নয়নাভিরাম পর্ব-০৯

0
1159

#নয়নাভিরাম (পর্ব-9)

♡আরশিয়া জান্নাত

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করি দাদীজান?”

“কর”

“ধরো তুমি একজনকে অনেকদিন ধরে ভালোবাসো,আবার তোমারে অন্য একজন অনেকদিন ধরে ভালোবাসে। তোমারে যদি বলি এদের মধ্যে একজনকে বাছাই করো। তুমি কারে করবা?”

দাদীজান কিছুক্ষণ ভেবে বললো, যে আমারে ভালোবাসে তাঁরে যদি বাছাই করি তাইলে হয়তো আমি অনেক সুখ পামু, সে আমারে অনেক যত্নে আগলাইয়া রাখবো ভালোবাসা দিয়া। কিন্তু বুবুন মন যে বড় হারামী। এরে যতোই পোষ মানানোর চেষ্টা করো যারে একবার চাইবো তারে ছাড়া কারো পোষ মানতো না। আমি যারে বহুবছর ধইরা ভালোবাসতাছি যে যদি আমারে কাইট্টাও ফালায় তাও তাঁর জন্যই আমার মন কানবো। মাইয়ামানুষের একটা দোষ আছে, হেরা সবকিছু আবেগ দিয়া ভাবে। যারে মন থেইকা খাঁটি ভালোবাসে সে ছাড়া অন্য কারো আদর সোহাগও সহ্য করতে পারে না, সবকিছু বিষের মতো লাগে। বুঝতে পারতাছোস কিতা কইতাছি?

“হুম বুঝলাম। কিন্তু যদি ঐ মানুষটা ভালো না বাসে তোমার ভালোবাসা একতরফা হয় তখন?”

“একতরফা আর দুই তরফা কি? মাইনষে মরনের শেষ দিন পর্যন্ত আশা রাখে। এইডা তো একতরফা ভালোবাসা! এর বেলায় না কইলেও বিয়া হইবার আগ পর্যন্ত আশা রাখবোই। তারপর নসীবে নাই ভাইব্বা মাইনা লইবো। অনেকে তো এরপরও আশা রাখে”

“দাদীজান একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে খুব রাগ করবা?”

“জানি কি জিগাইবি। আমিই কইতাছি শোন, তোর দাদাজানে ঐ রেণুমালার ছবি আর চিঠি যত্ন কইরা রাখতো। হের জীবনের প্রথম ভালোবাসা ভুলতে পারেনাই কইছে আমারে। আমারে কইলো নবীজি (সাঃ) তাঁর প্রথম বিবি খাদিজা (রাঃ) রে আজীবন মনে রাখছে, সবচেয়ে পেয়ারা বিবি তাইনের। আবার নবীজি (সাঃ) এটাও কইছে আয়েশা (রাঃ) রে সবচেয়ে ভালোবাসেন। আল্লাহর কাছে সবসময় ক্ষমা চাইয়া কইতো সব বিবিরে একরকম ভালোবাসতে হয় তবুও মন আয়েশা (রাঃ) রেই বেশি পছন্দ করে।
এহানে যদিও অনেক ফারাক আছে। কোথায় বিবি আর কোথায় প্রেমিকা (আল্লাহ মাফ করেন),এইডা খালি উদাহরণ দিছে মনের নিয়ম বুঝাইবার জন্য। এই মন যে একবারই একজনরেই ভালোবাসবো তা না। নতুনজনও অনেক গভীর ভালোবাসা হইতে পারে। রেণুমালারে ভালোবাসতো হের মানে এই না আমারে ভালোবাসেনা। সেতি হইছে অতীত আমি বর্তমান। মানুষ বর্তমানেই সুখি কি কস?”

“দাদাজান জানতো তুমি উনারে অনেক ভালোবাসো। এই ভালোবাসা দিয়েই উনারে বশ করছিলা।হেহে”

“ভালোবাসার মেলা শক্তিরে বুবুন। এই পৃথিবীতে এটাই একমাত্র অস্ত্র যা দিয়া খুন খারাবি ছাড়াই মানুষরে ঘায়েল করা যায়। এবার হাছা কইরা ক তো কারে ভালোবাসোছ? মিছা কবি না কইলাম আমি ঠিক জানি তোর মনে কেউ আছে!”

“দাদীজান তোমাকে মিথ্যা বলবোনা, কিন্তু সে তো আমারে ভালোবাসে না। তাঁর আশা রাখা কি ঠিক?”

“তুই কইছোস কিছু তাঁরে? হে জানে তুই যে ভালোবাসোছ?”

“উহুঁ,,,”

“তো কেমনে বুঝলি ভালোবাসে না? অন্য কারো কথা কইছে?”

“ছিল একজন। তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে,, কিন্তু আমারে তো কিছু বলেনাই,”

“জিজ্ঞাসা কর মনের কথা কইয়া দেখ। মিটমাট কর হয় ইস পার নাহয় ওস পার। এহনের যুগের মাইয়া হইয়া মনের কথা কইতে ডরাস?”

“আমি বলতাম যে? মেয়েরা বলে নাকি পরে যদি নির্লজ্জ ভাবে?”

“ভাবলে ভাবুক! উল্টাডাও তো হইতে পারে। তোরা সবকিছুতে সমান অধিকার কস। এই বেলায় পিছাবি ক্যান? মনের কথা সবসময় পোলারাই আগে কইবো ক্যান? ”

“হুহ! তুমি বেশি মডার্ন হয়ে গেছ”

“না গো বুবু মডার্ন হইনাই, তোর দাদা মরবার পর বুঝছি জীবনডা খুব ছোডো। ভালোবাসার মানুষডার লগে যতোদিন বাঁচি মনের কথা বেশি কইরা কওন দরকার, বেশি কইরা ভালোবাসনের দরকার, দুনিয়ার কঠিন পরীক্ষার দিনে যদি ভালামতো সঙ্গ না দেই জান্নাতে সুখের সাথী কেমনে হমু? তহন তো এমনিতেই কোনো দুঃখই থাকতো না। তোর দাদাজানরে শরমে কোনোদিন কইতে পারিনাই তাইনেরে কত ভালোবাসি। এহন আফসোস হয়, লাগে আহাইরে একটু যদি কইতাম হয়তো খুব খুশি হইতো,,,,,,”

“দাদীজান তুমি দাদাজানের সত্যিকার অর্থেই জান্নাতের সাথী। দাদাজান তোমার মনের খবর ঠিক-ই জানতো, সেটা নিয়ে মন খারাপ করিও না।”

দাদীজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর মন যা কয় তাই হুনিস। তয় ফলাফল যাই আসুক মন শক্ত রাখবি। মনে রাখিস আল্লাহ যা করে ভালার জন্যই করে।
_____________

ফাহিমকে ব্যাপারটা খুলে বলাটাই বেটার মনে হলো। ও আমার কথা নিশ্চয়ই বুঝবে সেই প্রত্যাশায় আমি ওকে সবটা খুলে বললাম। আমি ঠিক করেছি আরশানকে মনের কথা বলবো, এতে যা হবার হবে। উনি যদি রাজী না হয় তবে আমি আর কাউকেই বিয়ে করবোনা। অন্য কারো স্পর্শ কল্পনা করারই শক্তি নেই সেখানে অন্য কারো ঘরণী হওয়া তো বহুদূর! যদিও আব্বু শুনলে খুব রাগারাগি করবেন হয়তো একসময় পরিবারের সবাই খুব জোর করবেন, তাই এর আগেই আমি চম্পট হবো। অন্য কারো কথা আপাতত আমি ভাবতেই পারছিনা,,,

ফাহিম সবটা শুনে বললো, সন্ন্যাসী হবার পণ ছাড়ো। কথা দিচ্ছি যতোদিন না তুমি চাইবে আমি কিছু বলবোনা, অপেক্ষা করবো। মিঃ আরশান যদি রিজেক্ট করে অপেক্ষা করার অধিকারটা অন্তত দিও! আর যদি উনি রাজী হয়ে যান আই প্রমিজ বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো ফিলিংস এর কথা প্রকাশ করবোনা,আমার জন্য তুমি অন্তত বিপাকে পড়বেনা এই ভরসা রেখো। তবে আমি চাই তোমার মন না ভাঙুক, সে যেন এই অমূল্য রত্নটা হারিয়ে না বসে!
আমি হাসিমুখে বললাম, তোর মতো মানুষ হয় না। যদিও অপেক্ষা করে লাভ হবেনা তবুও তোর জন্য এইটুকু ছাড় দিবো। তবে এরমধ্যে তোর যদি অন্য কাউকে পছন্দ হয় আমার কথা ভেবে আটকে যাস না যেন!

“হাহাহা। সে তুমি ভেবোনা”

______________

রোজ আরশানের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর অন্ধকার বেলকনীতে এক নজর দিয়ে বাসায় ফেরা আমার অভ্যাস।আজও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি, কিন্তু আজ তাঁর বেলকনীতে লাইট জ্বালানো দেখেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। আরশান ব্যাক করেছে ভাবতেই আমার হাঁটু কাঁপতে লাগলো। আমি কি করবো? একবার গিয়ে দেখে আসবো? নাকি ফোন করবো? সে তো আমায় নক করেনি দেশে ফিরেছে তাও তো বললোনা। আমি কি সেধে গিয়ে দেখে আসবো? যদি জিজ্ঞাসা করে হঠাৎ কেন এসেছি?
না না সেটা জিজ্ঞাসা করবেনা। আন্টির সাথে তো প্রায়ই দেখা করি। আজও নাহয় গেলাম এ আর বিশেষ কি? গেল সপ্তাহে আন্টির সাথে দেখা করলাম কই তিনিতো এ বিষয়ে কিছু বলেন নি,এমন হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত হওয়া আমিটা না পারছিলাম গাড়িতে বসে বাসায় ফিরতে না পারছিলাম দু কদম হেঁটে গিয়ে আমার নয়নাভিরামকে এক পলক দেখতে। সে কি আগের মতোই আছে নাকি আরো সুন্দর হয়ে গেছে? দেখলে নিশ্চয়ই আগের মতোই চোখ জ্বালা করবে! আচ্ছা সে কি আমায় দেখে অবাক হবে ? এই যে আমি এখনো আগের মতোই আছি এক বিন্দুও বদলাই নি সে কি এতে খুশি হবে নাকি বলবে আপনি এখনো ম্যাচিওর হলেন না মিস মিমি?

আঙ্কেল গেইট থেকে বের হয়ে আমাকে দেখে বললেন,আরেহ মিমি যে! কেমন আছ?

“আস্সালামু আলাইকুম আঙ্কেল। ভালো আছি আপনি ভালো আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। বাসায় আসছিলেন নাকি? যাও যাও ভেতরে যাও, গতকাল রাতের ফ্লাইটে আরশান এসেছে। গিয়ে দেখা করো তোমাকে দেখলে খুশি হবে।”

“ওহ তিনি এসেছেন! তা আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

“আমি হাঁটতে বেরিয়েছি। দিনে তো বের হতে পারিনা রাতে একটু চক্কর না দিলে শান্তি লাগে না।তুমি চলোতো মা ভেতরে গিয়ে বসো আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরত আসবো।”

আমি বোকার মতো আঙ্কেলের সাথে ভেতরে গেলাম।ইশ একটু আয়নাও দেখতে পারলাম না চেহারা টা ঠিকঠাক আছে তো!
আমাকে দেখেই আফরোজা আন্টি জড়িয়ে ধরে বললেন,ভালো দিনে এসেছিস মিমি। খোকা দেখ কে এসেছে!

আমি তাড়াতাড়ি সোফায় বসে ওড়না দিয়ে পা ঢাকলাম। এই হতচ্ছাড়া পা দুটো আমারে শান্তি দিলো না। তারপর সে এলো! তিন বছর দুই মাস পাঁচ দিন বিশ ঘন্টা পনেরো মিনিট এগারো সেকেন্ড পর তাঁর চেহারা আমি দেখলাম!
সেই গভীর কালো চোখ, ঝলমলে চুল, ঠোঁটে চিরচেনা হাসি। ব্ল্যাক টিশার্ট আর টাউজার পড়ে ঘরোয়াবেশে থাকা আমার নয়নাভিরাম, আমার চক্ষু শীতলকারী। আমার আরশান, হ্যাঁ আমার আরশান! চাপদাঁড়িটা রেখে না জানি কত বিদেশিনীকে ঘায়েল করেছে? ইশ এতো সুন্দর হবার দরকার ছিল তাঁর? এতোশত ভীড় টপকে তাঁর মন অবধি যাওয়ার সাধ্যি আছে আমার, হাহ!

“হেই মিস রুমাইসা কেমন আছেন? কত্তদিন পর দেখা!”

চোখে কিছু পড়েছে এমন ভাব করে চোখে টিস্যু চেপে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

“ভালো আছি। চোখে কি হয়েছে আপনার? কাজল লেপ্টে ফেললেন দেখি!”

“তেমন কিছু না কি যেন পড়লো বোধহয়”

“ওহ ! তারপর বলুন কি অবস্থা? বাসার সবাই ভালো আছে?”

“হুম ভালো ”

“আপনি এমন চুপচাপ যে?”

“না মানে অফিস থেকে ফিরেছি তো খুব টায়ার্ড। আচ্ছা আমি এখন যাই পরে দেখা হবে,”

আমি আন্টিকে না বলেই ওখান থেকে বেড়িয়ে এলাম। ওখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে হিচকি তুলে কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম নিশ্চিত। কত অভিমান অভিযোগ আছে তাঁর নামে সে কি জানে? তাঁর সামনে বসতেই চোখ ফেঁটে কান্না আসছিল উফফ ,ছিঃ মিমি এতো ছিচকাঁদুনে তুই Shame on u!
________________

আফরোজা নাস্তার ট্রে এনে বললেন,কি রে মিমি গেল কই?

আরশানের ধ্যান ভাঙতেই বললো,মা তুমি ঠিক বলেছিলে মিস রুমাইসা খুব অভিমানী! আমি তো বুঝতেই পারিনি তাঁকে। চোখের পানিতে গাল ভেসে যাচ্ছে অথচ অকপট মিথ্যে অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেল! আমি এই মেয়ের অভিমান ভাঙাবো কি করে মা?

“তুই এসে গেছিস না দেখবি সব অভিমান গলে যাবে। এবার আর দেরি না করে মেয়েটাকে আমার ঘরের বৌ করে আন দেখি। আর কত বছর অপেক্ষা করবো আমি?”

আরশান মনে মনে বললো, মিস রুমাইসা অনেক কষ্ট পেয়েছেন তাই না? আমি যোগাযোগ রাখিনি বলে অভিমান গলা অবধি জমে আছে। আমি কিন্তু ঠিকই আপনার খবর রেখেছি, আপনার স্মৃতিচারণ করে আর শ’ খানেক ছবি দেখে এতোটা দিন কত কষ্টে কাটিয়েছি জানেন? সেখানের সবাই জানে আরশানের একটা মিষ্টি রাজকন্যা আছে। যে তাঁর চোখে যাদুর কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে। সেই চোখ অন্য কারো দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাতে পারেনা। সেই চোখজোড়া কেবল রুমাইসাকেই দেখতে চায়। মনের মাঝে কেবল তাঁরই ছবি আঁকা, কানে কেবল তাঁর হাসি আর কথার ঝনঝনানির শব্দ।
এই পৃথিবীতে আর কারো সাধ্য আছে এই মনে আসীন হবার?

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে