নাপুরুষ পর্ব-০৫

0
1361

#নাপুরুষ
#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



পৃথুল ও পাশে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মাথায় কাঁথা তোলে নেয়। রুপার রাগ হয় খুব।সে ধপধপ করে শব্দ করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে আসে। এসে রাগে হাঁপাতে থাকে।সে বুঝতে পারে না ও কোন ধরনের মানুষ! ওর এক সময়কার প্রেমিকা মারা গেছে এটা অবশ্যই দুঃখের কথা। ওকে ভুলতে না হয় তার কাছে সময় চায়তে পারে। কিন্তু এই জন্য কী একেবারে তার সাথে কথা বলা যাবে না!
কথা বললে পাপ হয়ে যাবে! এমনকি মুখটাও দেখানো যাবে না পর্যন্ত!
কী মহা মুশকিল!
রুপা মনে মনে ভাবে এসব কিছু না আসলে।এটা একটা নাটক।পৃথুলের প্রেমিকা বলতে কেউ নাই।ছিলও না কখনো।ওর অন্য কোন সমস্যা।সমস্যাটা ফিজিক্যাল! রুপার এটাই মনে হয়। এবং তার মন সায় দেয় যে সে যেটা ভেবেছে এটাই সত্যি।এক রত্তিও মিথ্যে নয়।

পৃথুলের বাবা ঢাকা থেকে ফিরে তিনদিন পর। এবং এসেই জানায় এক সপ্তাহের ভেতর তাকে আমেরিকা ফিরে যেতে হবে।কোম্পানি তাকে আবার ডেকেছে।এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে মাত্র। কিছুই করার নেই।ঈদটাও দেশে করে যেতে পারবে না!
রুপা অবশ্য এই লোককে যেমন বদমেজাজি কিংবা অহংকারী ভেবেছিল এই লোক তেমন না। কোন কারণে হয়তোবা সেদিন মন মেজাজ খারাপ ছিল তাই চুপ হয়ে ছিলেন।মুখ ভার করে।
কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরে তিনি রুপার ঘরে এসেছেন। রুপার জন্য তিনি ঢাকা থেকে একটা স্বর্ণের চেইন এনেছেন। দেখতে খুব সুন্দর! ঝকঝক করে ওর গায়ে আলো পড়লে!
তিনি এসে সেই চেইন রুপার হাতে দিয়ে বললেন,’তোমারে আমি বউ মা ডাকবো না মা। তুমি আমার মা। আমার নিজের মা মারা গেছে আমারে ছোট্ট রেখে।আমি বড় হয়েছি মেজো খালার আদরে সোহাগে। ছোট্ট খালারেই আমি মা ডাকতাম। ছোট্ট খালা এখন আর নাই। আমার মা ডাকারও এখন কেউ নাই। এখন তুমি আসছো আমার ঘরে। এখন থেকে তুমিই আমার মা।আমি সপ্তাহের ভেতরেই চলে যাবো আমেরিকায় মা। ওখানে গিয়ে রোজ একবার হলেও তোমায় কল দিবো।’
রুপার খুব ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে তার নিজের বাবাই তাকে এসব বলছে।
পৃথুলের বাবা আবার বললো,’শুনো মা,বদ মেজাজি হয়ো না। সাহসী হয়ে বেঁচে থাকবা। এবং লজ্জাকে কখনো প্রশ্রয় দিবে না। আর সব সময় পথ চলবে জ্ঞান দিয়ে।মূর্খের মতো অন্যের চলা পথে চলো না।মনে রেখো,জ্ঞানী এবং সাহসীরাই কেবল জানে নতুন নতুন পথ বের করতে।’
রুপা বুঝতে পারে না কিছুই এসব কথার মর্মার্থ। হঠাৎ তিনি তাকে এসব বলছেন কেন?
কিন্তু তার ঠিক ভালো লাগে এইসব কথা।তার ভালো লাগে শশুর বাবার সঙ্গ।এ বাড়িতে আর কাউকে ভালো না লাগলেও এই একটা মানুষের প্রতি তার ভীষণ ভালো লাগা কাজ করছে এখন। কিন্তু তার দুঃখও হচ্ছে। এই মানুষটা অল্পদিনের ভেতর চলে যাবে এ বাড়ি আর এ দেশ ছেড়ে।
রুপা ভাবে।ভাবতেই থাকে। পৃথিবীতে ভালো লাগার জিনিসগুলো কখনোই নিজের জন্য স্থায়ী হয় না।কখনোই না।

সে রাতেই লায়লার সাথে তার স্বামীর কথার কাটাকাটি হয় আবার।
লায়লাকে পৃথুলের বাবা জিজ্ঞেস করে,’একটা পদ্ম ফুলের মতো সুন্দর মেয়েটার লাইফটা কেন নষ্ট করলা তুমি? কোন কারণে?’
লায়লা বেগম অবাক হয়। তারপর ভোঁতা গলায় বলে,’এটা কোন ধরনের কথা বললা তুমি? ছেলের জন্য বিয়ে করিয়ে ঘরে বউ এনে কী দোষ করলাম আমি?’
‘হ্যা দোষ করেছো।বড় দোষ করেছো। এখন এর মাশুল দিবে তুমি। ‘
লায়লার এমনিতে রাগ উঠে না খুব একটা। কিন্তু আজ রাগ উঠে।সে চেত করে উঠে বলে,’এইসব কথা রাখো। ছেলে সুস্থ হচ্ছে। চিকিৎসা চলছে।’
‘কই সুস্থ হচ্ছে?বউয়ের সামনেও তো পরে না কোন সময়!’
লায়লা কীভাবে বলবে কথাটা বুঝতে পারে না। কিন্তু মৃদু হেসে বলে,’ছেলের জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের ওইসব বই কিনে এনেছিলাম। সেই বই সে পড়ে লুকিয়ে রেখে দিছে!’
পৃথুলের বাবার রাগটা এবার আরো চড়ে।বলে,’তুমি দেখি এখন অসভ্যতামি শুরু করে দিছো! লজ্জা করে না তোমার । ছিঃ!’
লায়লা বেগম কিছু বলে না।তার মন আজ আনন্দে আত্মহারা। সে ভাবছে ছেলে বইগুলো পড়েছে।বইগুলো পড়ে তার ভেতর একটা অনুভুতি এসেছে। অনুভূতি এসেছে বলেই তো লুকিয়ে ফেলেছে বই।
তাছাড়া সে একটু আগে দেখেছে রুপার মুখ ভরা হাসি। চেহারা যেন আলোর দ্যূতি ছড়াচ্ছে।লায়লার ধারণা ছেলে বোধহয় তাকে কাছে টেনেছিল! জিজ্ঞেস করা উচিৎ রুপাকে একবার। কিন্তু শাশুরী হয়ে এসব জিজ্ঞেস করে কী করে!

লায়লা বেগম মেয়ের সাথে কথা বলে।সুফলার সাথে।সুফলাকে বলে,’একটা খুশির সংবাদ আছে রে সুফল মা!’
সুফলা তার মায়ের মুখে দীর্ঘদিন পর আনন্দমুখর হাসি দেখে অবাক হয়। এবং সে জিজ্ঞেস করে,’কী খবর বল তো মা!’
লায়লা বেগম বলে,’ওরা আজ এক হয়েছিল। মেয়েটা যে কী আনন্দিত আজ!ডানা কাঁটা পরীর মতো এদিক ওদিক আনন্দে ওড়াওড়ি করছে!আহা আনন্দ!এই আনন্দ দেখার জন্যই তো আমি এতো দিন অপেক্ষা করেছিলাম।আমি সব সময় প্রার্থনা করতাম।মনে মনে আশা রাখতাম। আমার পুত্রবধূ হবে হাসিখুশি স্বভাবের।কথায় কথায় সে হেসে ভেঙে গড়িয়ে পড়বে!’
সুফলা অবাক হওয়া চোখে মার দিকে তাকায়।ওর ঠোঁট হাসি হাসি।সে উদ্বেগ মাখা গলায় বলে,’মা সত্যি?
লায়লা বেগম বলে,’তুই একটু ওকে জিজ্ঞেস করে দেখ না! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে রে!একটু জিজ্ঞেস করবি মা?’
সুফলা হাসে।সে হাসির শব্দ হয় না ‌।সে তার মার সাথে চোখাচোখি করে এবার।এর অর্থ আমি এক্ষুনি ওর সাথে কথা বলছি মা! এক্ষুনি!

পরদিন ভোর বেলা সুফলা আসে রুপার কাছে। এসে খুশি খুশি গলায় জিজ্ঞেস করে,’ওর সাথে তোমার কথা হয়েছে তাই না?’
রুপা অবাক হয়। অবাক হয়ে বলে,’কার সাথে আপু?’
‘পৃথুলের সাথে।’
রুপা মুখ গোমড়া করে জবাব দেয়।বলে,’নাহ।’
সুফলা বড় আশাহত হয়।বড় আশাহত! তবে মা তাকে কী বললো!
মার প্রতি তার রাগ হয়। ভীষণ রকম রাগ। ফুঁসতে থাকে সে রাগে। এই মহিলার সব সময় উত্তেজনা বেশি। উত্তেজনা বেশি না হলে কী এমন ছেলের জন্য ঘরে কেউ বউ আনে!
এরপর সুফলাই নিজের কাঁধে একটা দায়িত্ব টেনে নেয়।সে তার বরের সাথে কথা বলে। সবকিছু খুলে বলে তার কাছে।মিম্মির বাবা অট্টহাসি হেসে বলে,’আমি তো শতবার না করেছিলাম । বলেছিলাম ওকে বিয়ে করানোর কোন প্রয়োজন নাই।শুনলে কথা একবার! তোমার মা তো একেবারে গাছে চড়ে বসলো তখন। ছেলের কোন সমস্যা নাই। বিয়ে করালেই ঘরে বাচ্চা আসবে। এখন কী হলো? উপায় না পেয়ে আমায় খুঁজছো!
এখন বোনজামাইদের কাছে দেও।তারা শ্যালকের বউ রাখুক।’
কথাটা বলে আবার অট্টহাসি হাসে মিম্মির বাবা।
সুফলার রাগ উঠে যায়। এই লোকটা সব সময় মুখকাঁটা। কিন্তু সুফলা জানে মুখকাঁটা হলেও তার চরিত্র ভালো।সে এই বিষয়ে তাকে কোন রকম সন্দেহ করে না।
এরপর সুফলা বলে,’একটা বুদ্ধি সুদ্ধি দেও না।কী করতে পারি বলো না!’
মিম্মির বাবা বলে,’ভিডিও দেখাও।এডাল্টদের ভিডিও। রুপার ফোনে দেও।ও দেখাক ওর বরকে।’
সুফলা বললো,’ধুর!ওরা তো আলাদা আলাদা ঘরে থাকে!’
মিম্মির বাবা বলে,’বাবাকে বলো।উনি বলললেই দেখবে পৃথুল সুরসুর করে ও ঘরে চলে গেছে। রুপার সাথেই রাতে থাকতে শুরু করছে।’
মিম্মির বাবার কথাই সত্যি হলো।সুফলা যখন ওর বাবাকে বললো রুপা মেয়ে মানুষ এ বাড়িতে নতুন আর সে একলা একা একটা ঘরে থাকে।পৃথুল ওখানে যায় না।এটা কেমন দেখায় না বাবা!’
পৃথুলের বাবা সব বোঝে ফেলে। এবং সেদিন থেকেই পৃথুল যে ঘরে ছিল এই ঘর নিজে এসে দখল করে। তারপর পৃথুলকে বলে,’তুমি ও ঘরে গিয়ে থাকো। আমি আজ থেকে এখানেই থাকবো।’
কথাটা বলে চাপা হাসি হাসেন তার বাবা।পৃথুল সে হাসি দেখতে পায় না। কিন্তু তার রাগ হয় খুব। এবং ভয়ে তার ভেতরটা কেমন কাঁপতে থাকে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে