নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২২+২৩

0
366

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: বাইশ

সন্ধ্যা নামতে বেশি সময় বাকী নেই। এতো সময় কীভাবে পেরিয়ে গেলো নয়না বুঝতেই পারেনি। মেয়েরা যেভাবে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কান্না করে নয়না ঠিক সেভাবেই কান্না করছে। তূর্য অধৈর্য চিত্তে সোফায় মারুফের সাথে বসে ছটফট করছে। মিছিলদের বাড়িতে নয়না সেইদিনই না এলো! এতো তাড়াতাড়ি দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হয়ে গেছে! এই তো সেদিন ধুমধামে মিছিলদের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হলো। নয়নার সেদিন আনন্দ দেখে কে! মিছিলের সাথে সাথে সেও চঞ্চলা পাখির মতো উড়ছিল। সারাবাড়ির আনাচে কানাচে নয়না মিছিলের হাস্য ধ্বনি বাজছিল। এতো তাড়াতাড়িই সময় ফুরিয়ে গেলো! নয়না ভেবেছিল সে এখানেই থাকবে কিন্তু তার ধারণায় এক বালতি পানি ঢেলে তূর্য সকাল থেকে এসে বসে আছে। নয়না যাবে না বলার উত্তরে শান্ত স্বরে বলেছে, ” এই বাড়ির ঠিকানা তোমার পরিবার জানে। আমি চাই না তারা তোমাকে খুঁজে বের করে আবারও সেই নরকে নিয়ে যাক।”

তূর্যের কথায় মিছিলের পরিবার সবাই সহমত পোষণ করলো। এসব দেখে মিছিল বেজায় ক্ষেপে গেলো। বিদায়ের সময়ে নয়নার সাথে মিছিলেরও সেই কী কান্না! দুই বান্ধবীর কান্নায় কোরবানি হচ্ছে পুরো পরিবার। মারুফের স্ত্রী হেনার মনটাও খারাপ।
এই কান্নার শেষ নেই তূর্য বুঝে গেছে। এক প্রকার অধৈর্য হয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। নয়নার কাছে এসে বলল,” মন হচ্ছে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছো। আমাকে কী এখন বলাতে চাচ্ছো যে, বউ কান্না করো না আগামীকাল তো নিয়েই আসবো। আমার কিন্তু কথাগুলো বলতে কোনো সমস্যা নাই।”

তূর্যের কথা শেষ হতেই সারাঘরে হাসির রোল পড়লো।
নয়না কটমট চোখে তূর্যের দিকে তাকালো। তূর্যের এই মুহূর্তে ফাজলামো করতে ইচ্ছে করছে! নয়নার দুঃখ বুঝতে চাইছে না! তূর্য দাঁত বের করে হেসে বলল,” চলো বউ!”

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। নয়না নাক টেনে টেনে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছে। তূর্য নয়নার দুঃখে ঘি ঢালার জন্য টিস্যু এগিয়ে দিলো। নয়না তাতে তেতে উঠে তূর্যের পিঠে কিল বসিয়ে বলল,” মজা হচ্ছে! আমার দুঃখে আনন্দ পাচ্ছো? থাকবো না তোমার সাথে। গাড়ি থামাও, আমি থাকবো না তোমার সাথে।”

চলন্ত গাড়ি জোরে ব্রেক কষলো তূর্য। চোখ মুখ তার রক্তিম হয়ে গেলো মুহূর্তেই। নয়নার দিকে ফিরে দুই বাহু শক্তকরে ধরে বলল,” তুমি কী চাও, আমি নিঃশেষ হয়ে যাই! এই মেয়ে, আমাকে বুঝো না কেনো! তোমাকে সময় কাটানোর জন্য সাথে রাখিনি, তোমাকে ভালোবাসি, সারাজীবনের জন্য নিজের করে রাখতে চাই, ড্যাম ইট!”

তূর্যের উঁচু আওয়াজ শুনে চমকে উঠে নয়না। আঁখি জোড়ায় নেমে আসে অবাধ্য অশ্রুকণা! হেঁচকি তুলে কান্না করতে থাকে মেয়েটা। তূর্য স্টিয়ারিংয়ের উপর হাত দ্বারা আঘাত করে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো। সে নয়নাকে এভাবে কষ্ট দিতে চায়নি। নয়না তাকে ছেড়ে চলে যাবে শুনেই তো রাগ হয়েছিল। নয়নার দুই গালে হাত রেখে কান্না থামাতে চেষ্টা করলো তূর্য,” আ’ম সরি, লক্ষীটি! রাগটা কন্ট্রোল করতে পারিনি। আমি কী করবো, জড়িয়ে ধরবো? না থাক, তুমি কী মনে করবে। কান্না থামাও নাহলে, নাহলে!”

নয়না তূর্যে হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাতে কপাল ঠেকালো। ক্ষনে ক্ষনে হেঁচকি তুলছে সে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর মাথা তুলে বলল,” এতো সুখ আমার কপালে সইবে না,তূর্য! আমাকে কেন এতো ভালোবাসেন, বলবেন? আমি তো সাধারণ একজন মেয়ে, আপনার মতো ডাক্তারের জন্য অন্য কেউ…..!

নয়না কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না তার আগেই তার ঠোঁট জোড়ায় তূর্য আঙুল রেখে বলল,” হুঁশ! আমার অন্য কাউকে নয়, তোমাকে প্রয়োজন নয়ন! প্লিজ আমার হয়ে যাও, নয়ন!”

নয়না অপলক দৃষ্টিতে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। সময়ের হিসাব তার অজানা, আপাতত এভাবেই সময় চলুক। কে জানে! আগামীকাল যদি এই সময় না পাওয়া যায়!

প্রায় বিশ মিনিট পর নয়না দেখতে পেলো গাড়ি ভাবনার বাড়ির রাস্তায় না ঢুকে অন্যদিকে যাচ্ছে। প্রশ্নবোধক চাহনিতে নয়না তূর্যের দিকে তাকালে হেসে ফেললো তূর্য। ডান পাশে মোড় ঘুরিয়ে বলল,” তোমার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি, নয়ন।”

নয়না কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। এই লোকটা এতোটা ঠোঁটকাটা স্বভাবের কেনো? ভালোভাবে বললে কী হচ্ছিলো না! বলতেই তো পারতো যে,’ নয়না, আমাদের বাড়ি,গাড়ি, দেয়াল, ড্রায়ার সব দেখাবে নিয়ে যাচ্ছি।’ তা না বলে ডিরেক্ট শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথা! অসভ্য, নির্লজ্জ ডাক্তার। মনে মনে শত কথা আওড়ালেও জোরে বলতে পারলো না নয়না।
গাজীপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সাত কিলোমিটার দূরে মারতা বাজার অবস্থিত। বাজার থেকে ডানে মোড় টানলো তূর্য। প্রায় দুই মিনিট পর সবুজে ঢাকা একটি বাড়ির গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামালো সে। ইশারার নয়নাকে নামতে বলে নিজেও নামলো।

তূর্য এগিয়ে এসে নিজেই গেইট খুলে দিলো। নয়না তূর্যের পিছু পিছু হাঁটছে। বাড়ির আশপাশ দেখে মনে হচ্ছে, বাড়িটি একদম নতুন তৈরি করা হয়েছে। তিন তলা বিশিষ্ট বাড়ির সম্মুখে ছোট ছোট গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় কিন্তু কে করে? নয়না আশেপাশে দেখতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে তূর্য তাকে রেখে অনেকটাই সামনে এগিয়ে গেলো। নয়না একপ্রকার দৌড়ে তূর্যকে ধরে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো।
বাহির থেকে যতোটা সাধারণ মনে হয়েছে বাড়ির ভেতরটা ততোই অসাধারণ। আভিজাত্যপূর্ণ বাড়ির আসবাবপত্র দেখে নয়না মুখ হা করে রইলো। ডুপ্লেক্স বাড়ি নয়নার প্রথম দেখা, মাথার উপর বড়ো ঝাড়বাতি দেখে বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলো। তূর্য সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপর উঠে গিয়েছিল। নয়নাকে থামতে দেখে পিছনে ফিরলো। নয়নার বিস্ময়কর তাকানো দেখে বেশ লাগছিলো তার কাছে তাইতো মুঠোফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
নয়নার নড়চড় না দেখে বলল,” দেখা হয়েছে? চাচ্চু অপেক্ষা করছে।”

লাজুক হেসে নয়না সিঁড়িতে পা দিলো। তিনলায় পৌঁছে তূর্য সরাসরি দক্ষিণ পাশে চলে গেলো, যেখানে মাহবুব শিকদার বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। নয়না তখনো মাহবুব শিকদারের ব্যপারে অজ্ঞ। ঘরে প্রবেশ করতেই তূর্য ডেকে বলল,” এবার তো কথা বলবে আমার সাথে,চাচ্চু? নাও, তোমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি।”

মাহবুব শিকদারকে দেখে নয়নার অবাকের অন্ত নেই। মুখে হাত রেখে বলল,” ডাক্তার আঙ্কেলই তূর্যের চাচা?”

মাহবুব শিকদার এগিয়ে এসে বলল,” হ্যাঁ রে মা! তূর্য তোকে আমার কথা বলেনি?”
নয়না আড়চোখে তূর্যকে দেখে বলল,” বলেছে কিন্তু আপনিই যে চাচ্চু তা বলেনি।”

তূর্যের দিকে মিছে রাগ নিয়ে মাহবুব শিকদার তাকালে সে মাথা চুলকে বলল, ” সেভাবে জিজ্ঞেস করেনি তাই!”

মাহবুব শিকদার বেশি কথা বাড়ালো না। নয়নার উদ্দেশে বলল,” তুমি গিয়ে রেস্ট করো। আমাকে একবার হাসপাতালে যেতে হবে। কিছু লাগলে, তূর্যকে বলো কেমন!”

তূর্য নয়নাকে নিয়ে পশ্চিম পাশটায় এসে দাঁড়ালো। পাশাপাশি দুইঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ঘরটার দিকে ইশারা করে বলল,” আজ থেকে এই ঘরে থাকবে, কিন্তু তা কিছুদিনের জন্য।”

নয়না বোকার মতো উত্তর দিলো,” তারপর কী ভাবনা আপুর বাসায় চলে যাবো?”

তূর্য দুষ্ট হেসে নয়নার উদ্দেশে বলল,” না গো, কলিজা! তারপর তো তুমি আমার সাথে থাকবে; বিয়ের পর!”

নয়না চোখ বড়ো করে তূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই ডাক্তারটা এতো নির্লজ্জ কেনো?
তূর্য হাসতে হাসতে ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে করতে বলল,” হাসপাতালে যেতে হবে, নয়ন! ফ্রেস হয়ে এক কাপ কফি আনবে,প্লিজ? নিচ তলায় বাম পাশে রান্নাঘর!”

তূর্যের হুটহাট আবদারে নয়না আলাদা সুখ অনুভব করে। মানুষটা একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের কিন্তু সে জানে তা নিতান্তই নয়নার কাছেই। তূর্য একান্তই তার পছন্দের পুরুষ, ভালোবাসার পুরুষ। কাউকে ভাগ বসাতে দিবে না, নয়না। নিজের ভাবনায় মুচকি হাসলো নয়না। সেও তূর্যের মতো পাগল হয়ে গেছে।
—————

প্রায় দেড় দিনের মাথায় বাশারকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হয় বোরহান। লজ্জায় তার মাথা কাটা গেছে। নিজের ছেলের বিয়ের ব্যপারেও সে জানতো না। আকলিমা বিশেষ কিছু কখনে জানায় না। এমন একরা বড়ে কাণ্ড ঘটিয়েছে সেটাও জানাতো না যদি টাকার ব্যাপার না হতো! এদিকে নয়না দুই তিন সপ্তাহ থেকে নিখোঁজ। আদৌও বেঁচে আছে কী না কে জানে?
বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাশার সর্বপ্রথম নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। মাসুদা তখন গুনগুন করে গান গাইছিল আর মাথার চুল আঁচড়াচ্ছিল। বাশার কোনো কথা না বলে মাসুদার চুলের মুষ্টি ধরে বাহিরে নিয়ে আসলো। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে, এক পর্যায়ে বলতে শুরু করলো,” সেদিন ঐ লোককে টাকা দিলি না কেন, মা’গী। আমাকে পুলিশে নিয়ে গেলো তখনো ফিরালি না কেন? এক্ষুণি টাকা দিবি নয়তো তোকে মেরেই ফেলবো।”

কথা শেষ হতেই বাশার মাসুদাকে মারার জন্য উদ্যোগ নিলে বোরহান বাঁধা দেয়। বাশারের হাত থেকে মাসুদাকে ছাড়িয়ে উলটে বাশারের গালে থাপ্পড় বসায়। আকলিমা তেড়ে আসছিল স্বামীর দিকে বোরহান আকলিমার গালেও থাপ্পড় বসিয়ে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো,” তোর জন্য আমার সন্তানরা আজ বিপথে। তোকে করুণা করে বিয়ে করেছিলাম, যেন এই অবৈধ বাচ্চা বৈধতা পায়! নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলাম। কিন্তু আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আগাছা কেটে দিলে যেমন কিছু গাছ পরিষ্কার হয় না তেমন জিনগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয় না। তুই প্রমাণ করেই দিলি, তোর আর তোর ঐ লম্পট প্রেমিকের রক্ত এই ছেলের শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। ভাবীর কথায় যদি তোকে বিয়ে না করতাম তাহলে পঁচে গলে মরতি। এজন্যই তুই নয়নাকে দেখতে পারিস না,তাই না? মেয়েটাকে মেরে ফেললি তো? দেখেছিস পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। তোর সামনে তোর পরিবার আজ ছিন্নভিন্ন।”

এতো বছর পর কঠিন সত্যের মুখোমুখি হয়ে আকলিমা দেয়াল ঘেঁষে জমিনে বসে পড়লো। বাশারও স্তব্ধ প্রায়! সে অবৈধ সন্তান, বারবার একথাটাই মস্তিষ্কে ঘুরছে। এতোকিছুর মধ্যে মাসুদা হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। তার আহাজারিতে পড়া প্রতিবেশী এক হয়ে গেলো। কেউ কেউ এসে বাড়ির পরিস্থিতি দেখে প্রশ্ন করলো, ” ব্যাপারটা কী?”
মাসুদা তখন আহাজারি করতে করতে বলল,” আমার স্বামী যৌতুকের টাকা এনে দেইনি বলে, আমাকে বাড়ি থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে চাইছে।”

পাড়া প্রতিবেশীরা ছি ছি করতে শুরু করলো।বাশার অবাক হয়ে বলল,” আমি কখন বললাম?”

উত্তরে মাসুদা বাঁকা হাসলো।

চলবে……….

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: তেইশ

তিমিরাচ্ছন্ন পৃথিবী। নিস্তব্ধতায় ঘেরা চারপাশ। বন জঙ্গল থেকে পেঁচা ও শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। আজকাল শেয়াল রাতের সাথে দিনের আলোয়ও লোকালয়ে ঘুরাফেরা করে। চোখের সামনে গল্পের বইয়ে পড়া কাল্পনিক শেয়ালকে দেখে অনেকেই চমকায়, আবার অনেকে ভয়ে উলটে দৌড় লাগায়। নয়নার এই মুহূর্তে কঠিন একটি কাজ করতে ইচ্ছে করছে। ঘন জঙ্গলে এই রাতে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। একাকী সে কীই বা আর করবে! বারান্দায় বসে গুনগুন করে গান গাইছে। সময়ের হিসাব তার জানা নেই। রাত্রির ঠিক কয়টা বাজে খবর নেই। সন্ধ্যায় তূর্যের কাছে একটা ইমারজেন্সী কল আসায় দ্রুত হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর মাহবুব শিকদারও চলে যান! সেই থেকেই সে তূর্য ছাড়া একা সময় কাটাচ্ছে। বারান্দার ফ্লোরে মুঠোফোন পড়ে আছে, নয়নার নজর সেদিকেই গেলো। পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর ফোনে আলো জ্বলে উঠছে, নয়না স্মিত হেসে রিসিভ করে কানে ধরলো।অপরপাশ থেকে তাড়াহুড়োর স্বর শোনা গেলো,” এখনে বারান্দায় বসে আছো?”
” হু!”
তূর্য অপরপাশ থেকে ধমকের সুরে বলল,” তুমি কী চাইছো, রোগী রেখে তোমার কাছে চলে আসি! বুঝতে চেষ্টা করো না কেনো লক্ষীটি, আমি শান্তিতে রোগীদের সেবা করতে পারব তখনই যখন তুমি ঠিক থাকবে।”

নয়না মুচকি হাসলো। বারান্দা থেকে ঘরে এসে থাই গ্লাস লাগিয়ে দিলো। বিছানায় আরাম করে শুয়ে বলল,” আমি তো ঠিকই আছি।”
” কোথায় ঠিক থাকলে? একা একা ঠিক থাকা যায়? ডর ভয় নাই নাকি? এই নয়ন, শোনো?”
” হুম, বলো!”
” আমি কী চলে আসবো?”

তূর্যের কথা শুনে নয়না ফিক করে হেসে ফেলল। তূর্য এমনভাবে কথা বলছে যেন নয়না তার বিয়ে করা বউ! নয়না নিজের ভাবনায় থতমত খেয়ে গেলো, লজ্জায় মুখখানা লাল টকটকে হয়ে গেলো। বালিশে মুখ গুঁজে মিনমিন করে বলল,” আমার ঘুম পাচ্ছে, তূর্য!”

তূর্য নিশ্চুপ হয়ে গেলো। শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তার মাতাল স্বর ভেসে আসলো,” ঘুমাও,প্রিয়া! তোমার ঘুমের শব্দ শুনে আমি রাত পাড় করি!”
নয়না চোখ খুলে ফেললো। উঁচু আওয়াজ করে বলল,” আশ্চর্য! আমি কী ঘুমের মধ্যে নাক ডাকি নাকি?”

” আশ্চর্যের কিছু নেই, নয়না! স্লিপিং বিউটিকেও খুব সুন্দর লাগছিল তিনি দীর্ঘ শুয়েছিলেন, কখনও বৃদ্ধ হননি এবং তার প্রিন্স চার্মিং পাওয়ার জন্য তাকে নাক ডাকা ছাড়া আর কিছুই করতে হয়নি।”

নয়না উচ্চ স্বরে হাসলো। তূর্যের কথার প্রেক্ষিতে উত্তর দিলো,” তাহলে তো আমারও প্রিন্স চার্মিং এর জন্য নাক ডাকা শুরু করতে হবে!”

” তোমার প্রিন্স তোমাকে এমনিতেই ভালোবাসে। তার জন্য নিজেকে পরিবর্তন নয়, নিজেকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করো। তোমাকে পাওয়ার আকুলতা বিশাল পর্বতের চেয়েও উঁচু।”

রাত যতো গভীর হচ্ছে, প্রেমিকযুগলের খোশ আলাপন ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে প্রেমিক পুরুষ তূর্যের মতে হলে নয়নার মতে মেয়ের দুঃখের অবসান হতো।

——————————

প্রভাতের আলো ফুটতেই আকলিমা নড়েচড়ে বসে। সূর্যের আলো ঠিক তার চোখের উপর পড়ছে। চোখ খুলতেই বোরহান উদ্দিনের অবয়ব ভাসমান হলো আকলিমার চোখের সামনে। বোরহান উদ্দিন ব্যাগ প্যাক করে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আকলিমা উঠে স্বামীর পাশে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছো?”

” রিহানকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছি।”

আকলিমা বোরহানের হত ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,” রিহানকে নিয়ে যাচ্ছো মানে? আমার সন্তানকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যেতে দিব না।”

বোরহান হাসলো। আকলিমার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়ে বলল,” খবরদার ঐ খারাপ মুখে রিহানের নাম উচ্চারণ করবে না। এতোই যদি ছেলে ছেলে করো তবে কেনো ছেলেটাকে অসুস্থ অবস্থায় হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলে। কেনো নিজের সন্তানকে দূরে রাখলে?”

আকলিমার কাছে এর উত্তর নেই। সে তো বাশারের বুদ্ধিতে এই কাজ করেছিল। সে মিনমিন করে বলল,” বাশার বলেছিল,,,,

” বাশার, বাশার, বাশার তুই থাক তোর পাপের ফল নিয়ে। রিহান চলো,বাবা।”

ছোট্ট রিহান, বুঝ ক্ষমতা ভালো। ভালো,খারাপ বুঝেও।আকলিমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমি মানুষের মতো মানুষ হয়ে ফিরব, মা! বাবাকে ভুল বুঝো না, বাবার সাথে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার।”

আকলিমা বাকরূদ্ধ। মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। এই শোক সে কীভাবে কাটাবে? বোরহানের হাতে পায়ে ধরলো সে, অনুরোধের স্বরে বলল, ” এমন শাস্তি দিও না। রিহান কে রেখে যাও।”

বোরহান শুনলে তো! আকলিমার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো।

দরজার আড়াল থেকে মাসুদা সবটাই দেখলো। তার চোখে মুখে ক্রুর হাসি। ফিসফিস করে বলল, ” বদলা তো মাত্র শুরু! এখনো কতো কিছু বাকী আছে! আস্তে আস্তে বুঝবে, মেয়েদের সম্মানে হাত দেওয়ার নির্মম পরিণতি কেমন হয়, বাশার!”

———————

লোকে বলে, প্রেমিকা পটানোর আগ পর্যন্ত অথবা বিয়ে করার আগ পর্যন্ত নাকি প্রেমিকের বা স্বামীর হাতে ঢের সময় থাকে কিন্তু পটে গেলে বা বিয়ের পর তাদের সময় কোথায় চলে যায় কে জানে! বিগত এক সপ্তাহ ধরে নয়নার তূর্যের প্রতি সেই কী অভিমান! নয়নাকে কাছে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো, তূর্যের সময়ও ছিলো অনেক। নয়নাকে একা রাখেনি কখনো, অথচ নয়নাকে কাছে আনার পর থেকে সাহেব একদম পরিবর্তন হয়ে গেছে। সারারাত হাসপাতালে কাটায় আর সারাদিন ঘুমে। নয়নার সাথে সময়ের হিসাব করে সাক্ষাৎ হয় তার, কথাও হয় অল্প স্বল্প। ভাবখানা এমন যেন এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নয়না সাক্ষাৎ করতে এসেছে, সীমিত সময় কথা বলেই ডাক্তার সাহেব চলে যাচ্ছে।
গতকালই তূর্যের রাতের ডিউটি শেষ হলো। আজ তার ছুটি আগামীকাল থেকে দিনের ডিউটি শুরু হবে সাথে তূর্যের ব্যস্ততাও। সাধারণত তূর্য ছুটির দিনটাও হাসপাতালে কাটাতো কিন্তু নয়না তার জীবনে আসার পর থেকে ছুটির দিনটার জন্যই অপেক্ষা করতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত একটানা ঘুমিয়ে তূর্য নয়নাকে খুঁজতে শুরু করলো। তিনতলায় নয়নাকে না পেয়ে নিচে আসলো। এক দুইবার নয়নার নাম ধরে হাঁক ছাড়লো কিন্তু আশানুরূপ কোনো সাড়া পেলো না। তূর্যের মনে ভয় ঢুকলো ভেবে, নয়নার কিছু হয়ে যায়নি তো! তাড়াহুড়ায় সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামতে গিয়ে হোটচ খেতে খেতে বেঁচে গেলো। রান্নাঘর থেকে টুংটাং পাতিলের শব্দ ভেসে আসছে, তূর্য সেদিকে আগালো। পোলাওয়ের ঘ্রাণ তূর্যের নাকে বাড়ি খেলে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে হাসলো। নয়না তখন পেঁয়াজ বেরেস্তা পোলাওয়ের উপর ছিটিয়ে দিচ্ছিল। তূর্যের আগমনে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। তূর্যকে ইগনোর করে সে তার কাজ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহত দৃষ্টিতে তূর্য প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকটা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে কিন্তু কেউ শুনলে তো! অবশেষে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে তূর্য বলতে শুরু করলো,” কী করছো আমার না হওয়া বউ?”

আগুনের উপর ঘি ঢেলে দিয়ে তূর্য দুষ্ট হাসলো, নয়না গোস্ত নাড়াচাড়া করছিল; খুন্তিটা তূর্যের দিকে এগিয়ে এনে বলল,” একদম উলটা পালটা সম্বোধন করবে না, তূর্য।”

তূর্য বুক হাত রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল,” হায়! তোমার সুরে আমার নামটা কী কিউট শোনায়!”

তূর্যে লজ্জায় লাল হওয়া ভাব দেখে নয়নার রাগ নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো কিন্তু সে বাহিরে তা প্রকাশ করলো না৷ মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,” হাসপাতালে যাবে না! যাও যাও, জলদি তৈরী হয়ে নাও। নয়তো তোমার ইয়াং ইয়াং মেয়েরা যারা রোগী সেজে বসে আছে,তারা তোমার দেখা না পেলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে।”

নয়নার কথায় তূর্যের ভীষণ হাসি পেলো। মেয়েটার মনে এসব চলে! দুষ্টু সুরে বলল,” আর ইউ জেলাস,নয়ন!”

নয়না থতমত খেলো। মনকে প্রশ্ন করলো, সত্যিই কী সে জেলাস! তূর্যের মুখোমুখি না হওয়ার জন্য চেহারা আড়াল করে উত্তর দিলো,” বয়েই গেছে।”

তূর্য বলল,” মেয়ে তুমি হিংসার অজুহাত না খুঁজে,ভালোবাসার অজুহাত খুঁজো!”

নয়না মুখ বাঁকিয়ে বলল, ” নিজের মানুষটাকে অন্য কেউ দেখবে তা পৃথিবীর কোনো নারীই সহ্য করবে না। ”
” আমি সত্যিই কী তোমার পুরুষ, নয়ন!”
” এতেদিনেও বুঝলে না?”
” মুখে না স্বীকার করলে কীভাবে বুঝি!”
” সব কথা মুখে বলতে নেই, অপরপাশের মানুষটার জন্য মনের কোণে আলাদা স্থান আছে, তা বুঝে নিতে হয়।”

তূর্য গভীর নয়নে নয়নাকে দেখছে। নয়নার কাজ শেষ, সে রান্না ঘর থেকে বের হতে নিলে তূর্যের চোখের গভীরতা দেখে লজ্জা পেলো। তূর্যের চোখের উপর এক হাত রেখে বলল, ” এভবে তাকাবে না, আমার অস্বস্তি হয়।”

তূর্য হেসে নয়নার হাতে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলো। সহসা প্রেমিকের প্রেমময় প্রথম স্পর্শে নয়নার শরীরের শিরা উপশিরা টনটন করে উঠলো। হাত সরিয়ে তূর্যকে ধাক্কা দিয়ে বের হয়ে গেলো।
তূর্য তা দেখে বিড়বিড় করে বলল,” আর অপেক্ষা নয়!তোমাকে বৈধতায় আবদ্ধ করার সময় হয়ে গেছে, নয়ন!”

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে