#নয়নাভিরাম (পর্ব-৮)
♡আরশিয়া জান্নাত
এতো সুন্দর করে ডেকোরেশন করা ছাদটায় গালে হাত দিয়ে বসে আছি সবাই। দাদীজানের আজকেই সব জানতে হলো! এতো এতো প্ল্যানিং সব বুঝি ভেস্তে গেল। মন খারাপের পাশাপাশি বিরক্ত ও লাগছে খুব। মনে মনে একটা অপেক্ষা দাদাজান নিশ্চয়ই দাদীজানের মান ভাঙিয়ে ছাদে নিয়ে আসবেন, তারপর আমরা সবাই হৈ হুল্লোড় করবো।
ফাহিম— মিমি মন খারাপ করো না। এটা তোমাকে একদম মানাচ্ছে না।
ছোটন— ঠিক বলছোস ফাহিম। এই মিমি চল তো আমরা গিয়ে উনাদের টেনে নিয়ে আসি। এই বুড়ো বয়সে এসব নিয়ে বাড়াবাড়ির কি আছে।
নীলা— তোরা ছেলেরা ঠিক থাকলে এমন হতোনা। তোদের মনে থাকে এক বাইরে আরেক।
ইলহাম– এসব ফাও কথা। এখন পুরুষজাতীকে অসম্মান করে বিদ্বেষ ছড়াবিনা নীলা ভানু।
নীলা– ভানু ডাকবিনা । ভানু হবে তোর বৌ আমি না।
ছোটন– উফফ তোরা ঝগড়া থামাবি। কোথায় সল্যুশন বের করার চেষ্টা করবি তা না খালি ঝগড়া।
আমি উঠে বললাম তোরা থাক আমি আসছি।
নীলা– তুই আবার কই যাস?
আমি– শেষ ট্রাই করে আসি আসলে আসবে না আসলে আমরা একাই পার্টি করমু।
তখনই দাদাজান দাদীজানকে নিয়ে ছাদে আসলেন। পেছনে আপু ভাইয়ারা সবাই এলো।
দাদাজানের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই তিনি ইশারায় বললেন সব ঠিক আছে।
আমি দাদীজানকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাকে একদম নতুন বৌয়ের মতো লাগছে দাদীজান।
তারপর কেক কেটে ফটোসেশন হলো, অনেক হৈচৈ করে খাওয়া শেষে গানের আসর বসলো। শেষ ভালো যার সব ভালো!
__________
দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকগুলো মাস। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সবে বাবার অফিসে জয়েন করেছি। নীলা বিয়ে করে রাজশাহী চলে গেছে, ছোটন নিজের শহরে বিজনেস স্টার্ট করেছে,ইলহাম মালয়েশিয়ায় । ঢাকায় এখন বন্ধু বলতে কেবল ফাহিম ই আছে। তাঁর সাথে আমার সপ্তাহে একদিন হলেও দেখা হয়। বাকি সবাই যার যার জীবন নিয়ে মহাব্যস্ত। জীবনটা মাঝেমধ্যে অদ্ভুত মনে হয়। বন্ধুরা সব দূরে সরে যায় ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। আগের হাসি আড্ডা গান মনে পড়লে এখনো আনমনেই হেসে ফেলি কখনো বা চোখের কোণ ভিজে আসে। সময়ের রেষানলে পড়ে আমরা সবাই এগিয়ে যাই নতুন মানুষের ভীড়ে।
আমি ভেবেছিলাম আরশান আমার মনের অনুভূতি একটু হলেও টের পাবে, কিংবা তাঁর মনেও আমার জন্য কিছুটা হলেও ভালো লাগা থাকবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল ছিল। সে যখন হাসিমুখে বলেছিল এক সপ্তাহ পর সিঙ্গাপুর যাচ্ছে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এমন নয় যে আমি আগে থেকে জানতাম না সে যাবে। তবু আশা ছিল যাওয়ার আগে কিছু একটা বলে যাবে, আমার প্রত্যাশাই আমাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল হয়তো। আমি তাকে আমার বেস্ট হাসি দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলাম। সে জীবনে অনেক বড় হোক, অনেক অনেক সফল হোক মন থেকে সেই কামনা করেই উল্টোপথে বাসায় ফিরেছিলাম।
বাসায় ফিরে টেবিলের উপর চিপস দেখে অভ্যাসগত প্যাকেট খুলে খেতে খেতে রুমে গেছি অমনি ভুবনফাটানো চিৎকারে আমার কান ধরে গেল।
“ফুপ্পি তুমি আবার আমার চিপস খেয়ে ফেলছো। তোমার জন্য আমি চিপস রেখে শান্তি পাই না। আমার চিপস দাও”
আমি ডোন্ট কেয়ার মুডে বললাম, এখানে কারো নাম লেখা আছে? আমি পেয়েছি খাচ্ছি, তাতে কার কি হু??
“ঐ দেখো বড় করে R লেখা। R দিয়ে রিধি, তো আছে তো নাম লেখা। এটা আমার চিপস দাও আমারে,,,,”
“R দিয়ে রুমাইসা ও হয়। এই বাসায় আমিও আছি তো এটা আমার।”
রিধি এবার কান্না করতে করতে আম্মুকে ধরে আনলো,
“দেখো না দাদু ফুপ্পি আমার চিপস খেয়ে ফেলছে। এত বড় মেয়ে বাচ্চার চিপস খায়।”
“মিমি তুই কি বড় হবিনা? ভাইজীর চিপস কেউ খায়? কেন অযথা কাঁদাচ্ছিস বলতো?”
“তুমি এই পিচ্চি বুড়ির জন্য আমাকে বকছো? আমি বাচ্চা না তোমার? আমার জন্য চিপস থাকেনা কেন আমিও এখন কান্না করবো। আর শুনো আমি যে এই কিটক্যাট টা এনেছি এটা কাউকে দিবো না। যে একটু চিপস খেলে এতো কান্না করে তাঁকে আর কিচ্ছু কিনে দিবো না আমি”
রিধি চোখ মুছে বললো, দাদু তুমি যাও তো। আমার ফুপ্পি কে বকো না। আমার ফুপ্পিই তো চিপস খেয়েছে তো কি হয়েছে। বাবাইকে বলে আরো টিপস আনাবো। তারপর দুজন মিলে খাবো। ফুপ্পি আমি না তোমার ছোট্ট মা আমাকে চকলেট দেবেনা হু?
“এহহ এখন আসছে আমার ছোট্ট মা। ”
“ফুপ্পিইইইইইইইই”
” হাহাহা । নে মা ধর তোর চকলেট তাও গলারে শান্তি দে। কোন দিন যে আমার কানের পর্দা ফাটে আল্লাহ!”
ক্যাফেটেরিয়ায় বসে ফাহিমের অপেক্ষা করছি, গতকাল রাতে টেক্সট করলো আর্জেন্ট মিট করতে। অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পরও বলেনি কিছু। সামনের টেবিলে বসা কাপলের ঢং দেখছি বসে বসে। ভালোই লাগছে খারাপ না, মেয়েটা খুব মিষ্টি ধরনের বোঝাই যাচ্ছে। আমি বসে বসে তাদের সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হচ্ছি।
“স্যরি স্যরি লেট হয়ে গেল অনেক! বিরক্ত হও নি তো?”
“আরেহ না। বিরক্ত হবার কিছু নেই বেশ ইনজয় করছিলাম।”
“তাই নাকি? কি দেখছিলে ঐ কাপলকে?”
“হু”
“তুমি পারোও বটে! অন্যকে দেখে কি মজা পাও বলো তো?”
” ভালোবাসার মানুষদের একসঙ্গে দেখতে ভালো লাগে। চাইলেও নজর সরাতে পারিনা!”
“তুমি একা আছ কেন? কাউকে সঙ্গী করে তুমিও তেমন হয়ে যাও?”
“ভাবছি বৈরাগী হবো। বিয়েশাদী বাদ, পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়াবো আর বিন্দাস লাইফ লিড করবো।”
“এসব একা করার কি দরকার। এমন কাউকে চুজ করো যে তোমার মতো ভবঘুরে হবে। দুজন মিলে সবটা ঘুরে দেখবে!”
আমি মুচকি হেসে বললাম, কেন ডেকেছিস বললি না তো?
ফাহিম চোখ নামিয়ে কি সব ভাবলো। তারপর দম ছেড়ে বললো, মিমি আমরা খুব ভালো বন্ধু রাইট?
“সন্দেহ আছে?”
“প্রশ্ন না সহজ উত্তর দিও”
“ওকে!”
“তোমার কি মনে হয় আমাদের মাঝে সমঝোতা কেমন? মানে আমরা কি চাইলেই বেটার এক্সাম্পল হতে পারি?”
“এসব প্রশ্ন করছিস কেন? মনে হচ্ছে প্রপোজ করবি হেহেহে”
“করলে কি খুব বড় অপরাধ হবে?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাব বোঝার চেষ্টা করলাম। ফাহিম মোটেও ফান করার মতো ছেলে না,খুব রিজার্ভ আর হেল্পফুল ছেলে। সবসময় আমার আশেপাশে ছায়ার মতো ছিল। ও যদি আজ সত্যি সত্যিই প্রপোজ করে বসে না করার কি কোনো পথ থাকবে?
ফাহিম বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পারলো,শান্তস্বরে বললো, মিমি অস্থির হয়ো না। তোমার আনসার যাই আসুক আমাদের বন্ধুত্বে বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়বে না আই প্রমিজ!
তবে আমার মনে হলো বলে ফেলাটা আবশ্যক রেজাল্ট যাই আসুক! না বলতে পারার গ্লানির চেয়ে এটাই ভালো হবে।
মিমি আমি তোমাকে ভার্সিটির সেই ফার্স্ট দিন থেকে পছন্দ করি। তোমার দুষ্টুমি, হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েও হাসতে হাসতে খুন হওয়া, মানুষের বিপদে এগিয়ে যাওয়া কিংবা জীবনের সকল সমস্যাকে তুড়ি মেরে এড়িয়ে যাওয়া সবকিছু আমার পছন্দ। তুমি যখন হাসো আমার মনে হয় না এই পৃথিবীতে কান্না বলে কিছু আছে! দেখা হলেই যেভাবে পিঠ চাপড়ে বলো “কিরে শালা আছিস কেমন!” এটাতেও আমি মুগ্ধতা খুঁজে পাই। আমি প্রথমে ভেবেছি সবসময় আশেপাশে থাকি বলে মায়ায় পড়েছি বোধহয়। কিন্তু দিন যতো গেছে মায়া কাটেনি বরং পরিপূর্ণ ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে। এখনো তোমার সব সেই প্রথম দিনের মতোই আমার ভালো লাগে, তোমার দোষগুণ সব নিয়েই তোমাকে ভালো লাগে। তোমার হাসি যেমন ভালো লাগে তেমনই তোমার রাগে ভ্রু কুঁচকে তাকানোটাও ভালো লাগে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও কমেনা বরং নতুর করে দ্বিগুণ হারে বাড়ে। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি এসব অনুভূতি ঝেড়ে ফেলতে। কিন্তু তুমি মানুষটাই এমন যাকে একবার ভালোবাসা শুরু করলে সেটা কখনোই থামানো যাবেনা।
মিমি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কতোটা ভালোবাসি তা প্রকাশ করার সাধ্য নেই আমার।
বলা শেষ করেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফাহিম দৌড়ে চলে গেল।
আমি হতভম্ব হয়ে ফাহিমের সব কথা শুনলাম। কি বললো ফাহিম এগুলো! এতোশত অনুভূতি জমিয়ে রেখে ছিল আমার জন্য, কই আমিতো কখনোই বুঝতে পারিনি? এমন করে এতোটা বছর যে মানুষটা ভালোবেসেছে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া টা অন্যায় হবে না?
_____________
আমি আরশান কে ভালোবাসি। এই অদ্ভুত সত্যিটা টের পেয়েছি বহু আগেই। আমি সর্বদা ছুটে চলা মেয়ে, সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেছিলাম। আমার জীবনে এমন অনুভূতি আর কখনো হয়েছিল কি না আমার মনে পড়ে না। একটা মানুষের বকাবকিতেও কেউ প্রেমে পড়তে পারে তা কি বিশ্বাসযোগ্য? মনের অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে রাগে রুপান্তরিত করতে চেয়েছি। শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে তথ্য যোগাড় করা, কল করে হুমকি ধামকি দিবে এমন প্ল্যান করেও তাঁকে কত কি বুঝিয়ে গেছি, সান্ত্বনা দিয়েছি পরম আপনজনের মতো। তারপর নিজের বোকামিতে কপাল চাপড়েছি।
ক্লাসের মেয়েরা যখন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতো ইচ্ছে করতো সবকটার চোখ খুলে মার্বেল খেলি! যার সামনে দাঁড়ালেই হাঁটু কাঁপতো বলে স্কার্ট পড়া শুরু করেছিলাম, ফোনের অপরপাশে বসে কথার ফাঁকে ইচ্ছে করে থেমে তাঁর নিঃশ্বাস শোনার জন্য মরিয়া হয়ে থাকতাম। তাঁকে একটুখানি হাসাতে কত কি করেছি! তাঁর হাসিতে যে আমার চোখ প্রশান্ত হতো, মনের মাঝে চলতো অকৃত্রিম তান্ডব! কতো রাত যে এই ভেবেই কেঁদেছি মানুষটা তাঁর প্রাক্তনকে ভালোবাসে, তাঁকে ভুলতে পারছে না একটুও! অথচ সে কখনওই জানতে পারেনি সেসব, সে জানতো মিমি কখনোই কাঁদে না। মিমির মনে কোনো কষ্ট নেই। আরশানকে সে ভালোবাসে এটা ভাবতেই যে তাঁর চোখ ভরে আসতো সেটা কি আরশান জানবে?
কত মানুষ ই তো ভালোবাসে। ভালোবাসলেই কি কেউ কাঁদে? বিরহ ছাড়া এখানে কান্না আসবে কেন? এখানে তো সুখের অনুভূতি হবার কথা ছিল তবে আমার কেন এতো কান্না পেত? তবে কি আমি ভালোবাসতে পারিনা? এই যে মানুষটা নেই তারপরও তো আমি রোজ তাকে মিস করি। তার কথা ভেবে ঘুমোতে যাই। আমার সকাল হয় তার ছবি দেখে, এই তিন বছরে সে তো একবারও আমার খবর নেয় নি। ভুলক্রমেও টেক্সট করে জিজ্ঞাসা করেনি কেমন আছি। সেই মানুষটার অপেক্ষা করা বোকামি ছাড়া আর কি হবে?
তবুও আমি অজানা অপেক্ষায় আছি। সে ফিরবে আমার নয়নাভিরাম হয়েই চোখ জুড়াবে। হয়তো এসে বলবে, মিস মিমি আপনার কনট্যাক্ট নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, জানেন কত খুঁজেছি? আমি তো ভেবেছি দেশে ফিরে দেখবো আপনি বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছেন। যাক বাবা আমার সেই দূর্দিন এলো না!
ইশ সে কি পারে না আমার এই মিষ্টি কল্পনাগুলো সত্যি করে দিতে??
।
“মা এখন তোমার ছেলে প্রস্তুত। এবার তুমি তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করো”
আফরোজা আহমেদ ছেলের দিকে চেয়ে মুচকি হাসি দিলেন।
চলবে,,,,