নাপুরুষ পর্ব-০৬

0
1032

#নাপুরুষ
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



পৃথুল আর রুপা এক ঘরে।আজ থেকে এখানেই থাকতে হবে পৃথুলের।ওর বাবা এটাই নিয়ম করেছেন।পৃথুল ভয় পাচ্ছে। ভীষণ রকম ভয়।
সে কখনো ভাবেওনি তাকে রুপার সাথে এক ঘরে থাকতে হবে।তার বাবাও যে এমন কান্ড করে বসবেন তাও ভাবেনি!

রাতে ঘুমুবার সময় হলে পৃথুল প্রথম কথা বললো।তাও ভয়ে ভয়ে।সে চাপা স্বরে বললো,’শুনুন,আমি আপনার সাথে থাকতে পারবো না!’
রুপার রাগ উঠলো কি না কথাটা শুনে সে বুঝতে পারলো না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে বললো,’কেন? থাকতে অসুবিধা কী? বিয়ের পর হাসব্যান্ড- ওয়াইফ একসাথে থাকলে কী ধর্ম নষ্ট হয়?’
পৃথুল এই কথার কোন জবাব দিলো না। এবার দেখা গেল চুপচাপ বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সোজা শুয়ে পড়লো সে মেঝেতে, ফ্লোরের উপর। একটা বালিশ পর্যন্ত চেয়ে নেয়নি।ডান হাতটা বাঁকা করে হাতের উপর মাথার ভার রেখেই শুয়েছে।রুপা কিছু বললো না। শুধু রাগভরা চোখ নিয়ে দৃশ্যটা দেখে গেলো। এবং সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো ফ্লোরে শুয়ার পাঁচ থেকে ছ’মিনিট পর বেচারা ঘুমিয়ে হালকা নাক ডাকতে শুরু করলো।
রুপা একটু একটু ভয় পাচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি ওর শাশুড়ি কিংবা সুফলা আসে। এসে বলে দরজা খুলতে তখন কেমন হবে!যদি এসে দেখে পৃথুল এখানে শুয়ে আছে।মেঝেতে, ফ্লোরের উপর।একটা কাঁথা কিংবা বালিশও নাই তার মাথার নিচে । ওরা তো তখন তাকেই দোষারোপ করবে!
রুপা ডাকলো পৃথুলকে।আস্তে করে।ও গাঢ় ঘুমে। ঘুমের ভেতর সে রুপার মিনমিনে গলার ডাক কিছুতেই শুনতে পেলো না!

রুপা যে ভয় পেয়েছিল সেই ভয় কেটে গেছে এখন। অনেক রাত হয়ে গেছে।ওরা কেউ আসেনি।সবাই এতোক্ষণে ঘুমে তলিয়ে গেছে। শুধু ঘুম আসছে না রুপার।তার কী সব যেন চিন্তা হচ্ছে। অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা।তার কেন যেন মনে হচ্ছে তার জীবনে অদ্ভুত এক মানুষের আগমন ঘটবে।যে কি না তাকে পুরোটাই বদলে দিবে। সেই মানুষ তাকে ভালোবাসবে।আদর করে কাছে ডাকবে।কানের নিচে এসে উড়তে থাকা এলো চুল মুঠো করে ধরে দূরে সরিয়ে দিয়ে কানের নিচে শক্ত করে কামড়ে ধরবে।
ওর এমন হচ্ছে কেন? সারা শরীর কেমন ছটফট করছে। অদ্ভুত সব কল্পনা এসে জেঁকে বসেছে। অদ্ভুত তার আনন্দ হচ্ছে। সেই আনন্দ নিয়েই সে ও পাশের জানলাটা খুললো। বিদ্যুৎ চলে গেছে। এবং সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো বাইরে তখন ঝড়। খুব বেশি নয়। সামান্য।শীতল হাওয়া দিচ্ছে। তারপর শুরু হলো বৃষ্টি।ঝির ঝিরে বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতেও বাইরে হলুদ সড়ক বাতি জ্বলছে। সেই আলোতে সে দেখলো সুপুরি গাছগুলো কেমন নুইয়ে পড়েছে ঝরে। তার কেন যেন হঠাৎ মনে হলো, তার ভাবনার মানুষটি ঠিক এমন হবে।যে এসে তার বুকের কাছে এসে নুইয়ে পড়বে ওই সুপুরি গাছগুলোর মতোই। তারপর কান পেতে শুনবে তার বুকে জমে থাকা অগুণতি বছরের হাহাকার। সেই যে রোহের জগৎ। ওখান থেকেই তো এই মানুষটিকে পাওয়ার ব্যাকুলতা-আকূলতা তার।রুপা কী মনে করে যেন হাসলো।হি হি হি করে। সেই হাসি এসে শুধু তার কানেই বাজলো।বড় মিষ্টি হাসি।বড় মধুর এই হাসি। বাঁশির মতো।কিন্নর।যে হাসিতে প্রেমিকের প্রাণ জোড়ায়! কিন্তু তার প্রেমিক?সে তো ঘুমুচ্ছে।নাক ডেকে ডেকে।
তারপর রুপা মনে মনেই বললো,নাহ।পৃথুল তার প্রেমিক নয়। প্রেমিক মানেই যে স্বামী এটা ভুল কথা।অন্য কেউও তো প্রেমিক হয়।তার এ জীবনে কোন প্রেমিক আসেনি। কোনদিন কী আসবে?
ঝড় আর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রুপা গান ধরলো। রবীন্দ্রনাথের গান।

‘ওই মালতি লতা দোলে
পিয়ালও তরুরও কোলে
পূব হাওয়াতে মালতি লতা দোলে
মোর হৃদয়ে লাগে দোলা।’

গান গাইতে গাইতে সে দেখলো হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এবং সে কী মনে করে যেন ঘরের ভেতর তাকালো। তখনই দেখতে পেলো দৃশ্যটা। জড়োসড়ো হয়ে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো শুয়ে আছে পৃথুল।কী যে মায়াবী দেখাচ্ছে ওকে।নিস্পাপ।যাকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে।
রুপা চুপিচুপি জানলাটা বন্ধ করে পৃথুলের কাছে এলো। তারপর পৃথুলের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওর কপালে একটা চুমু খেলো আলতো করে।পৃথুলের সাড়া নেই।সে ঘুমুচ্ছে। এবার আর নাক ডাকছে না। শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে।
রুপার ইচ্ছে হলো ওর উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তে। তারপর ওর কালো ভ্রমরের ন্যায় চুলগুলোকে দু হাত দিয়ে মুঠো মুঠো করে ধরতে।এতে তো আর তার পাপ হবে না।ধর্ম অশুদ্ধ হয়ে যাবে না!
পৃথুলু তো তারই।তার নিজের মানুষ।সে আজ পৃথুলের সব দুঃখ সব যন্ত্রণা কষ্ট বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা কান্না সব, সবকিছু দূর করে দিবে।কান্নায় ভার হয়ে থাকা ঠোঁট থেকে তার গোলাপ রঙা ঠোঁট দিয়ে শুষে নিবে ঠোঁটের কষ্ট,ভার হয়ে থাকা বুকের সাথে কদম পাপড়ির মতো নিজের বুক মিশিয়ে তাড়িয়ে দিবে বুকের যন্ত্রণা। চোখের পাতায় গাঢ় ঘন নিঃশ্বাস ফেলে উড়িয়ে দিবে সব দুঃখ!
রুপা তাই করলো।তাই!
প্রথমে পৃথুলের এক পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর একটা হাত তুলে দিলো ওর গায়ে।পৃথুল নড়লো না। এরপর একটা পা এগিয়ে দিলো।পৃথুল নিথর। শুধু শ্বাস নিচ্ছে। তারপর ওর উপর নিজের সবটা ভর তোলে দিয়ে যেই না মুঠো করে ভ্রমর কালো চুলের জমিনে হাত বুলাবে ঠিক তখনই ও চিৎকার করে উঠলো।
‘কে?কে ,অ্যাই। কে?’
রুপা দ্রুত ওর মুখটা চেপে ধরলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’অ্যাই আমি।আমি রুপা। তোমার স্ত্রী।’
পৃথুল ওকে দু হাত দিয়ে এমন ভাবে ধাক্কা দিলো যে রুপা গিয়ে একেবারে ছিটকে পড়লো অনেকটা দূরে।পড়ে গিয়ে গায়ে সামান্য ব্যথাও পেলো।
পৃথুল দ্রুত উঠে গিয়ে সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। রুপার কাপড় এলোমেলো তখনও।গায়ে সামান্য ব্যথাও পেয়েছে।আর লজ্জা!
সে নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। ছিঃ!সে মেয়ে হয়ে কীভাবে আগ বাড়িয়ে ওর কাছে গিয়ে এসব করে বসলো।এতে পৃথুল কী ভেবেছে কে জানে! ওকে খারাপই ভাবলো কি না!
এরপর দেখা গেল পৃথুল সে রাতে আর ঘুমুচ্ছে না।ফ্লোরে বসেই খাটের সাথে হেলান দিয়ে আছে।উদাস মনে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।কী যেন ভাবছে আপন মনে।
রুপা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। তাকিয়ে আছে ও পাশে চোখ বন্ধ করে। এবার চোখ খুলতেও লজ্জা পাচ্ছে সে। নিজেকেই নিজে বারবার সে বলছে,বেশরম মেয়ে কোথাকার। লজ্জা শরম বলতে নেই একটুও।একটা ঘুমন্ত মানুষের সাথে কেউ এমন করে!

সে রাত কেটে গেলে পৃথুল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এমনিতে সে বাইরে যায় না খুব একটা।কারণ তার বন্ধু বান্ধব নাই বললেই চলে।বিদেশ বিভূঁইয়ে বড় হয়েছে।দেশে বন্ধু না থাকারই কথা। কিন্তু আজ এভাবে কোন কিছু না বলে বাইরে যাওয়ায় রুপার মনে ভয় ধরে।সে বুঝতে পারে না তার উপর রাগ করেই চলে গেল কি না!
পৃথুলের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নিয়েই সুফলা আসে রুপার কাছে।রুপা তখনও শুয়ে আছে।মাথা থেকে ওই চিন্তা কিছুতেই নামছে না। তাছাড়া রাতে ঘুমও হয়নি!
সুফলাকে আসতে দেখেই রুপা উঠে বসলো বিছানার উপর।
সুফলা এসেই মিষ্টি করে হাসলো। হেসে বিছানার একপাশে বসতে বসতে বললো,’কী খবর তোমাদের বলো তো? এবার খুশি তো তুমি?ভাই তো ঘরে এলো। নিজের মানুষ নিজের কাছে এলো!’
রুপা ভাবছে এটা বলবে কি না। ওই যে রাতের বিষয়টা। কিন্তু কী মনে করে যেন চুপ রইলো।
সুফলা নিজেই জিজ্ঞেস করলো,’পৃথুল তোমার কাছে এসেছিল?’
রুপা মিনমিনে গলায় বললো,’না আপু।’
রুপা হাসলো।বললো,’তুমি জোর করবে।ঈশারা করে কাছে ডাকবে।’
রুপা লজ্জা শরম ভুলে গিয়ে বলে ফেললো কাল রাতে কী কী ঘটেছে আর কী কী সে করেছে।
সুফলা শুনে বললো,’সাহসী মেয়ে।তুমি পারবে।ওর মন তুমিই জয় করতে পারবে।এক কাজ করো। তোমার ফোন দেও।লক খুলে দেও।’
রুপা তার মোবাইল ফোন সুফলার হাতে দিলো।
সুফলা সেই ফোনে শেয়ার রেইটে কী যেন দিলো। কোন ভিডিও সম্ভবত।ভিডিও দিয়ে বললো,’ এইগুলো পৃথুলকে নিয়ে দেখবে। বিয়ের পর এইগুলো সব হাসব্যান্ড ওয়াইফরাই দেখে।এতে মুহব্বত বাড়ে।’
রুপা ভাবলো কোন ওয়াজ নসিহত হবে হয়তো। নয়তো ভালো ভালো কিছু কথা। যেখানে প্রেমের বিষয় আছে।সম্পর্কের বিষয় আছে। সুন্দর সংসারের বিষয় আছে।
কিন্তু সুফলা চলে যাওয়ার পর ও মোবাইলের ফাইল ওপেন করতেই চমকে উঠলো।এসব কী!
কী নোংরা ওই মহিলা!
ঘেন্নায় ওর বমি এসে যাচ্ছে।
সে সঙ্গে সঙ্গে ভিডিও গুলো ডিলিট করলো।
তারপর রাগে দুঃখে ক্ষোভে কেঁদে ফেললো।
—–
এক সপ্তাহ হলো ওরা এক সাথে থাকে। একজন খাটে আর একজন ফ্লোরে নয়।দুজনই খাটে। দুজন দু’দিকে ফিরে ঘুমোয়। ওদের মাঝখানে দেয়াল তুলে থাকে একটা কোল বালিশ। ওদের দুজনের কেউই সেই বালিশ ডিঙোয় না। একজন লজ্জা এবং ভয়ে।অন্যজনের কারণটা গোপন।

এর মধ্যেই পৃথুলের বাবার চলে যাওয়ার তারিখ ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল তিনি চলে যাবেন। এই এক সপ্তাহে তিনি রুপার সবচেয়ে কাছের মানুষটি হয়ে উঠেছেন। রুপা তার সাথে কতো কথা বলে। এই মানুষটি ভীষণ অমায়িক।এক এক গল্প বলে তাকে হাসিয়ে ফেলে আবার কখনো কাঁদিয়ে ফেলে।রুপা মাঝেমধ্যে মানুষটির মুখের দিকে তাকায়।মুখে কিছুটা বয়সের ছাপ পড়েছে। বয়সের ছাপ পড়া এই মুখে মায়া আর মায়া। রুপার এবার শুধু কান্না পায়।যখনই মনে পড়ে তার শশুর কাল চলে যাবে তখনই সে মনের অজান্তেই হু হু করে কেঁদে উঠে। চোখের পাতা ভিজিয়ে ফেলে লবণ মাখা জলে।পেলব গাল তার ভেসে যায় যেন!
সে ভাবে, এই বাড়িতে কীভাবে বাকীটা জীবন পাড় করবে সে? এখানে যে তার ভালো লাগার কিংবা তাকে বোঝার আর কেউই নাই!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে