নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0
468

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ত্রিশ (অন্তিম পর্ব)

অন্ধকারের একটি কুঠুরিতে নয়নাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার গায়ের কাপড় অনেক অংশ ছেঁড়া। হাতাহাতির সময় হাতে পায়ে খামচি লেগেছে। অন্ধকার ঘরে এক ফালি আলো উপর থেকে তীর্যকভাবে নয়নার উপর পড়ছে। নয়ানর গলা শুঁকিয়ে চৌচির। তৃষ্ণায় হা করে নিশ্বাস ফেলছে। সে জানে না তার এই অবস্থা কে করেছে। অন্ধকারে শুধু কেউ তাকে বাজেভাবে স্পর্শ করতে চায়। বাশারের মতো তার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে ছুঁয়ে দিতে চায়। নয়না খুব করে তার থেকে বাঁচতে চায়ছে কিন্তু পারছে না। কীভাবেই বা পারবে? তাকে তো এই অন্ধকার কুঠুরিতে আঁটকে রাখা হয়েছে। আবারও কুঠুরির দরজা খুলে গেলো, নয়নাও সাথে ঘাবড়ে গেলো। জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। যথাসম্ভব গা ঢাকার চেষ্টা করলো। মানুষটা নয়নার একদম কাছাকাছি এসে বসলো। নয়না ঢোক গিলে প্রশ্ন করলো, ” কে আপনি?”
অপরপাশ নিশ্চুপ, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে
নয়না পুনরায় প্রশ্ন করলো,” আমার কাছে কি চান?”

মানুষটা এবার নয়নার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” তোকে।”

নয়নার চোখজোড়া সাথে সাথে বড়ো হয়ে গেলো। মানুষটার চেহারা এবার নয়না স্পষ্ট দেখতে পেলো। মানুষটা আর কেউ নয়, বরং তূর্য। তবে আজ তূর্যের চেহারায় নিষ্পাপতা নয় বরঞ্চ পাগলামো দেখতে পেলো নয়না। এলোমেলো ঘামার্ত মুখে সাইকোদের মতো লাগছে। নয়নার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হেসে বলল, ” তোকে বিয়ে করলে কী হবে। আনন্দ তো পাচ্ছি না!”

এরপর নয়নার সারা শরীরে দৃষ্টি ঘুরিয়ে পুনরায় বলল,” তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, নয়না।”

নয়না চিৎকার করে উঠে, সাথে সাথে তার ঘুম ভেঙে গেলো। শোয়া থেকে উঠে নয়না জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো। টি টেবিলের উপর থেকে এক গ্লাস পানি পান করে নিজেকে স্থির করে পাশে ফিরে বিছানায় তূর্যকে দেখতে পেলো না নয়না। ঘড়ির কাঁটা ভোর পাঁচটা বাজে বিশ মিনিট। নয়না এমন দুঃস্বপ্ন প্রায়ই দেখে। তবে আজকের স্বপ্নটা বেশ ভয়ংকর ছিলো। নয়নার তূর্যের উপর পূর্ণ আস্থা আছে সে নয়নার কোন ক্ষতি করবেও না ক্ষতি হতে দিবেও না। তূর্যের কথা ভাবতে ভাবতে নয়না বিছানা ছাড়লো। কে জানে তার পাগল ডাক্তার কী পাগলামি করছে!

বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে প্রায়ই পৃথিবীর বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। বর্ষার মৌসুমের জন্য তূর্য অধৈর্য চিত্তের অপেক্ষাও সমাপ্ত হয়েছে। আজ তাদের বিয়ের অর্ধ বছর পূর্ণ হলো। প্রিয়তমা স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে তূর্যের যা তা আয়োজন। সকাল সকাল নয়নাকে তৈরি হওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলো তূর্য। বেচারি নয়নার আজ ঘুম ভাঙছেই না যেন। তূর্যের বুঝে আসে না, নয়নার চোখে এতো ঘুম আসে কোথায় থেকে। কিছুক্ষণ আগেও না সপ নয়নার শব্দ শুনেছে! এই সময়েই ঘুমিয়ে পড়লো? সকাল ছয়টায় নয়নাকে উঠিয়ে তৈরি হতে বলে নিজেও তৈরি হয়ে নিলো তূর্য। ছয় মাসেও নয়নার কোনো পরিবর্তন হয়নি, তূর্য এখনো নতুন বউয়ের ঘ্রাণ পায় নয়নার শরীর থেকে। প্রতিনিয়ত নতুনরূপে পায় নয়নাকে। সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় নয়নাকে দেখে। নয়না তূর্যের চোখের, অন্তরের প্রশান্তির কারণ। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর নয়নার কণ্ঠস্বর তূর্যের ক্লান্তির অবসানের কারণ। তূর্যের ইচ্ছে করে সবসময় নয়নাকে চোখের সামনে বসিয়ে মন ভরে দেখতে। তূর্য যদি পারতো তাহলে নয়নাকে নয়নে বেঁধে রাখতো। তার শরীরের একাংশ নয়না।
বৃষ্টির সকাল,শীতল করে রেখেছে চারিপাশ। তূর্য নয়নার স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে একটি পাতলা শাল নিয়ে নিলো তূর্য। নয়না তৈরি হয়ে বের হলে তূর্য প্রথমে তার চোখে একটি কালো কাপড় দ্বারা বেঁধে দেয়। নয়না প্রথমে ভরকে গেলেও পরমুহূর্তে তার ডাক্তারের কথা ভেবে মুচকি হাসলো, ” সকাল সকাল ডাক্তার সাহেবের কী হলো!”

তূর্য নয়নার কানে অধর ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল, ” সারপ্রাইজ!”

নয়না আর কিছু বলতে পারে! সে তো জমে ফ্রিজ হয়ে আছে। তূর্য মুচকি হেসে নয়নাকে কোলে তুলে নিলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে বসিয়ে দিলো নয়নাকে। অজানা গন্তব্যে নয়না পাড়ি জমাচ্ছে তার প্রাণ প্রিয়র সাথে।

কানাইয়া বাজারে পৌঁছে তূর্য গাড়ি থামালো। এখানে সচারাচর আসা যাওয়া হয় বলে কিছু মানুষের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে, রফিক আজম। পেশায় সে কৃষক। খড়া মৌসুমে বিল শুঁকিয়ে চৌচির হয়ে গেলে ধান চাষ করে সে। কানাইয়া বাজারে তার একটি ছোট্ট চায়ের দোকান আছে। তূর্য গাড়িটা সেই দোকানের পাশেই পার্ক করে। নয়নার চোখ তখনো বাঁধা অবস্থায় ছিলো। তূর্য মুচকি হেসে নয়নার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,” ভয় করছে?”
নয়না প্রশস্ত হেসে উত্তর দিলো,” তুমি পাশে তো কীসের ভয়?”
তূর্যের হাসিমাখা মুখ উবে গেলো, সেখানে এক টুকরো কাঠিন্যতা এনে বলল,” যদি বিশ্বাস ভেঙে ফেলি? যদি অতীতের মতো তোমাকে ব্যবহার করি?”
নয়নার মুখের হাসি আরেকটু প্রশস্ত করে বলল,” অভাগীর কপালে এতোমাস সুখ লেখা ছিলো, এটা ভেবে না হয় মৃত্যুকে গ্রহণ করে নিবো!”

তূর্য কিছু বলল না। গাড়ি থেকে নেমে নয়নাকেও হাত ধরে নামিয়ে নিলো। তবে তূর্যের এবারের ছোঁয়া নয়নার কাছে খুব অপরিচিত মনে হলো। নয়না তবুও কিছু বলল না। সেসকালের দুঃস্বপ্নের রেশ বলে কাটিয়ে নিলো। নয়না সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। জীবনের যেই সময়টুকু সে তূর্যকে পাশে পেয়েছে তার স্মৃতি নিয়ে আজীবন কাটাতে পারবে। তূর্য নয়নাকে নিয়ে প্রায় পাঁচশত গজ সামনে এগিয়ে এসেছে যা নয়না চোখ বাঁধা অবস্থায় অনুধাবন করতে পারলো। তূর্য একপর্যায়ে থেমে গেলো। নয়নার হাত ছেড়ে দিলো। নয়না ঠায় দাঁড়িয়ে রউলো সে তূর্যের পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় রইলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তূর্য নয়না গা ঘেঁষে দাড়িয়ে বললো,” কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
” হৃদয়ে।”
” অনেক নাকি একটু?”
” মাপা যাবে না।”
” ইশ! বড্ড খারাপ তো আমি! এমন মিষ্টি বউকে কষ্ট দিচ্ছি! আরেকটু কলিজা! এরপর আর কষ্ট হবে না। সারাজীবনের জন্য সব কষ্ট শেষ হয়ে যাবে।”

তূর্যের রহস্যময় কথায় নয়নার নড়চড় হলো না। তূর্য তা দেখে হেসে নয়নার হাত শক্ত করে ধরলো। নিচু হয়ে নয়নার পায়ের জুতা খুলে দিলো। এরপর পায়ে পা মিলওয়ে হাঁটা শুরু করলো। কাঁচা রাস্তা শেষে পিচ্ছিল কাঁদায় পা বাড়ালো দুজন। কিছুক্ষণ পর শীতল পানির পা ছুঁয়ে দিচ্ছে অনুভব করলো নয়না। নয়নার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,” আমার স্বামী কখনোই খারাপ হতে পারে না।”

তূর্য নয়নাকে প্রশ্ন করলো,” কেমন ফিল করছো?”
” মনে হচ্ছে কোনো অজানা গন্তব্যে ভেসে যাচ্ছি।”
” আমি থাকতে অজানা নয় সুন্দরী! আমার মনের রাজ্যে ভেসে বেড়াবে তুমি।”

নয়না লজ্জা পেলো। তূর্যের হাতে চিমটি কাটলো। কিছুদূর এগোতেই কাঙ্খিত স্থানে এসে থেমে গেলো দুজন। তূর্য এবার নয়নার চোখের বাঁধন খুলে দিলো। অনেক সময় চোখ বাঁধা অবস্থায় ছিল বিধায় তাকাতে সমস্যা হচ্ছিল নয়নার।কিছু সময় পর স্বাভাবিক হলে নয়নার চোখের সামনে ভাসমান হলো সাদা, গোলাপী রঙের পদ্মফুলে সাজানো নৌকা। খুশিতে নয়নার চোখজোড়া চিকচিক করে। জনবল লোকসমাগমের কথা ভুলে সে তূর্যের বুকে মাথা ঠেকালো। তূর্য নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” আমাদের এক হওয়ার অর্ধ বছর পূর্তিতে আর কী চাই প্রিয়তমার?”

নয়না চট করে মাথা তুলে নিলো। আজকের দিনটার কথা সে কীভাবে ভুলে গেলো! অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে নয়নার অন্তর তা দেখে তূর্য নয়নার হাত ধরে নৌকার দিকে আগাতে আগাতে বললো,” আজকের দিনে মন খারাপ নয় তোমার মুখের হাসি দেখতে চাই, নয়ন!”

দুজন নৌকায় উঠলো। তূর্য পূর্ব থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিল। নয়নার পুরো নৌকায় নজর ঘুরিয়ে দেখলো। একপাশে খাবার রাখা আছে, সুঘ্রাণে পুরো নৌকা ভরে গেছে। নয়না তা দেখে তূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,” সকালে না ঘুমিয়ে এসব করছিলে, তুমি?”

তূর্য মাথা চুলকে বলল,” সারা জীবন কী বউয়ের হাতেই খাবো নাকি? একটু আকটু না খাওয়ালে শেষ বয়সে খোঁটা তো ঠিকই শোনাবে।”

নয়না তূর্যের বুকে কিল বসিয়ে বলল,” আমাকে ভালোই ভয় দেখানো হচ্ছিল, তাই না!”

তূর্য আফসোসের স্বরে উত্তর দিলো, ” ভয় পেলে তো! তোমার শিরা উপশিরায় এই তাবরেজ তূর্যকে এমনভাবে মিশিয়ে রেখেছো যে, তূর্য হাজার অপরাধ করলেও বিশ্বাস করবে না।”

নয়না আনমনে বললো,” আমরা যার কাছে ঠায় পাই, তাকেই আপন ভেবে নেই; কিন্তু তাদের মনের কথা বুঝতে পারি না।”
” আমাকেও বুঝতে পারো না, নয়ন!”
নয়না তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,” আমার জীবনের পূর্ণতা তুমি। তুমি আমাকে এমন কিছু উপহার দিয়েছো, যা পেয়ে আমি তুমি পরিপূর্ণ।”
তূর্যের হাসিমুখ এইটুকু হয়ে গেলো। নয়নার কথার মর্মার্থ বুঝতে প্রশ্ন করলো,” কীসের উপহারের কথা বলছো?”

নয়না তূর্যের হাত নয়নার পেটে রেখে ফিসফিস করে বলল,” কেউ আসছে!”

তূর্যের চোখ চিকচিক করছে খুশিতে। কী করবে, কোথায় যাবে, কাকে বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে। সে কী বেলাই বিলে ঝাপ দিবে? দিলে কী হবে, আনন্দ কী বাড়বে নাকি কমবে। নয়নার কপালে গাঢ় অধর ছুঁয়ে তূর্য মুঠোফোন হাতে নিলো।
মাহবুব শিকদার সিঙ্গাপুর গিয়েছে গত মাসেই। ফিরবে দুই তিন মাসের মধ্যেই। তূর্য চাচাকে ফোন করলো। একবার রিং হতেই মাহবুব শিকদার রিসিভ করে হ্যালো বলার পূর্বেই তূর্য বলে উঠলো, ” ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলেছে! ভাবছি তোমাকে পার্মানেন্ট সিঙ্গাপুরে থাকার ব্যবস্থা করে দিবো। দেশে জায়গা কম তো! তা কী সিদ্ধান্ত নিলে?”

মাহবুব শিকদার কী বলবেন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে চিৎকার করে বলল, ” আমি নেক্সট ফ্লাইটেই আসছি,বাপ! ডাক্তারী তুইই করিস।”

তূর্য হেসে ফোন কেটে দিলো। সিঙ্গাপুর থেকে আসতে একমাস সময় লাগবে। ততদিন না হয়,মাহবুব শিকদার আনন্দ জমিয়ে রাখুক!

তূর্য নয়নাকে নিয়ে সারাবিল ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুজনেই চুপচাপ, নয়না প্রকৃতি উপভোগ করছে আর তূর্য নয়নাকে দেখছে। কিছুক্ষণ পর তূর্য একটি শুঁকনো শাপলা ফুলের মালা পিছন থেকে বের করে এনে নয়নার গলায় পরিয়ে দিলো।নয়নার চিনতে অসুবিধা হয়নি, এই মালাটা সেই মালা যেটা সে তূর্যের সাথে প্রথমবার বেলাই বিলে এসে বানিয়েছিল। এটা তো নয়না যত্ন করে রেখে দিয়েছিল, তূর্য পেলো কোথায়? নয়না জিজ্ঞেস করলো,” কোথায় পেলে?”

তূর্য হেসে উত্তর দিলো,” তোমার ঘরে।”
নয়না আর কিছু বলল না। তূর্যের কাঁধে মাথা রেখে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো।

তূর্য গলা ছেড়ে নয়নাকে শক্ত করে ধরে বলতে শুরু করলো,” আজ নেই কোনো বাঁধা, নেই কোনো ভয়! আছে শুধু অঘাত ভালোবাসা। প্রিয়তমা! তোমাকে রাখিবো মনে, বাঁধিব নয়নে! চিৎকার করে জানিয়ে দিব সকলকে, নয়নে বাঁধিব তোমায় ও প্রাণ গো নয়নে বাঁধিব তোমায়!”

নয়নাদের জীবনেও সুখ আসে। হাতে হাত রেখে মাইলের পর মাইল পথ চলার সঙ্গী আসে। বুকে ঠায় দিয়ে সকল দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ার মানুষ আসে। গল্প উপন্যাসের পাতায় নয়নাদের জীবনে সুখ আসে কিন্তু বাস্তবতা বড্ড ভিন্ন! নয়নাদের মতো মেয়েদের সম্মান কখনোই রক্ষা করতে পারে না। রাতের আঁধারে কতো নয়নার শরীর ক্ষরণ হচ্ছে তা অজানা। নয়নাদের দুর্বল নয়, মাসুদার মতো শক্ত হতে হবে।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে