নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১২

0
391

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: বারো

হাসপাতালের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি কেবিনে অশান্ত তূর্যের দেখা মিললো। ছেলেটা সারা কেবিনে অস্থির চিত্তে পায়চারী করছে। বারবার নয়নার শরীরের আঘাত গুলো চোখে ভাসছে তূর্যের। যতবারই মনে পড়ছে বক্ষস্থলের বাম পাশে ব্যথা অনুভব করছে। তূর্যের ইচ্ছে করছে, বুকের বাম পাশটা চিঁড়ে দেখতে। কী এমন রোগ হয়েছে! যার কারণে এতো ব্যথা হচ্ছে! অনেক ভেবে তূর্য সিদ্ধান্ত নিলো, সে নয়নার কষ্ট ভাগাভাগি করে নিবে। মেয়েটার সরল, স্বচ্ছ মন আগেই তূর্যের অন্তরে দুর্বলতা তৈরি করেছিল। তূর্যের চাচার কথাও মাথায় আছে। কিন্তু তূর্যের ভয় হচ্ছে, নয়না যদি তার বিমুখী হয়! যখনের কথা তখন হবে। তূর্য কিছু একটা ভেবে কেবিন থেকে বের হলো, সরাসরি রিসিপশনের কম্পিউটারে কিছু খুঁজতে শুরু করলো। প্রায় পাঁচ মিনিট খোঁজার পর কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে সময় অপচয় করলো না মুঠোফোন বের করে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে নাম্বার নিয়ে নিয়ে নিলো, নাম্বারটি মিছিলের, তূর্য ফোন করলো। দেয়াল ঘড়িতে এগারোটা বাজে, এসময়ে মিছিল সজাগ কী না কে জানে?
দুই তিনবার রিং হতেহতে কেটে গেলো। মুঠোফোন টেবিলের উপর সজোরে রেখে মাথায় হাত রেখে বলতে শুরু করলো,” এই মেয়ে আমাকে পাগল করে দিবে।”

রিসিপশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত রবিন। নতুন জয়েন হয়েছে, প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে গিয়েছিল। তূর্যের অস্থিরতা দেখে প্রশ্ন করলো, ” ঠিক আছেন, স্যার?”

তূর্যের কী যে হলো! সে ছেলেটার দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেলে প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” আমাকে দেখতে কী আপনার এ্যাবনরমাল মনে হচ্ছে?”

ছেলেটা ভয় পেয়ে গেলো। মাথা না বোধক ইশারা করে বলল,” তা বলিনি।”

তূর্য ছেলেটার কথা শুনলে তো! হনহন পায়ে চলে গেলো।

প্রায় এক ঘণ্টা পর তূর্যের ফোনে কল আসলো, মিছিল কল করেছে। সময় অপচয় না করেই তূর্য রিসিভ করে বলল,” আমি ডাক্তার তূর্য। কিছুদিন আগে নয়নার সম্পর্কে যার কাছে বলেছিলেন। চিনতে পারছেন?”

” ইয়েস ডক্টর। অ্যানি প্রবলেম?”

তূর্য লম্বা একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,” নয়না আমাদের কাছে, আপনার বান্ধবী আজ সুইসাইড করতে যাচ্ছিল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে।”

বিগত সপ্তাহগুলোতে মিছিল ভাইয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত ছিলো। নয়নার খোঁজ নিতে পারেনি। প্রিয় বন্ধুর নির্মম অবস্থা দেখে চোখে জল চলে আসে। কাঁপা স্বরে উত্তর দেয়,” এখন নয়না কেমন আছে?”

” ভালো আছে, কিন্তু কতক্ষণ ভালো থাকবে জানা নেই।”
” মানে?”
” আপনার বন্ধুর পরিবার এতো জঘন্য, পুলিশকে জানানি কেন?”

মিছিল নিশ্চুপ হয়ে গেলো। সে কী-ই বা বলবে! কার কাছে অভিযোগ করবে? সে তো বন্ধুকে নিজের বাড়িতেই ঠায় দিয়েছিল কিন্তু তার বাবাই তো! মিছিল সেদিনের পুরো ঘটনা তূর্যকে বলল সাথে বাশারের অপকর্মের কথাও। পূর্বে বাশারের কথা গোপন রেখেছিল কিন্তু এবার কেন যেন তূর্যকে বিশ্বাস করলো কিন্তু কেন? উত্তর মিছিলের জানা নেই।

মিছিলের সাথে কথা বলে তূর্য কেবিন থেকে বের হয়ে এলো। সে খুব তৃষ্ণার্ত, নয়নাকে এক নজর দেখা আবশ্যক, নয়তো বক্ষস্থলের ব্যথায় মরে যাবে সে।

—————————–

স্বচ্ছ আকাশ হঠাৎই বাদলে ঢেকে গেলো। প্রকৃতির এরূপ পরিবর্তন নয়নার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো। গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডেকে যাচ্ছে, নয়না পিটপিট চোখে চারদিকে দেখছে। সে মনে করতে চেষ্টা করছে, তার সাথে কী ঘটেছিল। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর তার মনে পড়লো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্তের ঘটনা। সে তো ট্রেনের নিচে ঝাপ দিতে যাচ্ছিলো, তখন কেউ তাকে বাঁচিয়ে নেয়। ট্রেনের আবছায়া আলোয় দেখতে পেয়েছিল, উদ্ধার দাতা ছিল তূর্য। আসলেই কী তাই? নয়না কী তূর্যের বাসায় আছে? মস্তিষ্কে কথাগুলো ঘুরপাক খেতেই নয়না লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়লো। ধীরপায়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ালো। কেউ নেই! নয়না কী করবে? রাতও বেড়েছে তার উপর আবহাওয়াও খারাপ। যেই ঘর থেকে হাঁটা শুরু করেছিল সেই ঘরে এসেই নয়না থামলো। বাথরুমে পানির শব্দ হচ্ছে, তারমানে কেউ গোসল করছে। বাথরুমে কী নয়না নক করে দেখবে? যদি তূর্য বের হয়ে আসে! নয়না তখন কী করবে? দৌড় দিবে নাকি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। সাতপাঁচ ভেবে দরজায় করাঘাত করবে তখনই লোডশেডিং হয়ে গেলো। অচেনা বাড়ি, অচেনা স্থান,সবকিছুই নয়নার কাছে অচেনা। ইতিমধ্যে ফ্ল্যাটের প্রধান ফটকে করাঘাত করছে কেউ। নয়না কী করবে ভেবে পেলো না। অন্ধকারে হাতড়ে দরজা খুলে দেয়াই উচিত মনে করলো। দারজার অপর পাশের মানুষটা একেবারেই ধৈর্যহারা, একেরপর এক করাঘাত করেই যাচ্ছে। নয়না ভেবেই নিলো, অপরিচিতকে কিছু কথা শুনিয়ে দিবে সেই আশায় গেইট খুলে বলার আগেই কেউ একজন তার চোখে লাইট ধরলো। আলো থেকে বাঁচার জন্য নয়না দুই হাত চোখের সামনে এনে ধরলো।
তূর্য এ মুহূর্তে নয়নাকে আশা করেনি সে চোখ বড় বড় করে নয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো। আবহাওয়া বদলে নয়নাকে আজ অন্যরকম লাগছে। কয়েক সপ্তাহ পূর্বের মলিন নয়না আর আকজের নয়না আলাদা। নয়না দুই হাত দ্বারা চোখ ঢাকলো ঠিকই কিন্তু ঠোঁটজোড়া উন্মুক্ত রাখলো। ফলস্বরূপ বিড়বিড় করা ঠোঁটজোড়া দেখে তূর্য শুকনো ঢোক গিলে বলল,” তুমি সর্বনাশিনী, ভয়ংকর রমণী।”

ভাবনা গোসল সেরে নয়নাকে বিছানায় দেখতে পেলো না। দরজার কাছে বোকা তূর্যকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকলো,” কখন এলি,তূর্য? নয়নার চোখে লাইট ধরে রেখেছিস কেন?”

বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে তূর্য ফোন নামিয়ে নিলো। নয়নাও লজ্জায় চোখ থেকে হাত নামালো। সে ভুলেও তূর্যকে দেখছে না। ভাবনা টেবিল লাইট জ্বালিয়ে দেয়ার ফাঁকে দুষ্ট হেসে বলল,” নায়ক নায়িকার সিন শেষ হলে দরজা বন্ধ করে ভেতরে গিয়ে বোস। আমি লাইট জ্বালিয়ে আনছি।”

তূর্য গম্ভীর মুখে দরজা আটকে দিলো। নয়নার কাছে অচেনা পরিবেশ ও অচেনা স্থানে আপাতত তূর্যকে অনুসরণ করা ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই।

লাইটের পরিবর্তে ভাবনা দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে আনলো। একটি টেবিলের উপর অপরটি রান্নাঘরে। তূর্য সোফায় বসে ফোন ঘাটাঘাটি করছে। ভাবনা ভ্রু যুগল কুঁচকে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল, ” নয়নার জন্য স্যুপ বানিয়েছি, তোর জন্য কফি আনবো?”

তূর্যের গাম্ভীর্যভাবে উত্তর, ” উইথ আউট সুগার।”

” হ্যাঁ জানি! কফির বদলে করল্লার রস তোর প্রিয় খাদ্য।”

নয়না নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ভাবনা মেয়েটা চঞ্চল, তবে মনের দিক দিয়ে ভালো। নয়না কিছুক্ষণ যাবত তূর্যকে জিজ্ঞাস করার জন্য উশখুশ করছে। শেষবার সে যেই তূর্যকে সে দেখেছিল, আজকের তূর্য সে নয়। আজ নয়না গম্ভীর তেঁতো মুখো তূর্যকে দেখছে। মনে হচ্ছে, এই তূর্যকে কিছু জিজ্ঞেস করা মানে আগুন নিয়ে খেলা। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে নয়না জিজ্ঞেস করলো,” আমাকে কেন বাঁচালেন?”
” বউ বানানোর জন্য।”

তূর্যের সোজাসাপ্টা উত্তর কিন্তু কঠিন! নয়না বিষম খেলে। ভাবনা দৌড়ে পানি নিয়ে আসলো, নয়নার পিঠ চাপড়ে পানি দিয়ে বলল,” আস্ত মুরগী কী গলায় ঢুকিয়ে ফেলেছো? বিষম খেলে যে?”

কাশতে কাশতে নয়নার চোখ বেয়ে পানি বের হয়ে গেলো। তূর্য তা দেখে বাঁকা হেসে বিড়বিড় করে বলল,” আস্ত মানুষের মন চুরি করে ফেলেছে। কবে যেন খেয়েও ফেলে।”

নয়নাকে শান্ত করে ভাবনা স্যুপ নিয়ে আসলো। তূর্যের দিকে এক কাপ কফি এগিয়ে দিয়ে বলল, ” এই সময়ে আসলি যে? হাসপাতালে সব ঠিক আছে?”

কফিতে চুমুক বসিয়ে তূর্য উত্তর দিলো,” তোকে দেখতে আসলাম।”

” আমাকে নাকি নয়নাকে?”
ভাবনার সুর টানা কথায় তূর্যের কোনো নড়চড় হলো না। সে মনের সুখে কফি পান করতে করতে বলল,” তাকে জিজ্ঞেস কর, কেন আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে যাচ্ছিল। দুঃখ কী তারই আছে? পৃথিবীতে কতে মানুষই তো দুঃখী কই তারা তো আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে না!”

নয়নার মনে পড়ে বাশার তার সাথে যা করেছিল সেই কথা। তারসাথে ফুফার ডিসিশন, ফুফুর বানেয়াট কথা! সবকিছু মনে করে নয়না দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,” দুঃখীদের দুঃখ গায়ে লাগে না ডাক্তার সাহেব। তাদের মন ইস্পাতের তৈরী, সহজেই নরম হয় না। কিছু কারণ অজানা থাকলে যদি আমি ভালো থাকি তাহলে কী দোষ হবে?”

নয়নার কথনগুলো তূর্যের মনের কোটায় আস্তানা গড়ে তুললো। কফির কাপ সজোড়ে টেবিলের উপর রেখে বলল,” আগামীকাল তৈরী থাকবে, নয়ন! আমরা তোমার ফুফু ও ফুফার বাড়িতে যাব।”

নয়না ভয় পেয়ে গেলো। বিচলিত হয়ে বলল,” আমি ঐ নরকে আর ফিরে যেতে চাই না। দয়াকরে আমাকে কিছুদিন সময় দিন! কিছু একটা করে আমি এখান থেকে চলে যাবো।”
” কাল মানে কালই! আমার কথার কোনো নড়চড় হবে না। আমিও দেখতে চাই, তোমার আত্মীয় স্বজন কীরূপ আচরণ করে।”

————————–

দিনের শুরুটা যার ভালো কাটে সারাদিনই নাকি তার সাথে ভালো কিছুই ঘটে। আকলিমার আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত সময় কাটছে। নয়না থাকাকালীন তিনবেলা তাকে দিয়ে রান্না করিয়েছে আকলিমা। হাঁটুর ব্যথার নাম করে আরাম করেছে এতোদিন। আজ দুইদিন হলো নয়নার কোনে খোঁজ নেই। ম’রে আছে নাকি বেঁচে আছে কে জানে? বাশারকের এই দুইদিন হাতের কাছে বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। সারাদিন এক ফোন কানে দিয়ে রাখে। জিজ্ঞাসা করলেই বলে, ইম্পর্ট্যান্ট কল, চাকরি ব্যবস্থা নাকি করে দিবে। আকলিমা আর কথা বাড়া না নিজ কাজে মনোযোগ দেন।

কলিং বেল বাজছে অনবরত। আকলিমার আটা মাখছিল, সেই হাতেই দরজা খুলতে চলে আসলো। অপরিচিত মানুষকে দেখে প্রশ্ন করল,” আপনি কে?”
উত্তর এলো,
” আমি ডাক্তার মাহবুব শিকদার। ভেতরে আসতে পারি?”

চলবে………………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে