নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১৪

0
401

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: চৌদ্দ

সত্যিকারের বন্ধু কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবে না। শত ঝড় তুফান বয়ে যাক, বন্ধু কখনো আপনাকে ভুলবে না। আবার কিছু নামমাত্র বন্ধু আছে যারা প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে দূরে সরে যাবে। নয়না ও মিছিলের বন্ধুত্বটা অন্যরকম। নয়নাকে মিছিল ও তার পরিবার এতোটা আপন ভাবে যতোটা নয়নার ফুফুও ভাবে না। মিছিলের কোলে নয়না শুয়ে চোখের জল ফেলছে। মিছিলও সমানতালে নাক টানছে। সে ভাবতেও পারছে না কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রিয়,বন্ধুর সাথে এতো বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে। এই তো, মিছিলের বড়ো ভাইয়ের বিয়ে পরের সপ্তাহে। সেই সুবাদে ব্যস্ত ছিল সে। এখন নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। মিছিল নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” আমাকে একটা কল করতি,মিছিল। পুলিশ নিয়ে তোর ফুফু এবং ঐ বদমাশ ভাইকে ধরিয়ে দিতাম।”

” সেই পরিস্থিতিতে ছিলাম না। আমার ফোনটাও নষ্ট হয়ে গেছে, ফুফুর কাছে পড়ে আছে। ”

সকাল সকাল মিছিলের আগমন ঘটেছে। ঠিকানা তূর্যই দিয়েছে তাকে। ভাবনা সকাল সকাল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। নয়নার জন্য নাশতা রেডি করে এসে বলল,” আমি চললাম, নয়না। দরজা আটকে বসে থাকবে। অবশ্য তূর্য ছাড়া এখানে কেউ আসবেও না। তবুও সাবধানে থাকবে।”

নয়না চট করে শোয়া থেকে উঠে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” সে আসবে কেন? আর এমনিতেও আজ আমি চলে যাচ্ছি তাই না?”

ভাবনা অবাক হয়ে বলল,” কোথায় যাবে? তূর্য শুনতে পেলে তোমার ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবে। কোথাও যেতে হবে না, বোরিং লাগলে বই পড়ো, টিভি দেখো।”

এরপর মিছিলের উদ্দেশে বলল,” এই অবস্থায় নয়নাকে অন্য কোথাও পাঠানো ঠিক হবে না। তূর্য একদম বাড়ির বাইরে বের হতে নিষেধ করেছে। জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো, কিন্তু নয়নার ভালোর জন্যই তূর্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

নয়না নাকচ করছে। সে অন্যের দোহাই দিয়ে চলতে চলতে ক্লান্ত। আকলিমা ছিল তার আপন ফুফু, খাইয়ে পড়িয়েছে সে। সেই ঋণ পরিশোধ করার দোহাই দিয়েই এত বছর সেখানে পড়ে ছিল। নিজের সম্মানও বিসর্জন হয়ে যাচ্ছিল। তবুও সেখানেই পড়ে থাকতো। ভেবেছিল বাবাহারা মেয়ের আপজন তো একজনই আছে। বাবা সমেত ফুফা ও তো কতো আদর করে! কিন্তু সেই যখন নয়নার দিক বিবেচনা না করে সবার মতো স্বার্থপরদের কাতারে দাঁড়ালো তখনই নয়নার জীবন এলোমেলো হয়ে গেলো। সে বুঝে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে কেউ তার আপন নয়। সবাই স্বার্থপর, নিজের কার্যসিদ্ধি হাসিল করার জন্য নয়নাকে ব্যবহার করে শুধু। নয়না কাউকে জীবনে আর বিশ্বাস করতে পারবে না। বিশেষ করে পুরুষদের।
নয়না করুণ স্বরে ভাবনাকে বলল,” দুনিয়াটা স্বার্থপর, স্বার্থপর দুনিয়ার মানুষও। চাহিদা শেষ হলে সবাই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাবে। আমি আর কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।”
” তার কাছে তুমি বোঝা নও, ভালোবাসার মানুষ।”

ভাবনা মুচকি হেসে চলে গেলো ঠিকই কিন্তু পিছনে রেখে গেলো অবাক হওয়া দুই রমণীকে। যারা আশ্বর্যিত হয়ে বসে আছে।
———————-

দুপুরে ঘুমানো আমাদের সমাজের মানুষের প্রধান কাজ। দুপুরের আলস্য সময়ে যাদের ঘুমানোর অভ্যাস নেই তারা নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে মগ্ন থাকে। নয়নাকে রেখেই মিছিলের চলে যেতে হলো। ভাবনা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই মিছিলের মুঠোফোনে কল আসলো, কয়েকমিনিটের কথায় মিছিলের মুখে হু হা ছাড়া কিছুই শুনতে পায়নি নয়না। শুধু দেখতে পেয়েছিল তার হাসিমাখা মুখটা হঠাৎ চুপসে গেলো। মিনমিন করে বলল, ” আচ্ছা, ভাইয়া।”

নয়নার যা বুঝার সে বুঝে গিয়েছিল। মিছিল আরো কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলো। দুপুরে নয়নার ঘুমানোর অভ্যাস নেই। অচেনা পরিবেশে কী করবে বুঝতেও পারছে না। অগত্যা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো নয়না। তিনতলা বিশিষ্ট বাড়ির থেকে কিছুদূরে একটি পুকুর রয়েছে। পুকুরটির নাম জোড়পুকুর। দুই পুকুর মিলে বিশাল আয়তকার পুকুরটি এরপর বিস্তৃত মাঠ। কয়েকজন ছেলেপুলে ক্রিকেট খেলছে। নয়না এক দৃষ্টিতে তাদের খেলা দেখছে। ব্যাট হাতে হ্যাঙলা ছেলের থেকে ব্যাটের উজন বেশি মনে হচ্ছে তার কাছে। বোলিং করা ছেলেটা গুলুমুলু, দারুণ এনার্জিতে দৌড়ে আসছে বল হাতে। টানটান উত্তেজনা, নয়না ভেবেই নিয়েছে হ্যাঙলা ছেলেটা আজ ব্যাটের ভাড়ে ম’র’বে অথবা বল লেগে। প্রায় পাঁচ মিনিট যাবত তূর্য নয়নার উৎকণ্ঠা দেখছে। মেয়েটা অদূরে কাকে দেখছে? তূর্যকে একটু আকটু দেখলেও তো পারে! এই যে, রোগীদের ফেলে নয়নাকে এক নজর দেখার জন্য সে দৌড়ে এসেছে। এই খবর কী মেয়েটা রাখে? তূর্যের ঐ দৃষ্টির উপর হিংসে হচ্ছে যেই দৃষ্টি তূর্যকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখছে। তূর্য নিজের ভাবনায় ভয়ংকরভাবে আশ্চর্য হয়! তাবরেজ তূর্য কারো দৃষ্টিকেও হিংসে করছে? ভাবা যায়! আশাপাশে নজর ফেলে তূর্য উচ্চ স্বরে বলল,” বউ, ও বউ!”

লোকসমাজে বউ বলে কেউ সম্বোধন করলে নয়না নয় যেকোনো মেয়েই ফিরে তাকাবে। নয়নার আর হ্যাঙলা ছেলের কতল দেখা হলো না তার পূর্বেই দৃষ্টি সরিয়ে আনলো। তূর্য নিচে বাইকে হেলাল দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। তার মুখে অমায়িক হাসি। নয়নাকে দেখে হাত নাড়িয়ে হাই জানাচ্ছে। নয়না ভাবলো তার শুনতে ভুল হয়েছে তাই আড়চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি পুনরায় মাঠের দিকে নিবদ্ধ করবে তখনই তূর্য পুনরায় বলল,” ও বউ! তাকাও না!”

আশ্চর্য! নয়নাকে ডাক্তার বউ ডাকছে? কিন্তু কেন? এই ডাক্তার এমবিবিএস ডাক্তার নাকি পাগলদের ডাক্তার। পাগলদের ই হবে, নয়তো পাগলের মতো বিলাপ করছে কেন? নয়না কিছু না বলে নিচু মাথায় ঘরে চলে এলো।
তূর্য নয়নার চিন্তিত মুখখানা দেখে ভালোই মজা পাচ্ছিল কিন্তু নয়নার এরূপ চলে যাওয়ায় নিজেই বেকুব বনে গেলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে হাতের বন্ধনীতে তাকিয়ে বিল্ডিংয়ের ভেতরে প্রবেশ করলো।

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুনে যাচ্ছে নয়না কিন্তু সে দরজা খুলছে না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছে, দরজা খোলা উচিত হবে কী না। বাশারের কৃতকর্মের পর নয়না আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বাশার ছিল তার আপন ফুফাতো ভাই, তার কাছেই নয়না রেহায় পেলো না কিন্তু তূর্য! সেও বাশারের মতো হবে না তো! চার পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজার অপর পাশ থেকে তূর্যের কণ্ঠস্বর শোনা গেলো, সে ভরাট কন্ঠে বলছে,” দরজা খুলো বলছি নয়না। আমি জানি তুমি দরজার কাছেই আছো! একজন খারাপ তাই বলে পুরো পৃথিবীর ছেলেরা খারাপ নয়। আর একজন ডাক্তারের সময় নষ্ট করে কী তুমি ঠিক করছো?”

সবাই বলে, ডাক্তারদের সময়ের মূল্য আছে। তাদের সময় নষ্ট করা মানে একজন রোগীর সাথে অন্যায় করা। নয়না কাল বিলম্ব না করে দরজা খুলে দাঁড়ায়। তূর্য নয়নার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর ফেলে বলল,” গোসল করোনি?”

পরিধানের মতো পোষাক নয়না নিয়ে আসেনি। ভাবনাও তার থেকে খাটো। টাইট ফিটিং জামা পড়ে ভাবনা। নয়না সেই পোষাক পরতে পারবে না। সে সবসময় ঢোলা ঢালা জামা পরিধান করে। দরজা ছেড়ে নয়না ভেতরে চলে আসলো। তূর্য ভেতরে প্রবেশ করে কিন্তু দরজা আটকালো না। সোফায় বসে নয়নার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,” চার্জে বসাও, আর এক কাপ কফি দাও।”

এমনভাবে তূর্য কথা বলছে যেন নয়না তার বিয়ে করা বউ! সে ভাবছে, বাশারের মতো তূর্যও যদি সুযোগে গা ছুঁয়ে দিতে চেষ্টা করে? তখন সে কী করবে? নয়না ইতস্ততঃ হয়ে ফোন হাতে নিলো সাথে তার ধারণাও পালটে গেলো। তূর্যের প্রতি অল্প বিশ্বাসও স্থাপন হলো মনে। তূর্য টি টেবিলের উপর রাখা হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা বইটি হাতে নিয়ে নড়াচড়া করে থাকলো। নয়না এই সুযোগে ফোন চার্জে বসিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো। মেহমান ঘরে আসলে চা পানি খাইয়ে বিদায় দেয়ার মতো মেয়ে নয়না নয়। রান্নাঘরে থাকা ফ্রীজ খুলে ডিম দেখতে পেলো নয়না। সেল্ফের উপর নুডলস দেখেছে সে। ঝটপট নুডলস রান্না করে এক কাপ কফিও তৈরী করে নিলো নয়না। ট্রের উপর সুন্দরভাবে সাজিয়ে তূর্যের সামনে পরিবেশন করলো। তূর্যের উপন্যাসের প্রতি কখনো আগ্রহ জন্মায়নি। শুধুমাত্র নয়না যেন তার উপস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে পারে এজন্যই বই ধরা। গল্পের ইমনের ছোটবেলার কচ্ছপ ধরার কাহিনীটুকু পর্যন্ত পড়তে পেরেছে। নয়নাকে আসতে দেখে বই বন্ধ করে তাকালো তূর্য। চোখের সামনে নাস্তা কফি দেখে খানিকটা অবাক হলো। টু শব্দ না করে নুডলস হাতে নিলো। এক চামচ নুডলস মুখে পুড়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো। তূর্যের মা মা’রা যাওয়ার পর থেকে নিজে অথবা চাচা রান্না করে খাওয়া হয়। মাহবুব শিকদারের কোনো সন্তান নেই। স্ত্রী অল্প বয়সেই প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায় তারপর আর ভদ্রলোক বিয়ে করেনি। তূর্যকে লালন-পালন করে বড়ো করেছেন। বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদই আলাদা আর বাড়ির খাবারের স্বাদই আলাদা। আরেক চামচ মুখে দিয়ে গদগদ কণ্ঠে বলল,” বাহ! এখন থেকেই ডাক্তারের কঠোর মনকে নরম করার কৌশল শিখে ফেলছো? আ’ম ইম্প্রেসড।”

নয়না মুখ বাঁকা করে উত্তর দিলো,” মেহমান এসেছে আপ্যায়ন করছি, সে ডাক্তার নাকি পাগল তা দেখছি না। আপনাকে খুশি অখুশি করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই। অন্য কেউ আসলে তাকেও আপ্যায়ন করতাম!”

” কিন্তু আমাকে স্পেশালভাবে আপ্যায়ন তো করছো, মুখে স্বীকার না করলেও আমি জানি।”

নয়না আঙল তুলছিল কিছু কটু কথা শুনিয়ে দিবে। তূর্য বলতে না দিয়ে কফির দিকে ইশারা করে বলল,” কফির বদলে শরবত মেহমানকে খাওয়াতে চাচ্ছো? গরম করে নিয়ে আসো।”

তূর্যকে নয়নার ইচ্ছে করছে গলা টিপে মে’রে ফেলতে। প্রথমদিন নয়না ভেবেছিল তূর্য বেশ গম্ভীর ও বদমেজাজী ডাক্তার মানুষ কিন্তু আজ দেখলো, তূর্যের মতো দুষ্ট, ইতর, ঠোঁটকাটা ডাক্তার এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।

নয়নাকে রাগিয়ে তূর্য বেশ মজা পাচ্ছে। কফির কাপ হাতে নিয়ে হনহন করে নয়না চলে গেলো। তূর্য নুডলস পুরো শেষ করে বিড়বিড় করে বলল,” তিনবেলা খাবার রান্না করার জন্য হলেও এই রাঁধুনিকে আমার চাই!”

পরমুহূর্তে নয়নার কথা চিন্তা করে হেসে ফেলল। কফির মতো তেঁতো মুখো মুখ করে নয়না আসলো। তূর্য এবার দৃষ্টি সরায়নি, নয়নার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে নয়না বলল,” এখন আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে না?”

তূর্য কফির কাপ হাতে নিতে নিতে উত্তর দিল,” ডাক্তার যখন রোগী হয়ে যায়,তখন সময়ের চিন্তা করে কী লাভ! আমার একটু চিকিৎসা করে দাও তো, রাঁধুনি!”

নয়না প্রচুর বিরক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে তূর্যের ঠোঁট কাটা কথা শুনে ইচ্ছে করছে জোড়পুকুরে চুবাতে। নয়নার কাছ থেকে প্রত্ত্যুত্তর না পেয়ে তূর্য সিরিয়াস কণ্ঠস্বরে বলল,” ফোনটা নিয়ে আসো তো,নয়ন!”

নয়ন-ই তো ডাকলো! কিন্তু এই ডাকায় আপন আপন সুর বেজে উঠলো কেন? সাথে নয়নার হৃদ কম্পনও দ্রুত হলো। পা টিপে টিপে নয়না ফোন নিয়ে আসলো। তূর্যের হাতে ফোন দিলে এবার তূর্য ভদ্রতা দেখালো না। নয়নার হাত শক্ত করে ধরে দরজার দিকে এগিয়ে তাগাদা দিয়ে বলল,” দ্রুত চলো, নয়ন! ডাক্তারদের মতো আজকাল মার্কেটের লোকেদের হাতেও সময় কম থাকে। যখন তখন দোকান খুলে বসে থাকে না।”

নয়না হাত ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। চিৎকার করছে সমানতালে,” হাত ছাড়ুন। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

তূর্য সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামতে নামতে উত্তর দিলো,” তোমাকে বেঁচে দিতে।”

চলবে…………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে