নয়নে বাঁধিব তোমায় পর্ব-১০

0
381

#নয়নে_বাঁধিব_তোমায়
#আফসানা_মিমি
পর্ব: দশ

আজকের দিনটার কথা নয়না কখনোই ভুলবে না। কেনোই সে ভুলবে! বাশার আজ তার কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। নয়না কী করবে, কোথায় যাবে,কাকে বলবে বুঝতে পারছে না। অবশেষে উপরওয়ালা তার দরখাস্ত কবুল করেছেন। নয়নার ধৈর্য্যের ফল সে আজ পেয়েছে।

নয়না ভাবছে বিকালের সময়ের কথা। যখন সে নিঃশব্দে বসে কাঁদছিল। বাশার বাসায়ই ছিল নয়না তা জানতো না নাহলে সে দরজা আটকে ঘরে বসে থাকতো। কান্নার মাঝেই নয়না অনুভব করে তার মাথায় কেউ হাত রেখেছে। নয়না ভেবেছিল বোরহান হবে কিন্তু তার ধারণা ভুল করে বাশার নিজেই নয়নার ঘরে প্রবেশ করে এবং সেই নয়নার মাথায় হাত রাখে। নয়না তাৎক্ষণিক সরে বসলো। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলল, ” নিজের জীবন দিয়ে দিব, কিন্তু নিজেকে কলঙ্কিত হতে দিব না। আমাকে ছুঁবে না,বাশার ভাই।”

নয়নার কথা অগ্রাহ্য করে বাশার হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসলো। দুই হাত তুলে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ” আমাকে ক্ষমা করে দে, নয়না! তোর সাথে এতোদিন খুব খারাপ আচরণ করেছি। আমি অনুতপ্ত, আমাকে যেই শাস্তি দিবি তাই মাথা পেতে নিব।”

অশ্রুসিক্ত নয়ন, অনুনয়ের স্বর, বাচনভঙ্গি পরিবর্তন। নয়না কী সত্যি দেখছে? অবিশ্বাসের তীর এখনো বাশারের দিকেই এগোচ্ছে। নয়না কী! কোনো মেয়েই বাশারকে বিশ্বাস করবে না এবং ক্ষমাও করবে না। সে ভীত স্বরে বলল,” আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারব না, বাশার ভাই। আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও, নয়তো ফুফাকে ডাক দিব।”

বাশার দুঃখী হয়ে উঠে দাঁড়ালো। নয়নার পা ছুঁয়ে দেয়ার বাহানায় এগিয়ে এসে বলল,” তোর দুটো পা ধরি, নয়না! আমাকে ক্ষমা করে দে। আজ তোর কষ্ট দেখে আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি।”

বিছানার এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে নয়না বসে রইলো। তার শরীর কাঁপছে। বাশারকে একদম সহ্য হচ্ছে না। পাগলের মতো প্রলেপ করতে শুরু করলো, ” চলে যাও, বাশার ভাই! তোমার ভালো রূপও আমার সহ্য হয় না। তোমার মুখ দেখাও আমার জন্য পাপা। ঘৃণা হয় তোমাকে দেখলে। আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও। আমাকে বাঁচতে দাও।”

বাশার চোখের পানি মুছে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যোগ নিয়ে বলল, ” ভয় পাস নে, নয়না। এখন কথা বলছিস না ঠিক আছে, আমি পরে আবার আসবো।”

বাশার প্রস্থান নেওয়ার পর থেকে নয়না ভাবনার জগতেই কাটালো। এ কেমন জীবন যাপন করছে নয়না! সুখ আসলেও সে হাসতে পারে না, দুঃখভরা জীবনে আজীবন চলতে হচ্ছে তার!

রাতের খাবার টেবিলে এলাহী কাণ্ড ঘটে গেলো। বাশার আজ রাতের খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়েছে। রিহানকেও সন্ধ্যায় হোস্টেল থেকে নিয়ে এসেছে সে। বোরহান উদ্দিন ছোট ছেলেকে কাছে পেয়ে আপ্লুত হোন। সারা মুখে আদরে ভরিয়ে দেন। নয়নার খুব আফসোস হয় তা দেখে! সেও কল্পনার জগতে ডুবে যায়।
বাশার নিজে হাতে সবাইকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। বিশেষ করে নয়নার পাতে, ভাত, তরকারি, ডাল তুলে দিচ্ছে। আকলিমা ছেলের হাবভাবে দেখে বিরক্ত হোন। নয়নার প্রতি এক্সট্রা কেয়ারে ধমক দেন বাশারকে, ” এতো আদিখ্যেতা দেখানোর কী আছে? নয়নার কী হাত নাই? তোর এতো পিরিত কীসের? চুপচাপ খা, নয়তো ঘরে যা। এই মেয়ের জন্য নিজের ছেলেকেও সন্দেহ করতে হচ্ছে, এই মেয়ে, তুই কেন আমার সংসারে পড়ে আছিস? রাস্তায় পড়ে ম’রে যেতে পারিস না?”

বোরহান উদ্দিন নিশ্চুপে খাবার খাচ্ছিল। আকলিমার কটু কথা তার পছন্দ হলো না, অর্ধ খাওয়া রেখে সে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। আকলিমার উদ্দেশে বলল, ” তোমাকে নয়নার আপন ফুফু বলতে আমার ঘৃণা হচ্ছে। ফুফু ভাইজির বন্ধুর মতো থাকে কিন্তু তুমি হলে নয়নার জীবনের চরম শত্রু। আমি ভেবে নিয়েছি, এবার নয়নাকে নিয়ে ফিরবো। এখানে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাওয়ার থেকে দূরে না খেয়ে মরুক, তাও ভালো।”

আকলিমা রাগে ফুসফুস করছে। তার ভেতরের সত্তা আজ অনেক কথাই বলতে চাইছে কিন্তু সে ছেলের সামনে বলতে চাইছে না। টেবিলের উপর থেকে বাসনপত্র ফেলে দিয়ে নয়নার উদ্দেশে বলল,” আমার ছেলেকে নষ্ট করতে পারছিস না বলে এখন আমার স্বামীকে হাত করছিস? এতোটা নীচে নামতে পারলি কীভাবে? তোর বাবার অনুরোধ সেদিন না শুনলেই ভালো হতো, তবে আজ আমার সংসার বাঁচতো।”

ভীত নয়না আকলিমার কথার প্রত্ত্যুত্তরের জন্য কথা সাজিয়ে নিলো। সে যা চায় না, তাই ঘটে যায় তার সাথে। বিনা অপরাধে অপরাধী হতে হয় তাকে। আকলিমার দিকে ফিরে ছলছল চোখে বলল,” এতোদিন লাথি, মার খেয়েও মনে মনে ভাবতাম যে, আমার একজন অভিভাবক আছে! আজ তুমি আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করলে, আমাকে বে’শ্যা’দে’র সাথে তুলনা করতেও ভুল করলে না। জানো ফুফু! পৃথিবীর কোনো পুরষের প্রতি আকর্ষণ কাজ করে না। পুরুষদের বিশ্বাস করি না৷ তারা নারীদেরকে ভোগের বস্তু মনে করে মাত্র। আর রইলো ফুফার কথা! তিনি আমার গুরুজন। তোমার ছেলেকে আমি জাস্ট ঘৃণা করি, ঘৃণা। তার চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছে করে না।”

এতোকিছুর মধ্যে বাশার একদম নীরব। পেটভরে ভাত খেয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে। খাওয়ার শেষে সেমাই হাতে নিয়ে বলল,” সবাই ঘুমাতে যাও। আমি বের হচ্ছি, ফিরব আগামীকাল। একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য স্টাডি করতে হবে।”

বাশারের নীরবতা নয়নার চোখে বাঁধে। বাশারকে সে যতটুকু চিনেছে, সে এত সহজে ভালো হবে না। যতোই সে ক্ষমা চেয়ে নিক তার অন্তর কালো কুচকুচেই থাকবে।

আকলিমার মুখের উপর কথা! নয়নার দিকে তেড়ে আসতে নেয় আকলিমা। নয়না তা দেখে পিছনে সরে আসলো। হাত জোর করে বলল,” আজকের রাতটা সহ্য করে নাও, ফুুফু। কাল সকালেই আমি মিছিলের কাছে চলে যাবো।”

ঘরে ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করে নয়না। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সেভাবেই ঘুমিয়ে যায় সে! আজ এতো জলদি ঘুম চলে আসলো নয়নার! যেখানে রাতের পর রাত নির্ঘুমে কাটাতে হয় তাকে!
———————

মধ্যরাত, পুরো পৃথিবীর মানুষ নিদ্রায়মাণ। আঁধার আকাশের বুকে একখণ্ড চাঁদ কিরণ ছড়াচ্ছে। হেলানো বাতাসে গাছপালারাও হেলছে দুলছে। নয়নার ঘরের দরজা তখনই কেউ খুলে ফেলে। মিনি রেজারের সাহায্যে কেউ দটজার লক ভেঙে ফেলে একটি মূর্তিছায়া নয়নার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষটা কী চোর? কী চুরি করতে এসেছে? নয়নার ঘরে তো তেমন কোনো সম্পদও নেই! ছায়ামূর্তিটার লক্ষ হলো নয়না, সে ধীরপায়ে নয়নার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নয়নার পরিধানে সুতি থ্রি পিস। ঘুমে নিমগ্ন নয়না। তার ঘরে কেউ প্রবেশ করেছে টেরই পায়নি। ছায়ামূর্তিটি নয়নার ওড়নার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। একটানে নয়নার শরীর থেকে ওড়না আলাদা করে নিজের শার্টের বোতামে হাত লাগালো। নয়না তখনও বিভোর ঘুমে নিমগ্ন। যেই সম্মানের ভয়ে দিবা রজনী শংকায় কাটাতো আজ তা কেউ হরন করছে তারই অগোচরে। শার্ট বিহীন ছায়ামূর্তি এবার দাঁত বের করে হেসে নয়নার সারা শরীরে চোখ বুলালো। নয়নার মুখের কাছে ঝুঁকে ঠোঁটের পাশটায় হাত বুলিয়ে বলল,” বলেছিলাম না, আমি আবার আসবো। তোকে আজ কে বাঁচাবে, নয়না!”

ঘুমের ঘোরে নয়না কপালে, হাতে, ও শরীরের স্পর্শ কাতর জায়গায় কারো ছোঁয়া অনুভব করছে কিন্তু চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। শরীরের শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়ে গেছে। নয়না হাত তুলে শরীরের উপর ভর করে থাকা মানুষটাকে সরাতে চাইছে। কিন্তু মানুষটা সেই সুযোগ দিচ্ছে না। দুর্বল শরীরে বাঁচার জন্য নয়না হাতড়ে কিছু খুঁজছে। অবশেষে পেয়েও যায় নয়না, হিজাবের সাথে পরার সেফটিপিন মানুষটার ঘাড় বরাবর ঢুকিয়ে দেয় নয়না। মানুষটি আহ বলে সরে আসে। ঘাড়ে হাত দিতেই তরল পদার্থ অনুভব করে সে। নয়না দুর্বল পায়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো। গায়ে ওড়না জড়িয়ে বলল,” বাশার ভাই!”

বাশার উন্মাদের মতো আচরণ করতে শুরু করলো। সে নয়নার চুলের মুঠোয় ধরে বলল, ” আজ তোর শরীর খুলবে খাবো, মা’গি। অনেকদিনের ইচ্ছা আজ পূরণ করব।”

” এমনটা করো না, দোহাই লাগে বাসার ভাই।”

” সবাই ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগ আমি কীভাবে হাতছাড়া করি। তোকে কীভাবে ছেড়ে দেই বল! কত বছরের ইচ্ছে তুই! আজ সারাদিন তোর সাথে ভালো ব্যবহার করছিলাম যেন এমন একটা সুযোগ পাই। কাছে আয়, নয়না।”

কাছে আসার বিপরীতে নয়না দূরে সরে যায়। বাসারকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। নয়নার উদ্দেশ্য, সে এখনই পালাবে যেভাবে হোক এই নরক থেকে সে আজীবনের জন্য মুখ ফিরিয়ে নেবে। ভাবনা অনুযায়ী কাজ করা কি এতই সহজ! নয়না কী কখনো পারবে এই নরক থেকে মুক্তি পেতে!

ডাইনিং টেবিলের কাছাকাছি আসতে নায়না ওড়নার মধ্যে টান অনুভব করে। ভয়ে সে পিছনে ফিরে তাকালো। বাশারের ঘামার্ত মুখে বিশ্রী হাসি দেখতে পেলো। নয়না চিৎকার করে বলল, ” ফুফু, ফুফা, রিহান!”

” কেউ আসবে না। সবাই ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে।”

নয়নার এক হাত ধরে টেনে বাশার ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিজের জীবন বাঁচাতে অন্য হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা দিয়েই নয়না আটকাতে চাচ্ছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। হাতের আঘাতে ডাইনিংয়ের চেয়ার মাটিতে পড়ে বিকট শব্দ হলো। বাশারের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে জানে, আজ ঘূর্ণিঝড় হলেও বাড়ির কেউ জানতে পারবে না। নয়নাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মারে। প্যান্টের চেইনে হাত তার! শরীর গরম হয়ে আসছে। নয়নাকে দেখে কামোত্তেজনা বেড়ে গেছে।কামুকতার শীর্ষ পর্যায়ে নয়না পুনরায় উঠে যেতে নেয়। এবার বাশারের সহ্য হলো না, সে সজোড়ে নয়নার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। এতে নয়নার ঠোঁট কে’টে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত ঝড়তে শুরু করে। দ্বিতীয়বার নয়নার দিকে হাত বাড়াতে নিতেই কেউ একজন হুঙ্কার ছাড়লো। বাশারের শরীরে দুই তিনটে কিল, ঘুষি মেরে বলল, ” জা’নো’য়া’র! বোনের সাথে কী করেছিস?”

নয়না আবছায়া দৃষ্টি মেলে মানুষটার দিকে তাকালো। কান্নামাখা স্বরে বলল, ” আমাকে বাঁচাও, ফুফা।”

চলবে…………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে