দেড় বছর।
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে নাদিম। দেশে বাবা-মা, ছোট বোন এবং ছোট ভাই থাকে। বোন বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় বর্ষে এবং ভাই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে “ও লেভেলে” উঠেছে। নাদিম নিজেও ইংরেজি মিডিয়ামে পড়েছিল। তারপর আমেরিকাতে কম্পিউটার সাইন্সে ব্যাচেলার’স ডিগ্রি পড়তে এসেছে। ইউনিভার্সিটির দিনগুলোতে বাবা-মা অনেক কষ্ট করে পড়ার খরচ যুগিয়েছিল। বাড়ির সবার ইচ্ছে পাশ করে নাদিম বড় ছেলের দায়িত্ব নেবে। চাকরি করে যতটুকু সম্ভব টাকা-পয়সা পাঠিয়ে সাহায্য করবে। দেশে টাকা পাঠানোর জন্যই তো আমেরিকাতে পড়তে আসা।
সুবোধ ছেলের মতো পড়ালেখা শেষ করে ঠিক সময়ে ডিগ্রি পেয়েছে নাদিম। তারপর অনেক যায়গায় ইন্টার্ভিউ দিয়ে বাল্টিমোরে চাকরি পেয়েছে। দেশে থাকা-খাওয়া এবং ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ এত বেড়েছে যে নিজের প্রয়োজনের বেশি জমা করতে না। বাসার খরচ, ভাই বোনের পড়ালেখার খরচের একটা ভাল অংশ নাদিমের পাঠানো টাকাতে চলে। সংসারের প্রয়োজনেই ছেলেকে চেনা যায়। নাদিমের দায়িত্ব বোধের পরিচয় পেয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই অত্যন্ত খুশি। এরকম বড় ছেলে সংসারে কম হয়। বাড়ির সবাই নাদিমের জন্য মন খুলে দোয়া করে, ওর সুন্দর ভবিষ্যৎ চায়।
নাদিম সাধ্যমত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, তিরিশ রোজা করে। দেশে থাকতে বাবা-মা নামাজ রোজার যে অভ্যাস করিয়ে দিয়েছিল, এখনও সেটা ধরে রেখেছে। আমেরিকার শত রকমের প্রলোভন ওকে ধর্মচ্যুত করতে পারেনি। শুক্রবার জুম্মার দিনে নাদিম দুই ঘণ্টার জন্য লাঞ্চ ব্রেক নেয়। ইসলামিক সোসাইটি অফ বাল্টিমোরের মসজিদে নামাজ পড়তে যায়। বিকালে এক-দেড় ঘণ্টা বেশি সময় অফিস করে নামাজের সময়টুকু পুষিয়ে দেয়। কাজে-কর্মে এত ভালো, এত মনযোগী, যে প্রোজেক্ট ম্যানেজার প্রতি শুক্রবার দুই ঘণ্টার ছুটি দিতে দ্বিধা করেনি।
নাদিমের বস একজন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। নাম জেমস ওয়ার্ড। ব্যবহার অত্যন্ত ভালো। ভদ্রলোক বস হলেও বন্ধুর মতো ব্যবহার করে। বস ভালো হওয়াতে জান প্রাণ দিয়ে কাজ করতে খারাপ লাগে না। এই চাকরির কারণে বাবা-মা, ভাই, বোন সচ্ছল থাকতে পারছে, পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছে। এ জন্য অফিসকে পরিবারের একটি অংশ মনে হয়। তারপরও অনেক দিন থেকে নাদিমের মাথায় একটা দুশ্চিন্তা ঘুরছে। ওয়ার্ক পারমিট শেষ হওয়ার আগে অফিস থেকে এইচ ওয়ান ভিসা’র জন্য সাহায্য করবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছে না। ছয় মাস পরে ওয়ার্ক পারমিট বা অপশনাল প্র্যাক্টিকেল ট্রেনিং শেষ হয়ে যাবে। তার আগেই ভিসা পেতে হবে। তা না হলে চাকরি করা যাবে না। এখন মন দিয়ে কাজ করছে নাদিম। ভেবেছে কিছু দিন পর বস জেমস ওয়ার্ডের কাছে ভিসা’র কথাটা তুলবে।
সাধারণ ভাবে অফিসের সময় সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা। সপ্তাহের মাঝে বুধবার ঠিক সাড়ে চারটার সময় কনফারেন্স রুমে নাদিমকে ডেকে পাঠাল জেমস ওয়ার্ড। শেষ বিকেলে এরকম অনেক মিটিং হয়। আগামী দিনগুলোতে কী কী কাজ করতে হবে সে সব নিয়ে আলাপ আলোচনা চলে। কনফারেন্স রুমে যেয়ে নাদিম দেখল আগে থেকেই বস বসে আছে।
ভিতরে ঢুকতেই জেমস বলল, বসো, নাদিম। কাজ কর্ম কেমন হচ্ছে?
— ভালো। খুব ভালো। প্রজেক্টের কাজ সময় মতো আগাচ্ছে।
— গুড। কি জন্য ডেকেছি সেটাই আগে বলি। হাসিমুখে কথা শুরু করল বস। বলতে থাকল, নাদিম, তোমার কাজে কর্মে আমরা সবাই সন্তুষ্ট। তুমি কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের একজন সেরা প্রোগ্রামার। কিন্তু হয়েছে কী, আমরা নূতন একটা প্রোজেক্টের জন্য যে প্রপোজাল পাঠিয়েছিলাম, সে কাজ পাইনি। এ কারণে অনেকের বেতন দিতে পারছি না। বাধ্য হয়ে আমাদের প্রজেক্টের কর্মচারীর সংখ্যা কমাতে হচ্ছে। আমি সত্যি দুঃখিত, আগামীকাল থাকে তোমার অফিসে আসার দরকার নেই। ভবিষ্যতে প্রজেক্ট হাতে এলে আবার যোগাযোগ করব।
নাদিম ভেবেছিল ভাল কিছু বলার জন্য ডেকেছে, কিন্তু ওকে যে ফায়ার করে দেবে, এটা কল্পনাতেও ছিল না। এক মুহূর্ত আগে কী হয়ে গেল কিছুই মাথায় ঢুকছে না। এত শকড হয়েছে নাদিম যে কথা বলতে পারছে না। ওকে যে ফায়ার করা হবে সেটা নিশ্চয়ই হঠাৎ করে ঠিক করা হয়নি। নিশ্চয়ই আগে থেকে জেমস জানত। অথচ ঘুণাক্ষরেও নাদিমকে বুঝতে দেয়নি। গত কয়েক দিনের কথাবার্তায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে পারেনি। আজ সকালেও ভীষণ হাসিমুখে কথা বলছিল।
— জান প্রাণ দিয়ে এতদিন কাজ করলাম, এটা কি তার পুরষ্কার? আমাকে এভাবে ফায়ার করতে পারলে? ছলছল চোখে এইটুকুই বলতে পাড়ল নাদিম। এত ভালোমানুষ বসের এরকম রুক্ষ ব্যবহারে এত দুঃখ পেয়েছে নাদিম যে কিছুতেই চোখ শুকনা রাখতে পাড়ল না। কাউকে চাকরীচ্যুত করাটা ভীষণ কষ্টের কাজ। জেমস বলল, সত্যি, আমি সরি, নাদিম। আমার করার কিছু নেই। কন্ট্রাক্ট চাকরিগুলোতে এরকম ঘটনা খুব স্বাভাবিক। তুমি চেষ্টা করে যাও। কোথাও না কোথাও চাকরি পেয়ে যাবে।
এরই মধ্যে সিকিউরিটি গার্ড এসে হাজির হলো। সে দরজা খুলে ভিতরে এসে এক কোনে দাঁড়িয়ে রইল।
জেমস বলল, ও তোমাকে এগিয়ে দেবে। টেবিল থেকে তোমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নিয়ে যাও।
সিকিউরিটি গার্ড একজন আফ্রিকান আমেরিকান। সাইজে নাদিমের দুইগুণ হবে। বলল, প্লিজ, ফলো মি, স্যার।
লোকটা এমন করে কথা বলল, যে বসের সাথে আর কথা বলার সুযোগ নেই। লোকটা তাকে ডেস্কের ডেস্কের কাছে নিয়ে গেল। ডেস্কে ফিরে দেখল এরই মধ্যে নাদিমের কম্পিউটার সরিয়ে নেয়া হয়েছে। টেবিলের উপর একটা ছোট কাগজের বাক্স রাখা আছে।
গার্ড বলল, তোমার জিনিসপত্র বাক্সে নিয়ে নাও। আমাকে তোমার সাথে সাথে গাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে। তুমি অফিসে পারকিং থেকে বের হয়ে গেলে আমার ডিউটি শেষ হবে।
অফিসের আশেপাশের টেবিলের সবাই বুঝতে পারছে নাদিম ফায়ার হয়েছে। কেউ নাদিমের দিকে তাকাচ্ছে না। ওরা সবাই যার যার কাজে ব্যস্ততার ভাব দেখাচ্ছে। রাগে, দুঃখে ও লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। দ্রুত নিজের জিনিসপত্র বাক্সে ভরে হাঁটতে শুরু করল নাদিম। পিছনে পিছনে গার্ড আসছে। চাকরি চলে গেলে কেউ যেন অফিসের জিনিস পত্রের ক্ষতি করতে না পারে, বা কোনো রকম হইচই করতে না পারে তার জন্য সিকিউরিটি ডেকে তারপর ফায়ার করা হয়।
গাড়িতে বাক্স রেখে চোখ মুছল নাদিম। ভদ্র ছেলে দেখলেই বোঝা যায়। গার্ড লোকটার মায়া লাগল। বলল, তুমি শিক্ষিত ছেলে, এত ভেঙ্গে পড় না। এক বোতল হুইস্কি কিনে নিয়ে যাও। ঘরে যেয়ে ইচ্ছে মতো ড্রিঙ্ক করে ঘুম দাও। কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার খুঁজতে থাক, আরেকটা চাকরি পাবে। তারপর হ্যান্ডশেক করে বিদায় জানাল। নাদিম অফিসের পারকিং থেকে বেড়িয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল লোকটা।
পারকিং থেকে বের হয়ে বেশিক্ষণ গাড়ি চালাতে পাড়ল না নাদিম। এত খারাপ লাগছিল যে পাশে একটা শপিং মলে পার্ক করে বসে থাকল। একা একা কিছুক্ষণ কাঁদল। এভাবে সবার সামনে গার্ড ডেকে অফিস থেকে বের করে দেওয়াটা গায়ে বিছার কামড়ের মতো জ্বলছে। কান্নাকাটি করেও কিন্তু মন শান্ত হলো না। একটু পর আবার যখন গাড়ি চালানোর মতো অবস্থা হলো তখন আর কোথাও না যেয়ে সোজা এপার্টমেন্টে ফিয়ে শুয়ে পড়ল। সন্ধ্যায় একবার আম্মার সাথে কথা বলতে হবে। আম্মাকে কীভাবে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। বাড়িতে সবার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে। বিভিন্ন রকমের দোয়া দরুদ, “খতম পড়া” শুরু হয়ে যাবে। আবার চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত কারো মনে শান্তি আসবে না। চাকরি না পেয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। সেটা একটা মস্ত বড় ব্যর্থতা হিসাবে দেখা হবে।
মনের দিকে থেকে এত ধাক্কা খেয়েছিল যে ঘরে ফিরে শরীরটা ভেঙ্গে পড়ল। শুয়ে পড়তেই ভীষণ ঘুম পেলো। এই ঘুমটাই তাকে প্রাথমিক ধাক্কা থেকে বাঁচিয়ে দিল। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা রাতে ঢাকা থেকে ফোন পেয়ে। আম্মা ভিডিও কল করেছে।
ভিডিওতে ছেলের মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। অসময়ে নাদিম ঘুমায় না। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, আব্বু? ঘুমাচ্ছিলা?
— হ্যাঁ, আম্মু। মনটা ভালো না। অফিস থেকে আগে আগে ফিরেছি। ঘরে এসে খুব ঘুম পেয়েছিল।
— মন ভালো না কেন? কী হয়েছে বলো না?
একটু দ্বিধা করল নাদিম। তারপর মুখ কালো করে বলল, আজকে চাকরি চলে গেছে।
— ও আল্লাহ! বলো কী? কি হয়েছিল? কেন চাকরি চলে গেল? ফোন রেখে বাসার সবাইকে ডাকলেন, এই, শোনো, সবাই নাদিমের সাথে কথা বলো। ওর মন খারাপ।
এবার সবাই ক্যামেরার পিছনে এসে কথা বলতে শুরু করল। সবার মুখে দুশ্চিন্তা।
— কী হয়েছে, বাবা? জিগ্যেস করল ওর আব্বু।
— খারাপ কিছু হয় নাই। ওদের প্রজেক্টে টাকা নেই। কয়েকজনকে কাটছাঁট করতে হয়েছে। আমি তার মধ্যে পড়েছি। দোয়া করো। তাড়াতাড়ি যেন একটা চাকরি পাই।
একজন একজন করে সবাই কথা বলল। নাদিমকে সাহস দিল। ভাল করে নামাজ পড়তে বলল।
আবার অনেকক্ষণ ঘুমাল নাদিম। পরদিন সকালে উঠে মনে হলো এটা একটা ভিন্ন রকমের বৃহস্পতি বার। সবাই কাজে গেছে, অথচ নাদিমের কাজ নেই। সকাল হতেই আবার আম্মা ফোন করল।
— এখন কেমন আছিস? মন খারাপ করিস না। আমরা সবাই দোয়া করছি।
— বেশি চিন্তা করো না। একটা কিছু হয়ে যাবে।
— হাতে সময় আছে?
— তিন মাসের মধ্যে আরেকটা চাকরি পেতে হবে। না হলে দেশে ফিরতে হবে।
— বেশি চিন্তা করিস না। তেমন হলে দেশে ফিরে আসবি। কত ছেলে কত ভালো চাকরি করছে।
— আচ্ছা, দেখা যাবে।
— আর শোন, তোর নিউ ইয়র্কের খালা ফোন করেছিল। অনেক দিন থেকে ওর এক বান্ধবীর মেয়ের কথা বলছিল। আমেরিকার সিটিজেন। একটু ভেবে দেখিস।
— আচ্ছা, আম্মা। কোনো উপায় না থাকলে তখন চিন্তা করব। এখন বেশি চিন্তা করো না। আমি একটু বের হবো। পরে কথা বলব।
— শোন, কাল শুক্রবার জুম্মার নামাজে যাবি। অনেকক্ষণ নামাজ পড়বি। নিজের জন্য দোয়া করবি।
— আচ্ছা, আম্মা।
ফোন রেখে চুপচাপ বসে থাকল কিছুক্ষণ। সিকিউরিটি গার্ডের কথা মনে এলো। এত নামাজ-কালাম পড়ে এভাবে ফায়ার হয়েছে। এখন একটু হুইস্কি খেলে কেমন হয়? জীবনে কোনোদিন ড্রিঙ্ক করেনি। এবার একটু স্বাদ নিলে কেমন হয়? কিন্তু চিন্তাটা বেশিক্ষণ মাথায় রাখতে পাড়ল না নাদিম।
অফিস থেকে সেক্রেটারি মহিলা ফোন করল। নাদিম ফোন ধরার পর কেমন আছো জিজ্ঞেস করল। বলল, তোমাকে ফায়ার করে তোমার বসের মন খারাপ। কিন্তু আমাকে বলতে বলেছে, তোমাকে তিন মাসের সেভারেন্স পে দেবে। টেকনিক্যালি, তুমি বলতে পারবে আরো তিনমাস তোমার চাকরি আছে। মন খারাপ করো না। আমরা সবাই একটা কঠিন সময়ে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।
অযাচিত ভাবে তিন মাসের বেতন পেয়ে হুইস্কির চিন্তা পুরোপুরি মাথা থেকে তাড়িয়ে দিল নাদিম। ঠিক করল কাল মসজিদে যেয়ে অনেক করে নফল নামাজ পড়বে, নিজের ভালোর জন্য কান্নাকাটি করবে। তারপর জান দিয়ে আবার চাকরি খুঁজতে শুরু করবে।
শুক্রবার আজানের একটু আগে আগে ইসলামিক সোসাইটি অফ বাল্টিমোরের মসজিদে নামাজ পড়তে এলো। মসজিদটা একটা চিপা গলির মধ্যে। বড় রাস্তা থেকে অনেক দূরে। আজ অনেক দূরে ঘাসের মধ্যে পার্ক করল নাদিম। এখন ইচ্ছে করলেও আগে চলে যেতে পারবে না। নামাজের সময় পারকিং ভরে যাবে, এই জায়গা থেকে বের হতে অনেক সময় লাগবে। আগে বের হলেও গাড়িতে বসে থাকতে হবে। এত করে নিশ্চিত হওয়া গেল জামাত শেষ হলেও আর কিছুক্ষণ থাকতে হবে। নফল নামাজ পড়বে, কোরআন তেলাওয়াত করবে, তারপর গাড়িতে যাবে।
আজ জুম্মা পড়াল একজন তুরস্কের ইমাম। দেখতে বেশ ফর্সা। একেক দেশের ইমাম একেক ভাবে খুৎবা পড়ে। খুৎবার আগে না রকমের দ্বীনের গল্প বলে। এই ভদ্রলোকের গল্প অন্য ধরণের, টেসলা না কিনে আল্লাহর পথে বেশি বেশি দান করতে বললেন। আমেরিকাতে কখনো জুম্মার পর মোনাজাত করতে দেখেনি। খুৎবা শেষ হলে ইমাম কেমন যেন একটা দোয়া পড়েন। পাক-ভারতের লোকজন হাত তূলে। কিন্তু বাংলাদেশের স্টাইলে জামাতের পর দোয়া হয় না।
জুম্মা শেষ হতে লোকজন চলে যেতে শুরু করল। আস্তে আস্তে মসজিদ ফাঁকা হতে থাকল। এক সময় মসজিদের ভেতরে কয়েকজন বয়স্ক লোক ছাড়া আর কেউ রইল না। এবার বের হয়ে এলো নাদিম। মসজিদের ঠিক বাইরে লাঞ্চ বিক্রি করে কয়েকজন মহিলা। দুই প্যাকেট লাঞ্চ কিনল নাদিম। আজ আর খাবারের চিন্তা করতে হবে না।
বাইরে সে দেখল মসজিদের সামনে লোকজন নেই বলেই চলে। অনেক দূরে ওর গাড়িটা একা পরে আছে। হাঁটতে শুরু করবে, এমন সময় মেয়েটার উপর চোখ নাদিমের। একটা বেঞ্চিতে একা বসে আছে। পায়ের শব্দ পেয়ে নাদিমের দিকে তাকাল, চোখ ফিরিয়ে নিলো। ভীষণ বিষণ্ণ চাউনি। পরনে ঘাগরা-চোলি, মাথায়-শরীরে চাদরের মতো করে ওড়না পেঁচানো। পর্দা করেছে, কিন্তু হিজাব পরা না। চেহারা দেখে পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবি মনে হয়। আরব দেশের মেয়ে না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। চাকরি থাকলে দ্বিতীয়বার তাকাত না নাদিম, হেঁটে চলে যেত। কিন্তু হাতে কাজ না থাকায় একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, মে আই হেল্প ইউ?
কথাটা শুনে ফিরে তাকাল মেয়েটা। ভীষণ বিরক্ত চাউনি। যেন নাদিম যেচে কথা বলাতে মেজাজ খারাপ হয়েছে। জবাব দিল না মেয়েটা। মুখ ফিরিয়ে যেদিকে তাকিয়ে ছিল, সেদিকে তাকিয়ে থাকল।
মেয়েটার সাথে কথা বলায় এবার নিজের উপর রাগ হলো নাদিম। এরকম যেচে পড়ে কথা বলা উচিত হয়নি। নিজের মান-সম্মান নষ্ট হলো। গাড়িতে ফিরে এলো। স্টার্ট দিয়ে যেয়ে দেখল স্টার্ট নিচ্ছে না, মনে হয় ব্যাটারি ডাউন। সাথে ব্যাটারি চার্জার ছিল, চার্জ দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই মেয়েটাকে দেখতে পেলো। পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছে। গাড়ির হুড নামাতেই মেয়েটা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ক্যান ইউ প্লিজ গিভ মি এ রাইড?
অত্যন্ত ভাঙ্গা ভাঙ্গা দুর্বল ইংরেজি। মনে হয় ইংরেজি বলতে পারে না। মাত্র কয়েকটা কথা শিখে কাজ চালাচ্ছে। এই একটা লাইন বলতে যেন জান বের হয়ে যাচ্ছিল।
চাকরি না থাকায়, হাতে সময় থাকায়, মন মেজাজ অন্য রকম ছিল। কোনো চিন্তা না করেই জবাব দিল, ওকে। সিউর। কোথায় রাইড দিতে হবে?
কথা না বলে ফোনে একটা অ্যাড্রেস দেখাল মেয়েটা। জিপিএস এ অ্যাড্রেস দেখে ভয় পেলো নাদিম। বাল্টিমোরের একদম কালো এলাকা, ওদিকে সহজে যায় না নাদিম। কিন্তু দিনের বেলায় অন্য কথা। মেয়েটাকে সাথে নিয়ে বাল্টিমোরে গেল নাদিম। পুরানো, ভাঙ্গাচোরা বাড়ি, এদিকে ক্রাইম বেশি হয়। মেয়েটা বাড়ির সামনে আসতেই বলল, প্লিজ, কাম।
এই কথার মানে সাথে যেতে বলছে। একজন কালো লোক বারান্দায় বসে এই ভর দুপুরে ড্রিঙ্ক করছে। দেখে ডাকাত ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। গা ছমছম করে উঠল নাদিমের। এ কোথায় এলাম?
দরজা খুলে ভিতরে এলো মেয়েটা। অতি দ্রুত কিছু জিনিস ব্যাগে ভরল। তারপর আগে থেকে গুছিয়ে রাখা দুটা সুটকেস দেখিয়ে বলল। প্লিজ, টেক এন্ড গো।
মেয়েটার ভাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু জিনিস পত্র নিয়ে পালাচ্ছে। নাদিমের নিজেরও ভীষণ ভয় করছিল। দুই হাতে দুই সুটকেস নিয়ে গাড়ির দিকে উড়ে চলল। দ্রুত সুটকেস দুটা গাড়িতে তুলল। নিরাসক্ত চোখে মাতাল লোকটা সব দেখল, কিন্তু কিছু বলল না। আরো আয়েসের সাথে বোতল থেকে গলায় ঢালতে থাকল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত এলাকা ছেড়ে আবার সিকিউরিটি বুলেভার্ডে ফিরে এলো। এবার মনে শান্তি ফিরে এসেছে। একটা পারকিং এ গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?
ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে মেয়েটা বলল, আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
— কী নাম তোমার? জিজ্ঞেস করল নাদিম।
— মাই নেম সায়রা বানু। আই এম ফ্রম রাজস্থান। স্পিক নো ইংলিশ, অনলি রাজস্থানি।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে