নাপুরুষ পর্ব-১০

0
1208

#নাপুরুষ
#১০ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



রুপা এখন বাবার বাড়িতে। সাথে লায়লাও আছে।সে কথা দিয়েছিলো তিন চারদিন থাকবে। কিন্তু এখানে আসার পরদিনই গন্ডগোল বেঁধে গেল। সুফলা ফোন দিয়ে তাকে ভয়ংকর সংবাদটি দিলো।বললো,মিম্মির বাবা এরেস্ট হয়েছে। ওই ছেলে মিম্মির বাবার নাম বলে দিয়েছে। অপহরণের চক্রান্তের মূল হোতা হিসেবে তাকে এরেস্ট করা হয়েছে। সুফলা লায়লার কাছে ফোন দিয়ে প্রথমে কেঁদেছে। এরপর ইচ্ছে মতো বকাবকি করেছে।বলেছে, ‘তোমার জন্য শুধু এই পরিস্থিতি।মিম্মির বাবার কিছু হলে তোমারে আমি ছাড়বো না।আমি আদালতে গিয়ে বলবো,এর মূল হোতা তুমি। তুমিই এই নাটক সাজিয়েছিলে!’
সুফলা কমই বলেছে তার মায়ের কাছে। আসলে সে নিজেও জানে না তার স্বামী যে কত বড় বিপদের মুখে পড়েছে।মিম্মির বাবার ঠিক করা ছেলেটি যে মেয়েকে রুপা মনে করে ওসব অপবাদ দিয়েছিল সেই মেয়ে সামান্য কারোর মেয়ে নয়। সেই মেয়ে স্থানীয় মেয়রের ভাতিজি। এছাড়াও মেয়ের বড় ভাই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের বড় পদে অধিষ্ঠিত।তার কথায় শহরের লোকজন কান ধরে উঠবোস করে। ওদের মতো পরিবারের কারোর রিক্সা করে যাওয়ার কথা না কোথাও। কিন্তু ওই মেয়েরও রুপার মতো রিক্সা পছন্দ।সে তার মাকে নিয়ে মার্কেট যাবে বলে রিক্সা করে বেরুলো।আর শখ করে শাড়িও পরলো।মিম্মির বাবার ঠিক করা ছেলেটা জল ভেবে তরল হয়ে থাকা উত্তপ্ত শিশায় হাত দিয়ে বসলো। এবার এর পরিণাম কতোটা ভয়াবহ তা টের পাবে!

লায়লা মেয়ের সাথে কথা বলার পর থেকেই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। তার মাথায় কোন বুদ্ধি আসছে না। আসলে কী করতে গিয়ে যে কী করে ফেলেছে ওরা কিছুই বুঝতে পারছে না। এখানে থাকাও তো এখন সম্ভব না। মিম্মির বাবা এরেস্ট হয়েছে। সুফলা এ নিয়ে চিন্তিত।মেয়েটা একা কী করছে না করছে কে জানে!
এসব যখন সে ভাবছিলো ঠিক তখনই আবার ফোন করে সুফলা। ফোন করে বলে,’মা আমি আমার শশুর বাড়িতে চলে আসছি। তুমি আজ বাসায় চলে আসো। তারপর বাসা থেকে এখানে চলে আসবে। আমার শশুর বাড়িতে।
লায়লা বেগম বললো,’আচ্ছা।’
লায়লা বেগম ফোন কেটে দিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো।সে ভাবলো এখানে সত্যিটা বলবে কি না। তারপর বলেই দিলো। যদিও একটু ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বলেছে।সে রুপার মার কাছে বললো,’আমার মেজো মেয়ের হাসব্যান্ড একটা মিথ্যা মামলায় এরেস্ট হয়েছে। এক্ষুনি আমাদের চলে যেতে হবে।’
রুপা কথাটা শুনে আঁতকে উঠলো।সে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,’মিম্মির বাবা?’
লায়লা বেগম বললো,’হ্যা মা। এক্ষুনি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেও!আমি ড্রাইভারকে ফোন করেছি।ও এক্ষুনি এসে পৌঁছে যাবে।’
রুপা সবকিছু দ্রুত করছে। এখানে তিন চারদিন থাকার ইচ্ছেটা মরে গেছে একেবারে।তার সহজ সরল মন তো আর জানে না মিম্মির বাবা তাকে নিয়ে এক ভয়ানক চক্রান্ত করেছিল।জানে না বলেই সে মনে মনে মিম্মির বাবার জন্য দোয়া করতে লাগলো।বলতে লাগলো, আল্লাহ , মিথ্যে মামলায় এই মানুষটিকে তুমি জেলের ভেতর কষ্ট দিও না!

বাসায় পৌছে যাওয়ার পর ঘটে আরেক কান্ড।যে ছেলে কখনও কথায় বলে না সেই ছেলে আজ রেগেমেগে আগুন হয়ে তার মাকে অনেকগুলো কথা বলে ফেললো। সেই ছেলেটি আর কেউ না।পৃথুল।পৃথুল তার মাকে বললো,’মেজো আপু কী বলে গেল এসব?’
লায়লা বেগম অবাক হয়ে বললো,’কী?’
‘তুমি নাকি রুপার চরিত্র হনন করার জন্য লোক ভাড়া করেছিলে? তোমার জন্যই নাকি আজ মিম্মির বাবার জেল খাটতে হচ্ছে?’
লায়লা বেগম কী উত্তর করবে বুঝতে পারছে না।রুপা অবশ্য এখানে নাই। তবুও তার ভয় হচ্ছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে।কী যে হবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ওদিকে তাকে আবার এক্ষুনি মিম্মিদের বাড়ি যেতে হবে।মেয়ের স্বামী জেল হাজতে।ওরা অত বড় বিপদে।আর সে না গেলে কেমন দেখায়!
লায়লা বেগমকে চুপ করে থাকতে দেখে পৃথুল বললো,’আমি সব শুনেছি।সব।মিম্মির মা বলেছে। বাবাকে নিয়ে যা শুনেছি আমি তা বাবার কাছেই জিজ্ঞেস করবো।তার কাছ থেকেই এর জবাব নিবো।’
লায়লা বেগমের মাথা ঘুরছে।লাটিমের মতো।এ কী ভয়াবহ কান্ড!সে যে পথেই পা ফেলছে সে পথই মিলিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য কোন রাক্ষসের মুখে। কেন এমন হচ্ছে কেন?
আর সুফলাই বা অতটা ভালো সেজে গেলো কীভাবে?সে কী সুফলাকে একবারের জন্যও বলেছিল,তোর জামাইরে বল বুদ্ধি দিতে। বরং সে নিজে থেকেই তো মিম্মির বাবার সাথে কথা বলেছে। এখন সব দোষ তার কাঁধে আসছে কেন?
লায়লা বেগম ছেলের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ালো না।রুপাকে বললো,’মা তুমি রান্নাবান্না করে খেও।আমি ওদের বাড়ি যাই।দ্রুত আসার চেষ্টা করবো ওখান থেকে।’
বলে লায়লা বেগম মেয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল।

রুপা তার শ্বশুরের সাথে কথা বলছে। তাড়াতাড়ি এসে যেতে হলো বলে মন খারাপ কি না জিজ্ঞেস করেছে তার শশুর। সে বলেছে,না।মিম্মির বাবা বিপদে আছে।এরেস্ট হয়েছে।
এরেস্টের খবর অবশ্য পৃথুলের বাবাকে আর কেউ জানায়নি। রুপার কাছ থেকে শুনে তিনি শুধু এটাই বললেন, এই ছেলে এমনিতেও ক্রিমিনাল টাইপের। তুমি জানো না এই ছেলে কতটা পেরেশান করেছে অতীতে আমায়!আজ এটা কাল ওটা বলে আমার কাছ থেকে পঁয়ত্রিশ লক্ষ্য টাকা যৌতুক নিয়েছে। খুব চতুর টাইপের ছেলে।টাকা না দিয়ে উপায়ও ছিল না। এমন ভাবে চায়তো যেন ভিক্ষে চায়ছে। এবার কদিন খাটুক।আমি জানি।এমনি এমনি তাকে কেউ জেলে নিয়ে ভরে রাখেনি।
তবুও রুপা আফশোস করলো।বললো,বাবা এটা মিথ্যেই। দুলাভাই খুব ভালো মানুষ।আর আপনার কাছে হয়তোবা প্রয়োজনের জন্যই টাকা চেয়ে নিতো!
তারপর পৃথুলের বাবা জিজ্ঞেস করেছে পৃথুলের সম্পর্কে।পৃথুলের আচরণ কেমন? তার সাথে কেমন আচরণ করে! তাকে সময় দেয় কি না
এসব।
রুপা সবকিছুর ভালো ভালো উত্তর দিয়েছে।অথচ পৃথুল এ পর্যন্ত তার সাথে কোন কথা পর্যন্ত বলেনি। সামনে পর্যন্ত পড়ে না তার।
আঁড়াল থেকে রুপার সব কথাই শুনেছে পৃথুল। এবং সে অবাক হয়েছে। রুপা তার সম্পর্কে কতো ভালো ভালো কথা বলেছে। তাছাড়া তার বোন জামাইয়ের সম্পর্কেও ভালো কথা বলেছে
অথচ এই লোকটিই তাকে ফাঁসাতে চক্রান্ত করেছিল।আর সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছে এই জন্য যে রুপা তার বাবার সাথে যে কথাগুলো বলেছে ফোনে এই কথাগুলো সত্যিকারের বাপ-বেটির সু সম্পর্কের কথোপকথন। পৃথুল অবশ্য আগেও সন্দেহ করেনি ওদের।সুফলার কাছ থেকে শুনেও না। তবুও সে আঁড়াল থেকে কথাগুলো শুনলো।এমনিতেই। কথাগুলো শোনার পর রুপার প্রতি তার মমতা বেড়ে গেল বহুগুণে।

লায়লা বেগম মিম্মিদের বাড়িতে শাশুড়ির জায়গা থেকে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে ভয়াবহ বিপদে পড়ে গেল। ওদের ঘরে গিয়ে উঠতেই মিম্মির দাদি সরাসরি অপমান করলো লায়লাকে। চিৎকার করে বললো,’আপনার অকর্মা ছেলের জন্য আমার সহজ সরল ছেলেরে নিয়ে আপনি বিপদে ফেলছেন।এর পরিণাম আপনি টের পাবেন! আমার ছেলের যদি একটুও ক্ষতি হয় তবে আপনার মেয়েরে এখান থেকে সাথে করে নিয়ে যেতে হবে।না মা মেয়েরে এমনে এমনে বিদায় করবো না।গলায় জুতোর মালা দিয়েই তবে বিদায় করবো!হুহ।’
লায়লা বেগমের মুখে তালা। মুখে তালা তার মেয়ে সুফলারও। আজ সকাল বেলা সুফলা তার শাশুড়ির হাতের চড়ও খেয়েছে পর্যন্ত। অশ্রাব্য গালাগাল শুনেছে।হুমকি ধামকিও শুনেছে। মাকে এসব বলেনি।বললে লাভও নাই। কিন্তু সে এটা টের পাচ্ছে যে তার ভবিষ্যৎ কতটা ভয়াবহ হবে! এখানে টিকে থাকা তার জন্য কতটা কঠিন হবে!
অবশ্য সবটুকু সে জানেও না।যদি জানতো যে মেয়ের জন্য তার বর আজ জেলে সেই মেয়ের আসল পরিচয়, সেই মেয়ের চাচা কতোটা ক্ষমতাধর, মেয়ের বড় ভাই কতোটা শক্তিশালী! তখন সে জ্ঞান হারাতো।আর তার শশুর বাড়ির লোকেরা যদি এটা জানতো তবে তাকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধরে এতোক্ষণে বের করে দিতো!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে