#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: চব্বিশ
বিগত পনেরো দিনের ধকল কাটিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো বাশার। এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করতে কতো কিছু করতে হয়েছে তাকে। তার উপর মাসুদার আবদার পূরণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু প্রবাদটির মর্মার্থ বাশার প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছে। এখন তার বাড়িতে যেতে ভালো লাগে না। সারাদিন পথে ঘাটে ঘুড়ে বেড়ায়, গভীররাতে বাড়িতে ঢুকে। গাজীপুরের রেলওয়ের পাশেই মন্দির। মন্দিরের সামনের গেইটের পাশে কালিদাস নামক একজন দাদা নিমকি বিক্রি করে। এই ব্যবসা তাদের পূর্বপুরুষ থেকে চলে আসছে। বাশার বিশ টাকার নিমকি কিনে নিলো, তার মনে পড়ে গেলো নয়নার কথা। প্রথম প্রথম নয়না বাশারকে ভাই ভাই বলে বেড়াতো। একদিন বাশার ঘরে বসে ফুল সাউন্ডে গান শুনছিল।নয়না কোথায় থেকে বাশারের ঘরে আসলো। বাশারের কাছে এসে বললো,” আমাকে নিমকি কিনে দিবে,বাশার ভাই?”
বিরক্তির সাথে বাশার সেদিন উত্তর দিয়েছিল,” জ্বালাস না তো, নয়না!”
নয়না হাত জোর করে বাশারের কাছে নিমকি কিনে দেয়ার জন্য বললো। বাশারের শরীরে ঝাকিয়ে অনুরোধ করলো। ততক্ষণে বাশার সাউন্ড বন্ধ করে নয়নার দিকে ফিরলো। গলায় ওড়না পরিহিতা নয়নার শরীরের গঠন সেদিনই চোখে পড়লো। বাশারের কামোত্তেজনার শুরু হয় নয়নাকে দেখে। সেদিন বাশার এখান থেকে নিমকি নিয়ে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বিনিময়ে নয়নার শরীরের অঙ্গের ভাঁজে হাত ঘুরাতো সে, চক্ষু দিয়ে গিলে খেতো নয়নার শরীরকে। নয়না প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরবর্তীতে বুঝে গেলো। আপাদমস্তক ঢেকে চলাফেরা শুরু করলো। বাশারের কুদৃষ্টি থেমে গেলো। বাশার পরবর্তীতে প্রকাশ্যে নয়নাকে শয্যাসঙ্গীর আহ্বান জানালো। সময়ে অসময়ে নয়নার গা ছুঁয়ে দিতে চাইতো। না জানে, মেয়েটা কোথায়,কী অবস্থাতে আছে! নয়নার কথা স্বরণে আসতে বাশারের শরীরের শিরা উপশিরা টগবগ করে উঠে। নয়নাকে শয্যাশায়ী করার ইচ্ছে জেগে উঠে। নিমকি খেতে খেতে দুই হাত দূরে টপস প্যান্ট পরিহিতা যুবতীর দিকে চোখ যায় বাশারের। মাথা থেকে পা পর্যন্ত বারবার ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সে। একসময় মেয়েটি দুইজন ছেলে সমেত বাশারের সামনে দাঁড়ালো। বাশারের গাল বরাবর দুইটা থাপ্পড় দিয়ে মেয়েটি বললো,” মেয়ে মানুষ দেখলেই চোখ দিয়ে গিলতে মনে চায় তাইনা? আমি কিছুক্ষণ ধরে এই লোকটার কার্যক্রম লক্ষ্য করছি। একবার আমার দিকে তো একবার অন্য নারীর দিকে বাজেভাবে তাকাচ্ছে। ইচ্ছে তো করছে আরো কয়েকটা লাগাতে।”
মেয়েটার কথা শেষ হলো। আশেপাশে মানুষজন জড়ো হলো। বাশার ঘাবড়ে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মুখ খোলার আগে পাশ থেকে একজন ছেলে বলে উঠলো,” তোদের মতো মানুষদের জন্য আজ গোটা পুরুষ জাতি খারাপ।”
বাশার রাগে গজগজ করতে শুরু করলো। একটা সময় আসে, যখন আমাদের প্রচুর রাগ হয় এবং সেটা কাঙ্খিত মানুষের উপর ঝাড়তে না পারি তখন সেই রাগ অন্যের উপর বর্তাতে দ্বিধাবোধ করি না। বাশারের ক্ষেত্রেও তেমন কিছু ঘটেছে। বাড়ির রাগ সে বাহিরে ঝাড়তে শুরু করে দিলো। দুই এক লোকের কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” তাকাইছি তো কী হইছে? তোর মায়ের দিকে তো তাকাই নাই, যা ভাগ!”
লোকসমাগমে ভুল একটা কথা বলা মানেই ভয়ংকর কিছু। বাশারের কথা দশজন লোকের পছন্দ হলো না। কথার প্রেক্ষিতে কথায় হাতাহাতি পর্যায়ে চলে গেলো। বাশার মাঝ রাস্তায় জনগণের মা’র খেলো।
আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা ফ্রীতে বিনোদন নিতে পছন্দ করে, আরেক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা কোলাহলমুক্ত থাকতে পছন্দ করে। বাশারকে কিছু মানুষ ফ্রীতে মা’র দিলো, কিছু মানুষ এসে বিষয়টি মিটমাট করে ছাড়িয়ে দিলো।
ব্যাথায় জর্জরিত বাশার খুঁড়িয়ে চলছে, মুখে তার অকথ্য ভাষা রয়েছেই। রেললাইনের পাশে সুরমা রেস্তোরাঁ অবস্থিত, আকস্মিক বাশার হাস্যজ্বল নয়নাকে দেখতে পেলো। বাশারের চোখের সামনেই কোনো একজন ছেলের সাথে রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলো। বাশারের পরিবারকে চিন্তায় ফেলে নয়না নাকি একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে? বাশার নয়নাকে অন্য ছেলের হতেই দিবে না। সে আজ নয়নাকে পেলে চরম শিক্ষা দিবে, যা নয়না কোনোদিনও ভুলতে পারবে না। রাস্তার অপরপ্রান্ত থেকে আসতে আসতেই নয়নার গাড়িটা ছেড়ে দিলো। বাশার পিছু পিছু কিছুদূর দৌড়ে এসেও গাড়িটা নাগালে পেলো না। বাশার রাস্তার দিকে তাকিয়ে কটমট সুরে বলল,” একবার তোকে পেয়ে নেই, নয়না! তোর জীবনের সব রঙে পানি ঢেলে দিবো।”
পরমুহূর্তে কিছু একটা স্বরণে আসতেই চোখমুখ চিকচিক করে উঠে বাশারের। সে একটি রিকশা ডেকে উঠে পড়লো,রিকশাওয়ালা জায়গা জিজ্ঞেস করায় বলল,” গাজীপুর সদর হাসপাতালের দিকে নিয়ে যান, মামা।”
——————————–
ভালোবাসার অতলে ডুবে গেলে অপ্রিয়রাও প্রিয় হয়ে যায়। ডানা মেলে আকাশে উড়তে ইচ্ছে হয়! ভালোবাসার মানুষটির কথা ভেবে আনমনে হাসতে ইচ্ছে হয়! উত্তরার বড়ো একটি রেস্টুরেন্টে নয়না বসে তূর্যের কথাই ভাবছে। পাগল ছেলেটা নয়নাকে নিয়ে জনসম্মুখে না বসে প্রাইভেট রুমে বসিয়ে রেখেছে। তার চিন্তা চেতন এমন যে, নয়নাকে বাহিরের কেউ দেখতে পারবে না। কতোটা পাগলাটে হলে তূর্য এমন করে! এসব ভেবে মুখে নয়নার মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে। তূর্য নয়নাকে বসিয়ে রেখে কোথায় যেনো গেলো, নয়নাও সময় পেলো তার পছন্দের মানুষটাকে নিয়ে ভাবার। সময় অতিবাহিত হচ্ছে, তূর্যের ফেরার নাম নেই। নয়নার এবার চিন্তা হচ্ছে কিছুটা।
নয়না উঠতে যাবে তখনই তূর্যের আগমন ঘটলো একগুচ্ছ গোলাপের তোড়া হাতে। নয়না বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো, তূর্য নয়নার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে বলল,” আমার ফুলের জন্য একগুচ্ছ ফুল। আমাকে বিয়ে করবে, নয়ন!”
টেলিভিশন, সিনেমায় নয়না ফুলের সমাহার দেখতো। বাস্তবে আজ দেখে আবেগ কন্ট্রোল করতে পারলো না। কান্না করে দিলো। নয়নার ইচ্ছে করছে তূর্যকে একবার জড়িয়ে ধরতে কিন্তু সম্পর্কের জোর নেই বলে ধরলো না। ফুলের তোড়ায় মাথা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। তূর্য প্রেয়সীর কান্না দেখে থতমত খেয়ে গেলো। নয়নাকে স্বান্তনা কীভাবে দিবে বুঝতে পারলো না। এমনিতেও সে নয়নার অনুমতি ছাড়া তাকে স্পর্শ করে না। নয়নার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েও গুটিয়ে নিচ্ছে বারবার তূর্য। নয়না তা দেখে ফুলোর তোড়া তাদের মাঝখানে রেখে মাথা এলিয়ে দিলো তূর্যের বুকে। তূর্য স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে রইলো। নয়নার কান্না তার বুকে এসে লাগছে। সে কী ভুল কিছু বলেছে? নয়নার মনে কী কষ্ট দিয়েছে? নয়নার কী সম্মতি নেই? যদি এমনই হয়, তবে তূর্য তো জীবিত থেকেও ম’রে যাবে। নয়নাই তার জীবনের প্রথম ভালোলাগা। একজন সাধারণ মেয়ে তূর্যের চোখে অসাধারণ হয়ে উঠা। তূর্যের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নয়নার চোখের অশ্রু তার কাছে বিষক্রিয়া মনে হচ্ছে। তূর্যের এক্ষুনি সেই বিষক্রিয়া পান করে ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে।
নয়নার মাথায় হাত রেখে তূর্য চোখ বন্ধ করে রইলো। সময় নিয়ে নরম স্বরে বলল,” কান্না করে না, লক্ষীটি!”
নয়না তূর্যের বাহুডোর থেকে সরে আসতে চাইলে তূর্য বাঁধা প্রদান করলো। নয়নার মাথা শক্তকরে বুকে চেপে ধরলো সে। ধীর কণ্ঠে বলল,” এ বুকের তোলপাড় কার জন্য জানো, নয়ন? এ বুকের স্থানটা কার জন্য জানো কী? আমি বলছি, এ বুকের প্রতিটা বিট দ্রুত হয় একজনের কাছেই আসলে। আর সে হচ্ছে, নয়ন! আমার নয়ন, যার কাছে আমি অন্য এক তূর্য।”
নয়না নাক টেনে উত্তর দিলো,” এতো ভালোবাসা কেন দিচ্ছো, তূর্য?”
” কারণ তুমি তূর্যের ভালোবাসার প্রাপ্য।”
” আমার তো ভয় হয়!”
” আমি আছি তো!”
” যদি বাশার,,,,
তূর্য নয়নার মুখ তুলে ধরলো। তূর্যের নিশ্বাস নয়নার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। নয়নার চোখের অশ্রু মুছে তূর্য বলল,” তোমার অতীত যতোটা ভয়ংকর, বর্তমান ততোটা সুন্দর; ভবিষ্যৎ আমার জন্য তুলে রাখো। আমি তোমার সকল সময়ে বিচরণ করতে চাই!”
নয়না এক দৃষ্টিতে তূর্যকে দেখছে। এতো কাছাকাছি একই প্রথম তার দেখা। তূর্য ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে। নিজেকে প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণে রাখছে কিন্তু পারলে তো! দিনশেষে সেও তো পুরুষ! নয়নার চঞ্চলতা ভরা চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,” একটু পঁচা কাজ করি, একটু! ব্যাথা পাবে না।”
নয়না কিছু বুঝার আগে তূর্য নয়নার কপালে শক্তকরে চুমু খেলো। কতক্ষণ তূর্য ও নয়না এভাবে ছিলো জানা নেই। নয়না সরে যেতে চাইলেও তূর্য শক্তকরে ধরে রাখলো। যেন ছেড়ে দিলেই নয়না পালিয়ে যাবে।
দুইজন সুখী মানব মানবীর সুখের গল্প ধারাবাহিকতায় চলবে নাকি বাশার নামক কুৎসিত প্রকৃতির মানুষের আগমন ঘটবে, তা সময়ই বলে দিবে।
চলবে……………………