নসীব পার্ট-১৫ ( শেষ পার্ট)

0
2340

#নসীব
#পার্ট_১৫ #শেষ_পার্ট
#আরবি_আরভী

-দেখ সবাই কত খুশি প্লিজ রাজি হয়ে যা,,,

মনের মধ্যে ভয় কাজ করতে লাগল।।সবাই আবার আমাকে বোকা বানাচ্ছেন নাতো।।নীলয়ের পর কাউকে বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হয় আমার।। সিয়াম নিসন্দেহে ভালো ছেলে তাই বলে,,,

-অন্তত বাচ্ছাটার কথা ভেবে হ্যা বলে দে ,,,,এতেই সবার ভালো হবে দেখিস,,

চিন্তায় পড়ে গেছি।। জানি না কি হবে কিন্তু এই মানুষগুলোকে আমি কিছুতেই কষ্ট দিতে পারব না।।

৮ বছর পেরিয়ে গেল।। সাথে জীবন ধারনটাও অনেকটা বদলে গেছে ।আমার মেয়েই আমার সব।।টুশিকে ছাড়া আমরা কিছুই ভাবতে পারি না ওঁ আমাদের জীবন ।। বলে রাখা ভালো,,,, আমার ননদিনী মীনা তার বরের সাথে অস্ট্রেলিয়াতে সেটেল।। আমার শশুড় বাবা আর শাশুড়ি মায়ের মৃত্যুর পর সিয়াম আর আমি নতুন শহরে চলে আসি।।সেখানেই শুরু হয় আমার আর সিয়ামের ছোট সংসার।। বর্তমানে সিয়াম একজন সাকসেসফুল বিজনেসম্যান।। টাকা পয়সা ভালোবাসার কোনো কিছুর কমতি নেই আমাদের।।

সিয়ামের রাজকুমারী টুশি।।বয়স ৮।।অফিস থেকে ফেরার সময় সিয়ামের টুশির জন্য কিছু না কিছু আনতেই হয় তা না হলে সিয়ামকে কানে ধরে বাহিরে দাড়িয়ে রাখে সে।। খুব হাসি পায় বাবা- মেয়ের কান্ড দেখে।।ভালোবাসা কি তা উনার সাথে দেখা না হলে বুঝতেই পারতাম না।। প্রতি রাতে আমার দিকে তাকিয়ে “ভালোবাসি” না বললে নাকি উনার ঘুম হয় না।। ছুটির দিনে তিনজন একসাথে ঘুরতে যাওয়া,খেলাধুলা করা সবকিছু মিলে খুব সুখে আছি আমরা।।

এমনই একদিন টুশিকে স্কুল থেকে নিয়ে আসছি।। টুশি তার বাপ্পীর জন্য একটা কার্ড বানিয়েছে আজ নাকি বাবা দিবস তাই সে এটা দিয়ে তার বাপ্পীকে উইস করবে।। দুজন গাড়িতে উঠবো ঠিক সেই মুহূর্তে একজন লোক পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডেকে উঠে,,,,

-নীলা,,,

আমি পেছনের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ভয় পেলাম।। লম্বা চুল গাঢ় পর্যন্ত।। দাড়ির বাড়ে চেহারা নির্ণয় করা যাচ্ছে না।। শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা।। সে ইশারায় কাছে যেতে বলে,,আমি আস্তে করে বলে উঠলাম,,,

– কে? সরি চিনতে পারছি না,,

সে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,, ভাবলাম ভিখারী হয়তো,,

-সাহায্য প্রয়োজন?? কিছু খাবেন,,??
-আমার সন্তান কোথায়,, তুমি অপারেশন করনি তাই না,,

আমার উপর যেন আকাশটা ভেঙে পরলো বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো।।চোখদুটো খুব চেনা।। আমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললাম,,,

-আ,,আ,,আবির,,

আবির আমার দিকে তাকিয়ে রীতিমত কাদছে।। আমি তাড়াতাড়ি করে টুশিকে নিয়ে দৌড়ে চলে এলাম।। পেছন থেকে আবির চেঁচিয়ে বারেবারে একটা কথায় বলল,,
-আমার সাথে শুধু একবার কথা বল,,প্লিজ শুধু একবার,,

গাড়িতে বসে টুশি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল,,
-পাগলটা কে মামনি??
-কেউ না বাবা,, (মাথায় হাত বুলিয়ে)

বাসায় এসে কাঁন্না করতে লাগলাম।। আমার সাজানো সংসার বুঝি এবার ধ্বংস হয়ে যাবে খুব ভয় লাগছিল।।আবির কি আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে?? উনি সব করতে পারেন? আমি এখন কি করি।।

রাতে অন্যমনস্ক হয়ে থাকলে সিয়াম আমাকে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি ।।

কয়েকদিন পর আবির তখন অফিসে শুয়ে আছি হঠাৎ ছকিনা এসে বলে আমার সাথে নাকি একজন দেখা করতে এসেছে,,, নিচে এসে দেখি আবির।।মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।। সোফায় বসে আছেন।। আমাকে দেখে উঠে দাড়ালেন আমি দৌড়ে গিয়ে উনাকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজাটা দেখিয়ে দিলাম,,,,

-নীলা আমার সাথে একবার কথা বল প্লিজ আমি একবার আমার সন্তানকে দেখব,, আর কিচ্ছু না,,
– আমি আপনাকে চিনি না বেরিয়ে যান,, আমাকে পুলিশ ডাকতে বাধ্য করবেন না,,,

গেইটের দারোয়ান এসে আবিরকে বের করে দিল।।আমি স্তব্ধ হয়ে পরেছি।।এত বছর পরে কেন ফিরেছেন উনি কি চান আমার কাছে।।

বাহিরে বের হতে পারছি না উনার জন্য যেখানেই দেখা হয় উনার একটি কথা শোনার অনুরোধ রয়েই যায়।।রাতে ঘুমিয়ে আছি হঠাৎ ফোনে কল আসে।। আমি ঘুম ঘুম কন্ঠে,

-হ্যালো,,
-নীলা,,
-প্লিজ দয়া করেন আমাকে আর কল দিবেন না,, আমি আপনাকে চিনি না,,
-নীলা তুমি কি ভয় পাচ্ছ আমি যদি তোমার সন্তানকে কেড়ে নেই,,, বিশ্বাস কর আমি এমন কিছুই করবনা শুধু নয়ন ভরে একবার ওঁকে দেখব প্লিজ আগামীকাল দেখা কর জাস্ট একবার প্লিজ প্লিজ আমি কোনো ক্ষতি করব না তোমাদের প্লিজ একবার তারপর আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করব না প্রমিস,,
-ঠিক আছে আগামীকা দেখা করব কিন্তু এটাই লাস্ট বলে দিলাম,,,
-অনেক ধন্যবাদ তোমাকে অনেক,,
-টুট টুট,,

টুশিকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে আবিরের সাথে দেখা করতে গেলাম,,,উনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।।টুশি আইস্ক্রিম খেতে খেতে চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লো।। হাতে মেনু কার্ড নিয়ে অর্ডার করে আবিরের দিকে তাকিয়ে দেখি আবির নয়ন ভরা জল নিয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে আছেন,,

-চোখ দুটো আম্মুর মত, ঠোঁটের নিচের তিলটা তোমার আর ঠোঁট দুটো,,,,,

আমি বিরক্তির ভাব নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলতে লাগলাম,,,

-ঠোঁট দুটো আপনার মত তো ওঁ আপনার মেয়ে এটাই বলতে চাচ্ছেন,,আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবেন ওকে,,,

আবির আমার কোনো কথাই শুনছেন না টুশির কাছে গিয়ে ওঁর হাতে অনেকগুলো চকলেট দিয়ে পাগলের মত চুমু খেতে থাকেন,,,

– শুধু জন্ম দিলেই পিতা হয় না আবির,, আপনি যে দায়িত্ব কর্তব্য গুলো এড়িয়ে গিয়েছিলেন সিয়াম তা পূর্ণ করেছেন,,, ভেবেছেন সবকিছু ভুলে গেছি।। না।। আপনি আমার বাবার খুনী।।তাই আমাদের আর বিরক্ত না করে আপনার পরিবার নিয়ে আপনি সুখে থাকেন আমাদেরো ছেড়ে দিন এটাই চাই,,,
– আমার তো কেউ নেই,,হয়তো কদিন পরে আমিও থাকব না
-কেন তরী আপু খালামনি??
-বিয়ের দিন রাতে তরী অন্য কারো সাথে পালিয়ে যায়,,,,খুব ভালোবাসতাম তাকে,, এই ঘটনার পর থেকে কোনো মেয়েকে আর বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি,,,
-খালামনি,,(আগ্রহ নিয়ে)
-যখন তুমি একদম হারিয়ে গেলে তখন নিপা আম্মুকে তোমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানায়,, তোমাকে করা জুলুমগুলোর কথা মনে করে হঠাৎ আম্মুর হার্ট এটাক হয় তারপর পরকালে চলে যান,, সবসময় বলতো তোমাকে দেখতে চায় তোমার কাছে ক্ষমা চাইবে বলে,, কিন্তু তোমাকে খুজে পাইনি,,,
-আপনার এই অবস্থা ?আর এখানে কিভাবে এলেন??
-আম্মুর চলে যাওয়ার পর রোবট হয়ে গিয়েছিলাম দিন-রাত কাজে ব্যাস্ত থাকতাম কিন্তু আমার পিঠে চুরি দিয়ে আমার সেক্রেটারি আমাকে ধোকা দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্নসাৎ করে ফেলে,,,হিসাব না পাওয়ায় অন্যান্য কম্পানি শেয়ারিং বন্ধ করে দেয়,, ফলে কম্পানি অচল হয়ে পড়ে,,, ব্যাংকের loan পরিশোধ করতে না পারায় একপর্যায়ে আমি সবকিছু হারিয়ে ফেলি,,,, তারপর ভীষণভাবে ডিপ্রেশনে চলে যাই,,, আর এখন তো,,সবকিছুই আমার কর্মের ফল।। আমি অন্য শহরে থাকি খুব কষ্ট করে তোমার ঠিকানাটা জোগাড় করেছি তোমার কাছে একটিবার ক্ষমা চাইব বলে।।জানি কখনো পারব না তবুও বলব আমাকে ক্ষমা কর,,তুমি ক্ষমা না করলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না,,, ক্ষমা কর,,(হাত জোর করে চোখের পানি ফেলে,,

আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেছি।। মনের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে,,

-আর এখন তো কি,,?? বলেন
-আমার ভেতর এমন এক রোগ বাসা বেঁধেছে যা থেকে কখনোই মুক্তি পাবো না,, ডক্টর মিথ্যা আশা দিচ্ছে আমি তো জানি আমার আর বেশি দিন নেই,,,

তার কথাগুলো শুনে আমি যেন পাথর হয়ে গেছি।। ওয়েটার বিল দিয়ে গেলে আবির এক নজর মানিব্যাগটার দিকে তাকিয়ে আমার কাছ থেকে চোখ লুকাতে শুরু করল,,, আমি কিছু না দেখার ভান করে বিলটা প্যায় করে দেই।। তারপর উনাকে ১ লাখ টাকার চেক দিলাম।। উনি কিছুতেই নিতে চাচ্ছেন না খুব জোর করেই দিলাম।। উনি মৃদু হেসে চলে যাচ্ছেন,,,মনের মধ্যে অনেকগুলো কথা নাড়া দিতে লাগল।।এই সেই ব্যক্তি যে একসময় আমার পুরো দুনিয়াটা উলোটপালোট করে দিয়েছিলেন।। যার জন্য আমার বাবাকে হারিয়েছি।।সমাজ আমাকে অন্য নামে ডেকেছে।। মানুষ আমার দিকে বদনজরে তাকিয়েছে।।উনি চাইলেই আমাকে মেনে নিতে পারতেন কিন্তু উনি তা করেননি।। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন তিনি সব দেখেন।। কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ কোনোদিন সুখী হতে পারে না,, আল্লাহ বিচার করেছেন,, আমিও বলব আপনাকে ক্ষমা করেছি আবির আপনি মুক্ত আপনি মুক্ত আবির,,,

হঠাৎ সিয়ামের কল,,,
-কি করছ?
-কিছু না,, (চোখের পানি মুছে)
-ভালোবাসি,,
– অনেক বেশি ভালোবাসি

(উপরের দিকে থুথু ছুড়লে সেই থুথু নিজের উপরে এসে পরে।। সময় পরিবর্তনশীল।।জীবনে চলার পথে আবিরের মত একজন আসে যে জীবনটা একদম ধ্বংস করে দেয় সেই সুযোগে মুখোশ পড়া কয়েকটা মানুষ পাশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ করে যে ওঁরা আসলে আমাদের বন্ধু যেমনটা করেছে নীলয় আসলে তা নয় ওরাও হতে পারে আরও বেশি ভয়ংকর তাই বলে যে ভালো মানুষ নেই তা না আমরা খারাপের সাথে পরিচয়ের ভীড়ে কিছু ভালো মানুষকেও বিশ্বাস করতে ভয় পাই যেমন সিয়াম)

♪♪♪♪♪♪সমাপ্ত ♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে