#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: সাত
কল্পনার জগতে সবার স্বপ্নই পূরণ হয় কিন্তু বাস্তবে কখনো পূরণ হয় না; স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়। পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আছে যাদের স্বপ্ন বিশাল কিন্তু পূর্ণ হতে হতে আয়ু শেষ হয়ে যায়। আবার কখনো ম্যাজিকের মতো কেউ এসে স্বপ্ন সত্যি করে দেয়! লাখে একজন সেই ভাগ্যবান হয়। নয়নার জীবনে এমন একজনের খুব প্রয়োজন। বাস্তবে নয়নার মতো মেয়েদের জীবনে এমন কেউ আসে না৷ সমাজের কটুবাক্য আজীবন তাদের শুনতে হয়।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। অর্ধ পরিচিত একজন ছেলের সাথে নয়না যাচ্ছে, গন্তব্য তার এখনও অজানা। অর্ধ পরিচিত বলার কারণ, নয়না তূর্যের সম্পর্কে শুধু জানে সে একজন ডাক্তার। কার ছেলে, কার ভাই, কার বন্ধু কিছুই জানে না সে। মোটকথা ব্যক্তিগত জীবনে তূর্য কেমন সেই সম্পর্কেও অজ্ঞ সে। নয়নার বাবার মৃত্যুর সময়কার সাহায্যের কারণে সে তূর্যকে ভাল মনের মানুষ বলেই চিনে। সেই সূত্রপাতে আজকে তূর্যকে বিশ্বাস করেই অজানা গন্তব্যে যেতে রাজি হয়েছে। এছাড়াও সন্ধ্যার আগে সে বাড়ি ফিরতে পারবে না। পথঘাটে কতক্ষণই বা ঘুরে বেড়াবে। ব্যস্ত শহরে সবাই যে ব্যস্ত থাকবে তা কিন্তু নয়! আবার সবার মনই যে তূর্যদের মতো থাকবে তাও নয়। বাশারের মতো হাজার হাজার পুরুষ রয়েছে যাদের নজর একবারের জন্য হলেও নয়নার উপর পড়বে। তখন সে কোথায় যাবে? একাকী নয়নাকে পেয়ে নিশ্চয়ই তারা খুবলে খেতে চাইবে!
গাড়ি চলছে গাজীপুরের পূবাইলের পথে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়নাকে মুগ্ধ করছে। কানাইয়া পৌঁছে নয়না গাড়ি থেকে নামার জন্য ছটফট করতে শুরু করে। তূর্য আয়নায় দেখে মুচকি হাসে। বাবাহারা মেয়ের মন শান্ত করার জন্য তূর্য শান্তির জায়গায় তাকে নিয়ে এসেছে। কানাইয়া ব্রিজের পাশে গাড়ি পার্ক করে বের হয়ে আসে তূর্য। তার হাতে মাঝারি সাইজের হাত ব্যাগ। নয়না জিজ্ঞাসু চোখে তূর্যের দিকে তাকালে তূর্য হেসে বলল, ” সময় হলে এই ব্যাগের ভেতর কী আছে তা জানতে পারবে।”
নয়না কথা বাড়ায় না। তূর্যকে অনুসরণ করে পথ এগোয়। কানাইয়া ব্রিজ থেকে ইটের রাস্তাধরে আগাচ্ছে তূর্য তাকে অনুসরণ করছে নয়না। মনে হচ্ছে, একটি জীবন্ত পুতুল তার মালিকের অনুগত্য করে যাচ্ছে। ইটের রাস্তার পাশেই বেলাই বিল। আট কিলোমিটার বিস্তৃত বিলের বুকের উপর শাপলা ও কচুরিপানা শোভা পাচ্ছে। নয়না মুগ্ধ নয়নে তা দেখছে। খুশিতে তার চোখ চিকচিক করছে। আল্লাহর সৃষ্টি কতো সুন্দর, তা এখানে না আসলে সে বুঝতেই পারতো না। নয়নার থেকে কিছুদূরে তূর্য মাঝির সাথে দামদর করে নিল। তারা বিলের বুকে দুই ঘণ্টা সময় থাকবে এই চুক্তিতে নৌকা ভাড়া করলো। নয়না তূর্যের দিকে ফিরে তাকালে তূর্য বলল,” চলে এসো, আমরা নৌকায় চড়বো।”
নয়না কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,” নৌকা কী আপনি চালাবেন?”
” আমি ডাক্তার, মাঝি নই।”
নয়না জিভ কাটে। সত্যিই তো! ডাক্তার মানুষের কাজ হচ্ছে কা’টা’কা’টি করা, প্রেসক্রিপশনে ভুজুংভাজুং লেখা লেখে সাধারণ মানুষদের কনফিউশানে ফেলা সেখানে নয়না ডাক্তাকে কীসব বলছে। মাথা নত অবস্থায় নয়না এগিয়ে যাচ্ছে। মাথায় এখনো তূর্যের বলা কথা বাজছে। নৌকায় পা বাড়ানোর সময় অমনোযোগী হয়ে যায় নয়না, ফলস্বরূপ পা পিছলে পড়ে যেতে নেয় সে। তূর্য নয়নার ভাবগতি লক্ষ্য করছিল, নয়নাকে পড়ে যেতে দেখতে পেরে হাত শক্তকরে ধরে ফেলল সে। ভয়ে নয়না চোখ বন্ধ করে নেয়, তূর্য তার বুজে থাকা চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল, কতো সময় তার জানা নেই। চিন্তন ফিরে আসতেই নয়নার হাত তাৎক্ষণিক ছেড়ে দিয়য়ে বলল,” সবসময় কেন তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকো? এটা কী লঞ্চ পেয়েছো! যে নির্দিষ্ট সময় না উঠলে ছেড়ে দিবে? আসো আমি তোমাকে হাত ধরে উঠতে সাহায্য করি।”
কথা বলতে বলতে এক লাফে তূর্য নৌকায় চড়ে দাঁড়ায়। নৌকার তখন ঝুলছে, নয়না তা দেখে মিনমিন করে বলল, ” নৌকা ঝুলছে, আপনি আমাকে ফেলে দিবেন না তো?”
তূর্য হতাশ হলো কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল,” অবিশ্বাস করা কী তোমার বংশগত বৈশিষ্ট্য?”
” জি!”
নয়নার কথার গ্রাহ্য না করেই তূর্য হাত মেলে ধরে বলল,” আমার হাত ধরে উঠে এসো। ভয় নেই, ফেলে দিব না। আমরা ডাক্তাররা জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। আমি সজ্ঞানে তোমার কোনো ক্ষতি হতে দিব না।”
মুগ্ধ হয়ে নয়না তূর্যের কথা শুনে গেলো। শিক্ষিত মানুষদের কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো, তারা মানুষের সাথে খুব সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে। তাদের কথায় আলাদা মুগ্ধতা থাকে। ছাঁদ বিহীন নৌকা হেলেদুলে চলছে সাথে নয়না আর তূর্যও।
বেলাই বিলের বুকে নৌকার ছড়াছড়ি। দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই সময় কাটানোর জন্য এসেছে। নয়নার সেদিকে ধ্যান নেই, সে প্রকৃতির সাথে মিশে সময়টা উপভোগ করছে। মাঝে মাঝে পানিতে হাত ডুবিয়ে শাপলা তুলে নিচ্ছে, পানির ছিটিয়ে খিলখিল করে একাকীই হাসছে। তূর্য নয়নার আড়ালে একটি ছবি তুলে নেয়। সে কেন এমন কাজ করলো নিজেও জানে না। অবহেলিত সমাজে আমরা যখন কারে কাছে গুরুত্ব পাই, তখন সবকিছু ভুলে তাকেই আপন ভেবে নেই। মন খুলে তখন নিঃশ্বাস নেই। নয়নাও মন খুলে আজ নিঃশ্বাস নিলো। দুই হাত মেলে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল,” আজকের দিনটার কথা আজীবন মনে রাখবো। দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে ঋণী করে দিলেন, ডাক্তার সাহেব! এই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?”
” আমাকে সঙ্গ দিলে কিছুটা ঋণ শোধ হতে পারে, মিস নয়ন।”
নয়না চোখ খুলে দেখতে পায় তূর্য খাবার নিয়ে বসে হাসে। নৌকার উপর রোমাল বিছিয়ে খুব সুন্দর করে খাবার ডেকোরেশন করেছে তূর্য। নয়না অবাক হয়ে যায়, খাবারের আইটেম বিরিয়ানি, পাস্তা, জুস আর কোঁকাকোলা। তূর্য খাবার পরিবেশন করতে করতে বলল,” এখানে খাবার পাওয়া যায় না। আমি সবসময় রান্না করেই নিয়ে আসি। প্রত্যেকবার নৌকার মাঝি আমার মেহমান হয়। আর আজ!”
” আর আজ আমি আপনার মেহমান, তাই তো?”
তূর্য চমৎকার হাসলো। নয়নার দিকে পাস্তা এগিয়ে দিতে দিতে বলল,” তোমার ব্রেন তো খুবই পরিষ্কার! পড়াশোনা কতদূর করেছো?”
” অনার্সে দ্বিতীয় বর্ষ।”
এক চামচ বিরিয়ানি মুখে নিতেই নয়না চোখ বন্ধ করে ফেলে। একজন ছেলের হাতের রান্নার স্বাদ এতোটাই মজা যে তার আরো খেতে ইচ্ছে করছে। পরপর কয়েক চামচ খেয়ে নয়না বলল,” আমও এতোদিন ভাবতাম, ডাক্তাররা শুধু কাটা ছেঁড়াই করতে জানে অথচ ডাক্তাররা যে এতো ভালো রান্নাও জানে তা আজ জানলাম।
তূর্য হাসলো। একজন মেয়ের কাছ থেকে রান্নার প্রশংসা শুনে লজ্জা পেল। সবকিছু একপাশে রেখে সিরিয়াস হলো তূর্য। নয়নাকে এখানে নিয়ে আসার আরে একটি কারণ আছে। আজ সেই বিষয়ে নয়নার সাথে কথা বলবে। তূর্য নিজেকে তৈরী করে বলল,” ফুফুর কাছ থেকে চেলে আসছো না কেন?”
অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায় নয়না। তার সম্পর্কে তূর্য একটু বেশিই আগ্রহ প্রকাশ করছে না তো! নয়নার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও সে জ্ঞাত! নয়না উত্তর দিলো,” দুইজন মানুষের মুখের দিকে চেয়ে এখনো ওই বাড়িতে পড়ে আছি।”
” কে? কাদের কথা বলছো?”
” রিহান, যাকে আপনি বাঁচিয়েছিলেন। আরেকজনের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক বা থাকলেও সে আমার খুবই আপন। আমার ফুফা মো: হাফিজুল ইসলাম। ওনি কাজের সুত্রে সীতাকুণ্ডে থাকেন। আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। বাবার পর তিনিই আমার পরম আপনজন ছিলেন। ফুফুর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক থাকলেও ফুফা আমাকে এবাড়িতে নিয়ে এসেছেন। উনি যতদিন বাড়ি থাকেন আদরে যত্নে আমাকে কমতি দেন না। রিহান তার বাবার মতো, আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।”
” আর তোমার ফুফু ও তার ছেলে?”
আকলিমা ও বাশারের কথা উঠাতেই নয়না চুপ বনে যায়। তাদের সম্পর্কে সে কীই বা বলবে! নয়নাকে চুপ থাকতে দেখে তূর্য বলল,” যাই বলো নয়ন! তুমি কিন্তু খুবই সুইট মেয়ে। আমি চলে গেলে তোমাকে মনে রাখবো।”
” আপনি কোথায় চলে যাবেন?”
নয়নার হতভম্ব উত্তর তূর্যের ভীষন মনে ধরে। সে মুচকি হেসে বলল, ” এক বছরের জন্য আগামী সপ্তাহে সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি।”
” অহ!”
নয়নার হতাশার সুর তূর্যের কানে আসলো। সে আক্ষেপের স্বরে বলল,” তোমার জীবনটাকে গুছিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তাতে রাজি না। একটা কথা শুনে রাখো, নয়ন! পৃথিবীতে ভালো মানুষের পরিসংখ্যান করলে দুই থেকে তিনজনকে পাবে। সবাইকে বিশ্বাস করো না।”
নয়না ডাগরডোগর চোখে শুধু শুনেই গেলো। আজকের দিনটা শেষ না হোক! কিছুক্ষণ পরই তো সন্ধ্যা নামবে সাথে নয়নার জীবনেও আঁধার নামবে।
একটি ছোট্ট মেয়ে নৌকায় করে শাপলা ফুলের মালা বিক্রি করছে। তূর্য মেয়েটাকে ডেকে মালা কিনে নিলো। নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মেয়েটাকে আমার তরফ থেকে সামান্য উপহার।”
নয়না গ্রহন করে নিল। শাপলা ফুলের মালা গলায় পরে বলল,” আমাকে কেমন লাগছে?”
তূর্য আনমনে উত্তর দেয়,” পদ্মফুলের মতো!”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। জনে জন্য মানুষও কমে এসেছে। দুই ঘণ্টার কথা বললেও চার ঘণ্টা বেলাই বিলের কাটিয়েছে দুইজন। কানইয়া ব্রিজে পৌঁছানোর পথে ইটের রাস্তা পড়ে। তূর্য সেদিকে তাকিয়ে বলল,” বর্ষাকালে এই রাস্তায় পানি জমে থাকে। খালি পায়ে হাঁটার অনুভূতি দারুণ হয়। তুমি সময় করে বর্ষাকালে এসো। তখন আমার কথা মনে করবে।”
” আমি আজীবন আপনাকে মনে রাখবো, ডাক্তার!”
তূর্য হেসে বলল,” আমাদের মাঝে আজ যেই বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছে তা আজীবন থাকবে। আমিও তোমাকে ভুলবো না।”
অপরিচিত থেকে পরিচিত, পরিচিত থেকে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রণয়! আদৌও কী সম্ভব? নয়নার মন আজ আকাশ বাতাসে উড়ছে। তার জীবনের সকল কষ্ট ধুয়েমুছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আদৌও কী তাই! নয়না কী জানে, দূর হতে একজোড়া চোখ নয়নাকে পর্যবেক্ষণ করছে! মুঠোফোন বের চোখ জোড়ার মালিক কাউকে ফোন করে বলে,” পেয়েছি, কিন্তু সাথে একজন ছেলেকে দেখতে পাচ্ছি। বয়ফ্রেন্ড হতে পারে। কী করব?”
অপর পাশ থেকে উত্তর আসে, ” মে’রে ফেল।”
চলবে……………..