নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২৫+২৬

0
408

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: পঁচিশ + ছাব্বিশ

বহুদিন পর ভাবনার বাসায় নয়নার আগমন ঘটে। নাইট ডিউটি করে এসে ভাবনা তখন ঘুমাচ্ছিল। তূর্য যখন নয়নাকে নিয়ে আসে তখন বিকাল প্রায়। শপিং শেষে বাড়ি ফিরবে এখন। জোড়পুকুর পাড় আসতেই নয়না ভাবনাকে দেখার আবদার জুড়ে বসলো। তূর্য মুচকি হেসে নয়নার আবদার পূরণ করতে ভাবনার বাসায় চলে আসলো। ঘুমঘুম চোখে ভাবনা দরজা খুলে নয়নাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো। তূর্যকে রেখে নয়নার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। তূর্য মিছে অভিমান করে ফোন চালাতে ব্যস্ত হলেও তার কান দ্বয় সচল রাখলো। ফিসফিস করে দুজন কী যেন বলাবলি করছে। কিছুক্ষণ পর নয়নাকে নিয়ে ভাবনা তার ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। তূর্য থতমত খেয়ে ভাবনার কাণ্ড দেখলো কিন্তু কিছুই বুঝলো না।
তূর্য বারবার ফোনে সময় দেখে নিচ্ছে। দুই মেয়ে ভেতরে বসে কী খিচুড়ি পাকাচ্ছে কে জানে! প্রায় আধাঘণ্টা পর ভাবনার ঘরের দরজা খুললে তূর্য বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো। বসা থেকে উঠে বিরক্তিকর চোখে মুখে বিস্ময়ের আভা ভেসে উঠলো। নীল রংয়ের শাড়িতে নয়নাকে নীল পরি লাগছে। যেমনটা সে কল্পনা করেছিল তার থেকেও সুন্দর লাগছে নয়নাকে। নতমুখী নয়না অস্বস্তিতে দুই হাতের তালু ঘষছে। ভাবনা পিছন থেকে বলে উঠলো,” কেমন দিলাম?”

তূর্য মাথা চুলকে বলল,” আ’ম শকড। কখন যেন অজ্ঞান হয়ে যাই, নয়ন!”
শেষোক্ত কথা বিড়বিড় করে বললেও নয়না ঠিকই শুনতে পেলো। মুচকি হেসে আনমনে নয়না বলল,” ভাগ্যিস ভাবনা আপু পাশে আছে! নয়তো আমিও তোমার মতো লজ্জায় ম’রে যেতাম, তূর্য।”

স্বচ্ছ আকাশ হঠাৎই মেঘাচ্ছন্ন রূপ ধারণ করে ফেলল। মুহূর্তেই ঝুমঝুম বৃষ্টি ঝড়তে শুরু করলো। নয়নার আর বাড়ি ফেরা হলো না। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য অবলোকন করার প্রয়াশ জাগলো স্থিরমনে। নয়নার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখার মানুষ নয় তূর্য। গাড়ি থামালো মারতা ব্রিজ থেকে কিছুটা সামনে। এই জায়গাটা জনমানবশূন্য। দুই ধারে ধান ক্ষেতের মাঝে পিচঢালা রাস্তা। মাঝেমধ্যে দুই তিনটে অটো ও সি এন জি আনাগোনা করছে। বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য কয়েকজন রিকশাওয়ালা একপাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে অদূরে দোকানে অবস্থান করেছে। তূর্যদের বাড়ির পৌঁছাতে আরো দশ মিনিট সময় লাগবে। গাড়িতে বসে পরিপূর্ণভাবে বৃষ্টি উপভোগ করতে পারছে না নয়না। উশখুশ করছে বাহিরে বের হতে। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করছে সে। এতটুকু কী আর মন ভরে? তূর্য ব্যপারটা বুঝতে পেরে নয়নার পাশের দরজার লক খুলে দিলো। নয়না বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকালে সে বলল,” মহারানীর ইচ্ছে অপূর্ণ রাখার সাধ্য কী আর এই অধমের আছে? অসুখ হলে তো ডাক্তার বাড়িতেই সুযোগে সৎ ব্যবহার করবে, বিষয়টা নিশ্চয়ই মহারানীর পছন্দ হবে না! অবশ্য আমার জন্য কিন্তু মন্দ হবে না।”

নয়না ধ্যাৎ বলে তূর্যের বুকে আঘাত করে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। দুইহাত মেলে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিতে চাইলো। পরিধানে তার নীল সুতি শাড়ি। নয়না শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীর ভালোভাবে ঢেকে নিলো। জুতা জোড়া হাতে নিয়ে ধীরগতিতে হাঁটতে শুরু করলো। সে অপেক্ষা করছে তূর্যের৷ বৃষ্টির মধ্যে তূর্যের পাশাপাশি হাঁটলে মন্দ হবে না। অবশ্য যে কোনো মৌসুমেই নয়না তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গ আশা করে। কেননা তূর্যই এখন তার মনে প্রাণে সবটা জুড়ে আছে।
তূর্য নয়নার মনোভাব বুঝতে পারলো। গাড়ি লক করে নিজেও বের হয়ে নয়নার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। তার মুখের হাসি আজ সরছেই না। কিছুক্ষণ পর নয়নার হাত ধরলো, নয়না সেদিকে তাকালে তূর্য বলল,” সিনেমার মতো তো আর নেচে গেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারব না। আমরা না হয় হাতে হাত রেখে বৃষ্টির তালে পথ চলি!”

নয়না কিছু বলল না। সময়টা উপভোগ করলো। তূর্য খালি গলায় গান ধরলো,
“আগে কত বৃষ্টি যে দেখেছি শ্রাবণে
জাগেনি তো এতো আশা,
ভালোবাসা এ মনে
সে বৃষ্টি ভেজা পায়ে
সামনে এলে হায় ফোটে কামিনী,
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূণ্য মনে জাগে প্রেমের কাহিনী”

——————————-

একঝাঁক বৃষ্টি ঝড়ার পর পুরো পৃথিবী শীতল হলো। মানুষের চলাচল আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করলো। সদর হাসপাতালে ইমারজেন্সী বিভাগে আজ রোগীর সংখ্যা কম। মাহিন ও মিনহাজ কাজ না থাকায় বসে আড্ডা দিচ্ছিল। অবশ্য পাঁচ মিনিট পূর্বেই রাউন্ডে দুইজন রোগীদের অবস্থা দেখে এসেছে। দুই বন্ধু খোশালাপনে ব্যস্ত তখনই বাশার ইমারজেন্সী বিভাগে প্রবেশ করলো। তার শরীরের ক্ষত অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। মাহিন মিনহাজ দ্রুত এগিয়ে এসে বিনাবাক্যে চিকিৎসা প্রদান করতে শুরু করলো। কাজের ফাঁকে বাশারের পরিচয়, কীভাবে আঘাত পেলো ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চাইলো কিন্তু আশানুরূপ কোনো প্রত্ত্যুত্তর পেলো না। কাজ শেষে বাশার এদিক সেদিক তাকিয়ে তূর্যকে খুঁজতে শুরু করলো। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, নয়না তূর্যের সাথেই আছে। আজ যদি এখানে তাকে না পায় তো বুঝে নিবে তূর্যের সাথেই নয়নাকে সে দেখেছে। বাশারের চোরা চোখে তাকানোটা মিনহাজ খেয়াল করলো সে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো,” কাউকে খুঁজছেন? ”

বাশার তখন উত্তর দিলো,” আপনাদের সহকর্মী তূর্যকে দেখছি না! উনি কী আসেনি?”

মাহিনের ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। এতোক্ষণ ব্যাটাকে এতো এতো প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেলো না। যদিও মুখ খুলল সাথে সাথেই তূর্যের কথা জিজ্ঞেস করলো! আকস্মিক মাহিনের চোখজোড়া চাঞ্চল্য রূপ ধারণ করলো। বাশারের দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ে বলল,” আপনার নাম কী বাশার?”

অপরিচিত মানুষের মুখে নিজের নাম শুনে ভয় পেলো বাশার। ইতস্তত হয়ে বলল,” আপনি কীভাবে জানলেন?”

মাহিন ও মিনহাজের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। দুইজনেই এগিয়ে আসলো বাশারের একদম কাছে। কপালের ব্যান্ডেজ ছুয়ে দেয়ার বাহানায় মিনহাজ বলল,” তুই হাসপাতালে আসবি চিকিৎসার জন্য, গোয়েন্দাগিরি করগে আসবি কেনো? আজই শেষ, আর কোনোদিন যদি হাসপাতালের আশেপাশে দেখেছি তো পেট কে’টে কলিজা, কিডনি সব বের করে রেখে দিবো।”

প্রকাশ্যে হু’ম’কি ধমকি শুনে বাশারের গলা শুঁকিয়ে এলো। কয়েকবার শুঁকনো ঢোক গিলে মিথ্যা হেসে বলল,” আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করেছিলাম। আজ আসি হ্যাঁ!”

বাশার চলে যেতে নিলে মাহিন ডেকে উঠলো,” ঐ ব্যাটা, টাকা দিবে কে?”

পকেট খালি, টাকা পাবে কোথায় বাশার! সে তো গোয়েন্দাগিরি করতেই এসেছিলো কে জানতো এদের পাল্লায় পড়বে?
” টাকা তো আনিনি।”

মিনহাজ কথাটা শুনে বাঁকা হাসলো। দারোয়ান ভাই ব্রাদার্সদের ডেকে এনে উত্তম মাধ্যম দিলো।
————————

রাত বারোটা বাজে পয়তাল্লিশ মিনিট। লিভিং রুমে তূর্য ও মাহবুব শিকদার ছাড়া কেউ নেই। নয়না ঘুমিয়ে পড়েছে। দুজনের মধ্যে নীরবতা বিরাজমান। মাহবুব শিকদার ঘুমে ঢুলছে কিন্তু তূর্যের জন্য উঠে যেতে পারছে না। সে জানে তার একমাত্র ভাইপো কথা শেষ না করে তাকে উঠতে দিবে না। সেই কখন থেকে তূর্য আমতা আমতা করছে কিন্তু মূল কথাই বলছে না। অগত্যা মাহবুব শিকদার ঝিমাচ্ছে। বাবা সমেত চাচাকে কীভাবে নিজের বিয়ের কথা বলবে অনেক্ষণ যাবত ভাবছে,তূর্য। সে জানে মাহবুব শিকদার নয়নাকে খুব স্নেহ করে। একদিন তিনিই নয়নাকে বিয়ে করার জন্য তূর্যকে বলেছিল কিন্তু তূর্যই মানা করে দিয়েছিল। আজ সে কীভাবে বলবে? কিন্তু তূর্যকে তো বলতেই হবে, নয়তো আজ যা ঘটেছে! মিনহাজ এগারোটার দিকে তূর্যকে ফোন করে বাশারের কথা জানিয়ে দিয়েছে। তূর্য ভেবেছিল পরের মাসে ধীরচিত্তে বিয়েটা সেড়ে নিবে কিন্তু এখন আর তা করবে না। আকস্মিক সে মাহবুব শিকদারের উদ্দেশে বলল,” আমি আজই নয়নাকে বিয়ে করতে চাই, চাচ্চু।”

মাহবুব শিকদারের শরীর ঝাঁকিয়ে সোজা হয়ে বসলো। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে বলল,” এই রাতে তোর বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে?”

” সময়ের কাজ সময়ে করা ভালো। তুমি ব্যবস্থা করবে? নাকি কাজী অফিসের দিকে যাবো।”

বোম ফাটানো খবর শুনে কী আর মাহবুব শিকদার স্থির থাকতে পারবে? সে জানে, তার ভাইপো কেমন প্রজাতির মানুষ! মুখে যা বলবে তাই-ই করে ছাড়বে। অগত্যা মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন করার ফাঁকে উত্তর দিলো, ” তুই-ই বংশের নাম উজ্জ্বল করবি।”

—————————–

রাত আড়াইটা বাজে মিনহাজ ও মাহিন ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে তূর্যের বড়ি আসলো। দুইজনের থেকে ভাবনা খুবই এক্সাইটেড হয়ে আছে। তার চোখ মুখ চিকচিক করছে আনন্দে। বাড়িতে প্রবেশ করেই মাহিন ও মিনহাজ সোফায় লুটিয়ে পড়লো। ভাবনা তা দেখে কোমরে হাত রেখে বলল,” তোরা বন্ধুর বিয়েছে আনন্দ করতে এসেছিস নাকি ঘুমাতে এসেছিস?”

মাহিন কোনোমতে উত্তর দিলো,” ঘুমাতে এসেছি, যা ডিসটার্ব করবি না।”

ভাবনা ভেংচি কেটে ধেই ধেই করে উপরে উঠে আসলো। নয়না নিশ্চিত মনে ঘুমাচ্ছে। এদিকে তূর্য যে তার বিয়ের সানাই বাজিয়ে ধেয়ে আসছে তার খবর নেই। ভাবনা নয়নার ঘরের সামনে এসে দরজায় করাঘাত করলো। কিছুক্ষণ পর ঘুম ঘুম চোখে নয়না দরজা খুলে ভাবনাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভরকে গেলো। মুচকি হেসে ভাবনা ঘরে প্রবেশ করে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। গতকাল শপিং করে নিয়ে আসা জামাগুলোর মধ্য থেকে একটি লং সাদা গোলাপি সংমিশ্রণের থ্রি পিস নিয়ে নয়নার হাতি ধরিয়ে দিলো।নয়নাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঠেলে বাথরুমে প্রবেশ করালো। বাহিরে দাড়িয়ে থেকে বলল,” বেশি দেরি করো না,নয়না! একজনের তর আর সইছে না। শেষে তোমার দেখা না পেয়ে বিরহে ম’রে যাবে।”

সময় নিয়ে নয়না বের হলো। ভাবনা পূর্বের মতো নয়নাকে টেনে বিছানায় বসালো। নিজের ব্যাগ থেকে কাজল, লিপস্টিক বের করে ঝটপট লাগিয়ে দিলো। নয়নাকে এতোটুকুতেই অপূর্ব লাগছে। এরমধ্যে তূর্য নয়নার ঘরে প্রবেশ করলো। সাদা কাপড়ে স্নিগ্ধময়ীকে দেখে বুকের বাম পাশটায় হাত রাখলো। নয়না বোকা বোকা চোখে চেয়েই রইলো।তূর্য নয়নার কাছে এসে যখন বলল, ” চলো,নয়ন!”
নয়নার তখন খেয়াল হলো। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বলল,” এতো রাতে কোথায় যাবো?”
” বিয়ে করতে।”
কতো বড়ো কথা কিন্তু বলেছে কতো স্বাভাবিকভাবে তূর্য। নয়নার কর্ণধার যেন ভুল শুনেছে সে পুনরায় সঠিক বাক্য শোনার প্রয়াস করে বলল,” কী বললে?”
তূর্য শান্ত স্বরে বলল,” যা শুনলে তাই, চলো!”
” মজা করছো? কথা বার্তা কিছুই হলো না, হঠাৎ বিয়ে!”
তূর্য নয়নার চোখে চোখ রাখলো। হাতে হাত রেখে বলল,” আমায় বিশ্বাস করো তো, নয়ন!”

সম্মোহনী দৃষ্টিতে নয়না উত্তর দিলো,” হুম!”
” বিয়ে জিনিসটা ধীরে সুস্থে আগাতে হয় কিন্তু আমার হাতে তেমন সময় নেই। তোমার পরিজন যেকোনো মুহূর্তে আমার কাছ থেকে তোমাকে নিয়ে যেতে চাইবে। আমার কোনো রাইট নেই তোমাকে নিজের কাছে আটকে রাখার। কিন্তু আজ যদি আমাদের বিয়ে হয়, তবে তোমাকে নিজের কাছে রাখার পুরো রাইট থাকবে।”

নয়না কী করবে বুঝতে পারছে না। সে কোনোভাবেই ঐ নরকে ফেরত যেতে চায় না। বাশার নামক কিটের সামনে পড়তে চায় না। এদিকে তূর্য, যাকে সে জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। প্রতিটি মেয়েই তূর্যের মতো ছেলে চায় নয়নাও তূর্যকে মনে প্রাণে চায় কিন্তু এভাবে! ভাবনায় বিভোর থাকা নয়না আকস্মিক হাওয়ায় ভাসতে শুরু করলো। তূর্য নয়নাকে কোলে তুলে হাঁটতে শুরু করলো। নয়না ছটফট করছে, এভাবে কী কেউ কাউকে বিয়ে করে! তূর্য শান্ত স্বরে বলল, ” বড্ড ছটফট করেন, মিস নয়ন!””
” তাতে তোমার কী?”
” আমার সমস্যা নেই, তবে আপনি ব্যথা পেলে পুনরায় রোগী ফেলে আপনার কাছে বসে থাকতে হবে,এই রিক্স আমি নিচ্ছি না। তবে এরচেয়ে বড়ো রিক্স নেয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। বি রেডি মাই লেডি! সারাজীবনের জন্য তূর্যের হওয়ার জন্য তৈরী তো!”

লাজরাঙা গাল অস্পষ্ট থাকলো, নয়নার চিবুক নত অবস্থায় বলল, ” ডাক্তার মানুষ এতোটা নির্লজ্জ কীভাবে হয়?”

নয়নার বিড়বিড় আওয়াজ তূর্যের কানে প্রবেশ ঠিকই করল কিন্তু কোনো ভাবান্তর হলো না।
সোফায় মাহবুব শিকদার সহ আরো একজন লোককে বসারত অবস্থায় দেখতে পেলো নয়না। তূর্য দোতলায় পৌছাতেই নয়নাকে নামিয়ে দিয়েছে। বড়োদের সামনে অসভ্যতার ট্যাগ লাগাতে চায় না তারা।
তূর্য ও নয়নাকে পাশাপাশি বসানো হলো। ভাবনা এসে সর্বপ্রথম মাহিন ও মিনহাজের পশ্চাৎদেশের লাথি মেরে জাগালো। দুইটার দিকে তাকি বিশ্রী গালি দিলো। মাহবুব শিকদারকে এতোক্ষণ মাহিন ও মিনহাজ খেয়াল করেনি। তাকে দেখা মাত্রই তাড়াহুড়ো করে সোফা ছেড়ে সটান হয়ে দাড়িয়ে রইলো।

চারজন মনুষের উপস্থিতিতে নয়না ও তূর্যের বিয়ে সম্পন্ন হলো। নয়না পুরোটা সময়ে নিশ্চুপ ছিলো। বিয়ের সময়ে প্রতিটা মেয়েরই অভিভাবক পাশে থাকে অথচ নয়নার কী ভাগ্য! বাবা মা কী! চার কুলে কেউ নেই। কথাগুলো মনে হতেই কান্নায় ভেঙে পরে নয়না। তূর্য নয়নাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নয়নার হাতে হাত রেখে বলল,” খারাপ লাগছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”

নয়না নাক টেনে উত্তর দিলো,” বাবার কথা খুব মনে পড়ছে, তূর্য!”

তূর্য মুচকি হাসলো। নয়নার হাত শক্ত করে ধরে বলল,” মনে তো পড়বেই, নয়ন! কেননা তুমি আজ আঙ্কেলের শেষ আশা পূরণ করেছো।”

নয়না বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে মাথা তুলে তাকালো। চোখে মুখে তার প্রশ্নের ছাপ! মাহবুব শিকদার কাজীকে এগিয়ে দিয়ে এসে তূর্যের শেষোক্ত কথা শুনে বলল,” তোমার বাবার আইসিইউ থাকাকালীন সেন্স ফিরে আসে। তিনি আমাকে কিছু বলতে চাইছিল। তোমার বাবার অবস্থাও আশংকাজনক ছিলো।শেষ কোনো আশা আছে কী না তা জানার জন্য অক্সিজেন মাক্স খুলে দেই। তখন উনি আমাকে বলেছিলে, যেন তোমাকে দেখে রাখি। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই মনে মনে তূর্যের জন্য পছন্দ করেছিলাম। তোমার বাবার কথা শুনে আমার আরজিও জানাই। তখন তিনিও সায় প্রদান করেন। এরপরই পাঁচ মিনিটের মাথায় উনি মৃত্যু বরণ করেন।”

বাবার মৃত্যুর ঘটনা শুনে নয়না ভেঙে পড়লো। তূর্য নয়নার মাথা চেপে বুকে ঠেকিয়ে বলল,” থামো নয়ন! তোমার কান্না আমার বক্ষস্থলে ক্ষতের সৃষ্টি করছে।”

নয়না তো কান্না থামালোই না উলটো অজ্ঞান হয়ে গেলো। তূর্য পালস চেক করে পাঁজা কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেলো।”

——————————-
সকালের কিরণ চোখে পড়তেই নয়নার ঘুম ভেঙে গেলো। আড়মোড়ে উঠতে নিলে খেয়াল হলো সে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে আছে। নড়াচড়া করার জো নেই তার। এমনভাবে মানুষটা আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই নয়না পালিয়ে যাবে। নয়না খেয়াল করলো, জড়িয়ে ধরে রাখা মানুষটার শরীর থেকে চেনা পরিচিত ঘ্রাণ পাচ্ছে। পরমুহূর্তে নয়নার শেষ রাতের কথা স্বরণে আসে। তূর্যের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। এখন সে আর একা নয়, তূর্য নামক পুরুষটিও তার জীবনে জড়িয়ে গেছে। নয়নার নড়াচড়ায় তূর্যের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। সে নয়নার মাথা বুকের মধ্যে চেপে রেখে ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,” ঘুমাও তো বউ! তোমার চিন্তায় সারারাত বসে ছিলাম, এবার আমার জন্য সারাদিন বসে থাকবে।”

লজ্জায় নয়না তূর্যের বুকে চুপটি করে শুয়ে রইলো। অস্বাভাবিক নিঃশ্বাস আটকে রাখার মিথ্যা প্রয়াস করলো কিন্তু নিঃশ্বাস আটকে রেখে কতক্ষণই বা থাকবে! অস্বস্তিতে যখন নয়না ছটফট করতে শুরু করলো তখন তূর্য বিরক্তির স্বরে বলল,” সমস্যাটা কী, নয়ন?”
” ছাড়ো তো!”
” না ছাড়লে কী ফাঁ’সি’র দড়িতে ঝুলাবে?”
নয়না তূর্যের বুকে কিল বসিয়ে বলল,” এসব কেমন কথা?”
” তাহলে কী বলবো, রোমান্টিক কথাবার্তা? বললে কী তুমি শুনতে পারবে?”

” তুমি একটা!”
নয়নার কথা অসম্পূর্ণ অবস্থায় তূর্য বলল,” পাগল, ডাক্তার।”

নয়না এবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো। সেই হাসিতে মুগ্ধ তূর্য। নয়নার দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে