নিজ গৃহে পরবাসী

0
645

রোকেয়া শোন, তুমি যদি ভালোভাবে আমার ছেলেমেয়ের সাথে কথা না বলতে পারো তবে ওদের ডাক দোহাই দেবার দরকার নেই। কত হাজার মানুষ মা ছাড়া বড় হয়, ওরা দুভাইবোনও এমনিতেই বড় হবে। যদি ওদের মেনে নিতে কষ্ট হয় তবে চাইলে তুমি তোমার বাবার বাড়ি ফিরে যেতে পারো।’

আমার স্বামীর এ কথা শুনে আমার পুরো শরীর যেন কেঁপে ওঠে। কি বলেছি আমি বাচ্চা দুটোকে যে ওকে এভাবে বাচ্চাদের সামনেই আমাকে শাসন করতে হবে? বিয়ে করে যখন এনেছিল তখন তো বলেছিল আমিই ওদের মা। আদরে শাসনে নিজের সন্তানের মত যেন পালন করি। সেই আমি যখন সামান্য শাসন করলাম সেটাতেই বাবা হিসেবে ভোল পাল্টে ফেললো?

রাগ করে দুপুরে ভাত খাইনি। কি অদ্ভুত একজন কেউ জানতে পর্যন্ত চাইলোনা আমি ভাত খাবো কি না? চোখের পানিতে বালিশ ভিজলো আর মনের ভেতর এক জীবনের জমানো ক্ষোভেরা বুঝি সঙ্গী হলো সেই অশ্রুজলের।

পাঁচ ভাইবোনের সংসারে আমার অবস্থান তৃতীয়। ওপরে দুই ভাই আর আমার পরে আরো দুইবোন। এক ছোট্ট মফস্বল শহরে আমার বেড়ে ওঠা। সেই ছোটবেলা থেকে কি ভীষণ শাসনের মাঝে কেটেছে দিন। তুই বড় মেয়ে তাই এটা করতে পারবিনা, তুই মেয়ে তাই এটা করা বারণ, তুই ঘর থেকে একা বের হবিনা, তুই মাঠে খেলতে যাবিনা, স্কুল থেকে একা আসবিনা, বোরকা ছাড়া বের হবিনা। এ যেন এক নিয়মের পৃথিবীতে এক জড়বস্তুর অবস্থান। যে তার বানিয়ে দেয়া নিয়মের বাইরে যেতে পারবেনা। পারবেনা নিজের মত করে কিছু ভাবতে। মেয়েলোকের বেশী পড়তে হবেনা, ঘরের হাড়ি ঠেলার জন্য এতো বিদ্যাদিগগজ হয়ে লাভ কি ইত্যাকার কথার মাঝেও কিভাবে কিভাবে যেন কলেজের চৌকাঠ পর্যন্ত চলে যাওয়া হয় আমার। হয়তো রোগা প্যাকাটি মার্কা ছিলাম বলে বিয়ে দেয়া যায়নি আগেভাগে, তাই বসে না থেকে পড়ুক ধরনের অবস্থা। অনার্সে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম খুব। সুযোগ মেলেনি বাসা থেকে। তবু কান্নাকাটি করায় বাড়ির কাছের ডিগ্রী কলেজে পড়ার সুযোগ মেলে।

ডিগ্রী পাস করার পরে বাবা মায়ের মাথা নষ্ট হওয়ার যোগাড়। আমার যে বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বাকী বোনদের কি হবে? নাহ এ বেলা তেমন একটা কষ্ট পেতে হয়না। পাত্র যেন এ বেলা তৈরীই ছিল। ভালো চাকুরে, শহরে থাকে। আপাতত আমি কিছুদিন গ্রামে থাকবো। তারপর আমার স্বামী একটু গুছিয়ে নিলেই শহরে চলে যাব। নিজের একটা সংসার হবে। স্বামী রাজী থাকলে হয়তো একটা চাকুরী করার অনুমতিও পেয়ে যেতে পারি। আমার স্বপ্নগুলো খুব বড় কিছু ছিল বোধহয়। আর তাই বিয়ে হলেও শহরে যাবার সে স্বপ্ন আমার পূরণ হয়না। কয়েক ঘন্টার নোটিশে আমার স্বামী মারা যায় বিয়ের কয়েক মাস না ঘুরতেই। হার্ট এটাক। ওর নাকি ছোটবেলা থেকেই হার্টের সমস্যা ছিল। বিয়ের আগে জানায়নি।

আমার ভাইয়েরা শুরুতে খুব চিল্লাফাল্লা করে আমাকে ঠকিয়েছে বলে। আমি কাউকেই কিছু বলিনি। যে মানুষটার সাথে একজীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই যখন বেঁচে নেই তখন কথা বাড়িয়ে কি লাভ? সৃষ্টিকর্তার সাথে তো আর ঝগড়া করা যায়না। শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসি বাবার বাড়ি। আমার ঘর বলে যে ঘরটা ছিল সেটা আমার বিয়ের পরপরই দখল হয়ে গেছে একভাইয়ের দ্বারা। বাবাবাড়িতে আমার উপস্থিতি বিয়ের পরপর কয়েকদিনের জন্য আনন্দের হলেও একবারে চলে আসাটা আর আনন্দের থাকেনা। নিজের ঘরে এসেও যেন আমার ঘর না এটা। যেন বিয়ে হওয়ার সাথে সাথে আমি হারিয়েছি বাবাবাড়ির ঠিকানা। এখন বুঝি জোর করে থাকতে এসে অনধিকার চর্চা করে ফেলেছি। ঘরের সব কাজ সামলে সবার খেয়াল রেখেও যেন কাউকেই সুখী করতে পারতামনা। সবাই যেন শুধু আমার ওপরেই বিরক্ত। এমনকি আমার ছোটবোনকে দেখতে এলেও আমার সামনে যাওয়া নিষেধ ছিল।

একটু মুক্তি, একটু অন্য কোথাও পালিয়ে যাবার তীব্র আকাঙ্খায় দ্বিতীয় বিয়েতে রাজী হই। ঐ ঘরে দুজন বাচ্চা আছে জেনেও আমি তখন মরিয়া। এই বাড়ি থেকে পালাতে পারলে বাঁচি। নিজের মানুষগুলোর এমন ব্যবহার আমি আর নিতে পারছিলামনা। বিয়ের রাতে শাহাদাত যখন বলে আমার বাচ্চাগুলোকে দেখে রেখো, আজ থেকে তুমিই ওদের মা; আমি খুশীমনে ওদের জড়িয়ে ধরেছিলাম। যত্নের কোন ত্রুটি আমার দিক থেকে আমি করেছি বলে আমার মনে পরেনা। একসাথে থাকতে গেলে বাচ্চাদের কি সবসময় আদর করা যায়, না তারা সবসময় আদুরে ডাকে পোষ মানে? শাহাদাত বলেছে আমি ওদের মা, সেই বোধ থেকেই শাসন যে করি প্রয়োজন হলেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি নিজের বাচ্চাকে শাসন করা আর অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা ভেবে শাসন করার মাঝে অনেক ফারাক। আর সেজন্যই বুঝি আজ শাহাদাত এতোগুলো কথা শুনিয়ে দিল। আচ্ছা আমি কি খুব বেশী খারাপ ব্যবহার করেছি ওদের সাথে? কি জানি হতেও পারে।

সেই বিয়ের প্রথমদিন থেকে আমাকে রোজ যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে এক মৃত চরিত্রের সাথে। আমার প্রতি মূহুর্তে তুলনার শিকার হতে হচ্ছে এমন একজন চরিত্রের সাথে যার পৃথিবীতে এখন সশরীরে অস্তিত্বই নেই। একজন জীবিত মানুষের মতই কি আরেকজন কেউ হতে পারে? কথায়, কাজে কিংবা ব্যবহারে? সেখানে নিত্যদিন মৃত মানুষটি কেমন ছিল, কেমন করে সংসার করতো, কিভাবে বাচ্চা পালতো এসব কথা শুনতে শুনতে আমার প্রায়শই ইচ্ছে করতো বলতে ঐ মানুষটি কি কোন মহামানবী ছিল? তার মধ্যে কি কোন রাগ, ক্ষোভ, হতাশা ছিলনা? সেগুলো যদি আশেপাশের বাকীরা যারা বেঁচে আছে তারা মেনে নিতে পেরেছে তবে আমার এই সামান্য শাসন কেন এতো প্রশ্নের শিকার হবে?

মাথার ওপরে আলতো হাতের স্পর্শে চমকে উঠে বসি। আমার শাশুড়ি মা এসে বসেছেন পাশে।

– চল, ভাত খাবি।

খিদে নেই মা।

– মেয়েলোকের রাগ থাকতে নেই জানিস? ভাতের রাগতো আরো থাকতে নেই।

আমিতো মা বাচ্চাগুলোকে নিজের বলেই মেনে নিয়েছি। এই সংসারটাকে আপন করার প্রানপন চেষ্টা করেছি তবে কেন আজ চলে যাওয়ার কথা উঠলো? এ ঘর কি তবে আমার ঘর না?

– হুম তোর ঘর, আবার তোর ঘরও না। মেয়েলোকের জীবন হলো অনেকটা স্বর্ণলতার মত। যে কদিন বাপের ঘরে থাকে ঘর আলো করে জুড়ে থাকে। বিয়ে দিয়ে বাবা লতাটা তুলে দেয় অন্য গাছে। সেই ঘরে যতদিন স্বামী থাকে ততদিন হয়তো কিছুটা স্বস্তি, খানিক বোধহয় শান্তিও থাকে।তারপর সেই লতার জায়গা হয় ছেলের ঘরে। সে ঘরে টিকে আছি সেই শান্তি থাকলেও স্বস্তি কিন্তু কখনোই থাকেনা। কারণ ওখানে যে তখন আরেক লতার আবাস। মেয়েলোক এক জীবন নিজ গৃহে পরবাসীর জীবন কাটিয়েই যায়, বেঁচে থাকতে হয় বলে। যদি চলে গেলে সেখানে শান্তিতে থাকবি এমন গ্যারান্টি থাকতো তবে বলতাম, চলে যা। পৃথিবীতে টিকে থাকাটাই যখন মুখ্য তখন যেভাবে স্বস্তিতে থাকা যায় সে চেষ্টা করে যাওয়াই কি উচিত নয়?

আপনিও কি তবে আমার মতই স্বর্ণলতা?

– সেটা তুই যা বোঝার বুঝে নে।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে