#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: সাতাইশ
কখনো কী শুনেছেন, বিয়ের পর বউকে নিয়ে কাজে যেতে? শুনেননি তো! তবে আজ শুনুন। কাজটা কে করেছে ইতিমধ্যে বুঝতেও পেরেছেন হয়তো! তূর্যের কেবিনে মুখ ফুলিয়ে নয়না বসে রয়েছে। তার বরের মতো পাগল ডাক্তার এই জনমে কোথাও দেখেনি সে।
বিয়ের পরেরদিন সে বউ ছাড়া হাসপাতালে আসবেই না। ইমারজেন্সী বিভাগ থেকে বারবার কল আসছিলো। এদিকে নয়নাও জিদ ধরে বসেছিল যে, সে আজ বাহিরে কোনোক্রমে বের হবে না। লাজ শরম কিছু থাকতে হবে তো! এমনিতেও পুরুষদের তুলনায় নারীদের লাজ একটু বেশিই থাকে। এই পরিস্থিতিতে চাইলেও তারা লোকসমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, পুরুষরা কী তা বুঝবে?
অগত্যা নয়না তূর্যের সাথে হাসপাতালে আসতে বাধ্য হয়। বর্তমানে নয়না তূর্যের কেবিনে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সময় এখন দুপুর বারোটা বাজে নয়না এখানে এসেছিল সকাল আটটায়। এই কয়েকঘন্টা সময়ের মধ্যে একবারও তূর্যের দেখা পায়নি সে কিন্তু বউয়ের খোঁজ খবর ঠিকই রেখেছেন তিনি। কখনো কফি কখনো জুস আবার কখনো হালকা নাস্তা দিয়ে পাঠাচ্ছে তূর্য। দরজার কড়াঘাতে নয়না উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো তার মন বলছে এবার তূর্য এসেছে। মন কী আর ভুল বলবে! অর্ধ খোলা দরজার হাতলে ধরে তূর্য কারো সাথে হেসে কথা বলছে। নয়না তার বরের হাসি দেখছে। সে ভাবছে, প্রাণোচ্ছল ছেলেটাই কী তার স্বামী? পরক্ষণে মনে মনে বলল, হ্যাঁ! এই সুদর্শন দুষ্ট মানবটা শুধু তারই। নয়না লজ্জায় দাড়িয়ে গেলো,সে কী বলবে সেটাও মনে মনে সজিয়ো নিলো। এদিকে দরজা আটকে তূর্য ঘরে প্রবেশ করে সরাসরি নয়নার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। মাঝে মাঝে নয়না তূর্যকে দেখে বুঝতে পারেনা যে তার মনে কী চলছে! প্রায় পাঁচ মিনিট নয়নাকে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরে রাখলো তূর্য। ফিসফিস করে বললো,” মিস ইউ সো মাচ, মাই লেডি!”
নয়নার মান গলে পানি হয়ে গেলো কিন্তু মিছে অভিমান করে রইলো। তূর্যের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,” মিস না ছাই! কতো সময় ধরে একা বসে আছি। এখন আসার সময় হলো!”
তূর্য নয়নাকে নিয়ে চেয়ারে বসলো। নয়নাকে কোলের উপর বসিয়ে বলল,” ইমারজেন্সীতে আজ একজন মেয়েকে নিয়ে আসা হয়েছে। বয়স কতো হবে, আঠারো কী ঊনিশ! বিষ খেয়েছিল, ওয়াশ করিয়ে কেবিনে শিফট করতে দেরী হয়ে গেছে। এজন্যই আসতে দেরী হলো, রাগ করে না বউ!”
নয়না নিজের কথা ভাবছে, সেও তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল কিন্তু তার পাশে তূর্য ছিলো বিধায় বেঁচে ফিরতে পেরেছে। মেয়েটাও নিশ্চয়ই তার মতো নরকে পা দিয়েছিল,তাইতো আত্মহত্যার মতো খারাপ পথ বেছে নিতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না। নয়না মনে মনে সিদ্ধান্তঃ নিলো সে মেয়েটাকে দেখতে যাবে, সুখ দুঃখের কথা বলবে। কারণ সে জানে, এই পরিস্থিতিটা কতোটা ভয়াবহ। নয়না তূর্যের কাছে আবদার জুড়ে বসলো,” আমাকে মেয়েটার কাছে নিয়ে যাবে, তূর্য? ”
তূর্য দেখতে পেলো তার প্রিয়তমা স্ত্রী সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে, তারমানে নয়না মেয়েটাকে সত্যি সত্যিই দেখতে যাবে। তূর্য নয়নার এই ইচ্ছেটাও অপূর্ণ রাখবে না তাই মুচকি হেসে বলল,” লাঞ্চটা সেরেই নিয়ে যাবো। এবার চলো।”
নয়নাকে নিয়ে তূর্য গাজীপুরের রাজবাড়ী মাঠ থেকে একশ গজ দূরে অবস্থিত চিকেন চিলি রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসলো। দুপুরের খাবার খেয়ে বের হতে নিলে নয়না হাঁটার গতি থামিয়ে দিলো। নয়নার শরীর কাঁপছে, ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে আসছে। সে নিজেকে তূর্যের পিছনে আড়াল করে রেখেছে। তূর্য নয়নার ভাবভঙ্গি লক্ষ করে সম্মুখে তাকালে বাশারকে দেখতে পেলো। মুহূর্তেই তূর্যের হাসিমুখ পরিবর্তন হয়ে লালা আভা ভেসে উঠলো। বাশার তাদের দিকেই এগিয়ে আসলো। নয়নাকে ভালোভাবে দেখে বলল,” এই শহরেই তোর এতো নাগর থাকলে আমাকে কী আর মনে ধরবে? এজন্যই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস,তাই না? অবশ্য তুই তো তোর মায়ের দিক পেয়েছিস, তোর মা যেমন বাজারী ছিলো তুইও তেমন হয়েছিস।”
তূর্যের সামনে তার স্ত্রীকে অপদস্ত করছে তাও বিশ্রী ইঙ্গিতে! ব্যাপারটা সহ্য করার মতো নয়। তূর্য তেড়ে এসে বাশারের নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিলো। একটা নয় দুইটা নয় পরপর কয়েকবার ঘুষি মেরে নাক থেকে র’ক্ত বের করে ফেলল। নয়না তূর্যকে বাঁধা দিচ্ছে বারবার অনুরোধ করছে যেন আর না আঘাত করে। এদিকে বাশার যেন তার পরিকল্পনায় সফল হয়েছে। তূর্যের থেকে ছাড়া পেয়ে নাকে হাত দিলয়ে র’ত মুছে নিলো। আশেপাশে ভালোভাবে লক্ষ করে জোরে চেচামেচি শুরু করলো,” আমার বোনরে ফিরাইয়া দেন, ভাই! আমার মা বোনের জন্য কান্না করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই যে, ভাইয়েরা দেখে যান! ডাক্তার বলে আমার মতো সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করছে। আমার বোনকে পালিয়ে এনে রক্ষিতা করে রেখেছে। এই দেখেন, আমি প্রতিবাদ করায় মেরে কী অবস্থা করে দিয়েছে।”
রেস্টুরেন্টের সামনে বিরাট বড়ো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলল বাশার। লোকজন সমবেত করে মনগড়া কাহিনী বলে দিলো সে। আর আমাদের দেশের মানুষ সবসময়ের মতো একপাক্ষিক বক্তব্য শুনে তাই বিশ্বাস করে নিলো। কয়েকজন তূর্যের দিকে আঙুল তলতে ভুল করলো না।বাশার এসব দেখে বিশ্রী হাসলো। নয়নার দিকে বাজে ইঙ্গিত করলো। তূর্য নীরব দর্শকের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে চাইছে নয়নয় কিছু বলুক, তূর্য তার জীবনের কতোটা অংশ জুড়ে আছে সবাইকে বলুক। তূর্যকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, লোকজনের সামনে নয়না স্পষ্ট গলায় বলতে শুরু করলো,” ইনি আমার স্বামী। আমরা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। দয়াকরে এই লোকের কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না।”
বাশারের হাস্যজ্বল মুখ নিমিষেই চুপসে গেলো। থমথমে পরিবেশে নয়নার কথা কানে বাজতে লাগলো। কিন্তু বাশার তবুও বেঁকে গেলো না, পুনরায় প্রশ্ন তুলল,” কী প্রমাণ আছে? নির্লজ্জ মেয়ে, কোন পাড়ায় তোকে নিয়ে যায় যে নিজেকে এই ছেলের বউ বলতেও লজ্জা পাচ্ছিস না!”
বাশার বলতে বলতে নয়নার কাছে আসছিল। তূর্য তখন বাঁধা দিয়ে বলল,” আর এক পা আগালে তোমার পা ভেঙে দিব, শালা সাহেব!”
এরপর সমবেত লোকজনের উদ্দেশে বলল,” আজকাল কী বিয়ের রেজিস্টার প্যাপার সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে? আমাদের মুখের কথা কী বিশ্বাস হচ্ছে না! একজন মেয়ের হাত,নাক,কানের অলংকার কখন পরে? অবশ্যই বিয়ের পর! এখন অনেকেই বলবেন, আজকালকার মেয়েরা বিয়ে ছাড়াই অলংকার পরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের উদ্দেশে বলছি, বিয়ে হচ্ছে পবিত্র বন্ধন যারা এই বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাদের বাহ্যিক অভ্যন্তরীণ দিক লক্ষ করলেই বুঝা যায়। আর সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার হচ্ছে, এই লোকের ভাষা! দেখুন তো, আমি তার মতো কোনো মেয়েকে অপমান করেছি কী না!”
তূর্যের কথায় সকলে সহমত পোষণ করলো। কেউ কেউ বলল,” এই লোকের মনেই শয়তানী, সাধারণ পাবলিকদের সহায়তায় আপনাকে হেনস্তা করতে চেয়েছে।”
রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার ততক্ষণে এসে উপস্থিত হলো। তূর্যের সাথে কুশলাদি বিনিময়ের পরে দারোয়ান দিয়ে বাশারকে পথ দেখিয়ে দিলো।
পুরো ঘটনায় নয়না খুব ভয় পেলো। তূর্যের শার্ট খামছে ধরে বলল,” হাসপাতালে চলো, তূর্য!”
তূর্য কথা বাড়ালো না। নয়নাকে শক্তকরে ধরে গাড়িতে উঠলো।
————————————
সন্ধ্যা হয়ে আসলো। তূর্যের ডিউটির সময় শেষের পথে। এবার সে নয়নাকে একা রাখেনি, রাউন্ডের সময়ও নয়নাকে পাশে রেখেছে। তূর্য ও নয়না যখন বিষপান করা মেয়েটির কেবিনে প্রবেশ করছিল তখন তারা শুনতে পেলো, মেয়েটির মা বলছে,” আমি পুলিশের কাছে যাবো, ঐ ছেলেকে জেলে ঢুকাবো। আমরা গরীব বলে, মানুষ না! আমার মেয়েটার আজ এই অবস্থার জন্য ঐ কুলাঙ্গার দায়ী।”
তূর্যের আগমনে মেয়েটির মা থেমে গেলো। তূর্য ফাইল চেক করতে লাগলো।নয়না এক ধ্যানে মেয়েটির নিস্তেজ শরীর দেখছে, মায়াবী চেহারার অধিকারী মেয়েটার জীবনে কী এমন ঘটেছিল যার কারণে আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছিল! নয়না সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটির মায়ের উদ্দেশে বলল,” আত্মহত্যা কেন করতে গিয়েছিল, আন্টি। সঠিক সময়ে নিয়ে না আসলে কী হতে পারতো, ভাবতে পারছেন?”
কিছু সময় আমরা মনের দুঃখ প্রকাশ করাতে অপারগ হয়ে যাই, দায়িত্বের ভাড়ে নিজেদের পাথর বানিয়ে ফেলি। কিন্তু যখন কেউ আমাদের কাঁধে ভরসার হাত রাখে, তখন মন প্রাণ উজার করে দুঃখ বিলাপ করতে থাকি। মেয়েটির মায়ের অবস্থাও তেমন। একাকী মেয়েকে নিয়ে লড়তে থাকা পাথর হৃদয় গলে গেলো নিমিষের।চোখের কোণে অশ্রু এসে ভীড় করলো। মেয়ের হাত ধরে বিলাপের সুরে বলল,” কোন এক ছেলের সাথে কথা বলতো, কাঁকন। দুইদিন ধরে মেয়েটা আমার কাছে এসে বলল, তার কীসের ভিডিও ছেলের কাছে আছে। দুই লাখ টাকা চাইছে, নইলে ভিডিও ভাইরাল করে দিবে। মেয়ের সম্মান বাঁচাতে জমানো টাকা ঐ ছেলেকে দিয়ে দেই। আমাদের সম্বল ঐটুকুই ছিলো। মেয়েকে বলছি যেন চিন্তা না করে। কিন্তু কী হয়ে গেলো! আমার মেয়েটা আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো।”
কাঁকনের মা আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো। নয়নার বর্তমান যুগের মেয়েদের বোকামি শুনে বড়োই আফসোস হলো। এই মাকে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা নয়নার জানা নেই। সে লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে প্রশ্ন করলো, ” পুলিশকে জানান, আন্টি! আমার স্বামী এবং আমি আপনার পাশে আছি। আমরা সকল ধরনের সহায়তা করব।”
কাঁকনের মায়ের চোখ মুখ চিকচিক করছে। মেয়ের সাথে করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস সঞ্চয় করে সে। তূর্য নয়নাকে দেখে মুচকি হাসে, কে বলবে এক সময় এই মেয়ে অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করেছে! আজও তো ভয়ে তূর্যকে আঁকড়ে ধরেছে। তূর্য কাঁকনের মায়ের উদ্দেশে বলল, ” টাকা কার হাতে দিয়েছিলেন?”
” একটা ছেলের হাতে।”
” দেখতে কেমন ছিল।”
” খাটো, সুন্দর, গাল ভর্তি চাপ দাঁড়ি। গালে একটা কাটা দাগ আছে।”
কাকনের মায়ের কথা শেষ হতেই মুহূর্তেই নয়নার চোখ জোড়া বড়ো হয়ে গেলো। সে বিড়বিড় করে বলল,” এই কাজ বাশার ভাইয়ের নয়তো!”
চলবে…………….
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: আটাশ
বাশরের ঘর এখন পুরোটাই মাসুদার দখলে। শুধু ঘর বললে ভুল হবে পুরো বাড়িটাই মাসুদার দখলে। ইদানীং মাসুদা ঘরে বসে কী যেন কাজ করে! আকলিমা দরজায় আড় পেতে কখনো ঠুসঠাস শব্দই শুনতে পায় আবার কখনো কাগজপত্র উলট পালট করার শব্দ পায়। মেয়েটার মতিগতি আকলিমার বুঝে আসে না। ঘর থেকে বের হলে রান্না করে, খায়ও কিন্তু আকলিমাকে সাধে না। সে যে এবাড়ির বউ কেউ দেখে বলবে না। আকলিমা এই মেয়ের চালচলন দেখে অতিষ্ঠ তার উপর ছোট ছেলেকে বোরহান নিয়ে চলে গেছে। একদিনও খবর পর্যন্ত নেয়নি আকলিমার। এতদিন হাঁটু ব্যাথার অভিনয় করতে করতে আজকাল হাঁটুতে সত্যি সত্যিই ব্যাথা দেখা দিয়েছে। বেশিক্ষণ হাঁটাচলা করলে ব্যাথা বাড়ে।
সন্ধ্যায় বাশার বাড়ি ফিরে আসলো জীর্ণশীর্ণ হয়ে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, ঠোঁট কে’টে র’ক্ত বের হয়ে তা শুঁকিয়ে গেছে, মাথায় বেন্ডেজ করা। আকলিমা ছেলেকে দেখে চিৎকার করে উঠে। মাসুদা তা শুনে দরজা খুলে বাহিরে দেখে, বাশারের এই অবস্থা দেখেও ভাবান্তর হলো না তার। দরজা খোলা রেখে পুনরায় ঘরে চলে গেলো। আকলিমা রাগে গজগজ করে বাশারকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,” কেমন মেয়েকে বউ বানিয়ে আনলি, স্বামীর করুণ অবস্থা দেখেও কাছে আসলো না!”
বাশার নিরুত্তর, সে ভাবছে নয়নাকে কীভাবে ঐ ডাক্তারের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে পারবে। আকলিমার কথা শুনছেই না বুঝতে পেরে আকলিমা নিজেই মাসুদার কাছে গেলো। চুলের মুঠি শক্তকরে ধরে বাহিরে টেনে আনতে লাগলো। মাসুদা ব্যথায় গোঙরাতে লাগলো। নিজেকে বাঁচাতে সে আকলিমার পেটের দিকটায় শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আঘাত করলো। আকলিমা কী আর সহ্য করতে পারে! ছিটকে পড়লো দরজার কাছটায় যেখান থেকে বাশারকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ব্যাথা-বেদনার থেকে বেশি আওয়াজে আর্তনাদ করে উঠলো আকলিমা। ছেলেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো,” ও বাশার, ম’রে গেলাম রে! তোর বউ আমাকে আজ মে’রে ফেলবে। আমাকে বাঁচা বাপ, আমাকে বাঁচা!”
বিরক্তিকর দৃষ্টিতে বাশার আকলিমার কাছে এলো। হাতে ধরে উঠাতে নিলে আকলিমা গগনবিদারী চিৎকার করে বলল,” তোর বউকে তো কিচ্ছু বলবি না! বলবি কেনো? বউকে পেয়ে মাকে তো ভুলেই গেছিস। আজ তোর চুপ থাকাতে আমাকে আঘাত করেছে কাল মে’রে ফেলবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে!”
এমনিতেও বাশার চিন্তায় ছিলো তার উপর সারাদিনই মা’র খেয়ে গেলো। বাড়িতে এসেও অশান্তি শুরু হলো। সব মিলিয়ে বাশার নিজেকে সামলাতে পারলো না। আকলিমাকে ডিঙিয়ে গিয়ে মাসুদাকে ইচ্ছেমতো মারতে শুরু করে দিলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এবার মাসুদা টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। বাশার মারতে মারতে মাসুদাকে শুইয়ে দিয়ে দরজার কাছে আসলো। আকলিমা ছেলের রাগ দেখে ভরকে গেলো সে তো চেয়েছিল বাশার মাসুদাকে এক দুইটা চর থাপ্পড় বসিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিক কিন্তু বাশার যে এতো মারবে বুঝতে পারেনি। বাশার এসেছিল দরজা আটকাতে, আকলিমা ছেলেকে বাঁধা দিলো,” বাবা, মাথা খারাপ করিস না। এই মেয়ের কিছু হলে আমাদের জেল হয়ে যাবে। ছেড়ে দে বাপ!”
” দরজার সামনে থেকে সরে যাও, মা! এই মা’গী’র তেজ আজ শেষ করমু। কতো বড়ো সাহস, আমাকে জেলের ভাত খাওয়াবে? আজ একে না শায়েস্তা করতে পারলে আমি শান্তি পাবো না।”
বাশার যা করতে চাইছে আকলিমা তা কখনো করতে দিবে না। ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে বাহিরে এনে নিজের ঘরে আটকে রাখে। বাশারের ঘরে উঁকি দিয়ে মাসুদার অবস্থান দেখে নিলো। মেয়েটা গুটিশুটি মেরে খাঁটের সাথে মিশে আছে। আকলিমার মনে কষ্ট নয়,আনন্দের জোয়ার ভাসছে। এবার যদি আপদ বিদায় হয়! এদিকে আকলিমার অগোচরে মাসুদা রহস্যময় হাসলো। দুর্বল শরীরে হেঁটে টেবিলের কাছ থেকে আগ থেকে সেট করে রাখা গোপন ক্যামেরা বের করে বিড়বিড় করে বলল,” খেলা এবার জমবে ভালো।”
——————————–
হাসপাতাল থেকে দশদিনের ছুটি মঞ্জুর করা হলো। এই দিনগুলোতে তূর্যের অনেক কাজ। প্রথমত নয়নাকে পুরো দুনিয়ায় সামনে স্বীকৃতি দিতে হবে দ্বিতীয়ত মাহবুব শিকদারের রিটায়ার্ড হওয়ার সময় পরের মাসে। গাজীপুর সিটিতে চাচার জন্য একটি চেম্বার খুলতে হবে। যার কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। সকাল থেকেই তূর্য দৌড়ের উপর আছে কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে নয়নার খোঁজ ঠিকই নিচ্ছে সে। প্রায় ছয় ঘণ্টা তূর্য নয়নার থেকে দূরে তাই সে ঠিক করলো দুপুরের খাবার সে নয়নার সাথে বসেই খাবে। এমনিতেও বিবাহিত হয়েও এখনো সিঙ্গেলদের মতো জীবন যাপন করতে হচ্ছে তূর্যকে। অনুষ্ঠান না করা অবদি নয়না তার কাছে ধরা দিবে না বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে।মহারাণীর কথা কী আর তূর্য ফেলতে পারে! অগত্যা এক বাড়িতে থেকেও তূর্য ও নয়না আলাদা রাত্রিযাপন করছে।
গাড়ি মারতার রাস্তায় ঘুরিয়ে নিলো তূর্য। তার পাশের সিটেই একগুচ্ছ গোলাপের তোড়া রাখা আছে। তূর্য নয়নাকে এই পর্যন্ত কিছুই দিতে পারেনি। ফেরার পথে কিছু অলঙ্কার নিয়ে আসলো। বাড়িতে প্রবেশ করে তূর্য সময় অপচয় করলো না, নয়নার নাম ধরে হাঁক ছাড়লো। নয়না রান্না শেষ করে গোসল করতে ঢুকেছে সবে। তূর্যের ডাক তার কানে পৌঁছায়নি। নয়নার সাড়া শব্দ না পেয়ে তূর্য কিছুটা ভয় পেলো, তাড়াহুড়ো করে উপরে চলে আসলো। নয়না গোসল করছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। দরজার কাছটায় এসে বলল,” বউ! একটা কথা শুনবে?”
ভেতর থেকে নয়নার কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো,” কিছু বলবে, তূর্য?”
তূর্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” বলতে তো চাইছি অনেক কথা, উজাড় করে দিতে চাই ভালোবাসা।”
আচমকা নয়না দরজা খুলে দিলো। তূর্যের কাব্যিক কথায় ভীষণ হাসি পেলো। তূর্যের মাথার কেশবে হাত চালিয়ে বলল,” পাগল,ডাক্তার।”
তূর্য মাথা চুলকে ফুলের তোড়া নয়নার দিকে ধরলো। আকস্মিক নয়নার দিকে ভালোভাবে তাকাতে মস্তিষ্ক কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে গেলো। অর্ধভেজা শরীর,মাথায় তোয়ালে প্যাঁচিয়ে রাখা, ঘাড়, গলায় বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। তূর্যের নজরে আসলে সে শুকনো ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলল,” এই রূপ দেখালে সুস্থ মানুষ এমনিতেও পাগল হয়ে যাবে, যেখানে আমি তো পাগল ডাক্তার।”
নয়নার অস্বস্তি বাড়লো। সে তো স্বাভাবিক মনেই তূর্যের সামনে এসেছিল কিন্তু পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাড় করাবে কে জানতো! গোলাপের তোড়া হাতে তুলে নাকের কাছে ধরে লম্বা নিশ্বাস নিলো। গোলাপ ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ নাকি তূর্যের নয়া বঁধুর শরীরের ঘ্রাণ কোনটা বেশি সুন্দর! তূর্য ভাবছে। মস্তিষ্ক থেকে দুষ্ট মনোভাব সরিয়ে নয়নার হাত ধরে বিছানায় বসালো তূর্য। প্যান্টের পকেট থেকে দুইটা বক্স বের করে নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” আমাদের বিয়ে হঠাৎ করে হওয়ার তোমাকে গহনা দিতে পারিনি। আমার ইচ্ছে ছিল, আমার স্ত্রীকে নিজের উপার্জিত টাকায় গহনা কিনে পরাবো তাই সামান্য উপহার আনলাম।”
তূর্য কথাগুলো বলতে বলতে কানের দুল ও নাকের ফুল বের করলো। নয়নার কানের দুল খুলে তূর্যের নিয়ে আসা দুল খুব যত্নে পরিয়ে দিলো কিন্তু বিপত্তি ঘটলো নাকের ফুল পরানোর সময়। তূর্য নয়নার একদম কাছাকাছি চলে গেলো। তারা একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তূর্য এবার মনের সাথে যুদ্ধ করলো না, মন যা চায় তাই করলো। নাকের ফুল পরিয়ে সেখানে চুমু খেলো। নাক থেকে সরে এসে নয়নার দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে রইলো। নয়নার ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে তূর্যকে তা খুব টানছে। নয়নার অনুমতি ছাড়া সে কিছুই করতে চায় না অগত্যা মনোযোগ সরাতে নয়নার মাথা থেকে তোয়ালে খুলে নিলো সে। নয়নার কপালের চুলের দিকটায় গভীরভাবে চুমু একে ধরে রাখলো। ঠোঁট সরিয়ে সেভাবে থেকেই বলক,” তুমি খুব সুন্দর, নয়ন!”
একটি বাক্য, যা প্রতিটা নারীকে লজ্জায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। লজ্জায় নয়না মাথা নিচু করে রাখলো। পরপর তূর্যের ভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো,” একটু জড়িয়ে ধরি, নয়ন?”
এতো আকুল আবদার নয়না কর ফেলতে পারে? নিজেই হাত বাড়িয়ে তূর্যকে জড়িয়ে ধরলো। নয়নার সম্মতি পেয়ে তূর্যও মুচকি হেসে নয়নাকে জড়িয়ে ধরলো, খুব শক্ত করে। নয়নাও মুচকি হাসলো, তূর্যের বুকে মাথা রেখে বলল,” বৈবাহিক স্ত্রীর কাছে কী সব বিষয়েই অনুমতি নিতে হয়?”
চলবে……………..