নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-২০+২১

0
421

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: বিশ

গাজীপুর থেকে প্রায় সাইত্রিশ কিলোমিটার দূর মাওনা চৌরাস্তায় অবস্থিত কাকলি ফার্নিচারের প্রধান শো রুম। বাশারকে তার স্ত্রী এক ঘণ্টার পথ জার্নি করে এখানে নিয়ে এসেছে। শো রুমে প্রবেশ করতেই নীচতলায় খাঁট, সেলফ, কেবিনেট ইত্যাদি সামগ্রী দেখতে পাওয়া গেলো। মাসুদার নীচতলায় কোনো কাজ নেই তাই বাশারকে নিয়ে সোজা দোতলায় উঠে গেলো। সোফা, খাট সহ নানারকম কাঠের আসবাবপত্র সাজানো গোছানো রয়েছে। মাসুদা এক লক্ষ টাকার পালঙ্কের কাছে এসে ছুঁয়ে দেখছে। বাশারও খুব খুশি! তাদের মতো মধ্যবিত্তদের ঘরে এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক মানে কতো কিছু! আর টাকার বিষয়টাও বাশারকে ভাবাচ্ছে না কেননা টাকার থলিকেই তো বিয়ে করে এনেছে! এখন কী আর তার চিন্তা আছে?
শো রুমের মালিক মোঃ সোহেল রহমান বাশার এবং মাসুদাকে হাসিমুখে স্বাগতম জানিয়ে বলতে শুরু করলো,” আপনারা খুব লাকি বুঝলেন! পৃথিবীতে কতজন আর আছে! যারা পালঙ্কের উপর ঘুমায়! পৃথিবীতে আশি শতাংশ মানুষরা দামী গাড়ি,দামী পোশাক, কিনে টাকা উড়ায়, যা আজ আছে কাল নেই। কিন্তু আপনারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কাকলি ফার্নিচার বিশ্বের একমাত্র ভাইরাল ফার্নিচার। যা দামে কম কিন্তু মানে ভালো।”

ভদ্রলোকের বিশাল ভাষণ শুনে বাশার মনে মনে বলল,” বিক্রয় করার অভিনব কৌশল হলো, কথার আকর্ষণ। তুমি মিয়া বলতে থাকো।”

মাসুদা খুশিতে গদগদ হয়ে বাশারের উদ্দেশে বলল,” আমি আজই এক লক্ষ টাকার পালঙ্ক ঘরে নিয়ে যাবো। প্লিজ প্লিজ তুমি ব্যবস্থা করো!”

বাশার স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে মোঃ সোহেল রহমানের উদ্দেশে বলল,” আপনি সব ফর্মালিটি পূরণ করুন। আমরা এটাই নিব।”

” কোনো চিন্তা করবেন না স্যার। আমরা আজই আপনাদের ঠিকানায় পৌঁছে দিব।”

ফর্মালিটি পূরণ করে বাশার ও মাসুদা শো রুম থেকে বের হয়ে আসে। সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামার সময় মাসুদা সোহেল রহমানের দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসে।

—————————————-

হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো, বাঁটো ফুলের মৌ!” গানটা ছাড়া বিয়ে বাড়ির আমেজ জমে উঠে না। ঊনিংশ শতকের সময়ে দাদী চাচীরা গলা ছেড়ে গান গাইতো, একজোট বেঁধে গীত গাইতো। বর্তমান জেনারেশনে গানগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে। বাংলা গানের পরিবর্তে হিন্দি বা ডি জে গান চলে হলুদের অনুষ্ঠানে। ময়মনসিংহ থাকতে নয়নারা ভাই বোনেরা হলুদের গান শুনে নাচতো। হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে তুলতো সারা এলাকা। এখন সেগুলো স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ। মিছিলের সাথে কোনো একদিন হলুদের আনন্দ নিয়প গল্প করছিল। সেই সুবাদে আজ মিছিল একমাত্র বন্ধুর জন্য হলুদের গান বাজাতে বলে। নয়নার দেখা সেই স্টেজে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়ছে। একপাশে সাউন্ড বক্সে হলুদের গান বাজছে অপরপাশে স্টেজে বাচ্চারা নাচছে।
বিকালের এই সময়টায় মানুষের আনাগোনা কম। অতিথিরা এখনো আসা শুরু করেনি। নয়না এই সুযোগে বাচ্চাদের আনন্দ উপভোগ করছে। বাচ্চাদের ভুলভাল নাচে করতালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে সে। মুখে তার ভুবন ভোলানো হাসি। দূর থেকে কেউ যে তার হাসিতে মাতোয়ারা হচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। নয়নার পাশে তূর্য এসে দাঁড়ালো। নয়নার সেদিকে খেয়াল নেই। তূর্যের ঐ বাচ্চাদের উপর হিংসে হচ্ছে। তাদের স্থানে সে কেন থাকলো না? তূর্যের জন্য তাহলে নয়নার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠতো! নয়নার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বিষয়টা তখন খেয়াল হয় যখন তূর্য নয়নার হাতে একটি শপিং ব্যাগ তুলে দেয়। উৎসুক দৃষ্টিতে নয়না তূর্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” এটা কী?”
তূয নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,” শাড়ি।”
” আমি নিতে পারব না।”
নয়না শপিং ব্যাগ তূর্যের হাতে ধরিয়ে দিলো। সে আর তূর্যের কাছে ঋণী হয়ে থাকতে চায় না। নয়না চলে যেতে নিলে তূর্য নয়নার হাত ধরে ফেললো। নয়নার হাত টেনে একদম নিজের কাছাকাছি এনে বললো,” আমার সব তোমার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছি, তোমার দুঃখকে নিজের করে নিয়েছি। আজ আমার খুশির জন্য এটা নিতে পারবে না, নয়ন!”

নয়না শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ছলছল চোখে বলল,” আমাকে ছোঁবেন না, তূর্য! অতীতের ঘা তাজা হয়ে উঠে। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি।আমি চাই না, দ্বিতীয়বার আপনাকে অবিশ্বাস করতে।”

তূর্য গাঢ় চোখে নয়নাকে দেখে নিলো। মেয়েটা কী তাকে ভয় পাচ্ছে! তূর্যের উদ্দেশ্য তো খারাপ ছিলো না। অবশ্য সে এখনো নয়নার কাছে পরপুরুষ! নয়নার অনিচ্ছায় ছোঁয়া ঠিক হয়নি। তূর্য দুই হাতে মাথার চুল টেনে বললো,” আচ্ছা সরি, ছুঁবো না। কাছেও আসবো না। তবে আমার কথা শুনো! মানতে চাও না কেন? আমি কী তোমার দিকে বাজে উদ্দেশ্যে তাকিয়েছি! তোমাকে ভালোবাসি, বুঝতে চাইছো না কেন? ”

তূর্যের উচ্চ আওয়াজে নয়নার অন্তর কেঁপে উঠলো। তূর্যের বলা একটা কথাও ভুল নয়। সেই বেশি বেশি বুঝে। নয়নাই বা কী করবে! তার অতীত যে খুবই বিশ্রী। একজনের জন্য
সে তূর্যকে কষ্ট দিলো যে কী না নয়নার দুঃখে সুখে সাক্ষী হিসাবে আজীবন তার পাশে থাকবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। তূর্য তাচ্ছিল্য হাসলো। নয়নার হাতে শপিং ব্যাগ তুলে দিয়ে চলে যেতে নিলো। নয়নার ঠিক সেই মুহূর্তে কী হলো! তূর্যের টি শার্টের পিছনের দিকটা খামচে ধরলো। নয়নার মাথা তূর্যের পিঠে ঠেকিয়ে বলল,” যাবেন না, প্লিজ!”
” থাকলে তো আমায় খারাপ ভাববে।”
” আমি নির্বোধ, এবারের মতো ক্ষমা করুন!”
” আমি কে ক্ষমা করার। যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে কোনো সম্পর্ক নেই।”
” জিদ দেখাচ্ছেন কেন? আমার সম্পর্কে তো সবই জানেন।”
” বুকে হাত রেখে বলো তো! আমায় বিশ্বাস করো কী না!”
” মিথ্যা বলি!”
“হুম!”
” আপনার কাছাকাছি থাকলে শান্তি পাই না! দূরে গেলে ছটফট করি না। আপনার অনুপস্থিতিতে বুকে ব্যাথা হয় না। আপনার কথা ভেবে হাত পা নিশপিশ করে না। আপনার কথা শুনলে শুনতে ইচ্ছে করে না।”

তূর্যের ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। চোখ বন্ধ করে সময়টাকে অনুভব করতে লাগলো সে। এদিকে নয়নাও নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে রইলো। তূর্যের থেকে কিছুটা দূরে সরে বলল,” আজ সন্ধ্যায় থাকবেন না?”
তূর্য নয়নার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” যদি আমার জন্য সাজো, তবে আসবো। ”
নয়না নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” আমি অপেক্ষায় থাকবো।”
—————————

সন্ধ্যা লগ্নে আকলিমার বাড়ির সামনে উপচে পড়া ভীড় জমে আছে। লোকের মাথা লোকে খাচ্ছে। বড়ো বড়ো দুই দুইটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে বাড়ির সামনে। আজ মাহবুব শিকদারের রেখে যাওয়া বডিগার্ডরাও উধাও। কোথায় গেছে কে জানে! নাকি পুলিশের ভয়ে পালিয়েছে? এতো মানুষের ভীড় সাথে পুলিশের আগমনের ব্যপারটা অদ্ভুত নয় কী? মাহবুব শিকদার মানুষ ডিঙিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেন। অতিরিক্ত মানুষেরা মিলে শব্দ দূষণের সাথে বায়ু দূষণ করছে। মুখে মাক্স চেপে মাহবুব শিকদার খুব কষ্টে ভেতরে ঢুকেন। নয়নার ফুফা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন। আকলিমা পাশেই জমিনে পড়ে আহাজারি করে কাঁদছে। মাহবুব শিকদার সঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। বাশারকে তার ঘর থেকে কয়েকজন ধস্তাধস্তি করে বাহিরে নিয়ে আসলো। বাশার বারবার বলছে, ছেড়ে দাও।” কে ছাড়বে বাশারকে? আর মাসুদাই বা কোথায়? কয়েকজনের মধ্যে কাকলী ফার্নিচারের মালিক সোহেল রহমানও ছিল। ভদ্রলোকের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। মাহবুব শিকদার বুঝতে পারলেন পরিবেশ খুবই গরম। তখন শুনতে পেলেন একজন ভদ্রলোক বলতে শুরু করলো,” টাকা দিতে পারবেন না, তাহলে লাখ টাকার খাট নিয়েছেন কেনো? নিয়েছেন তো নিয়েছেন, খাটটা ভেঙেও ফেলেছেন! আরে আস্ত থাকলেও তো বিক্রি করে টাকা উসুল করতে পারতাম!”
মাহবুব শিকদারের চোখে মুখে আশার আলো ছড়িয়ে পড়লো। সে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো,” ঘটনা কী ভাই?”

ভদ্রলোক বলল,” কি বলবো ভাই ব্যবসায়ীদের কষ্ট! এই ব্যাটা বলেছিল বাড়িতে যদি পালঙ্ক দিয়ে আসি তাহলে টাকা পেমেন্ট করবে। অগ্রীম ২০ হাজার টাকা দিয়েও এসেছিল কিন্তু বাড়িতে আসার পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মিল না হওয়ায় আমার লোকেদের ইচ্ছামত পিটিয়ে তাড়িয়ে দিল। টাকা চাওয়াতে আরো কয়েকটা মেরে বের করে দিলো। আবার কী বলল, আমার ব্যবসা নাকি একবার লাটে উঠেয়ে দিবে। এতোটুকু কথা কী কম ছিল?উপায়ান্তর না পেয়ে আমি পুলিশ নিয়ে আসলাম। হয় বেটা টাকা দিবে নাহলে পুলিশের মার খাবে।”

খুবই দুঃখের বিষয়। মাহবুব শিকদার তাদের কষ্টে কষ্টিত হলো। চোখ থেকে চশমা খুলে বললো,” বেয়ান সাহেবার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।”

চলবে……..

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: একুশ

দরজায় করাঘাতের শব্দ হচ্ছে সাথে নয়নার বুকের ধুকপুক আওয়াজও বাড়ছে। শাড়ি পরিহিতা নয়না চোখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। সে কোনোক্রমে দরজা খুলবে না বলে পণ করেছে। হলুদের অনুষ্ঠান অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। আজ নয়না সেজেছে, চোখে মোটা করে কাজল লাগিয়েছে, ঠোঁট জোড়ায় লাল রঙের লিপস্টিক দিয়েছে। এতটুকুতেই অপ্সরা লাগছে। হলুদের দিনে হলুদ শাড়ি না পরলেই নয়, তূর্যের পছন্দের প্রশংসা করতে হয়। নয়নার গায়ে হলুদরঙ ফুটে উঠেছে। নয়না অস্বস্তিতে দুই হাতের তালু ঘষছে। সে ঠাহর করতে পারছে দরজার অপরপাশে তূর্য দাড়িয়ে আছে। তাই তো লাজে চোখ বন্ধ করে আছে। কিছুক্ষণ পর মিছিলের কণ্ঠস্বর নয়না শুনলো,” শুনছিস নয়না! তূর্য ভাই এসেছে। তোর হলো নাকি?”

নয়না ফিসফিস করে উত্তর দিলো,” উনার জন্যই তো বের হচ্ছি নারে, মিছিল! তুই বুঝবি না।”

মিছিল আরো কয়েকবার দরজায় করাঘাত করে চলে গেলো। ভাইয়ের বিয়ে, মিছিলের কতো কাজ! তূর্য অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। নয়নাকে ডাকার জন্য কয়েকবার করাঘাত করেছিল কিন্তু আফসোস মেয়েটা দরজা খুলল না। ইতিমধ্যে মিছিল, নয়না ও তূর্যের সম্পর্কে সমস্ত ঘটনা তার পরিবারকে জানিয়েছে। সবাই নয়নার সুখেই খুশি। তূর্যকে পরিবারের একজন মনে করে নিয়েছে। বিগত দুইদিনে এজন্যই তূর্যের মিছিলদের বাড়িতে আনাগোনা নিয়ে কেউ কিছু বলছে না।
তূর্য এবার নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। সে জানে, নয়না দরজার কাছেই দাড়িয়ে রয়েছে। তূর্য বুকভরা নিঃশ্বাস ফেলে নয়নাকে ডাকলো,” নয়ন! চলে যাবো?”

তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে গেলো। তূর্যের চক্ষুদ্বয়ের সামনে প্রদর্শিত হলো হলদে কন্যার। আচ্ছা, আজ হলুদ কার?প্রশ্নটা করা অযাচিত কেননা তূর্যের মনে, প্রাণে নয়না ছাড়া আর কেউ ধরা দিবে না। নয়না নতমুখে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, ভুলেও একটিবারের জন্য তূর্যের দিকে তাকাচ্ছে না। এদিকে তূর্য পলক ফেলার কথা বেমালুম হয়ে নয়নাকেই দেখছে। শাড়ি পরিহিতা নয়নাকে আজ প্রথমই দেখা। লাজরাঙা মুখশ্রীতে হালকা সাজসজ্জা। তূর্য বুকে হাত রেখে বলল,” ওহে রূপসী! আমি ক্ষণে ক্ষণে হারিয়ে যেতে চাই তোমার আঁখিতে। আমার প্রেয়সী, আমার প্রেমময়ী! তুমি কী জানো, তোমার চেহারার মায়ায় প্রতিনিয়ত ডুবে যাচ্ছি; ফেরাতে পারছি না গো মনকে।”

নয়না দুই হাতের তালু ঘর্ষণ করছে। এমন কাব্যিক কথার প্রত্ত্যুত্তরে কী বলতে হয়! তারও কী কাব্যিকভাবে উত্তর দিতে হবে! নয়না মনে মনে ভাবছে, ডাক্তারটা এতো ভালো কেনো? তার প্রতিটা কথায় গভীরতা আছে। নয়নার জন্য তার আকুলতা সাময়িক সময়ের জন্য নাকি সারাজীবনের জন্য? প্রশ্নটা মনে আসতেই নয়না চোখ তুলে তাকালো। তূর্যের চোখে মুখে আকুলতা।নয়নার একটি কথাশোনার প্রবল আকাঙ্খা। নয়না মুচকি হেসে বলল,” ডাক্তার হঠাৎ কবি হলো কীভাবে? পেশা কী চেঞ্জ করে ফেলেছেন?”

তূর্য গাঢ় চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” এক সর্বনাশীর প্রেমে পড়ে ডাক্তার এখন কবি হয়ে গেছে।”

” মোহ কে’টে গেলে আগের পেশাই ঠিক লাগবে।”

তূর্য নিগূঢ় হেসে বলল,” এই মোহ কখনেই কাটবে না। একবার ভালোবেসেই তো দেখো!”

” যদি মনঃক্ষুণ্ন হয়! সাধারণ মেয়ের কপালে সুখ আসে না। বেদনাই তাদের নিত্যকার সঙ্গী।”

” আমি সাধারণ, পছন্দ করিও সাধারণ। ওই সাধারণ মেয়ের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করতেই চাই কিন্তু সে তো মন বুঝে না!”

তূর্যর মন শক্ত লোহার মতো। কোনো কথায় বাঁকানো যাবে না। কিন্তু নয়না যে সাহস পাচ্ছে না, একবার মনে হচ্ছে তূর্যকে আঁকড়ে ধরলে বাঁচতে পারবে আরেকবার মনে হচ্ছে তার জীবনে তূর্য আসলে সেও দুঃখের অতলে ডুবে যাবে।

নয়না ও তূর্য পাশাপাশি হাঁটছে। সবসময় তূর্য এই সেই কথা বলে নয়নাকে লজ্জায় ফেলে দেয় কিন্তু এখন সে নিশ্চুপ মনে, বিষয়টা নয়নার একদমই ভালো লাগছে না। সে যেচে কথা বলবে তারও সাহস হচ্ছে না। বারবার মাথা ঘুরিয়ে তূর্যকে দেখছে। নয়নার ভাবভঙ্গি তূর্য সবটাই খেয়াল করছে। নিজের মনকে সে আর আটকাতে পারলো না, পরিশেষে বলল,” বাঁকা চোখে না তাকিয়ে সরাসরি দেখলে আমি মাইন্ড করব না। যতোই হোক! আমার মন তো তোমার কাছেই বন্দী। তুমি যখন ইচ্ছে এই মনকে পড়তে পারো।”
নয়না বেশ লজ্জা পেলো। শাড়ির আঁচল কাঁধ বরাবর শক্ত করে ধরে বলল,” তেমন কিছু না। আজ আপনাকে অন্যরকম লাগছে।”
” কেমন?”

তূর্যের তৃষ্ণার্ত স্বর, নয়নার এক একটি কথা,শেনার প্রবল আকুলতা। নয়না দাড়িয়ে গেলো, তূর্যের হাত শক্ত করে ধরে বলল, আপনার হাতে হাত রেখে হাঁটলে কী আপনার সমস্যা হবে, তূর্য?”

কতোদিনের অপেক্ষা! কতো আকুলতা! হাহাকার করা হৃদয় এই বুঝি শীতল হলো। তূর্যের বিশ্বাস হচ্ছে না। তার শরীর হিম হয়ে আসছে। সে তো নয়নার মনে এভাবেই জায়গা করে নিতে চেয়েছিল! অবশেষে সে স্বার্থক হলো। খুব শক্তকরে নয়নার হাত ধরলো সে। এতোটাই শক্ত যে, নয়না চাইলেই এই বন্ধন ছাড়তে পারবে না৷ নয়না তূর্যের প্রতি অভিমান করে বলল,” চলে যাবো না, তবুও ভয়!”

” ভয় নয়, নিজেকে ঠিক রাখতে আপাতত তোমাকে প্রয়োজন।”
” হাসপাতালে যাবেন না?”
তূর্য পাল্টা প্রশ্ন করলে,” তুমি বলা যায় না? আপনি তো পরকে বলে ডাকে। আমি পর বুঝি?”

নয়না উত্তর দিলো,” আপনি আমার হৃদয়ের সুপ্ত স্থান দখল করে নিয়েছেন। যেই স্থানটা আমি বিশেষজনের জন্য রেখেছিলাম। আপনি নিজেও জানেন না, আপনি আমার জন্য কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট, তূর্য!”

একসাথে এতে ধাক্কা তূর্য হজম করতে পারছে না। আপাতত তার বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়া প্রয়োজন। নয়নার কথার প্রত্ত্যুত্তরে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” হাসপাতালে যেতে হবে নয়ন! তোমার এরূপ আমার জান নিয়ে ফেলবে, নয়ন!”

নয়না হাসলো। তূর্যের হাতের বন্ধন নরম করলো। নয়নার চোখে চোখ না মিলিয়ে একপ্রকার নয়নার থেকে পালিয়ে চলে গেলো তূর্য। নয়না একাকী প্রিয় পুরুষের চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকলো।

——————–

আকলিমার বাড়িতে কান্নার রোল, বোরহান উদ্দিন টাকা নিয়ে থানায় ছুটেছেন। রিহানকেও হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, সে আপাতত ভাইয়ের উপর প্রচুর বিরক্ত। রিহান জানে, তার ভাইয়ের মতো মুখোশধারী লোক পৃথিবীতে নেই। তবে সে যে এতোটা নীচু পর্যায়ে চলে যাবে কে জানতো!
আকলিমা ছেলের শোকে পাগল প্রায়। কী থেকে কী করছে নিজেও জানে না। সে খেয়াল করলো, তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে মাসুদা একবারের জন্যও ঘর ছেড়ে বের হয়নি। কিন্তু কেনো? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই আকলিমা ছেলেট ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। মাসুদাকে খুশি মনে আচার খেতে দেখে রাগান্বিত স্বরে বলল,” এই মেয়ে! তোমার স্বামীকে যে বিনা কারণে পুলিশে নিয়ে গেছে, সেই সম্পর্কে কোনো চিন্তা আছে? তুমি কীভাবে এখানে বসে বসে আচার খাচ্ছো?”

মাসুদা আচার চিবোতে চিবোতে উত্তর দিলো,” আপনারা তো আছেনই, তাই চিন্তা করছি না।”

আকলিমা ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসে ঠিকই কিন্তু যখন শাশুড়ির চরিত্রে থাকে তখন সে পুরো দজ্জাল শাশুড়ীর মতো ব্যবহার করে। মাসুদার হাত থেকে আচারের বয়াম কেড়ে নিয়ে বলল,” তোমার জন্যই আমার ছেলে থানায়। টাকাটা দিয়ে দিলে কী হতো!”

মাসুদা এবার সোজা হয়ে দাড়ালো। আকলিমার দিকে আঙুল তুলে বলতে শুরু করলো,” আপনার ছেলে আমাকে বাড়ি থেকে পালিয়ে এনে বিয়ে করেছে। আমার ভরনপোষণের খেয়াল তো তারই রাখতে হবে! আমি তো এমন কোনো শর্তে বিয়ে বসিনি যে, বিয়ের পর টাকার গদির উপর তাকে রাখবো!”

” টাকার গরম দেখাচ্ছো? আমার ছেলে একবার আসুক, তোমাকে উচিত শিক্ষা দিব।”
মাসুদা আকলিমার থেকে এক ধাপ এগিয়ে বলল,” কীভাবে শিক্ষা দিবেন! যেভাবে নয়নাকে প্রতিদিন মেরে শিক্ষা দিতেন,সেভাবে?”

আকলিমা বিষ্ময় হয়ে গেলে। অবিশ্বাসের সুরে বলল,” তুমি নয়নাকে কীভাবে চেনো?”

মাসুদা রহস্যময় হেসে আকলিমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” ইট’স সিক্রেট।”

—————————

উত্তরা কমিউনিটি সেন্টার, ৬ নাম্বার সেক্টরে অবস্থিত। মারুফের স্ত্রী হেনাকে এখান থেকেই উঠিয়ে দেয়া হবে। মিছিলরা কমিউনিটি সেন্টারে পৌছে গেছে ইতিমধ্যে। বর পক্ষের সকলে উপস্থিত হলেও উপস্থিত নেই নয়না ও তূর্য। তারা দুইজন আলাদা গাড়িতে আসবে। মিছিল বারবার তূর্যের ফোনে কল করেই যাচ্ছে কিন্তু তূর্য ফোন তোলার খবর নেই। এই নিয়ে মিছিলের ক্ষোভের অন্ত নেই সে ফোন হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,” নয়া নয়া আশিক হইয়া আমার বান্ধবীরে নিয়া নিছে। ভবিষ্যতে তোমাকে বাসর ঘরে ঢুকতে দিব না, ডাক্তার ভাইয়া! হুহ।”

কতোটা দুঃখ, কতোটা কষ্ট নিয়ে মিছিল কথাটা বলল। তূর্য শুনতে পেলে কী অবস্থা করতো!
এদিকে নয়না মুখ ফুলিয়ে গাড়িতে বসে আছে। তার পাশেই তূর্য মনের সুখে গাড়ি চালাচ্ছে। ভাবখানা এমন, যেন সে রাস্তায় নয় আকাশে উড়ে উড়ে গাড়ি চালাচ্ছে। নয়নার মান হওয়ার কারণ তূর্য। এই একরোখা জিদ্দি ডাক্তার নয়নাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চার হাত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নয়নার খুব ইচ্ছে ছিল মিছিলের সাথে কমিউনিটি পর্যন্ত যাবে কিন্তু বদ ডাক্তার মানলে তো! উলটো নয়নাকে ফোর্স করছে তূর্যকে তুমি করে বলতে, যা নয়না কখনোই করতে পারবে না। এদিকে তূর্য নয়নার মুখ থেকে তুমি সম্বোধন না শোনা পর্যন্ত কমিউনিটি সেন্টারে যাবে না বলে পন করেছে। উত্তরার অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নয়নার কোনো কথাই শুনছে না। অগত্যা মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো নয়না। তূর্য তা দেখে মুচকি হেসে খালি গলায় গান ধরলো,
“ভালোবাসি বলে দাও আমায়,
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল।
তুমি শুধু আমারই হবে,
যদি করো মিষ্টি এই ভুল।”

নয়না মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে। এক ডাক্তার আর কী কী পারে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তূর্য হাসছে নয়নার মুগ্ধতা ছেয়ে যাওয়া মুখটা দেখে। নয়নাকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য একটু কেশে বলল,” কবুল বলে দেখো, তোমার এই লাজ ভাঙার দায়িত্ব আমার। শুধু যে কাটাছেঁড়া করতে পারি তা ভেবে ভুল করো না মেয়ে! আমি কিন্তু আদরও করতে জানি।”

তূর্যের কথা শেষ হতেই নয়না ছিহ্ বলে তূর্যের হাতে আস্তে করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। তূর্য হু হা করে হাসতে লাগলো। নয়নাও মুচকি হাসছে, সে এমন একজনের পাল্লায় পড়েছে যে নয়নাকে সর্বদা লজ্জায় ফেলে। নয়না বুঝতে পারছে তূর্য আজ তার মুখ থেকে তুমি সম্বোধন না শোনা পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকবে। অগত্যা নিঃশ্বাস আটকে নয়না বলল,” কমিউনিটি সেন্টারে চলো, তূর্য! ”

তূর্য হঠাৎ করে ব্রেক কষলো। নয়নার দিকে তাকাতে নিলে নয়না তার চোখে হাত দিয়ে রাখলো। তূর্য স্মিত হেসে বলল,” আজ তুমি বলেছো, কাল ভালোবাসিও বলবে।”

নয়না ভেঙচি কাটলো। বিড়বিড় করে বলল,” বাঙালিরা বসতে চাইলে খেতেও চায়।”

চলবে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে