#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: আট
সন্ধ্যা নামছে, সাথে শহরের ব্যস্ততাও। দুপুরের আলসে সময়ের পর পর শহরও নীরব হয়ে যায়, জমজমাট হয়ে উঠে সন্ধ্যার পরে। নয়নাকে বিদায় জানিয়ে তূর্য নিজের পথে চলে যায়। বহুদিন পর নয়না মনভরে নিঃশ্বাস নিয়েছে। প্রাণবন্ত হাসিতে ঝনঝন করে উঠেছে মন ও শরীর। বাড়ি ফিরতে নয়নার বেশ দেরী হয়ে গেলো। পৃথিবীর বুকে তখন আঁধার নেমে এসেছে। নয়না কলিং বেল চাপ দিলো। সময় নিয়ে দরজা খুলে দেয় রিহান। তার চোখ মুখ শুঁকনো হয়ে আছে। নয়নাকে দেখামাত্রই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করে সে। নয়না হতবাক বনে গেলো। রিহানের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ” কী হয়েছে আমার ভাইটার?”
” ভাইয়া বলেছে, আগামীকাল আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিবে, নয়ন আপু। মাকে বুঝাও আপু,আমি হোস্টেলে থাকবো না।”
নয়নার অন্তর কেঁপে উঠে। প্রশ্ন জাগে, হঠাৎ রিহানকে কেন বাশার ভাই হোস্টেলে পাঠাবে? নয়না একবার ভাবে, বাশারকে জিজ্ঞেস করবে পরক্ষনেই বাশারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা মনে পড়লে চুপসে যায় সে। নয়নাকে তার কাছে যেতে দেখলে নিশ্চয়ই ভেবে নিবে সে বাশারের ডাকে সাড়া দিয়েছে কিন্তু বাস্তবে নয়না এমনটা কিছুই চাইছে না।
রিহানক নিয়ে নয়না ঘরে চলে আসে। ওড়নার আড়াল থেকে নেতিয়ে যাওয়া শাপলার মালা বের করে সে। রিহানকে আজকের দিনের সব ঘটনা খুলে বলে। আকলিমা বাসায় নেই, বাজার করতে গেছে। বাশার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেছে। নয়না তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারছে। রিহান মালাখানা উলট পালট করে দেখে বলল,” আপু, ডাক্তারটা কিন্তু খুব সুন্দর। ”
” হ্যাঁ, কিন্তু জানিস রিহান! মানুষটা অদ্ভুতও।”
নয়নার আনমনে উত্তরে হাহাকারের আভাস পাওয়া গেলো। তবে কী অল্প সময়ের মধ্যে নয়নার মনে তূর্যের জন্য আলাদা জায়গা করে নিয়েছে? মনে ডাক্তারকে স্থান দিলেই বা কী! ডাক্তার তো সপ্তাহ খানিক পর বিদেশে পাড়ি জমাবে। নয়নাকে কী তার তখন মনে পড়বে? নয়না আর ভাবতে চায় না। সে কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। বাস্তবে তূর্যের সাথে দেখা না হোক! স্মৃতির পাতায় তূর্যকে নিয়ে ভাববে সে।
————-
রাত দশটায় আকলিমা, বাশার ও অপরিচিত একজন ছেলে বাড়িতে আসে। নয়না রান্নাঘরে তখন ব্যস্ত। আকলিমার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে আসে সে। অপরিচিত মানুষ দেখে মাথার কাপড় ঠিক করে। অপরিচিত ছেলেটা নয়নার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে বাঁকা হাসলো। নয়নার কাছে ছেলেটির তাকানো ভালো লাগেনি। এমনভাবে বাশার তাকে দেখে। কাচুমাচু হয়ে নয়না আকলিমার উদ্দেশে বলল,” ডাকছিলে ফুফু?”
আকলিমা রেগেমেগে তেড়ে নয়নার কাছে আসলো। দুই গালে থাপ্পড় বসিয়ে বলল, ” সারাদিন কোন না’গ’রে’র সাথে ঘুরে বেড়িয়েছিস? সত্যি করে বল ছেলেটা কে?”
নয়না হতভম্ব হয়ে যায়। ভয়ে শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। এতোদূরের পথ সম্পর্কে ফুফু কীভাবে জানে? মনে প্রশ্ন জাগে। মিথ্যা বলল নয়না,” কেউ ছিল না।”
বাশার কথার ফোড়ন কেটে তখন বলল,” মিথ্যা কেন বলছিস। নুমান নিজ চোখে তোকে দেখেছে। আর আমিও নিজের চোখে তোকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছি।”
ছেলেটির নাম নুমান। নয়না এতক্ষণে বুঝতে পারে, এসব বাশারের কারসাজি। নুমান এবার মুখ খুলল, ” এটাই তো সেই মেয়ে, যাকে আজ আমি বেলাই বিলে দেখেছি। বাশার তো বলেছিল, ছেলেপেলে দিয়ে ব্যাটাকে আচ্ছা রামধোলাই দিতে কিন্তু দেখতেই বোঝা গেছে বড়োলোক বাড়ির বিগড়ে যাওয়া সন্তান, তাই চেপে গেছি।”
আকলিমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। সে নয়নাকে চড় থাপ্পড় দিয়ে যাচ্ছে আর সাথে অকথ্য গালিগালাজ। নয়না কাঁদতে কাঁদতে বারবার ক্ষমা চাইছে কিন্তু আকলিমা তা শুনলো না। একসময় নয়নার নাক দিয়ে র’ক্ত বের হওয়া শুরু করল। বাশার তা দেখে মায়ের উদ্দেশে বলল, ” থামো এবার। জেলে যাওয়ার শখ হয়েছে নাকি?”
রিহান পর্দার আড়াল থেকে নয়নার মার খাওয়া দেখছে। ছেলেটা একবার আঘাত পেয়ে ভয় পেয়েছে। নয়নার কষ্ট দেখে কাঁদছে সে। আকলিমা ক্লান্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায়। রিহানকে দেখে বাশার নিজের ঘরে আটকে রাখে। নুমান বাশারকে ইশারায় বাহিরে ডেকে এনে বলল,” যাই বলিস বাশার, তোর বোনটা কিন্তু ভীষণ সুন্দরী। দুধে আলতা গায়ের রং! একটু যত্ন পেলে ঝলমল করবে শরীর। একটা কাজ করলে হয় না! মেয়েটাকে এতো মারধর না করে আমাকে দিয়ে দে।”
নুমান কথা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই বাশার নুমানের নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে বলল, ” নয়না আমার জিনিস। একদম নজর দিবি না, শা’লা। চোখের সামনে খাবার পেয়েও আমি খেতে পারছি না সেখানে তুই উড়ে এসে নিয়ে চলে যাবি? জান বাঁচাতে চাইলে আমার সামনে আর আসবি না।”
নুমান বন্ধুকে গালি দিতে দিতে বাড়ি ছাড়লো।
নয়নার শরীরে শক্তি নেই। নাকের র’ক্ত ঝড়া বন্ধ হচ্ছে না। ওড়না চেপে ধরে রেখেছে সে। এতো অত্যাচার সহ্য করতে পারছে না নয়না। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় আবারও বাড়ি ছাড়বে। সেবার বাবা ছিল, পিছুটান ছিলো নয়নার। এখন তার ইহজগতে কেউ নেই। নয়না বাচলো কর মরলো তা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথাও নেই। দুর্বল শরীরে নয়না বাড়ি থেকে বের হতে চাইলে বাশার পথ আটকায়। নয়নাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড় বরাবর নাক রাখে। লম্বা করে নয়নার শরীরের ঘ্রান শুঁকে বলে, ” এখনও সময় আছে, নয়না। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যা। নয়তো মায়ের হাতে এভাবেই মার খেতে থাকবি।”
” আমি মরে যাবো, তবুও তোমার হবো না।”
কাঁপা স্বরের উত্তরে বাশারের রাগের মাত্রা বেড়ে গেলো। সে নয়নাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,” আপোষে না পেলে জোর করতে আমি জানি। আজ তোকে আমার হতেই হবে।”
নয়নার ওড়না দিয়ে খুব শক্ত করে মুখ বেঁধে ফেলে বাশার। নয়নাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় বাড়ির বাইরে। নয়না যথাসম্ভব নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে। আকলিমা কি যেন ভেবে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। বাশারের এহেন আচরণে চিৎকার করে বলল,” কি করছিস, বাশার?”
নয়নার হাত ছেড়ে দিলো বাশার। আমতাআমতা স্বরে বলল, ” ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম আরকি।”
” এতো রাতে কোন ডাক্তারের কাছে নিবি? ঐ মেয়েকে এতো আহ্লাদ কেন করছিস,শুনি? ছেড়ে দে! ওর মুখ বেঁধেছিস কেন?”
” আমাকে বাপ মা তুলে বকছিল, মা। তাই!”
বাশারের একের পর এক মিথ্যা কথাতে নয়না মাথা ঝাঁকিয়ে না বোধক ইশারা করছে। হাত ছাড়া পেয়ে চট করে মুখ খুলে বলল,” আমাকে বাঁচাও, ফুফু নয়তো একদম মেরে ফেলো। বাশার ভাই আমার সর্বনাশ করতে চাইছে।”
যতটুকু সহানুভূতি আকলিমার মনে তৈরি হচ্ছিল তা নিমিষেই ফুরিয়ে গেলো। ছেলেকে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। তার মতে, নয়না তার মায়ের মতো। নয়নার মা যেভাবে তার ভাইকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছিল, নয়নাও সেভাবে তার ছেলেকে ফুসলিয়ে নিজের করতে চায়। আকলিমা নয়নার হাত ধরে টেনে বাড়িতে নিয়ে আসে। নয়নাকে ঘরে আটকে রেখে বাহির থেকে তালাবদ্ধ করে দিলো সে। বাশারের উদ্দেশে রেখে বলল,” এই মেয়ের আশেপাশে তোকে যেন না দেখি।”
বাধ্য ছেলের মতো বাশার মায়ের কথা মান্য করে ঘরে চলে যায়। আকলিমা নয়নাকে শুনিয়ে বলল, ” বে’শ্যা’বাড়ি যেতে পারিস না? আমার ছেলেকে কেন নষ্ট করতে চাচ্ছিস?”
নয়না উন্মাদের মতো ভেতর থেকে হেসে উত্তর দিল,” আমাকে মে’রে ফেলো,ফুফু! আমি আর বাঁচতে চাই না।”
পরদিনই রিহানকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বাশার নিজেই সবকিছু ঠিকঠাক করে এসেছে। তার মনে কী চলছে সেই জানে! বাড়ি ফিরে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। তাকে বাঁধা দেয়ার মতো আর কেউ নেই। সমাজের লোকেদের ভয়ে নয়নাকে নিয়ে বাহিরে সে যেতে পারবে না। যাই করবে এবাড়িতে থেকেই করবে। নয়নার এমন অবস্থা সে করবে যেন কাউকে বলতে না পারে। নয়নার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা ভাবতেই শরীর গরম হয়ে আসে বাশারের।
—————
সপ্তাহ দুয়েক পর এক সকালে নয়না রান্না করছিল। কলিংবেলের আওয়াজ তখন তার কানে আসে। এতো সকালে কেউ আসে না। ভীত পায়ে নয়না প্রধান ফটক খুলে দেয়। নয়নার ফুফা অর্থাৎ আকলিমার স্বামী হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে নয়নাকে দেখে বলল, ” কেমন আছিস,মা!”
দীর্ঘদিন পর কারো মুখে আদুরে ডাক শুনতে পেয়ে নয়না কাঁদতে কাঁদতে বলল, ” বাবার জানাজায় আসলে না কেন,ফুফা?”
“নুরুজ্জামান মারা গেছে? কবে? কীভাবে? আকলিমা তো আমাকে কিছুই জানায়নি!”
বাশারের বাবার কথায় তাচ্ছিল্য হাসে নয়না। আপন ফুফু এতোটা নিকৃষ্ট হতে পারে আকলিমাকে না দেখলে কেউ বুঝতো না। মিছে হেসে নয়না বলল,” তুমি কষ্ট পাবে,তাই হয়তো বলেনি!”
চলবে……………..