নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৪

0
407

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: চার

শেষরাতে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে নয়নার ঘুম ভাঙে। তরতর করে তার শরীর ঘামতে শুরু করে। তৃষ্ণার্ত গলা, ভীত চোখ জোড়া এক ফোঁটা পানির খোঁজ করছে। হৃদপিণ্ডের দ্রুত উঠানামা জানান দিচ্ছে সে এই মুহূর্ত প্রচন্ড ভয় পেয়েছে। মানুষ যখন কোনো বিষয় নিয়ে আশঙ্কায় থাকে অথবা একজন মানুষকে যখন কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত চাপ দেয়া হয় যা দিনে রাতে তাকে সেই বিষয় সম্পর্কে ভাবায়, তখন স্বপ্নঘোরে সে তাই দেখে। নয়নার কাছে স্বপ্নটা জীবন্ত মনে হচ্ছে। সন্দেহ দূর করার জন্য সে দরজার দিকে তাকায়, নাহ! দরজা সে যেভাবে আটকে রেখেছিল সেভাবেই আছে। পানির জগ খালি, এই রাতে নিশ্চয়ই সবাই ঘুমে মগ্ন। ঘর থেকে বের হয়ে পানি আনতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায় নয়না। রান্নাঘরের পশ্চিম পাশটার ঘরটা বাশারের ঘর সেখান থেকে এখনো আলো জ্বলছে। নয়না তা দেখে শুঁকনো ঢোক গিলে। যথাসম্ভব শব্দহীন পায়ে পানি পান আনতে যায়। বলে না! ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়’ অর্ধ পোশাকে বাশার দরজা খুলে বের হয়ে আসে। দরজার আড়ালে নয়না তখন লুকিয়ে, নিশ্বাসের গতি নামা নিয়ন্ত্রণ করে রাখে কিছু সময়ের জন্য। বাশার চারদিকে না তাকিয়ে সরাসরি ফ্রিজের দিকে এগোয়। ঠান্ডা পায়েসের বাটিতে আঙুল ভিজিয়ে চেটেপুটে খেয়ে নেয়। নয়না আড়াল থেকে সবকিছুই দেখছে, ঘৃণায় পেটের ভেতর থেকে সব গুলিয়ে আসছে। বাশার নামক মানুষটার প্রতিটা কাজে সে ঘৃণিত ইশারাই বুঝতে পায়। অথচ সে গোটা বিশ্বের কাছে পবিত্র ছেলে।
বাশার যেভাবে আসছিল সেভাবেই ঘরে চলে যায় তবে এবার সে দরজা আটকায় না। নয়না পড়ে মহা বিপাকে, যদি ভুলক্রমে বাশার তাকে একবার দেখতে পারে তো রক্ষা নাই। ধীরপায়ে নয়না নিজের ঘরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। খাবারের টেবিলের কাছাকাছি আসতেই বাশার পুনরায় ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। এবার কোনোদিকে না তাকিয়ে নয়নার কাছে এসে বিশ্রীভাবে হাসলো। ঝট করে নয়নার হাত ধরে বলল,” আমি জানতাম, তুই আমার কথায় রাজি হবি। আর একমুহূর্তও দেরী করিস না, নয়না। আমার ঘরে চল। মা কিছুই টের পাবে না।”

” হাত ছাড়ো, বাশার ভাই। নয়তো আমি তোমাকে আঘাত করে বসবো।”

” আমাকে রাগাস না, নয়না। আপোষে রাজি হয়ে যা, নয়তো আমি কী কী করতে পারি আজ দেখলিই তো। ”

নয়না হাত মোচড়াচ্ছে, ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। একজন পুরুষের শক্তির কাছে নারীর শক্তি কিছুই না। নয়নার ক্ষেত্রেও তাই। তার আর পানি পান করা হলো না, বাশারের হাতেই তৃষ্ণার্ত অবস্থায় হরন হবে তার শরীর! রিহানের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে নয়না নড়েচড়ে দাঁড়ায়, উৎসুক দৃষ্টিতে রিহানের আগমনের প্রার্থনা করে নয়না। রিহান ঘুম ঘুম চোখে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসে। হাতে পায়ের বিভিন্ন স্থানে তার ব্যান্ডেজ। নয়নাকে এই বাড়িতে যদি কেউ আপন ভাবে তবে সে রিহান। পূর্বে বাশারের নজর নয়নার উপর ছিল আজকাল যা শরীরে হাত দেয়া পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। রিহান বুঝে, না বুঝে নয়নার সামনে ঢালস্বরূপ দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বাশার এবং নয়নাকে একসাথে দেখতে পেয়ে যা বুঝার বুঝে যায় সে। বাশারের উদ্দেশে বলল,”” আপার হাত ছাড়ো, ভাইয়া।”

উপরওয়ালা কখন কাকে কার দ্বারা, কীভাবে কাকে সাহায্য করেন তিনিই জানেন। নয়না রিহানের কাছে চির কৃতজ্ঞ। সবসময়ের মতো আজও তার ছোট ভাই তাকে রক্ষা করতে ঢাল হয়ে আসছে। বাশার রিহানের কথা কানে নেয় না, রিহানকে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকে সে, ” রিহান, কী হয়েছে ভাইয়া? কিছু খাবে? ভাইয়াকে বলো, এনে দেই?”

” তুমি নয়না আপার হাত ছেড়ে দাও, ভাইয়া। নয়তো আমি মাকে ডাকবো।”

” তোর আপাকে একটা পড়া বুঝিয়ে দিব, তুমি ঘরে যাও, ঘুমিয়ে পড়।”

রিহান দমিয়ে যাওয়ার পাত্র না। সে বাশারের কাছে এসে এক ঝটকায় নয়নার হাত ছাড়িয়ে নেয়। দশ বছর বয়সী ভাই, বাশারের কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছে বিষয়টা যেমন বাশারের কাছে লজ্জার তেমন রাগের। বাশার কিছু বলার উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বে রিহান বলল,” তুমি রাতে লুকিয়ে সিগারেট আর কোকাকোলার মতো বিশ্রী গন্ধের পানি পান করো, মাকে কিন্তু বলে দিব। আপার থেকে দূরে থাকো, ভাইয়া। ”

বাশারের এমন রূপ নয়না ছাড়াও কেউ জানে! বাশার ঘামছে আর ভাবছে কীভাবে রিহান এসব জানলো? পরমুহূর্তে মনে পড়লো কিছুদিন আগের কথা, রিহান ভাইয়ের সাথে ঘুমাবে বলে বায়না ধরেছিল। আকলিমা নিষেধ করেনি, ভাই ভাই একসাথে থাকবে; এটা আনন্দের। কিন্তু নাকচ করেছিল বাশার, সে ঐদিন মা’দ’ক’দ্র’ব্য বাড়ি এনেছিল। রিহানকে সেদিন অনিচ্ছায় সাথে এনেছিল। সে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর মা’দ’ক’দ্র’ব্য সেবন করেছিল কিন্তু সে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি যে রিহান সজাগ ছিল। রাগে গজগজ করতে বাশার ঘরের দরজা আটকে দেয়।

নয়না ছলছল চোখে রিহানের হাতে ও শরীরে হাতড়াচ্ছে। রিহানকে সে সেদিন অনিচ্ছায় আঘাত করেছিল। আকলিমা ও বাশার নয়নাকে তো রিহানের কাছেও ঘেষতে দেয়নি। রিহানের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে বলল, ” আমি তোকে ইচ্ছে করে আঘাত করিনি, রিহান।”

” আমি সুস্থ আছি, আপা। পানি খাব।”

নয়না রিহানকে চেয়ারে বসিয়ে পানি আনতে চলে যায়। দুই ভাই বোন গলা ভিজিয়ে আরো কিছুক্ষণ দুঃখ সুখের গল্প করে নেয়। নয়না আজ রিহানের জন্য বেঁচে গেছে কিন্তু পরেরবার! পরেরবার তাকে কে বাঁচাবে?

————————–

দুই সপ্তাহ পর। সময় তখন সকাল দশটা বাজে। ব্যস্ত নগরীর মানুষদের ব্যস্তকর্ম তখন শুরু হচ্ছে। ব্যস্তময় শহরে ট্রাফিকের লাল বাতি, সবুজ বাতি জ্বলা শুরু করেছে। নয়নার অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা আর কিছুদিন পর। ক্ষুধার্ত পেটে বই কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে সে। আরো একটা কারণ আছে, নুরুজ্জামান তাকে ডেকেছেন। সকালের নাশতা সেই তৈরি করেই এসেছে। আকলিমার ইদানীং হাঁটুতে ব্যথা এসেছে। সারাদিন বিশ্রামেই থাকে। আগে নয়নাকে দিয়ে টুকটাক কাজ করাতো, এখন সংসারের পুরো কাজ করায় তাকে দিয়ে। প্রায়ই কাজকর্ম শেষে অভুক্তই থাকতে হয় নয়নাকে। আজও তাই, তবে গত দুই সপ্তাহে তার নির্ভয়ে দিন কেটেছে। বাশার চট্রগ্রাম বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেছে। একেবারে বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ঘুরে বাসায় আসবে। ততদিন নয়না মন ভরে নিশ্বাস নিবে।

নয়নার বাবার কাছে চিঠি পৌঁছেছে। হয়ত তাই তিনি নয়নাকে ডেকেছেন। নয়না বাবার কাছে এসেছে। নুরুজ্জামান মেয়েকে ডেকে উধাও। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করাতে বলল, তিনি নাকি বাজারে গেছেন, নয়নার জন্য চাবি রেখে গেছেন। ঘরবাড়িহীনদের জন্য সরকারের করে দেয়া বাড়িতে নুরুজ্জামান থাকেন। নিজের ঘর বাড়ি, অর্থ সম্পদ, প্রিয়জনদের সর্বনাশা আগুন খেয়ে নিল তখন সব ছেড়ে শহরে আশ্রয় নেয় নুরুজ্জামান। মেয়েকে নিজের কাছে না রেখে বোনের কাছে রাখেন যেন দশজন মানুষের সামনে মেয়ের সম্মান হরন না হয়। কিন্তু তিনি কী জানেন! মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে কতোটা খারাপ করে ফেলেছেন! এখন তো দৈনিক সম্মান হরনের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয় নয়নাকে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পরও নুরুজ্জামানের আসার কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে নয়না ঘর থেকে বের হয়ে আসে। পরিধানে তার কালো বোরকা। যথারীতি ঘরে তালা ঝুলিয়ে চাবী প্রতিবেশীর কাছে রেখে রওনা করে। পথিমধ্যে সে দেখতে পায় কিছু মানুষ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু পথচারীরা জটলা ছেড়ে নয়নার দিকেই এগিয়ে আসছে। নয়না তখন তাদের কথোপকথন শুনতে পায়,” আহারে! লোকটা কতো ভালো মানুষ ছিল। নিজের মেয়েকে বোনের কাছে রেখে নিজে কষ্টে দিন পাড় করতো। এভাবে হঠাৎ করে ম’রে যাবে, কে জানতো!”

নয়নার অন্তর কেন যেন কেঁপে উঠে। দ্রুত সামনে আগায় সে৷ মানুষদের ঠেলে দেখতে পায় নুরুজ্জামানকে যিনি জমিনে পড়ে আছেন। এক পায়ে জুতা আছে অন্য পায়ের জুতা কোথায় যেন পড়ে আছে। সময় নষ্ট না করে নয়না বাবাকে কাছে এসে বসে। নুরুজ্জামানের মাথা কোলে রেখে ডাকলো, ” বাবা, বাবাগো! ও বাবা, কথা বলো!”

কিন্তু আফসোস! নয়নার বাবা কথা বলা তো দূরের কথা চোখ জোড়া খুলে দেখছে না। নয়না আশেপাশের মানুষদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়ায়, ” আমাকে কেউ সাহায্য করুন, বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে। একজন ধরলেই হবে!”

কেউ এগিয়ে আসেনি। কিছু মানুষ জটলা ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে তো কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। একদল মুঠোফোন বের করে পুরো দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত।
নয়না কাঁদছে, এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ যে কারো আপন নয়, আবারও প্রমাণিত হলো।

মেডিক্যালের একটি বাস ঐ পথ ধরেই কোথাও যাচ্ছিল। মানুষদের ভীড় দেখে গাড়ি থামায়। ঘটনাস্থল তখন খুবই করুণ, নয়না জোরে জোরে কাঁদছে। একজন ডাক্তার সবার আগে এগিয়ে আসে। গায়ে ফর্মাল পোশাকের উপর এপ্রোন। নুরুজ্জামানের কাছে এসে হাতের পালস পরীক্ষা করতে শুরু করে। ঘড়ি ধরে এক মিনিট সময়! কাঙ্খিত হৃৎস্পন্দন না পেয়ে সহকর্মীদের ডাকতে শুরু করে সে, ” মিনহাজ, ভাবনা, মাহিন দ্রুত আয়, রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক।”

কোনো মেয়ে বাবার আশঙ্কাজনক খবর শুনে স্থির থাকতে পারবে না, নয়নাও পারছে না। নুরুজ্জামানের গালে হাত রেখে চিৎকার করে উঠলো, ” বাবা, কী হয়েছে তোমার? এই যে আমি এসেছি। এমন করো না বাবা, তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।”

উত্তর পায় না নয়না। পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকে সে। এমনসময় ভাবনা এসে নয়নাকে তার বাবার থেকে দূরে সরিয়ে আনে। তিনজন যুবক নুরুজ্জামানকে ধরে বাসে উঠায়। অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানোর সময়ও নেই। নুরুজ্জামানের মাথার পাশটায় যেই যুবক ধরেছে, সে উচ্চ স্বরে ভাবনার উদ্দেশে বলল, ” ওর খেয়াল রাখবি তো!”

ভাবনা আশ্বাসের স্বরে উত্তর দেয়, ” হ্যাঁ।”

নয়নাকে জাপ্টে ধরে রেখেছে ভাবনা। কিছু একটা মনে করে সে যুবকটিকে ডাকলো, ” তূর্য!”

তূর্য ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ভাবনা তখন বলল, ” একসাথে গেলে মন্দ হয় না। মেয়েটার অবস্থা বুঝার চেষ্টা কর!”

তূর্য নুরুজ্জামানকে এক নজর দেখে বলল, ” নিয়ে আয়, তবে কাঁদতে নিষেধ কর তাকে। তার কান্না দেখে আমি চিকিৎসা করতে পারব না।”

ভাবনা খুশি হয়। সে নয়নাকে জোর করে বাসে তুলে। দুই তিনটে সিট পাশাপাশি ততক্ষণে বিছানো হয়ে গেছে। নুরুজ্জামানকে সেখানে শুইয়ে দেয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা চলছে। স্টেথোস্কোপের সাহায্যে হৃৎস্পন্দন খোঁজার চেষ্টা করছে তূর্য। নয়নার বাবার হাত ধরে গুনগুন শব্দ করে কাঁদছে। যার কারণে তূর্যের চিকিৎসার ব্যাঘাত ঘটে। সে বিরক্ত হয়ে ধমক দেয় নয়নাকে, ” চুপ করা যায় না! দেখছেন না চিকিৎসা চলছে? কান্না ছাড়া আর কিছুই কী বুঝেন না? চুপ করে বসে থাকুন, নয়তো বাস থেকে নামিয়ে দিব।”

নয়নার কান্না বন্ধ হওয়ার বদলে আরে বেড়ে যায়। তবে সে এবার জোরে কাঁদছে না। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। তূর্যের এবার মাথা গরম হয়ে যায়। সে বিনাবাক্যে পুনরায় চিকিৎসা শুরু করে।
কান্নারত অবস্থায় নয়না তূর্য নামক ডাক্তারকে ভালোভাবে দেখে নেয়। এই ডাক্তার সেই ডাক্তার যে নয়নাকে বিবাহিত ভেবেছিল। নয়না এপ্রোনের বুকপকেটে গোটা অক্ষরে লেখা নামটা কয়েকবার মুখে আওড়াল, ” তাবরেজ তূর্য।”

চলবে………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে