#নিভৃতে_তেজস্বিনী
#পর্ব_১৪
#লেখায়_নামিরা_নূর_নিদ্রা
“আমরা আর আপনার ফ্যাক্টরিতে কাজ করব না স্যার।”
“হঠাৎ করে কেন তোমরা এমন করছ?”
“আপনি নিয়মিত আমাদের পারিশ্রমিক দেন না। তাছাড়া আমাদের সাথে ভালো ব্যবহারও করেন না। এমন মানুষের সাথে আমরা কোনো কাজ করব না।”
“আজ থেকে আমরা আপনার সাথে কাজ করা বন্ধ করে দিলাম। আগে নিজের ব্যবহার ঠিক করুন। তারপর ব্যবসা করতে আসবেন। আসি স্যার!”
শ্রমিকদের কোনো কথায় যেন বুঝতে পারে না মাহতাব। তারা মা*থা ঘুরছে। কোনো রকমে চেয়ারে বসে সে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। আজ থেকে তার ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এখানে তো আর কোনো শ্রমিকই নেই। কীভাবে চলবে এই ফ্যাক্টরি!
গত এক মাস যাবত তার সাথে যা হচ্ছে সব খারাপ হচ্ছে। ব্যবসায় একের পর এক লস, এরপর শ্রমিকদের দল বেঁধে চলে যাওয়া। সবকিছু মিলিয়ে মাহতাব মুহূর্তের মধ্যেই যেন মিশে গেল মাটির সাথে।
সারাদিন আর বাসায় ফেরে না মাহতাব। একটা বারে বসে ম*দ্যপান করে ঘন্টার পর ঘন্টা। পাশেই তার কয়েকজন বন্ধু বসে আছে। তুরাগ নামের একজন প্রশ্ন করে,
“হঠাৎ করে তোর এমন দুরাবস্থা হলো কীভাবে?”
মাহতাব মা*তাল কণ্ঠে উত্তর দেয়,
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না রে। কয়েক মাস আগেও সব ঠিক ছিল। আমি নিমুকে বিয়ে করার পর থেকেই আমার জীবনে নেমে এলো বিপর্যয়।”
“কিন্তু তুই তো বলেছিলি তোর বউ অনেক ভালো। তোদের তো একটা মেয়েও আছে।”
“নিমু আমার দ্বিতীয় স্ত্রী!”
“কী বলছিস তুই? দ্বিতীয় স্ত্রী মানে? তুই আরেকটা বিয়ে করলি কবে?”
“এই বিয়েটা এক প্রকার বাধ্য হয়েই করেছি আমি।”
মাহতাবের কথার মানে কেউই বুঝতে পারে না। রবিন নামের একজন জিজ্ঞেস করে,
“ঘটনা কী বল তো?”
“শোন তাহলে। প্রায় দেড় বছর আগে অনলাইনে নিমুর সাথে পরিচয় হয় আমার। প্রথম প্রথম তেমন কথা হয়নি। একদিন ওর ছবি দেখে প্রশংসা করি আমি। সেই থেকে নিয়মিত কথা শুরু হয় আমাদের। সিরাত আমার প্রথম স্ত্রী। ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু তারপরেও আমি নিমুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। নাবিহা হওয়ার পর সিরাতের মনমেজাজ প্রায় সময় খিটখিটে হয়ে থাকত। আমার কাছে আসতে চাইত না সহজে। ফলে ওর প্রতি ক্রমশ আগ্রহ হারিয়ে ফেলি আমি। নিমু রাজশাহীর মেয়ে। একদিন ওকে আমি দেখা করার কথা বলি। নিমুও রাজি হয়ে যায়। আমি সিরাতকে অফিসের কাজের কথা বলে চলে যাই রাজশাহী। প্রথম দেখাতেই আমরা একে-অপরের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসি। এরপর প্রায়ই ওর সাথে দেখা করতে যেতাম আমি। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। এক রাতে নিমু আমাকে কল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওর বাসায় ঘনঘন ছেলে মানুষকে আসতে দেখে বাড়িওয়ালা এবং পাড়াপ্রতিবেশি ঝামেলা করছে। এখন ওকে বিয়ে না করলে ওর বাঁচা কঠিন হয়ে যাবে। আমি যদি ওকে ভালোবাসি, তাহলে যেন বিয়ে করি। আবেগের বশবর্তী হয়ে আমিও ওকে বিয়ে করে ঢাকায় নিয়ে আসি। এসবের কারণে সিরাতের সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় শেষ হয়ে যায়। তার উপর বাবা রাগ করে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমার ব্যবসার উপরেই সংসার চলছিল। এখন ব্যবসাও বন্ধ। আমি তো পথে বসে গেলাম!”
বিরতিহীনভাবে কথাগুলো বলে থেমে যায় মাহতাব। অতিরিক্ত নে*শার ফলে ঠিকমতো চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না সে। সব শুনে তুরাগ বলে,
“সুখে ছিলি, সেটা পছন্দ হলো না তোর। তাই খাল কেটে কু*মির আনলি ঘরে।”
মাহতাব কিছুই শুনতে পায় না। ঢলে পড়ে রবিনের গায়ে। তুরাগ সেদিকে তাকিয়ে বলে,
“চল ওকে ওর বাসায় দিয়ে আসি।”
“তুই মাহতাবের বাসা চিনিস?”
“একদিন ঠিকানা দিয়েছিল। আগে কখনো যাইনি।”
“ঠিকানা যখন আছে তাহলে চল।”
বাসার সামনে এসে কলিংবেল বাজাতেই নিমু এসে দরজা খুলে দেয়। সিরাত রান্নাঘরে ছিল। মাহতাবকে মা*তাল অবস্থায় দেখে নিমু জিজ্ঞেস করে,
“ওর এই অবস্থা হলো কীভাবে? আর আপনারা কে?”
নিমুর প্রশ্নের জবাবে তুরাগ বলে,
“আমরা মাহতাবের বন্ধু। আসলে আজকে বেশি খেয়ে ফেলেছে। এজন্য নিজেকে সামলাতে পারেনি। তাই আমরা নিয়ে এলাম ওকে।”
“আচ্ছা ওকে ঘরে নিয়ে চলুন। আসুন আমার সাথে।”
মাহতাবকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে দু’জন।
“আপনাদের ওয়াশরুম কোনদিকে? একটু চোখেমুখে পানি দিতাম।”
নিমু তুরাগকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলে সে গিয়ে চোখেমুখে পানি দেয়। ওয়াশরুমের পাশেই রান্নাঘর। তুরাগ বের হওয়ার সময় রান্নাঘরে সিরাতকে দেখে চমকে ওঠে। তাড়াতাড়ি রবিনকে নিয়ে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। যাওয়ার আগে নিমুকে বলে যায়,
“মাহতাবকে বলবেন আমার সাথে যেন আগামীকাল দেখা করে৷”
এত তারাহুরো করে বাসা থেকে বের হতে দেখে রবিন তুরাগকে প্রশ্ন করে,
“কী হলো? এভাবে বেরিয়ে এলি কেন?”
“মাহতাব আগামীকাল দেখা করুক। তারপর একসাথে বলব তোদের।”
“এই হঠাৎ করে কী হলো তোর বল তো?”
“বললাম তো এখন কিছু বলতে পারব না। আগামীকাল বলব। এখন চল তো এখান থেকে।”
তুরাগের এমন ব্যবহারের কারণ বোধগম্য হয় না রবিনের। অগত্যা সে চুপচাপ হেঁটে নিজের বাড়ি চলে যায়।
সকালে সূর্যোদয় হওয়ার পর গোসল করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সিরাত। পাশাপাশি মেয়েকেও তৈরি করে দেয়। সিরাতের চুলগুলো কোমড়ের নিচ অবধি হওয়ায় চুল শুকাতে সময় লাগে। এদিকে হিজাব ছাড়া বের হয় না সে। তাই ভেজা চুলগুলো বেঁধে নেয়। তার উপর হিজাব বেঁধে নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে নাবিহাকে কোলে নিয়ে বের হয়ে যায় সে। এত সকালে সিরাতকে বের হতে দেখে নিমু অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলে না।
ঘড়ির কাঁটা যখন আটটার ঘরে, তখন সিরাত বসে আছে আলিশান এক বাড়িতে। আসার সাথে সাথে তাকে কফি দেওয়া হয়েছে। বাচ্চার জন্য খাবার দেওয়া হয়েছে। সিরাত কফির কাপে চুমুক দিয়ে অপেক্ষা করে একজনের জন্য। কিছুক্ষণ পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সে। সালাম দিয়ে বলে,
“আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন প্লিজ।”
সিরাত সোফায় বসলে ঠিক তার মুখোমুখি বসে ব্যক্তিটি। কিছু একটা ভেবে সিরাত মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,
“মিস্টার ফাইয়াজ রাহমান আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য।”
ফাইয়াজ রাহমান নিজের জন্য রাখা কফিটা হাতে নিয়ে বলে,
“ঠিক কীসের জন্য?”
“মাহতাবের ব্যবসায় লালবাতি জ্বা*লানোর জন্য।”
সিরাতের কথায় হো হো করে হেসে ওঠে ফাইয়াজ। ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখে বলে,
“তার মতো একজনের জন্য তো এমন কিছুই প্রাপ্য তাই না?”
“ওর কাজের সূত্র ধরেই আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু কখনো ভাবিনি আমার হয়ে কাজ করবেন আপনি। আপনার এই সাহায্যের কথা আমি সত্যিই ভুলব না।”
“মিস্টার ফাইয়াজ রাহমান লাভ ছাড়া এক পা আগায় না। আপনি আমার ব্যবসায় সফলতা আনতে সাহায্য করেছেন। তাই আপনার বিপদে পাশে দাঁড়ানো আমার দায়িত্ব। এখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই।”
“আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে আপনি অবগত তো?”
“হ্যা হ্যা নিশ্চয়। চিন্তা করবেন না সিরাত। আমি আপনার পাশে আছি।”
“আমরা তাহলে আগামী সাত দিনের মধ্যেই কাজ শুরু করি?”
“যেমনটা আপনার ইচ্ছা।”
“আজ তাহলে উঠি। আমাকে এখান থেকে আরেক জায়গায় যেতে হবে।”
“আপনি চাইলে সকালের নাস্তা আমরা একসাথে করতে পারি।”
“আজ নয়, অন্য একদিন নাস্তা করব। আসি।”
ফাইয়াজ রাহমানের সাথে দেখা করে বের হওয়ার সময় সিরাত নাবিহার কপালে চুমু খেয়ে বলে,
“তোমার মাম্মা যা করছে তাতে হয়তো তুমি তোমার মাম্মাকে সাময়িক সময়ের জন্য ভুল বুঝবে। কিন্তু বড়ো হয়ে একদিন অবশ্যই আমাকে ধন্যবাদ দেবে।”
চলবে??