#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: আঠারো
মানুষের জীবনের মোড় কোনদিকে ঘুরে যাবে কারো জানা নেই। গল্প উপন্যাসের মতো যদি বাস্তবের জীবন হতো কতোই না ভালো হতো; কিন্তু হায়! বাস্তবতা খুবই কঠিন।
নয়নাকে অস্থিরতার মধ্যে রেখে তূর্য দরজা আটকে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেই সকালে তূর্য এসেছে, নয়নার বলা কথা শুনে বেচারা বিশাল বড়ো ধাক্কা খেয়েছে তাইতো বলা নেই কওয়া নেই চট করে গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। নয়না অনেকবার ডাকার চেষ্টা করে না ডেকেই ফিরে আসে। দুপুর হতে চলল, তূর্য এখনো ঘুমাচ্ছে। নয়না ভাবছে, তূর্যের পরিবারের কথা। এই যে সকাল থেকে তূর্য বাড়ি ছাড়া তার খবর কী পরিবারের মানুষজন রাখে? চিন্তা করছে না বুঝি! আশ্চর্য মানুষটার আশ্চর্য পরিবার। কোনো চিন্তাভাবনা নেই। ভাবনায় বিভোর থাকা নয়নার সময়ের খবর নেই যখন ধ্যান হলো ততক্ষণে যোহরের আজান দিলো। নয়নারও কিছু খাওয়া হয়নি, মূলত অতিরিক্ত চিন্তায় কিছু খায়নি। কিন্তু না খেয়ে আর কতক্ষণ? তূর্য ঘুম থেকে উঠলেও তো কিছু দিতে হবে? সাতপাঁচ ভেবে দুই হাতে চুল প্যাঁচিয়ে খোঁপা করে নিলো নয়না। সাধারণত তূর্যের সামনে মাথায় ওড়না চেপে রাখে এখন যেহেতু তূর্য নেই তাই ওড়না শরীরে প্যাঁচিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটে।
ফ্রিজের মাছ,মাংস ছাড়া আর কোনো অপশন নেই নয়নার কাছে। অগত্যা দেশী মুরগী ফ্রিজ থেকে নামিয়ে পানিতে ডুবাল। ঝটপট চিকেন বিরিয়ানি রান্না করে নয়না ক্ষান্ত হলো। সময়ের হিসাব করলে নয়না দেখতে পেলো দুপুর দুইটা বাজে। এখনো মানুষটা উঠেনি! ডাক্তার মানুষের সময় নাকি অনেক মূল্যবান হয়, এই তার সময়ের হিসাব! নয়না অন্তরে সাহস সঞ্চয় করে গেস্ট রুমের দরজায় করাঘাত করলো। দুই মিনিটের মধ্যে তূর্য দরজা খুলে নয়নার চিন্তিত মুখখানা দেখে হেসে উঠলো। ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,” এক কাপ কফি করে দিবে, নয়ন? আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।”
তূর্যের ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর নয়নার হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা বাড়িয়ে দিলো। সে বুকের বাম পাশটায় চেপে ধরে কফি বানাতে চলে গেলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তূর্য ফ্রেস হয়ে বের হয়। তূর্যের ব্যপারে নয়না একটা বিষয় বুঝতে পেরেছে, তূর্য একদম ফিটফাট থাকতে পছন্দ করে। এই যে, ফ্রেস হওয়ার পর তূর্যের পোশাক থেকে শুরু করে মাথার চুল, হাতের ঘড়ি সব ঠিকঠাক করেই বের হয়েছে! তূর্য মুঠোফোন বের করে কাউকে ফোন করলো। নয়না এই সুযোগে কফির কাপ তূর্যের সামনে টেবিলের উপর রেখে সরে আসলো। ফোনে ব্যস্ত থাকলেও তূর্য সবটা খেয়াল করলো। কথা বলা শেষে জোরে নয়নাকে ডেকে বলল,” কোথায় গেলে?”
ইশ! মনে হচ্ছে বিয়ে করা বউকে আহ্লাদ করে ডাকছে। নয়না ঘর থেকে মাথা বের করে বলল,” কিছু লাগবে?”
