নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-০৩

0
423

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব:তিন

” তোমাকে আকলিমার বাড়িতেই থাকতে হবে,নয়না। আমাদের দুঃসময়ে তোমাকে যে আশ্রয় দিয়েছে তার ক্ষতি করে পালিয়ে আসলে কীভাবে? আরে! পশুদের এক দুইদিন আদর যত্ন করলে তারাও পোষ মেনে যায়। আর তোমাকে তো আমার বোন খাইয়ে দাইয়ে বড়ো করছে। একটুও মায়া জন্মায়নি? সবকিছুর প্রতিদান তুমি এভাবেই দিয়ে আসলে?”

নির্বিকার নয়না,পিতার মুখে এহেম কথা সে আশা করেনি। অবশ্য একপাক্ষিক কথা শুনে অপরপক্ষকেই সবসময় দোষারোপ করা হয়। নিশ্চয়ই এখন নয়নার বাবা তার কথা শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিবেন! সেই প্রত্যাশায় নয়না মুখ খুলে, ” বাবা, আমি কিছু বলতে চাই!”

” আমি জানি, তুমি কী বলতে চাইবে। আকলিমা তোমাকে মেরেছে এই বিষয়েই তো?”

নয়না ‘হ্যাঁ’ বলার সুযোগ হয় না তাঁর পূর্বেই নুরুজ্জামান অর্থাৎ নয়নার বাবা ক্রোধভরা কণ্ঠে বলে উঠেন, ” গুরুজন শাসন করতেই পারে, তাই বলে তার ক্ষতি তো করতে পারো না। রিহানের কথা বাদই দিলাম, বাশারের সাথে তুমি এমন আচরণ কীভাবে করতে পারলে। ছেলেটার আজ ইম্পর্ট্যান্ট ইন্টারভিউ ছিলো সেখানে না গিয়ে বিছানায় কাকুতি করছে।”

” বাবা,বাশার ভাই আমার শরীরে,,,,!

” আমি সব জানি, আকলিমা আমাকে সব বলেছে। তুমি এক্ষুণি আমার সাথে ফিরে যাবে এবং তোর ফুফু ও বাশারের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে।”

নুরুজ্জামান নয়নার কোনো কথা শুনতে রাজি না। তিনি মেয়েকে নিজের সাথে বোনের বাড়িতে নিয়ে উঠবেন। মিছিলের পরিবার অসহায়, নয়নার বাবা জীবিত সেখানে তারা অধিকার খাটাতে পারে না। নয়নার হয়ে কথা বলতে গেলেও শেষে নয়নার সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক নষ্ট হবে তাদের। প্রিয় বান্ধবীর ক্ষতি মিছিল চাইছে না, তাই নুরুজ্জামানের কথার প্রেক্ষিতে বলে,” আঙ্কেল, আপনি নিশ্চয়ই স্বইচ্ছায় আপনার মেয়েকে নরকে ফেলতে চাইবেন না। ঐটা বাড়ি নয়, আমার কাছে জাহান্নামের আগুন মনে হয়। যেখানে একজন অসহায় মেয়ের উপর মানসিক, শারীরিক অত্যাচার করা হয়।”

আকলিমা এতক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। ঘরে বসে ভাইকে যেভাবে পড়িয়ে নিয়ে এসেছিল সেভাবেই নুরুজ্জামান কথা বলছে, এ নিয়ে তিনি মনে মনে ভীষণ খুশি ছিল কিন্তু মিছিলের কথায় নড়েচড়ে বসেন তিনি। খুব সূক্ষ্মভাবে মিছিলের কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলেন, ” কীসব বলছো মা, নয়না আমার ভাইজি। তাকে শাসন করার অধিকার আমার আছে। তোমার মা বাবা কী আদর শাসন ছাড়াই বড়ো করছে? শুনো মেয়ে! নয়না তোমার বন্ধু, সে যা বলবে তাই তুমি বিশ্বাস করবে৷ আমাদের কথা বিশ্বাস হবে না। আমরা এখন নিরপরাধ হলেও অপরাধী হয়ে আছি তোমাদের চোখে।”

মিছিল প্রত্ত্যুত্তরে বলতে পারল না। সে কীই বা বলবে, আকলিমার কথার প্রেক্ষিতে কিছু বললেও যুক্তিতে সে পারবে না।

নয়না নুরুজ্জামানের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত জোর করে অনুনয় করে বলল,” বাবা, আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। ঐ বাড়িতে আমি ফিরে যাবো না, ঐ বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

” আমি রাস্তায় পড়ে থাকি, তুমি মেয়ে মানুষ সেখানে থাকতে পারবে? মাথার উপর ছাদ আছে এমন বাড়িতে তোমাকে রাখছি, তবুও তোমার মন ভরছে না?”

বাবার কথায় কষ্ট পায় নয়না। আহত হয় বাবার অন্যায় বিচারে। প্রত্ত্যুত্তরে ভাঙা গলায় সে বলল,” বাবার ছায়া পেলে ছাদ প্রয়োজন পড়ে না, মাথায় হাত রাখলেই শান্তি পাওয়া যায়। আমি ফুফুর বাড়িতেই থাকব,বাবা। তুমি আর রাগ করো না, শরীর খারাপ করবে।”

নয়না দেরী করে না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে মিছিলের ঘরে চলে যায়। আকলিমা বেজায় খুশি। মনে তার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। এই মেয়ের জন্য তার দুই ছেলে বিছানায় শোয়া অবস্থায়। তিনি এতো সহজেই নয়নাকে ছেড়ে দিবেন না।

মিলিছ কাঁদছে। সে জানে, নয়না আকলিমার কাছে গেলে সুখে থাকবে না। প্রিয় বান্ধবীর কষ্ট কবে লাঘব হবে কে জানে! তার জীবনে সুখের ছন্দ আদৌও কী বাজবে?

———————–

সুখ দুঃখে ভরা আমাদের জীবন। ছোট্ট এই জীবনে চাহিদাও অনেক। রঙে প্রাচুর্যে গড়া পৃথিবীতে বাঁচার তাগিদে কতকিছুই ত্যাগ করতে হয়। নয়না না হয়, জীবনটাই বিসর্জন দিয়ে দিল! রাতের আঁধারে নয়না নিজের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বিছানায় দুই হাঁটু একত্রিত করে জড়োসড়োভাবে মাথা নেতিয়ে কাঁদছে। এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ তার আপন না। নয়নার কানে বাড়ির সকলের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। নয়না ভাবছে কিছুক্ষণ পূর্বের কথা।

বাড়িতে প্রবেশকরা মাত্রই নয়না বাশারের সামনে এসে দাঁড়ায়। বাশারের মাথায় ব্যান্ডেজ করা, নাক মুখ ফুলে ফেঁপে একাকার। নয়নাকে ফিরে আসতে দেখে বিশ্রীভাবে হাসে। নয়নার অন্তর তা দেখে কেঁপে উঠে। নুরুজ্জামান মেয়ের উদ্দেশে তখন বললেন,” আকলিমা আর বাশার কাছে ক্ষমা চাও, নয়না।”

ছলছল চোখে ব্যথাযুক্ত হৃদয়ে নয়না বাবার দিকে তাকায়। তার গভীর চাহনির কথাগুলো নুরুজ্জামান আদৌও বুঝতে পারছে? নাহ! নয়নার বাবার বুঝ ক্ষমতা হারিয়ে গেছে। ইট পাথরের ভীড়ে থাকতে থাকতে মনটাও শক্ত হয়ে গেছে। গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নয়না ক্ষমা চেয়ে নেয়, ” আমাকে ক্ষমা করে দাও, ফুফু। তোমার ছেলেদের উপর হাত তোলা আমার উচিত হয়নি।”

এরপর বাশারের উদ্দেশে বলল,” আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করো, বাশার ভাই। আজ থেকে তোমার আশেপাশে ঘেঁষবো না তুমিও আমার কাছে এসো না।”

ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করে দেয়া মহৎ গুন। কথার প্রেক্ষিতে সে বাশারকে তার আশেপাশে ঘেঁষতে নিষেধ করে দিল, তা কী কেউ বুঝতে পেরেছে? অবশ্য বাশারের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। সে নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল, ” আমার মনে কোনো দুঃখ নেই,বোন। যেভাবে তোর ভালো হবে, সেভাবেই এবাড়িতে থাকবি। এমন কাজ করবি যেন আমরা খুশি হই।”

নয়না বাঁকা চোখে বাশারকে পর্যবেক্ষণ করে। তার লোলুপ দৃষ্টি নয়নার শরীর পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। কেউ দেখলে বুঝবে না, বাশার নামক ভদ্রলোকের আড়ালে বিকৃত রূপ।
আকলিমা ভাইয়ের সামনে ভালোমানুষির নাটক শুরু করে দেয়। নয়নার মাথায় হাত রেখে বললেন,” ফুফুর সাথে রাগ করে এভাবে চলে যেতে হয় নাকি? আমি না হয় একটু শাসনই করেছিলাম। ঐসব আর মনে নিস না, মা!”

বাশারও মায়ের কথার তালে তাল মিলিয়ে বলল, ” হ্যাঁ, মা ঠিকই বলেছে নয়না। আর রাগ করে থাকিস না। সব ভুলে নতুন করে শুরু কর।”

আপনজন নামক জালেমদের অভিনয় দেখে নয়না তাচ্ছিল্যে হাসে। ধীরপায়ে নিজ ঘরে এসে দরজা আটকে বসে থাকে। অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, বাহিরে হাসির আড্ডা চলছে আর নয়নার মনে চলছে কাল বৈশাখী ঝড়। দরজার কষাঘাতে নয়না নড়েচড়ে বসে। নুরুজ্জামান মেয়েকে ডাকতে এসেছেন। একবার দুইবার তিনবার ডেকেও সাড়া না পেয়ে চলে যান তিনি। অশ্রুসিক্ত আঁখি মুছে নয়না পড়ার টেবিলের দিকে আগায়। খাতা কলম বের করে বাবার জন্য চিঠি লেখে।

প্রিয় বাবা,

তুমি একবারও আমারদিক জানতে চাওনি। ভালো আছি কী নেই একবারও বুঝতে চেয়েছো? প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ একই ছাদের নিচে থাকলে কুমন্ত্রণার শিকার হবেই। বাশার ভাই আমাকে বোনের নজরে নয়, খারাপ নজরে দেখে। নিজেকে রক্ষা করার জন্য তাকে আঘাত করেছিলাম। একবার ভেবে দেখো তো, একজন মেয়ে কখন একজন ছেলেকে আঘাত করে? আমি উত্তর দেই! একজন মেয়ে তখনই একজন ছেলেকে আঘাত করে যখন ঐ মেয়ের সম্মানে কেউ হাত দেয়! আমিও তো তাই করেছিলাম।
তুমি আজও আমাকে চিনলে না! আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে করে না জানো বাবা! মিনা, মিন্টুর মতো আমিও যদি সেদিন মায়ের সাথো আগুনে পুড়ে ম’রে যেতাম, তাহলেই ভালো হতো। অন্তত তোমার বোঝা হতাম না। মা বেঁচে থাকলে হয়তো আমার চাহনি দেখেই বুঝে যেত। আমার বিপদের আভাস পেত। তুমি কী জানো বাবা, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মেছি! নয়তো আমার মা কেন আমায় একা করে চলে গেলো? আর আমার বাবা, যিনি বেঁচে থেকেও আমার কাছে মৃত। আমার প্রতি এতো অনিহা কেন,বাবা? আমি তো তোমারই সন্তান। নতুন করে তুমি সংসার গড়েছো, তাই কী আমাকে নিজের কাছে রাখছো না? আহ! আমার ভাগ্য! ও বাবা আমাকে একটা বিষের বোতল এনে দিবে! গলাটা ভিজাই! এরপর এই নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেই। তাহলে পুরুষ নামক পশুদের লালসার শিকার হবো না! ফুফুর কথা শোনার সময় পেলে অথচ আমার কথা শুনলে না! সত্যি বলতে, তুমি আমার বাবা না। আমার ছোটবেলার বাবার সাথে এই বাবার মিল নেই। আমার বাবা আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনতো, কিন্তু এখন বাবা পরের কথার তালে চলে। আমি তোমাকে চাই না, বাবা। আর আমি এই নরক ছেড়েও যাব না। এখানেই পঁচে গলে প্রাণ হারাবো।

ইতি,
নয়না

ডুকরে কেঁদে উঠে নয়না। খাতা কলম বন্ধ করে বিছানার দিকে টলমল পায়ে এগোয়। সে আজ ঘুমাবে, অনেক ঘুমাবে। হতে পারে, আজ রাত্রিই তার জীবনের শেষ রাত্রি!

——————–

ঘুমের ঘোরে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে নয়নার। মনে হচ্ছে কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। চোখ খুলে তাকায় সে, এলোমেলো চুলে আকলিমা তার গলা চেপে ধরে রেখেছে। পায়ের কাছে বাশার যে নয়নার পা দুটো শক্তকরে ধরে রেখেছে। আকলিমার চক্ষুর আড়ালে তার বেয়াড়া হাতজোড়া পায়জামা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে ব্যস্ত। দুটো অসহনীয় যন্ত্রণায় নয়নার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। চোখ দুটো লাল হয়ে আসছে। বাঁচার আকুতি মিনতি করছে সে। হাত পা যথাসম্ভব নাড়িয়ে ছাড়া পেতে চাচ্ছে কিন্তু এতো সহজেই ছাড়া পাওয়া সম্ভব! আকলিমার ক্রোধভরা কণ্ঠস্বর নয়নার কানে পৌঁছে, সে বলছে, ” আজ তোকে মে’রেই ফেলব, অলক্ষ্যি মেয়ে।”

চলবে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে