নিপার কথা আমি কখনো ভুলব না।

0
1216

নিপার কথা আমি কখনো ভুলব না। অন্যরকম একটা মেয়ে ছিল ও। আমি ওকে প্রাইভেট পড়িয়েছি চার মাস। তখন আমি বুয়েটে পড়ি, ফাইনাল ইয়ারে। বুয়েটে ঢোকার পর থেকেই প্রচুর টিউশনি করিয়েছি, ভাল টিচার হিসেবে কিছুটা নামডাকও ছিল। কিন্ত ফাইনাল ইয়ারে এসে সবকিছু ছেড়ে পড়াশোনায় দিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম। এসময় একদিন আমার রুমমেট ফারাবী আমার কাছে এসে ওর কাজিন নিপাকে পড়ানোর কথা বলল। বলল ওর মামা নিপাকে শুধু অংক করানোর জন্য কাউকে খুঁজছেন। শর্ত হচ্ছে ফাইনালে কমপক্ষে ওকে ৮০ নাম্বার পাওয়াতে হবে বিনিময়ে মোটা অংকের সন্মানী দিবেন তিনি। ফারাবীর মামা বিশাল ব্যাবসায়ী, গুলশানে আলিশান বাড়ী। আমি চিন্তা করলাম আমার সবচেয়ে খারাপ ছাত্রীও অংকে ৯০ পেয়েছে, ৮০ পাওয়ানো তো কোন ব্যাপারই না আর এই একটা টিউশনি আমাকে চারটা টিউশনির সমান ইনকাম দিবে, পড়াশোনার তেমন কোন ক্ষতি হবেও না, রাজী হয়ে গেলাম।

প্রথমদিনই মামার সাথে কথা হলো। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তার খুবই চিন্তা এবং স্বপ্ন।

– দেখ, আমার মেয়েকে আমি ডাক্তার বানাবো, মেয়েটা ছাত্রীও ভাল কিন্ত অংকটা বোঝে না। ক্লাস এইটের ফাইনালে অংকে কমপক্ষে ৮০ না পেলে সায়েন্সই পাবে না। হাফ ইয়ার্লিতে ও সবগুলো সাবজেক্টে ৮০র উপরে পেয়েছে কিন্ত অংকে ফেল করেছে! তুমি বুঝতে পারছ, তোমার চ্যালেন্জটা কেমন হবে?

– আমি চ্যালেন্জ পছন্দ করি, স্যার।

– ঠিক আছে, ওর ফাইনাল পরীক্ষার কিন্ত মাত্র চার মাস আছে, কবে থেকে শুরু করতে পারবে?

– কাল থেকেই শুরু করি?

– ঠিক আছে। তোমার সময় শুরু।

পরদিন নিপার সাথে প্রথম দেখা হলো। খুব চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের মেয়ে কিন্ত খুব স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। প্রথমদিন একটু হালকা চালেই শুরু করলাম।

– আচ্ছা বলোতো, দুই আর দুইয়ে যোগ করলে কি তিন হয়?

– হয়, স্যার।

উত্তরটা শুনে আমি একটু ভড়কে গেলাম। ক্লাস এইটের ছাত্রী এটা কি বলল!? তারপরও জিগ্গেস করলাম,

– কিভাবে? বোঝাও।

– স্যার ম্যাথম্যাটিকালি যোগ করলে হবে না, লজিকালি চিন্তা করলে হবে।

– মানে?

– ধরেন, আপনি আর আমি মিলে দুইজন, আমি আর বাবা মিলে দুইজন। ম্যাথম্যাটিকালি দুইজন আর দুইজনের যোগফল চার কিন্ত লজিকালি তো তিন!

অন্যরকম চিন্তাভাবনা!খুবই ইমপ্রেসড হলাম আর ওর সাথে সম্পর্কটা খুব তাড়াতাড়ি ইজি হয়ে গেল। নিপা জিগ্গেস করল-

– স্যার, আমরা অংক শিখি কেন?

– অংক শিখলে জীবনে অনেক সমস্যা সমাধান করা যায়।

– স্যার, ক্যালকুলাস আপনার জীবনে কোন সমস্যার সমাধান করেছে?

ধাক্কা খেলাম। পড়াশোনার বাইরে ক্যালকুলাস দিয়ে লাইফের কোন সমস্যার সমাধান করেছি মনে করতে পারলাম না। ক্যালকুলাসের সন্মান বাঁচাতে আমি ওকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

– তুমি সব সাবজেক্টে এত ভাল কিন্ত অংকে ভাল নাম্বার পাওনা কেন?

– আমি অংক বুঝিনা।

– অংক বুঝতে হবে এটা কে বলল?

– সবাই তো তাই বলে।

– বাজে কথা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কে কতটা শিখল বা বুঝল সেটা গুরুত্ব দেয় না, গুরুত্ব দেয় কে কতটা মুখস্ত করতে পারল সেটা। তোমার অংক বোঝার দরকার নেই, মুখস্ত করো, তোমার বাবার স্বপ্ন সফল হয়ে যাবে।

নিপা বইয়ের সব অংক মুখস্ত করে ফেলল পরের তিনমাসের মধ্যে। বলা বাহুল্য ফাইনালে ও সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল আর আমাকেও চ্যালেন্জে জিতিয়ে দিল। ওর বাবা খুবই খুশি হয়ে আমাকে বললেন-

– তুমি ওকে পড়ানোটা কন্টিনিও করো, এসএসসি পাশ করিয়ে দাও।

– না, স্যার। সামনে আমার পরীক্ষা, আর কোন টিউশনি করব না। তবে স্যার, একটা অনুরোধ করতে পারি?

– নিশ্চয়ই।

– স্যার, নিপাকে ওর পছন্দের সাবজেক্টে পড়তে দিয়েন, জোর করে কোন কিছু চাপিয়ে দিয়ে ওর প্রতিভা নষ্ট করে দিয়েন না।

নিপার বাবা কথা দিয়েছিলেন। মোবাইল যুগের আগের ঘটনা তাই এরপর নিপার সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। আজ হঠাৎ প্রায় পচিশ বছর পর ওর সা্থে দেখা, সুপ্রিম কোর্টে। জমিজামার একটা কেস নিয়ে কোর্টের করিডোরে দাড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ একজন কালো কোট পড়া মহিলা আমার সামনে এসে দাড়ালো-

– স্যার, চিনতে পারছেন?

– আমার কোন স্টুডেন্ট বুঝতে পারছি কিন্ত ঠিক চিনতে পারছি না।

– স্যার, আমি নিপা!

– নিপা! তোমার না ডাক্তার হবার কথা ছিল?

– হ্যা, স্যার। কিন্ত বাবা আপনাকে কথা দিয়েছিল আমাকে আমার মতো পড়তে দিবে, ওনি কথা রেখেছেন। আমি এখন ব্যারিস্টার এবং বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে আইনগত পরামর্শ দেয়ার জন্য সর্ব কনিষ্ঠ আইনজীবী এবং আইনজীবী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক। আপনার একটা ছোট পরামর্শ আমাকে কতটা সাফল্য দিয়েছে, দেখেছেন স্যার।আপনি বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু কে কতটা মুখস্ত করতে পারল সেটারই মূল্য দেয়, দেখেন স্যার তাই দিয়েছে! আমি আজকে সাদা এপ্রোন না পড়ে কালো কোট পড়ে দাড়িয়ে আছি! অনেক খুজেছি স্যার আপনাকে একটা কথা বলার জন্য, পাইনি। আজ যখন পেয়েছি কথাটা বলতে চাই।

– কি কথা?

– ধন্যবাদ, স্যার!

– আমাকে না, সিস্টেমকে ধন্যবাদ দাও। এই সিস্টেম তোমাকে তুমি করেছে ঠিকই কিন্ত আরো কত নিপাকে নিপা হতে দিচ্ছে না কে জানে? তুমি তো পরামর্শক, জায়গামতো একটা পরামর্শ দিতে পার না!?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে