#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: তেরো
মাহবুব শিকদার সোফায় বসে আছে। ভদ্রলোক আরামে বসে চা পান করছে। অবশ্য চা তিনি নিজেই চেয়ে নিয়েছে। আকলিমা সম্মোহনী হয়ে চা করে নিয়ে এসেছে। বুট স্যুট পরিহিত ভদ্রলোককে পরিচিত মনে হচ্ছে তার কিন্তু স্বরণে আসছে না। কথাবার্তায় ভদ্রতার ছোঁয়া, বড়োলোকও হবে! আকলিমার বুঝে আসছে না, ভদ্রলোক কেন এসেছে।
আকলিমার প্রতিবেশী ফজল মিয়া, রোজ স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে। কারণ ঘাঁটলে দেখা যায়, স্ত্রী পরকিয়ায় আসক্ত। আজও তাদের মাঝে ঝগড়া হচ্ছে। ভদ্রলোক বাড়িতে আসছে, শব্দদূষণেরও একটা ব্যাপার আছে! আকলিমা প্রধান ফটক আটকে দেয়ার জন্য উদ্যোগ নিলো। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তখন মাহবুব শিকদার বলল,” দরজা আটকাবেন না, আমার ভাইপো আসবে। বুঝেনই তো! জোয়ান ছেলে, শরীরের রক্ত গরম। হাতের কাছে সবকিছু তৈরী করা না পেলে গুণ্ডামি শুরু করে।”
আকলিমা আরো ভয় পেলো সাথে অবাকও হলো, ভদ্রলোকের সাথে কথা আগানো শুরুই করেনি তারমধ্যে বলছে ভাইপোও আসবে? আবার ছেলেটা নাকি ডেঞ্জারাস! আকলিমা ভদ্রলোকের কাছে এসে বলল,”আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় যেন দেখেছি।”
” আমি ডাক্তার মাহবুব শিকদার। শুরুতেই তো বললাম!”
হেঁয়ালিপূর্ণ কথায় আকলিমা চুপসে গেলো। এতো বড়ো মাপের মানুষ তার বাড়িতে এসেছে। উদ্দেশ্যই বা কী? মাহবুব শিকদার মিটিমিটি হাসছে তার দৃষ্টি ঘুরেফিরে আকলিমার চুপসে যাওয়া মুখের দিকেই নিবদ্ধ হয়েছে। আসার পূর্বে ভাইপোর কাছে সমস্ত ঘটনা শুনেছে। নয়নার সাথে তাদের কু-আচরণের কথাও জেনেছে। মাহবুব শিকদার কেশে মনোযোগ নিজের দিকে এনে আকলিমাকে প্রশ্ন করলো,” আমার বউমা কোথায়?”
আকলিমার তো দুই সন্তান, দুইজনই ছেলে। তাহলে ভদ্রলোক কার কথা জিজ্ঞেস করছেন? নয়নার কথা ভুলে বসেছে সে। আকলিমার হয়তো শুনতে ভুল হয়েছে তাই সংশোধন করে নেয়ার জন্য বলল,” আপনার ভুল হচ্ছে, আমার দুই ছেলে। আপনি কোন মেয়ের কথা জানতে চাইছেন?”
” নয়নার কথা জিজ্ঞাসা করছি। তা সে কোথায়! ডাকুন তাকে। আজ একেবারে পাকা কথা ফাইনাল করেই উঠবো।”
আকলিমা আঁতকে উঠলো, নয়না তো আজ দুইদিন ধরে নিখোঁজ। পাড়া প্রতিবেশী কেউ টেরই পায়নি নয়না যে বাড়ি নেই। তাহলে এই ভদ্রলোক কীভাবে জানলো? আকলিমা ঘামতে শুরু করেছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। কাঁপা স্বরে উত্তর দিলো,” নয়না তো বাড়িতে নেই!”
” কি বলছেন? নুরুজ্জামান মৃত্যুর পূর্বে আমাকে তো বলেছিল, মেয়েকে এই বাড়িতেই রেখেছেন। তাহলে নেই বলছেন কেন? কোনোভাবে কী মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছেন?”
আকলিমার ভয়ে কেঁদে দেয়ার মতো অবস্থা। এবার সে ভদ্রলোককে চিনতে পেরেছে। নুরুজ্জামানের মৃত্যুর পর হাসপাতালে এক নজর দেখেছিল। এই বাড়িতে সে ছাড়া বাশারও আছে কিন্তু সে তো ঘর আঁটকে বসে আছে। বাহিরে যে আকলিমার উপর সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে তার খবর রাখে? থরথর করে কাঁপছে আকলিমা। এরমধ্যেই বাড়ির বাহিরে মোটরযান এসে থামলো। মাহবুব সোফায় হেলান দিয়ে বাঁকা হেসে বলল, ” মেয়ের হবু জামাই প্রথমবারের মতো এসেছে, যান বরন করে এগিয়ে নিয়ে আসুন।”
না চাওয়া সত্ত্বেও আকলিমা দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। চোখে সানগ্লাস পরে, ফর্মাল পোশাকে তূর্য বাইক থেকে নেমে আসলো। মোটরযান একপাশে সাইড করে রেখে এদিকেই এগিয়ে আসলো। আজ তূর্যের সাথে নয়নারও আসার কথা ছিল কিন্তু নয়না ঘর আটকে বসে আছে। তূর্য অনেকবার চেষ্টা করেছিল নিয়ে আসতে, ধমক অনুরোধ কেনোটাই নয়না শুনেনি। অগত্যা নাটক সাজিয়ে মাহবুব শিকদারকে পাঠায় তূর্য।
আকলিমার সামনে তূর্য এসে দাঁড়ালো। সানগ্লাস খুলে বুকপকেটে রেখে বলল,” ফুফু শাশুড়ি আম্মা, এতো কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? ঘরে বুঝি মন টিকছে না?”
আকলিমা সেই কখন থেকে হা করেই আছে মুখ বন্ধ করছে না। মাহবুব শিকদারকে দেখে যতোই না অবাক হশেছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ অবাক হয়েছে তূর্যকে দেখে। তূর্য এতক্ষণে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ফলেছে। নজর ঘুরিয়ে বাড়ির অভ্যন্তরীণ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে। আকলিমা এবার দরজা আটকাতে ভুলল না। এগিয়ে এসে তূর্যের উদ্দেশে বলল,” তুমি!!!!”
আকলিমার কথা শেষ করার পূর্বে তূর্য সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে বলল,” আমি তাবরেজ তূর্য শিকদার। মাহবুব শিকদারের একমাত্র ভাইপো এবং নয়নার একমাত্র হবু স্বামী।”
আকলিমা বাকরূদ্ধ, কী বলবে সে? কোথাকার কেউ এসে তারই বাড়িতে উঁচু আওয়াজে কথা বলছে অথচ সে কথাই বলতে পারছে না। বাশারের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আকলিমার সাইডটাও যেন ভারী হলো। সে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,” দেখ বাবা, এরা কী বলছে? ”
বাশার অচেনা মানুষের দেখে এগিয়ে আসলো। ভ্রু যুগল তার কুঁচকে আছে। অসময়ে যার তার প্রবেশ তার ভীষণ অপছন্দ। এগিয়ে আসতে আসতে বাশার মাকে প্রশ্ন করলো, ” কারা এসেছে?”
তূর্য মুষ্টি বদ্ধ হাতে বসে আছে। সে বর্তমানে এমন একজন কীটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে যে নারীদের ভোগের সামগ্রী মনে করে। তূর্য নিজের রাগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করছে। সে নয়নার পরিবারকে সহজে নয় কৌশলে শাস্তি দিবে। বাশার কাছাকাছি চলে আসতেই তূর্য উঠে দাঁড়ালো। তূর্যের পিঠ তখন বাশারের মুখ বরাবর। বাশারের হাইট পাঁচ ফিট তিন কিন্তু তূর্যের সামনে নিজেকে দেড় ইঞ্চি বাট্টু মনে হচ্ছে। তূর্য বাশারের দিকে ফিরে তাকিয়ে পিঠে দুইটা চাপড় দিয়ে বলল,” কী ব্যাপার, শা’লা।”
অচেনা মানুষ বাশারকে শালা বলছে? ব্যপারটা হজম হলো না বাশারের। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” এক্সকিউজ মি!”
” কয়েকদিন পর সম্পর্কে শা’লা হবে। তো শা’লা’কে শা’লা বলবো না তো ফিটার খাওয়া বাবু বলবো?”
তূর্যের জবান মুখে চললেও হাত চালাচ্ছে বাশারের পিঠে। প্রতিটা কথায় বাশারের পিঠে চাপড় দিয়ে যাচ্ছে। বাশার ভালোই আঘাত পাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে তা হজম করে নিচ্ছে। বাশার বুঝতে পারছে, তূর্য ইচ্ছে করেই তাকে আঘাত করছে।
তিনজন মিলে সোফায় বসলো। আকলিমা ছেলের পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার ছেলের মতো সেও এতক্ষণ ভালোই হেনস্থা হয়েছে। মাহবুব শিকদার গলা খাকাড়ি দিয়ে বলতে শুরু করলো,” মেয়ে বাড়ি না বুঝলাম। কোথায় গিয়েছে জানেন না তাও বুঝলাম। কিন্তু মেয়েকে তো খুঁজে বের করতে হবে! একটা কাজ করি, আমার বন্ধু জসিম। গাজীপুরের এসপি। তাকে বরং ফোন দিয়ে নয়নার কথা জানাই, কি বলেন?”
মাহবুব শিকদার মুঠোফোন বের করে বন্ধুকে কল লাগালো। বাশার কিংবা আকলিমার প্রত্ত্যুত্তরের অপেক্ষা করলো না। বাশার আকলিমা দুজনই ঘামছে তাদের পাপকর্মের ফল এভাবে ভোগ করতে হবে জানলে নয়নার সাথে খারাপ করতো না। শুধু বাশার নয় পাপকর্মের ফলাফল কতোটা ভয়াবহ তা যদি পৃথিবীর সকল অপরাধী জানতে তাহলে কখনোই পাপ করতো না।
তূর্য তীর্যক দৃষ্টিতে বাশারকে দেখছে। তার ইচ্ছে করছে এখনই বাশারের মাথা মাটিতে পুঁতে ফেলতে। কিন্তু সে এতো তাড়াতাড়ি এমন কিছু করবে না। বসা থেকে তূর্য দাঁড়িয়ে গেলো। আকলিমার উদ্দেশে বলল,” নয়নার ঘরটা কোন দিকে?”
হাতের ইশারায় আকলিমা নয়নার ঘর দেখিয়ে দিলো। তূর্য সেদিকেই এগিয়ে গেলো।
একটা খাট, একটা পড়ার টেবিল, একটা আলমারি ছোট ঘরটাতে এই কয়েকটা আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। তূর্য প্রথমে বিছানায় বসলো এক দুইবার বিছানা ঝাঁকিয়ে পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। বই খাতা পরিপাটি করে গোছানো দেখে মুচকি হাসলো তূর্য। ধুলোর স্তূপের ফু দিয়ে উড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,” এভাবেই ফু দিয়ে তোমার সব কষ্ট উড়িয়ে দেব, নয়ন!”
আলমারি খুলে শুঁকনো শাপলাফুলের মালা দেখে স্তব্ধ বনে গেল তূর্য। কাপড়ের উপরে সযত্নে নয়না মালা রেখে দিয়েছে। তূর্য চোখ বন্ধ করে এতোদিনের বোকামির জন্য আফসোস করে। তার মনে পড়ে যায় সিঙ্গাপুর যাওয়ার দুইদিন আগের কথা,
তূর্য সেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছিল। মাহবুব শিকদার ভাইপোর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার ব্যপারে নাখুশ ছিলো। বড়ো ভাই মারা যাওয়ার পর একমাত্র ভাইপোকে একাহাতে মানুষ করেছে মাহবুব শিকদার। কখনো চোখের আড়াল করেনি। সেদিন সরাসরি তূর্যের কাছে গিয়ে বলেছিল,” সিঙ্গাপুর যেয়ো না তূর্য। আমি তোমার জন্য মেয়ে পছন্দ করেছি।”
তূর্য সেদিন অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ” আমাকে জিজ্ঞাসা না করে কীভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিলে চাচ্চু?”
” মৃত বাবার কাছে কথা দিয়েছি, তার মেয়েকে পুত্রবধু করে ঘরে তুলবো। আমার কথার খেলাফ কখনো হয়নি। এবারও যেন না হয়। নয়নাই তোমার স্ত্রী হবে।”
তূর্য সেদিন অনেক রাগ করেছিল। নয়নার সাথে একবেলা কাটানো মুহূর্ত ভেবে রাগ হচ্ছিল কিন্তু আজ! আজ সে আফসোস করছে। এতোদিন নয়নার খোঁজ নিলে হয়তো মেয়েটার সাথে এমন কিছু ঘটতো না।
শাপলা ফুলের মালা হাতে প্যাঁচিয়ে তূর্য ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। বাশারের কাছে বসে পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, ” কী ব্যপার শা’লা, মুখটা অমন শুঁকনো লাগছে কেন? মনে হচ্ছে বড়ো কোনো অপরাধ করেছো? এমন তো নয়! তোমার কারণে আমার হবু বউ নিখোঁজ হয়ে গেছে? ”
বাশারের প্যান্ট ভিজে যাওয়াই বাকী ছিল। সেটাও অল্প স্বল্প ভিজিয়ে ফেলেছে। পুলিশকে কে না ভয় পায়! বড়ো বড়ো অপরাধীরাও পুলিশের সামনে আসলে খেজুর হয়ে যায়। আর বাশার তো সামায নারীলোভী! এতোক্ষণে তূর্য ও মাহবুব শিকদারের ক্ষমতা সম্পর্কে তার ধারণা হয়ে গেছে। একবার যদি নয়নার নিখোঁজ হওয়ার কারণ তারা জানতে পারে তো চৌদ্দ শিকলের ভাত খাইয়ে ছাড়বে। বাশার তুলতে উত্তর দেয়,” নয়নাকে তো আমি আপন বোনের মতোই আদর করতাম। মনে হয় বান্ধবীর বাসায় গেছে, চলে আসবে।”
” আসলেই ভালো। আমাকে মিসড কল দিতে বলো, আসল কারণ জেনে নিব।”
এরপর মাহবুব শিকদারের উদ্দেশে বলল, ” আসল অভিভাবক তো অনুমতি দিয়েই দিয়েছে। তাহলে আর কার অনুমতির অপেক্ষা করছো চাচ্চু! মেয়ে বাড়ি ফিরলে না হয় আবার আসবো!”
মাহবুব শিকদার তূর্যের কথায় সায় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ব্লেজারের মধ্য বোতাম আটকে আকলিমার উদ্দেশে বলল,” আজ চললাম। মেয়ে দেখতে এসে মেয়েকেই পেলাম না। কী ভাগ্য কী ভাগ্য। আমরা না হয় কাল পুলিশ নিয়ে আবার আসবো। কি বলেন বেয়াইন?”
আকলিমা মিছে হেসে বলল, ” তার আর দরকার পড়বে না। আমাদের মেয়ে এর আগেই চলে আসবে।”
তূর্য বাশারের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বলল, ” শা’লা, নিজের জান বাঁচা! প্যান্টটা পাল্টে নে, নয়তো চেটেপুটে খেয়ে নে। পরবর্তীতে যদি খাওয়ার মতো মুখই না থাকে?”
তূর্য বাঁকা হেসে মাহবুব শিকদারকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আকলিমা এবার আটকে রাখা নিঃশ্বাস ফোঁস করে ছেড়ে বলল, ” এরা ডাক্তার! নাকি ডা’কা’ত!”
বাশার প্যান্টের দিকে তাকিয়ে নাক মুখ কুঁচকে উত্তর দিলো, ” তোমার, আমার জম!”
চলবে………..