কফির কাপ চুমুক দিয়ে তূর্য প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” উম! চিনি ছাড়া কফির সাথে তোমাকে লাগবে।”
নয়না ভেংচি কাটলো। একাকী পুরুষের সামনে থাকতে আপত্তি প্রকাশ করে বলল,” নুন ছাড়া যেমন তরকারিতে স্বাদ নেই, সম্পর্ক ছাড়া তেমন পুরুষের আশেপাশেও থাকতে নেই।”
” সকাল থেকে তাহলে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কী দরজার সামনে ঘুরঘুর করেছো?”
নয়না নাক সিটকে উত্তর দিলো,” ছিহ! কীসব কথা?”
তূর্য হাসলো। কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল,” উচিত কথা বললেই ছিহ! এদিকে যার মন নিয়ে নিতে চাইছো তাকেই অনাহারে রাখছো? এটা ঠিক নয়,নয়ন!”
নয়না জিহ্বায় দাঁত চেপে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।
সে ভুলেই বসেছিল, তূর্য সকাল থেকে না খাওয়া। ভাবনার ফ্যাটটা খুবই ছোট। দুইটা বেডরুম, ডাইনিং ও পাকঘর; এতটুকুতে টুকটাক জিনিস নিয়ে মেয়েটা ফ্ল্যাট সাজিয়েছে। সোফার টেবিলে নয়না বিরিয়ানি রাখলো। বিরিয়ানির ঘ্রাণে সারাঘর ম ম করছে। তূর্য লম্বা করে নিঃশ্বাস টেনে নিজেই প্লেটে খাবার পরিবেশন করে নিলে। নয়না তখনো দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তূর্য ততক্ষণে এক লোকমা মুখে পুরে নিয়েছে। নয়নার হাতের রান্নার তুলনা হয় না। তূর্য এই পর্যন্ত যা যা খেয়েছে অমৃত মনে হয়েছে। তূর্য এতোটাই এক্সাইটেড ছিল যে নয়নার কথা ভুলে গেলো। একাকী এক প্লেট বিরিয়ানি শেষ করে আরেকবার নিলো। তূর্যের তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখে নয়নার ভালো লাগলো। সে হেসে বলল,” আরেকটু দিব?”
তূর্যের এতক্ষণ পর নয়নার কথা স্বরণে আসলো। সে নয়নাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,” দাড়িয়ে আছো কেন? এদিকে আসো, তুমি কী জানো! তুমি কতো মজার রান্না করো! কীভাবে জানবে, আসো এক লোকমা খাইয়ে দেই। আমার থেকে খেয়ে বলবে কেমন হয়েছে!”
বলতে বলতে তূর্য নয়নাকে বসিয়ে এক লোকমা মুখে ঢুকিয়ে দিলো। তূর্যের আকস্মিক কাজে নয়না নিশ্বাস নেয়ার মতো সময় পেলো না। মুখে খাবার নিয়ে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো। এক্সাইটেড হয়ে তূর্যের করা কাজে সেও বিস্মিত হলো! নয়না তাকে ভুল বুঝলো না তো! নয়নাকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল,” আমার চাচ্চু বলে, আমার হাতের রান্না নাকি অনেক মজার। তোমার কী মনে হয়?”
মুখের খাবার কোনোমতে গিলে নয়না উত্তর দিলো,” ভালো।”
” ভালো তো হতেই হবে! আমি যে বিরিয়ানিতে বিশেষ কিছু মিক্সড করি।”
নয়নার জানতে ইচ্ছে করলো না কী মিক্সড করে তূর্য।দেখা গেলো তূর্য নিজেই বলল,” জানতে চাও বিশেষ জিনিসটা কী?”
মাথা সায় দিয়ে নয়না সম্মত জানালো। তূর্যের খাওয়া শেষ, প্লেটে পুনরায় বিরিয়ানি তুলে নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ” ভালোবাসা।”
বিস্মিত চোখে নয়না তূর্যের দিকে তাকালো। প্রত্ত্যুত্তরে কী বলবে সে! লজ্জা গ্রাস করছে নয়নাকে। তূর্য নয়নার হাতে প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,” পুরুষের এটো থালায় খাবার খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। খেয়ে প্রমাণ করো তো! কথাটা সত্য নাকি মিথ্যা!”
———————–
দুপুরের খাবারের টেবিলে হরেক পদের খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে আকলিমার বাসায়। আভিজাত্যপূর্ন আসবাবপত্র চিকচিক করছে টেবিলের উপর। আকলিমা মাথায় হাত রেখে ভাবছে,এই আসবাবপত্র সে কবে কিনেছিল? মনে নেই। এরমধ্যে মাসুদা ও বাশার ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। খাবারের টেবিল দেখে মুচকি হেসে বলল,” আসলে আমার পাতিলে রান্না করা খাবার পছন্দ না। সারাজীবন রান্নাঘরে দামী প্যান দেখে অভ্যস্ত। সকালে নোংরা পাতিল গুলো দেখে গা ঘিনঘিন করছিল। এখন ঠিক আছে। থ্যাঙ্কিউ জানু!”
বাশার খুশিতে গদগদ করছে। দুপুরেই মাসুদা মোটা অঙ্কের টাকা দিলো বাশারের হাতে। সেই টাকা দিয়েই এসব কেনা। থলে ভর্তি টাকা আর সুন্দরী বউ পেলে মা, ভাইকে কে চেনে? আকলিমা বাশারকে রামধমক দিলো,” টাকা পেয়েছিস কোথায়? এতো টাকা দিয়ে ইন্জিনিয়ার বানালাম, আমাদের তো একটা সুতা পর্যন্ত কিনে দিতে পারিসনি। আর বউ বলার সাথে সাথেই লাখ লাখ টাকা বের করছিস? টাকা কোথায় পেলি?”
” উফ মা! এতো কৈফিয়ত চাচ্ছো কেন? খেলে খাও, নয়তো আমাকে খেতে দাও। মাসুদাও সকাল থেকে না খেয়ে আছে।”
আকলিমা রাগে গজগজ করতে করতে না খেয়েই চলে গেলো। বাশার মাকে ফেরালো না। মাসুদার হাত ধরে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলল,” এবার তো কাছে আসো, সোনা?”
মাসুদা খাবার খাওয়ার বাহানায় প্রত্ত্যুত্তর দিলে,” জানোই তো! পালঙ্ক ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না। টিভিতে দেখলাম, কাকলী ফার্নিচারে এক লাখ টাকার পালঙ্ক বিক্রি হচ্ছে। আমার সেটা চাই-ই চাই! আর যদি এনে না দাও, তাহলে কাছে আসতে পারবে না।”
বাশার মাসুদার গলার দুই ইঞ্চি নিচে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,” তুমি বললে এক লাখ টাকার খাঁট কেন? পুরো ফার্নিচারের দোকান তুলে আনবো, জানমান! আজই নিয়ে আসবো, আর রাতেই,,,,,!
মাসুদা লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। এদিকে বাশার মনে মনে এই বলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে, ” টাকার থলে তো আমার ঘরেই, চাইলে এক লাখ কী দশ লাখ খরচ করলেও টাকা কমবে না।”
———————————–
বিকাল চারটায় মিছিল নয়নাকে নিতে আসলো। ভাবনা তখন বাড়িতে ছিল।আশ্চর্যজনকভাবে সেও নয়নাকে মিছিলের সাথে যেতে রাজি হলো। অথচ দুইদিন আগেও ভাবনা নিষেধ করেছিল। নয়না খুশিমনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তূর্যের কথা মনে পড়ায়। তূর্য যাওয়ার আগে বলে গেছে সে আগামীকাল নয়নাকে নিয়ে তার চাচার কাছে যাবে। যদি আগামীকাল এসে নয়নাকে না পেয়ে মন খারাপ করে! তখন সে কী করবে? বিছানায় বসে নয়না হাজারো কথা ভাবছে। নয়নাকে বসে থাকতে দেখে মিছিল এগিয়ে আসলো। আঁজলা ভরা মুখখানা উঁচু করিয়ে বলল,” কী হয়েছে, আমার জানটার?”
” উনি যদি রাগ করে?”
নয়নর উনিটা যে কে, তা মিছিল খুব ভালো করেই জানে। তবুও নয়নাকে বাজিয়ে দেয়ার জন্য বলল,” তোর উনিটা কী ডাক্তার তাবরেজ তূর্য, নয়ন!”
লজ্জায় নয়নার গালদুটো লাল টমেটো হয়ে গেলো। মিছিল তা দেখে নয়নার কাছে এসে আরো খোঁচানোর উদ্দেশে বলল,” এসব কী নয়ন! কতদূর গড়লো শুনি? ইয়ে টিয়ে কী সব হয়ে গেছে?”
নয়না আশ্চর্য হয়ে যায়। এই মিছিলটা এতো দুষ্ট হল কবে থেকে? নয়নাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই বদটা আজ এসেছে? নয়না অকপটে উত্তর দিলো,” তুই একটু বেশিই ভাবছিস। ঐসব কিছু না।”
নয়না নার্ভাসের কারণে ঘামতে শুরু করে। মিছিল বিষয়টা খেয়াল করলে নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” আমার নয়নতারা! তুই কী জানিস! আকাশের বুকে তুই জ্বলন্ত একটা চাঁদ! তোকে যে পাবে সে খুব ভাগ্যবান হবে।”
নয়নার চোখের সামনে তূর্যের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। পছন্দের মানুষ বলে কী? লজ্জায় নয়না মিছিলকে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,” সে ভাগ্যবান নয় মিছিল বরঞ্চ তাকে যেই মেয়ে পাবে সে ভাগ্যবতী।”
চলবে……….
#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: ঊনিশ
মিছিলদের বাড়িতে প্রবেশ করে নয়নার বিষ্ময় শেষ হলো না। আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে গেইট থেকে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত সাজানো হয়োছে। রংধনুর সাত রং যেভাবে দূর আকাশে মেলে থাকে ঠিক তেমনভাবে ফুলগুলোকে সাজানো হয়েছে। অদূরে স্টেজ সাজানো হয়েছে নয়না সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। মিছিলের আনন্দ আজ দেখে কে? প্রিয় বান্ধবীকে নিয়ে বাড়িতে এসেছে, এই আনন্দ ধরে রাখার মতো নয়! বাড়িতে প্রবেশ করে উচ্চ স্বরে হাঁক ছাড়লো মিছিল, ” মা! তোমার মেয়েকে নিয়ে এসেছি। কোথায় গেলে?”
মিছিলের মা পাশের ঘরেই ছিল। মেয়ের ডাকে ঘর ছেড়ে নয়নাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। পরম মমতায় আদরের সাথে বলল,” কেমন আছিস মা!”
নয়না মুচকি হেসে উত্তর দিলো, ” ভালো আছি।”
মিছিলের বাবা নুরুল ইসলাম পেশায় একজন ব্যবসায়ী। সারা বছর তার দেখা মিলে কই? ব্যবসার কাজে এ-শহর থেকে ঐ-শহরই ঘুরে বেড়াতে হয়। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাসায় থাকা! নয়নাকে দেখা মাত্রই বলতে শুরু করলো,” সেদিন আমি বাড়ি থাকলে তোমাকে ঐ পশুদের সাথে যেতে দিতাম না। ভালো করেছো চলে এসে। এখন থেকে এখানেই থাকবে। ”
নয়না মুচকি হেসে সায় দিলো। মিছিলের মা দুই মেয়েকে এবার তাগাদা দিলো, ” তোরা ফ্রেস হয়ে খেয়ে নে। খবরদার মিছিলের সঙ্গ পেয়ে বসে থাকবি না নয়না? এই মেয়েটা আস্ত অলস, আমার সাথে কোনো কাজই করতে চায় না। দুইজন এসে আমাকে সাহায্য করবি।”
নয়না হেসে বলল,” আচ্ছা, আন্টি।”
ছেলে পক্ষের বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন হয়? মেয়ে বিদায়ের সময়ে মেয়ে পক্ষরা যেভাবে কান্না করে, ছেলে পক্ষও কী কান্না করে? নয়না ছেলে পক্ষের জমজমাট বিয়ে দেখেনি। ময়মনসিংহ থাকতে মেয়েদের ধুমধামে বিয়ে হতে দেখেছে, তাও দূর থেকে। ছেলেদের বিয়ে দেখেনি, কেনো দেখেনি সে নিজেও জানে না। ছেলে পক্ষের বিয়ে দেখার জন্য এক্সাইটেড হয়ে আছে নয়না। লজ্জায় সে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
আজ সন্ধ্যায় মেহেদীর অনুষ্ঠান, আগামীকাল গায়ে হলুদ। মেহেদী অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। মিছিলও সেখানেই ব্যস্ত! নয়না একাকী ঘরে বসে মুঠোফোন হাতে নিয়ে বসে রইলো। তূর্যের নাম্বারটাতে ডায়াল করে কয়েকবার কেটেও দিলো। সে আসার পর থেকে মানুষটার সাথে কথা হয়নি। সেও তো একবার খবর নেয়নি! নয়নার বুঝি অভিমান হয় না! পরক্ষনেই নয়নার মনে পড়লো, তূর্যের তো এখন নাইট শিফট চলছে।হয়তো মানুষটা ঘুমাচ্ছে! শুধু শুধু ফোন করে ডিস্টার্ব করা কী ঠিক হবে? মুঠোফোন রেখে দিলো নয়না। বিকালে না হয় ফোন করে নিবে সে?
এদিকে বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুঠোফোন চেক করছে তূর্য। নয়নার একটি কলের আশার ঘুম হচ্ছে না তার। অথচ মেয়েটার কোনো চিন্তাই নাই সে হয়তো এতক্ষণ বিয়ে বাড়িতে নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে।
সন্ধ্যা লগ্নে নয়না ব্যতীত সবাই তৈরি হয়ে নিলো। নয়নার অস্বস্তি হচ্ছে এতো মানুষের ভীড়ে যেতে। মিছিল কোথায় থেকে দৌড়ে আসলো, হাতে করে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো মেয়েটা। নয়না এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো, তার মনোযোগ মিছিলের দিকে শপিং ব্যাগে কী আছে দেখার ইচ্ছে নেই। মিছিলকে পাশে বসিয়ে বলল,” কুকুরের দৌড়ানো খেয়েছিস নাকি? এভাবে হাপাচ্ছিস কেনো?”
নয়না খেয়াল করলো, মিছিল খুব সুন্দর সবুজ রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। সবুজ রংটা বেশ মানিয়েছে মিছিলের গায়ে। আমরা সাধারণত যারা গাঢ় রঙগুলো এভয়েড করি তারা হঠাৎ সেই রঙের পোশাক পরলে ফুটে ওঠে। মিছিলের সবসময় সবুজ রং অপছন্দ। আজ পরার পর সবুজ পরী লাগছে। মিছিল শপিং ব্যাগ নয়নার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,” বাঘের খপ্পরে পড়েছিলাম। এটা ধর, পরে তৈরি হয়ে নে। আমি মায়ের কাছ থেকে গহনা নিয়ে আসছি। একসাথে সাজবো।”
যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নয়নাকে একা ফেলে দৌড়ে চলে গেলো মিছিল। নয়নার প্রত্ত্যুত্তরের অপেক্ষা করলো না মেয়েটা।কী ধুরন্ধর মেয়ে! নয়না একবার হাতের কাছে পেলে উত্তম মাধ্যম দিবে।
শপিং ব্যাগ খুলে সুন্দর সবুজ রঙের আনারকলি দেখতে পেলো নয়না। সবুজ রঙের সাথে লাল ওড়নার কম্বিনেশন দারুণ লাগলো তার কাছে। সময় অপচয় না করে নয়না জামা পরে নিলো। মিছিল কাউকে বকতে বকতে ঘরে প্রবেশ করলো। তার হাতে গহনার বক্স। নয়নাকে দেখামাত্রই গহনার বক্স বিছানায় রেখে এসে জড়িয়ে ধরলো। ময়নার গালে চুমু খেয়ে বলল,” আমার নয়ন চাঁদটাকে দারুণ লাগছে। রঙটা তোর শরীরে খুব মানিয়েছে। আয় তোকে গহনা পরিয়ে দেই।”
নয়না নাকচ করলো। সে তাদের গহনা কেন পরবে? মিছিলের চোখ রাঙানো দেখে নয়না চুপটি করে বসে রইলো। সিম্পল একটা গহনার সেট নয়নাকে পরিয়ে দিলো মিছিল। তাতেই অপরূপা লাগছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে কাজল এনে নয়নার চোখে পরিয়ে দিলো মিছিল। এবার যেন মেয়েটার রূপের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। নয়নাকে বসিয়ে মিছিলও তৈরি হয়ে নিলো। একসাথে দুই বান্ধবী ঘর থেকে বের হতেই মিছিলের মায়ের সামনে পড়লো। ভদ্রমহিলা নয়নার এরূপ আগে কখন দেখেনি। আঁজলা ভরে এক হাত রেখে বলল,” মাশাআল্লাহ, আমার মেয়েটাকে তো অল্প সাজেই অপরূপা লাগছে।”
নয়না লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে রাখলো। মিছিলের মা হেসে চলে গেলো। স্টেজ রেখে পুরো ছাদ ডেকোরেশন করা হয়েছে লাল নীল রং কাগজ ও শতকের মতো আয়না দিয়ে। নয়না হা করে সবটা দেখছিল। এতোকিছুর মধ্যে বেচারি মনে মনে তূর্যকে খুব মিস করছে। কিছুক্ষণ আগে সে মনে সাহস সঞ্চয় করে তূর্যকে ফোন করেছিল, লজ্জায় লাল নীল হয়ে তূর্যের স্বর শোনার অপেক্ষা করছিল, কিন্তু আফসোস! নয়নার মনের বাসনা পূরণ হলো না। তূর্যের ফোন বন্ধ ছিলো। নয়নার মনটাই খারাপ হয়ে যায়। বর্তমানে নয়না ঘুরে ঘুরে ছাঁদের ডেকোরেশন দেখছে। মিছিল ছাদে আসতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নয়না একাকীই ঘুরছে। ফটোসেশানের জন্য একটা স্থান তৈরি করা হয়েছে। যেখানে দাঁড়ালে দশটি আয়নার মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায়। নয়না সেখানে দাড়িয়ে ছিল। আচমকা সে পিছনে জলপাই রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত তূর্যেকে দেখতে পেলো। এক মিনিট দুই মিনিট কতক্ষণ সময় ধরে সে তাকিয়ে ছিল হিসাব নাই। তূর্যও তার দিকেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনের ভুল ভেবে নয়না দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় তাকালো। এবারও সে তূর্যকে দেখতে পেলো। নয়না বুঝতে পারলো, তূর্য তার কল্পনায় নয় বাস্তবে দাড়িয়ে আছে। মস্তিষ্কে বিষয়টা গেঁথে যেতেই নয়না চট করে তূর্যের দিকে ফিরে তাকালো। এদিকে তূর্য নয়নাকে দেখে অন্য এক পৃথিবীতে চলে গেলো। সাজগোজহীন নয়নাক যতোটা স্নিগ্ধ লাগে সাজগোজ করা নয়নাকে ততোটা অপরূপা লাগছে। লজ্জায় নয়না মাথা নত করে রাখলো। তূর্য মুঠোফোন বের করে এই অবস্থাতেই তার এবং নয়নার কিছু ছবি তুলে নিলো। নয়নার কাছাকাছি এসে মাতাল সুরে বলল,” তুমি সবুজ পাতার বুকে সেই পদ্মফুল, যার রূপের আগুনে ঝলসে যাচ্ছে আমার বুক!”
নয়না চোখ তুলে তূর্যের দিকে তাকালো। কাজলদিঘী চোখে তূর্য মুহূর্তেই ডুবে গেলো, বিড়বিড় করে বলল,” এই কাজলদিঘী মেয়েটাই তাবরেজ তূর্যের অস্তিত্ব জুড়ে আছে।”
নয়না স্পষ্ট শুনতে পেলো। কিছুটা অভিমান হলো তূর্যের প্রতি, সে অকপট সুরে বলল,” আসলেন কেনো?”
তূর্য হাসিমুখে জবাব দিলো,” তবে কী চলে যাবো!”
” বলছি কী?”
” কি বলতে চাও!”
” ফোন বন্ধ ছিলো যে?”
” সারাদিন খোঁজ নিয়েছো?”
” আপনিও তো নিলেন না।”
” আমি আর তুমি কী এক?”
” ছেলেরা কী সব পারে? মেয়েদের কোনো অধিকার নাই?”
” তা বলিনি! বাদ দাও, কাছে এসো কথা আছে।”
” দূর থেকেই বলুন, কাছে আসলে পাপ হবে।”
” বড্ড কথা বলো, কার কাছে শিখেছো? মিছিল কী পড়িয়ে পড়িয়ে নিয়ে এসেছে?”
নয়না মিছে অভিমান করে চলে যাওয়ার ভান ধরে বলল,” বোবা নই, কথা জানি। ঝগড়া ডাবল পারি।”
” বিয়ের পর করো।”
নয়না থেমে গেলো। বিয়ের পর বলবে এর অর্থ কী? তূর্যের দিকে প্রশ্নবোধক চাহনি দিলে সে বলল,” বিয়ে করবে আমায়, নয়ন?”
নয়না প্রত্ত্যুত্তর করলো না। আবার দাড়ানো থেকেও নড়লো না। তা দেখে তূর্য এগিয়ে এসে বলল,” চলে যেতে হবে, হাসপাতালে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এবার বিদায় দাও,নয়ন!”
নয়নার বলতে ইচ্ছে করছে, “যাবেন না তূর্য!” কিন্তু সে বলতে পারলো না। গলায় কী যেন আটকে আছে। তূর্যকে এগিয়ে দেয়ার বাহানায় সম্মুখে হাঁটা শুরু করলো।
এদিকে মিছিল তূর্যকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এগিয়ে এসে বলল,” সারাদিন আমাকে জ্বালিয়ে প্রেমময়ীর সাথে কথা বলেই চলে যাচ্ছেন? এটা মানবো না।”
” আজ সারাদিন তুমি আমার খুব উপকার করেছো। এখন বলো কী চাও!”
মিছিলের হাতে মেহেদি ছিল সে ভেবে উত্তর দিলো, ” হাত বাড়িয়ে দিন, বলছি।”
তূর্য হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলো। মিছিল সুন্দর করে সেখানে টি এবং এন ইংরেজি অক্ষরে লেখে লাভসেটের মধ্যে আবদ্ধ করে দিয়ে বলল,” আজীবন আমার জানটার মুখে এভাবেই হাসি ফুটিয়ে রাখবেন, ভাইয়া! এটা আপনার এই ছোট বোনের আবদার!”
তূর্য মুচকি হেসে অন্য হাতে মিছিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” যেদিন থেকে তার দুঃখগুলো মুছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছি সেদিন থেকেই তাকে নিজের করে নিয়েছি।”
মিছিল ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো। কেউ ডাক দেয়ায় তূর্যকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।
মিছিলদের বাড়ির গেইটের কাছাকাছি আসতেই নয়না থেমে যায়। তার পিছনে তূর্য, ছাদ থেকে নামতে দেরী করেছে। নয়নার কাছাকাছি এসে তূর্য কঠিন এক আবদার জুড়ে বসলো,” একবার তোমার হাতটা ধরতে দিবে, নয়ন?”
নয়না কী করবে বুঝতে পারছে না। নয়না দাড়িয়ে রইলো। নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ, তূর্য এটা ভেবে মুচকি হেসে নয়নার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে বলল,” এই হাত কখনোই ছাড়বো না। সাবধানে থেকো, নয়ন!”
তূর্য চলে গেলো। রেখে গেলো থরথর করে কাঁপতে থসকা নয়নাকে। তূর্য যেই হাত ধরেছিল সেই হাত চোখের সাৃনে মেলে ধরে নয়না। তূর্যের হাতে আঁকা মেহেদির ছাপ তার হাতে লেগে আছে। নয়না আশ্চর্য হয়ে তা দেখে বলল,” মানুষটা ইচ্ছে করেই এই কাজ করলো!”
চলবে…………..