#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: এগারো
কালরাত্রি বলে কী কোনো রাত আছে? যদি হয়েও থাকে তবে সেটা কী সবার জীবনে একবারই আসে? নাকি নয়নার জীবনের মতে বারবার আসে! বাস্তবে নয়নারা কী কখনোই সুখী হয় না! তাদেরও তো বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়, আকাশে ডানা মেলে উড়তে ইচ্ছে হয়, কিন্তু! বাশারদের নতো নরপশুরা নয়নাদের বাঁচতে দিতে চায় না। ভোগের সামগ্রী মনে করে। নয়নার মতো অসংখ্য নয়না রয়েছে, রাতের আঁধারে যারা আপনজনের দ্বারা নির্যাতিত হয় কিন্তু দিনের আলোয় তাদের হাসিমুখে চলতে হয়। নয়না এই যাত্রায় তাদের বিপরীত ছিল।
নয়নার ঘরে বোরহান উদ্দিন বসে আছে। পাশেই আশ্চর্যান্বিত হয়ে আকলিমা দাঁড়িয়ে আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, বাশার এতোটা নীচু প্রকৃতির। আজও হয়তো বিশ্বাস করতে না যদি বোরহান স্বচক্ষে ছেলের পাপকর্মের সাক্ষী না হতো। বাশার মাথা নিচু করে অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছে। নয়না ডাইনিং টেবিলে মাথা নিচু করে কাঁদছে। বোরহান ছেলের দিকে রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,” যা করেছিস, ভালো করিসনি। যাকে বোনের নজরে দেখার কথা তার সাথেই, ছিহ! এতো খারাপ কি করে হতে পারলি? একজন এতিম মেয়েকে অপদস্ত করতে তোর কলিজা কাঁপলো না?”
বাশার বাঁচার জন্য মনে মনে নতুন ফন্দি আঁটলো। বোরহানকে মিথ্যা কথা বলল,” আমরা একে অপরের ভালেবাসি, বাবা। একটু মন মালিন্য হয়েছিল সেটাই ঠিক করতে এসেছিলাম।”
বোরহান এগিয়ে এসে বাশারের গাল বরাবর থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” জোর করা আর প্রেম করা আমাকে তোর শেখাতে হবে না, জানোয়ার। আমার তোকে সন্তান বলতেই ঘৃণা হচ্ছে।”
বেরহান সারাঘর পায়চারি করতে করতে আকলিমার উদ্দেশে বলল,” তোমার জন্যই দুই ছেলেকে ফেলে দূরে থাকছি, এই তোমার শিক্ষা!”
আকলিমা নিস্তেজ শরীরে উত্তরে বলল,” আমাদের সম্মান আর রইলো না। লোকসমাজে আমরা মুখ দেখাবো কীভাবে?”
বোরহান নিশ্চুপ হয়ে কিছু একটা ভাবলো। এরপর চট করে বলল, ” আমি কালই বাশার আর নয়নার বিয়ে দিতে চাই।”
নয়না কান্না থামিয়ে বোরহানের কাছে এসে হাত জোর করে বলল, ” দয়া করো ফুফা, এমন শাস্তি দিও না। আমি এই রাতের আঁধারে বাড়ি ছাড়বো, তোমাদের সম্মানে কোনো দাগ ফেলতে দিব না। তবুও আমাকে এই খারাপ লোকটার সাথে বিয়ে দিও না।”
আকলিমা তেড়ে আসে নয়নার কাছে। হাত মুচড়ে ধরে বলল,” আমার ছেলেকে ফাঁসিয়ে ভালো সাজা হচ্ছে! আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম,তুই আমার ছেলেকে তোর রূপের জালে ফাঁসাচ্ছিস। হয়েছেও তাই!”
বোরহান উদ্দিন আকলিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরে গর্জে উঠলো, ” আকলিমা! ঐ মেয়েকে কেন দোষারোপ করছো? নিজের ছেলেকে এতো ভালো মনে করো না। আমি তোমার ছেলের দুষ্ট রূপ দেখেছি।”
আকলিমা চুপ হয়ে যায়। যাকে সে সহ্য করতে পারে না তাকে কীভাবে পুত্রবধূ হিসাবে গ্রহণ করবে! বাশার বোরহানের পায়ে পড়লো। কান্নার সুরে বলল,” আমি ভুল করেছি, প্রায়শ্চিত্ত আমিই করব। নয়নাকে বিয়ে করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আগামীকাল না, দুই সপ্তাহ পরে নয়নাকে বিয়ে করব।”
আকলিমাও ছেলের কথায় সায় দিয়ে বলল,” বাশার ঠিক বলেছে। নয়তো লোকেরা বলাবলি করবে, একরাতের মধ্যে বিয়ে! নিশ্চয়ই ছেলে মেয়ে অকাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে, তাই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।”
” মানুষ ভুল তো আর বলছে না! তোমার ছেলেই তো মেয়েটার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল।”
তাদের কথোপকথনের মাঝে নয়না বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তিনজন মানুষ নয়নাী বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অজ্ঞ। ঠিকানা বিহীন পথ ধরে চলতে শুরু করেছে নয়না। শা শা করে গাড়ি তার শরীর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। নয়নার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। গাজীপুরের রেললাইনের কাছাকাছি চলে আসে নয়না। সময় তখন তিনটা বাজে পঞ্চান্ন মিনিট। ভোর চারটার ট্রেন ছাড়ার সময় হয়েছে। গাজীপুর রেল গেইট থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। নয়না চোখ বন্ধ করে মা ছোট ছোট ভাইবোনদের চেহারা মনে করতে চেষ্টা করে। বাবার চেহারা চোখের সামনে ভাসতেই নয়নার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে থাকে। জীবনের কাছে নয়না হেরে গেছে। একাকী লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠেছে সে। ট্রেনের হুইসিল কর্ণধারে পৌঁছালো নয়নার, আপনাআপনি মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ধীরপায়ে রেলগাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। আর কিছু সময়! এরপরই নয়না নামক কারো অস্তিত্ব এই নশ্বর পৃথিবীতে থাকবে না। কেউ আর নয়নাকে বোঝা মনে করবে না। ভয়ে রাতের পর রাত জেগে থাকতে হবে না। চোখ বন্ধ করে মৃত্যুকে স্বাগত জানায় নয়না। দুইহাত মেলে ধরে ঝাপ দিবে এই মুহূর্তে কেউ একজন নয়নার হাত টেনে ধরে। ঝকঝক করে ট্রেন নয়নার পাশ দিয়ে চলে গেল। অশ্রুসিক্ত চোখে নয়না শুভাকাঙ্ক্ষীর দিকে তাকানোর পূর্বেই মানুষটা নয়নার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল,” কী করতে যাচ্ছিলে, পাগল মেয়ে!”
এমনিতেও ঘুমের ঔষধ সেবন করার কারণে নয়নার শরীর দুর্বল ছিল। তার উপর এতো ধকল! থাপ্পড় খেয়ে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে সামনের মানুষটার বুকে ঢলে পড়ে।
বলিষ্ঠ দেহে শক্ত করে নয়নাকে জড়িয়ে ধরে তূর্য। নয়না জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে তা প্রত্যাশা করেনি সে। ভাবনা ব্যাগ কাঁধে তূর্যের দিকে দৌড়ে এসে বলল,” মেয়েটা কে? কী হয়েছে?”
” নয়না, সেই নয়না! যার জন্য তাবরেজ তূর্যের সিঙ্গাপুর যাওয়া মিস হয়েছে। তার স্বপ্ন পূরণ হওয়া অপূর্ণ রয়ে গেছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! যাকে দূর থেকে ঘৃণা করতে চাচ্ছি সেই এখন আমার বুকে।”
তূর্যের কাঠকাঠ জবাবে ভাবনা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এতোদিন সে জানতো তূর্য তার চচার জন্য সিঙ্গাপুর যায়নি কিন্তু আজ সত্যি জেনে সে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
তূর্য নয়নাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে গালে হাত রেখে জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করলো। গালে কয়েকবার চাপড় দিয়ে তূর্য ডাকলো,” এই মেয়ে! এই নয়না! শুনতে পাচ্ছো? ড্যাম! কীসের এতো কষ্ট তোমার? শুনতে পাচ্ছো?”
কিন্তু নাহ! নয়নার জ্ঞান ফেরাতে পারলো না তূর্য। অবশেষে ভাবনা তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বলল,” ওকে হাসপাতালে নিতে হবে, তূর্য! দেরী করিস না।”
সময় অপচয় না করে তূর্য নয়নাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। বন্ধুদের ডেকে নিজের ব্যাগ সামগ্রী উঠাতে বলতে ভুললো না।
রেলগেইট থেকে গাজীপুর সদর হাসপাতালের দূরত্ব দেড় কিলোমিটার প্রায়। পাঁচ ছয় মিনিটের রাস্তা তূর্যের কাছে বিশাল মনে হচ্ছে। ভোর রাতে রিকশা ছাড়া অন্য কোন যানবাহন পাওয়া যায়নি। তূর্য কাল বিলম্ব না করে নয়নাকে নিয়ে রিকশায় চড়ে বসে। নয়নাকে বসিয়ে নিজে পাশে বসে। নয়নার মাথা তূর্যের কাঁধে রাখা, একহাতে তূর্য তাকে ধরে রেখেছে। দৃষ্টি তার নয়নার শুকনো মুখশ্রীতে। তূর্য অমন মায়াবী শুকনো মুখখানা দেখে আনমনে বলল,” তোমার অন্তরে আমার নিশ্বাসের আশ্রয় মিলে যাক, তোমার ভালোবাসায় আমার জীবন পাগল হয়ে যাক। তোমার দুঃখগুলো সব আমার হয়ে যাক।”
তূর্য কথাগুলো বলে খিঁচে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয়। মেয়েটাকে সে যতো দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে মেয়েটা ততো কাছে আসছে। মেয়েটার মায়াভরা চাহনি উপেক্ষা করা মুশকিল! মাদকতা কাজ করে, মায়া জন্মে যাচ্ছে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর হাসপাতালে পৌঁছে তূর্য। নয়নাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে ইমারজেন্সি বিভাগের দিকে এগিয়ে যায় সে।
ভাবনা ইতিমধ্যে পৌঁছে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করলো। তূর্য ততক্ষণে কাপড় ছেড়ে নয়নার কাছে আসলো। ভাবনা প্রেশার মেপে সূর্যয়ের উদ্দেশে বলল,” গতবারের মতো শরীর দুর্বল।”
তূর্যের কী যে হয়! সে মিছে রাগ করে নয়নার উপর। ভাবনার কথার প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” এতো বড়ো ধিঙ্গি মেয়ে! অথচ নিজের যত্ন নেয় না। এতো বড়ো একটা কাজ করতে যাচ্ছিল! হাসপাতালে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। ওকে না হয়,তোর ফ্ল্যাটে নিয়ে যা। আমি সেলাইন, খাবার নিয়ে আসছি।”
কথাগুলো বলেও তূর্য দাঁড়িয়ে রইলো। নয়নার গালে, হাতে আজও আঁচড়ের দাগ, হয়তো মেয়েটার উপর অত্যাচার করা হয়েছে! তূর্যের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মুষ্টিবদ্ধ হত টেবিলের উপর আঘাত করে হনহনিয়ে বের হয়ে আসে।
দুইজন নার্সের সাহায্যে ভাবনা নয়নাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসলো। দক্ষিণ ছায়াবীথির চার নাম্বার বাড়ির তৃতীয় তলায় ভাবনা একাকী থাকে। আপনজন সবাই ময়মনসিংহে গ্রামে থাকে। ছুটিতে তূর্য সহ আরো কয়েকজন বন্ধুরা মিলে ভাবনার বাড়িতেই গিয়েছিল। আজ সকালেই ফিরেছে সবাই। বন্ধুরা মিলে হেঁটে ফিরতে যাচ্ছিল তখনই রেললাইনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই। তারা তখনও জানতো না মানব অথবা মানবীটা নয়না। তূর্য জীবন বাজি রেখে নয়নাকে বাঁচিয়ে নেয়।
নয়নার সেলাইন চলছে। তূর্য নিজে আসবে বললেও আসেনি। মিনহাজকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় সে। ভাবনা বন্ধুর অদ্ভুত আচরণ ঠিকমতো ঠাহর করতে পারছে না। সবার বেলায় তূর্য স্বাভাবিক থাকলেও নয়নার কাছে আসতেই অস্বাভাবিক আচরণ করে। নয়নাকে একবার কাছে টানে তো একবার দূরে সরিয়ে দেয়। ভাবনা ভাবছে, কী চলছে ছেলেটার মনে?
————————–
হাসপাতাল, পথঘাট, রেলস্টেশন কেনোটাই খোঁজা বাদ রাখেনি বাশার। নয়নাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে সে। বোরহান উদ্দিন নির্দেশ দিয়েছেন, নয়নাকে নিয়ে বাসায় না ফিরতে পারলে বাড়িতে জায়গা দিবে না। প্রায় দুইঘণ্টা যাবত নয়নার কোনো খোঁজ না পেয়ে বাশার একটি কফিশপে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ যাবত তার মুঠোফোন বাজছে, দৌড়াদৌড়ি করার জন্য ফোন ধরতে পারেনি। ক্লান্ত শরীরে টেবিলের উপর এক বোতল পানি দেখে ঢকঢক করে পান করে নেয় বাশার। প্যান্টের পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে বাঁকা হাসলো। রিসিভ করে ফোন কানে দিয়ে বলল,” কেমন আছো সুইটহার্ট?”
চলবে………………