নাপুরুষ পর্ব-০৮

0
1020

#নাপুরুষ
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



লায়লা বেগম ঝট করে ফোন রেখে দিলো। তারপর মোবাইল ফোনটা ঢিল মেরে বিছানার ওপাশে জানলার দিকে ছুঁড়ে মারলো। কিন্তু ফোন অতদূর গেলো না। ফোন গিয়ে পড়লো বিছানার নরম গদিতে। ফোনের সামান্যতম ক্ষতিও হলো না!
সে এখন শরীরে আগুন ধরে যাওয়া মানুষের মতো হাঁসফাঁস করছে। কান্নাকাটি করছে। পাগলের মতো আচরণ করছে।একা একাই। নিজের সাথে নিজে।

সুফলা এতোক্ষণ মেয়েকে খিচুড়ি খাওয়াচ্ছিলো। খিচুড়ি খাওয়ানো শেষ হলে সে মার ঘরে এসে দেখে মার অবস্থা খারাপ। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। কপাল চাপড়াচ্ছে।
সুফলা চমকে গিয়ে বললো,’কী হয়ছে মা?’
লায়লা বেগম কেঁদে ফেললো জর জর করে।
‘ও মা,মারে সব শেষ! এই কালনাগিনী আমার বাড়িতে এসে সব ধ্বংস করে দিলো। আমার সংসারটাও নষ্ট করলো!’
সুফলা এখনও কিছু বোঝে উঠেনি।মা আবার নতুন কোন তথ্য পেলো না তো এই বিষয়ে!
সে তাই তার মাকে জিজ্ঞেস করলো।বললো,’কেন? আবার কী হলো?’
লায়লা বেগম বললো,’তোর বাপ ফোন দিয়েছিলো আমায়।’
আধো কান্নাভেজা গলায় কথাটা বললো লায়লা।
সুফলা বললো,’ফোন দিয়ে কী বললো?’
‘ওই কালনাগিনীর কথাই বললো!’
সুফলা আশ্চর্যের একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছালো। তবে কী এসব সত্যিই?বাবা নিজের মুখেই মাকে বলে দিলো!
সুফলা বললো,’কী কী বলছে বাবা?কী চায় বাবা এখন?’
‘কী চায় সেটা কী আমারে বলছে!’
সুফলার এবার রাগ পেলো।ওর মায়ের এসব অতি উত্তেজনা তার ভালো লাগে না।সে ধমকের গলায় বললো,’তাহলে বললো টা কী তোমার কাছে?’
লায়লা আবার কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে।
কাঁদতে কাঁদতে বললো,’তুই!তুইও আমার বিপক্ষে! তুইও আমার বিপক্ষে সুফলা?ধমক দেস। পয়সাওয়ালা বাপের পক্ষে চলে গেছস?যা তাইলে।তোর বাপের নতুন বউরে গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম কর।আর মা ডাক গিয়ে।না মা না আম্মাজান বলে ডাকিস। হারামজাদি!’
লায়লা রাগে থরথর করে কাঁপছে।
এবং সে উত্তেজিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুফলা মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে রেখে মার পেছন পেছন গেলো। লায়লা রুপার ঘরের দিকে যাচ্ছে।
সুফলা মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো,’কোথায় যাও?’
লায়লা ব্যাঙ্গ করে বললো,’তোর নতুন মায়ের কাছে।তার কপালে একটা চুমু খাইতাম!’
সুফলা বুঝতে পারলো অবস্থা সুবিধার না।মা গিয়ে রুপার সাথে দূর্ব্যবহার করবে।এটা ভালো হবে না।রুপা যদি বাবার কাছে বলে দেয় তবে ভয়াবহ কান্ড হবে। যদিও সুফলা নিজেও সন্দেহ করে তার বাবা এই মেয়ের সাথে পরকিয়ার সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কিন্তু এর পরেও রুপাকে এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না।এতে হীতে বিপরীত হবে। এরচেয়ে সে মিম্মির বাবার সাথে কথা বলবে। পরামর্শ করবে।ও যা বলে সেভাবেই এগুবে।সে খুব স্বামী ভক্ত মানুষ।ধর্ম কর্ম না করলেও স্বামীকে সে খুব ভজন করে। স্বামীর কথা ছাড়া পাশের ঘরের উঠোনেও উঁকি দেয় না!
সে মায়ের আপাতঃ রাগটা থামাতে মার হাতটা টেনে ধরলো। তারপর বললো,’আমার কাছে এরচেয়ে ভালো খবর আছে। সমস্যা সমাধানের খবর। তুমি আমার সাথে এসো। ঘরে চলো!’
লায়লার রাগ ধপ করে নিভে গেল।এই মেয়ে তার বড় ধুরন্ধর। যেহেতু বলেছে সমাধানের খবর আছে তবে নিশ্চয় আছে।তার একটুও সন্দেহ নেই মেয়ের উপর।
ঘরে ফিরেই লায়লা বেগম বলে,’বল।কী সমাধান আছে বল!’
সুফলা বললো,’সমাধানের কথা পরে বলবো।আগে কুমুদ কথা শুনো।’
লায়লা উত্তেজিত গলায় বললো,’কুমুদ কথা মানে?’
সুফলা হাসলো। হেসে বললো,’মাথা তো তোমার হট। এই হট মাথা কোল করার জন্য যে কথা বলবো এই কথার নাম কুমুদ কথা। এই শব্দের আবিষ্কারক তোমার জামাই।মিম্মির বাবা!’
লায়লা বেগম ধমকের গলায় বললো,’ফাউল কথা রাখ।কাজের কথা বল। সারাদিন তোর মুখে এই একটাই নাম।মিম্মির বাবা।মিম্মির বাবা।যেন মিম্মির বাবা বড় কামেল পীর। সারাদিন তার নামই জপ করা লাগবে!’
মায়ের এমন বিদ্রুপাত্মক কথাটা তার বুকের ভেতর গিয়ে বিঁধেছে। কিন্তু সে তা মাকে বুঝতে দিলো না।সে আপাতত আশু সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে গেল।বললো তার মাকে।
‘মা, তুমি কী রুপাকে মারতে যাচ্ছিলে?’
লায়লা বেগম বিদ্রুপের গলায় বললো,’না।তার কপালে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম!’
সুফলা জানে মা রুপাকে মারতেই যাচ্ছিল।তাই সে শান্ত গলায় মাকে বললো,’মা, নতুন বউয়ের গায়ে হাত তোললে তোমারই বিপদ হতো। এই মেয়ের লজ্জা নাই। লজ্জা থাকলে তো আর সে শশুরের সাথে এসব করে বেড়ায় না! এখন এই মেয়েকে মারলে এই মেয়ে গলা ছেড়ে এ বাড়ি ও বাড়ির লোককে তার কান্না শুনাতো। মানুষকে ডেকে ডেকে বলতো,ওরা আমায় মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে। আমার নাকি শশুরের সঙ্গে পরকিয়া!
যদি এসব বলতো তখন কেমন হতো? তোমার মুখ কী থাকতো এতোক্ষণে? এইসব কাজ করতে হয় চুপিচুপি।বুঝেছো?’
লায়লা বেগম বললো,’হ বুঝেছি। এখন সব বুঝেছি।রাগের মাথায় এটা করলে খুব খারাপ হয়ে যেতো!’
সুফলা বললো,’বুঝলেই মঙ্গল। আলহামদুলিল্লাহ।’
লায়লা বেগম এবার উঠে পড়ে লাগলো। বললো,’তুই না বললি এটা সমাধান করবি। চুপিসারে।কেমনে?বল!’
সুফলা বললো,’বললে তো আবার সমস্যা। এই কাজের সমাধানের যে বুদ্ধি দিবো তারে তো তুমি পছন্দ করো না!’
লায়লা বেগম মাথা মোটার মতো বললো,’কে দিবো?কে দিবো সমাধান?’
সুফলা মৃদু হেসে বললো,’মিম্মির বাবা।’
লায়লা বেগমের মুখ কালো হয়ে গেল। কিন্তু সে আর কিছু বললো না।

সুফলা মিম্মির বাবাকে ফোন দিয়ে বললো সবকিছু।
মিম্মির বাবা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললো,’এটা তুমিও বিশ্বাস করো তবে?’
সুফলা বললো,’অবিশ্বাসের কী আছে!আমেরিকায় থেকে বাবা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তুমি বিশ্বাস করবে না।রুপাকে পেয়ে বাবা আমাকেও ভুলে গেছে পর্যন্ত!’
মিম্মির বাবা ফের হাসলো। হেসে বললো,’তোমার বাবা পরকিয়া করে কী করবে বলো?উনি তো অক্ষম!’
সুফলা কথাটার মানে বুঝতে পারলো না।তাই চুপ করে সবটা শুনতে চাইলো।
মিম্মির বাবা আবার বললো।আগের কথাটাকে পরিষ্কার করতেই এটা বলা।
‘তোমার বাবা অক্ষম বলেই শেষ বেলায় আরেকটা অক্ষমরে জন্ম দিছেন!’
কথাটা বলে শেষ করে মিম্মির বাবার সে কি হাসি। মোবাইল ফোনে ওর হাসি শুনছে সুফলা। তবুও মনে হচ্ছে ওর কানের পর্দা ফেটে যাবে। এই লোকটা এমনই।বিশ্রী বিশ্রী কথা বলে সব সময়। কিন্তু ভেতর ভালো।এটা খুব ভালো করেই জানে সুফলা।
তাই সে রাগ করে না বরের প্রতি।সে বরং মধুময় গলায় বলে,’একটা উপায় বলো না!যা করলে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না!’
মিম্মির বাবা বেফাঁস আরেকটা কথা ছাড়ে।বলে,’পৃথুলরে বলে তার বউরে তালাক দেওয়াও। এরপর বাবার জন্য রুপারে বিয়ে করাও।এই তো সমাধান। সহজ সমাধান!’
সুফলার বিরক্তি লাগে।মা তার পাশেই দাঁড়িয়ে।যদি শুনে পেলে এসব সর্বনাশ হবে।এমনিতেই মা তার বরকে দেখতে পারে না।এসব শুনলে তো কোনদিন ওর বরকে এ বাড়ির ত্রী সীমানায় পা-ও ফেলতে দিবে না!
সুফলা এবার তাড়া দেয়।অনুরোধের গলায় বলে,’প্লিজ বলো না কিছু একটা।প্লিজ প্লিজ বলো!’
মিম্মির বাবা এবার বলে।বলে,একটা ছেলে আছে তার হাতে। খুব পটু। এই ছেলেকে দিয়েই কাজটা করাবে সে।সুফলাকে মিম্মির বাবা বললো, রুপার ফোন নম্বরটা দিতে শুধু। বাকীটা ও দেখবে।
সুফলা খুশি হয়েছে।খুশি হয়ে টেক্সট করে সে রুপার ফোন নম্বরটা পাঠিয়ে দিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।
কিন্তু এতে লায়লা বেগম মোটেও সন্তুষ্ট নন।মিম্মির বানর বাবা কী করতে যাচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।এতে উল্টো তার বিপদ হবে না তো!মান সম্মান রক্ষা হবে তো!
দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল লায়লা। এবং মনে মনে তখন সে রুপার মৃত্যু কামনা করলো।ওর জন্যই এসব হয়েছে।ওই মূল ডাইনি।তার ইচ্ছে করছে ওই ডাইনিটাকে কুপিয়ে পিস পিস করে ফেলতে!

পরদিন সকাল বেলা অদ্ভুত আচরণ করলো লায়লা বেগম। রুপার সাথে আপন মায়ের মতো কথা বললো।বললো,’মা আমি তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবো। তিন চারদিন থাকবোও ওখানে। কোন সমস্যা নাই।আজ দুপুরেই যাবো।
রুপা বলবে না বলবে না করেও বলে ফেললো,’পৃথুল যাবে না মা?’
লায়লা বেগম মুখ কিছুটা ভার করে বললো,’না গো মা।ওর আবার মন খারাপ।ওই মেয়েটাকে নাকি গতকাল স্বপ্নে দেখেছে। সেই মেয়ে তাকে বিশ্বাসঘাতক ডেকেছে স্বপ্নে। এরপর থেকেই তার মন খারাপ!’
রুপা আশাহত হলো।তার ভাগ্যে বোধহয় স্বামীর সোহাগ লিখা নেই।সে মনে মনে ঠিক করলো ধৈর্য্য ধরবে। ধৈর্য্য না ধরেই বা কী করবে?বিয়ে তো আর রোজ দিন হয় না! তাছাড়া এ বাড়ির মানুষ গুলো কতো ভালো!তার শশুর যেন তার নিজের বাবা। শাশুড়ি যেন নিজের মা।আর সুফলাও কতো ভালো!পৃথুলও মানুষ ভালো। কিন্তু ওর যে আসলে সমস্যাটা কী!ওই মেয়ের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি যদি সত্যি হয় তবে এই মেয়ে থেকে কবে বেরিয়ে আসবে পৃথুল? রুপা জানে না!

রুপাদের রওনা হওয়ার আগেই আরেকবার ফোন করলো মিম্মির বাবা। সুফলা তখন ওদের ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিলো।বরের কল আসায় সে ঘর থেকে বেরিয়ে আড়ালে গেল।এই সময়ই তাকে একটা চক্রান্তের বিষয়ে সব খুলে বললো তার বর।বললো, তুমি এক্ষুনি রুপার হাত থেকে ওর ফোনটা চেয়ে নিবে।বলবে, তোমার ফোনের ব্যালেন্স শেষ। তুমি আমার কাছে একটা মিসড কল দিবে ওর ফোন দিয়ে। এই কথা বলে ফোন নিয়ে একটা ম্যাসেজ দিবে এই নম্বরে।আমি বলছি তুমি ফোনে উঠিয়ে নেও নম্বরটা।
রুপা নম্বরটা সংগ্রহ করলো। তারপর বললো,’কী ম্যাসেজ দিবো?’
ওর বর বললো,’লিখবে,আমি আজ ঠিক দেড়টায় তোমার সাথে দেখা করবো মৃন্ময়ী পার্কের সামনে। তুমি পার্কের সামনে থাকবে। আমার সাথে থাকবে আমার শাশুড়ি।আমরা রিক্সা করে যাবো। তুমি আমাদের দেখেই রিক্সা থামাবে। তারপর পরিচয় দিবে, তুমি আমার মামাতো ভাই।’
সুফলা বললো,’কিছুই বুঝলাম না!’
মিম্মির বাবা বললো,’বুঝতে হবে না। মাকে বিষয়টা বলবে।যখন ওই ছেলে দেখা করতে আসে তখন মা যেন ওই ছেলের পথেই হাঁটে।মানে ওই ছেলে যা বলে তাই বিশ্বাস করে। তারপর বাকীটা তোমরাই বুঝতে পারবে। আমার আর হেল্প লাগবে না!সাপও তোমাদের লাঠি দিয়ে মারতে হবে না।সাপ এসে তোমার বাবাই মারবে।তার নিজের লাঠি দিয়ে।’
সুফলা সব বুঝতে পারলো এবার।জলের মতো সবকিছু পরিষ্কার তার কাছে ।সে ঘরে এলো এবং মিম্মির বাবা যা যা বললো তাই করলো।মেসেজেটা সেন্ড করে আবার ডিলিট করে দিলো এখান থেকে। ওদের নোংরা খেলাটা এখান থেকেই শুরু।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে