নভেম্বরের শহরে পর্ব-১০

0
923

#নভেম্বরের_শহরে
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০

দৃষ্টির মাঝে এক রাশ কৌতূহল। মুখে ভয়ের ছাপ নিয়ে তাকিয়ে আছে নুহা। সামিনের মুখে রক্তিম আভা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড রেগে আছে সে। নুহা অস্থির দৃষ্টি ফেলে আশে পাশে তাকাল। কেউ এভাবে দেখে ফেললে অনেক রকম কথা বলবে। এমনিতেই তাদের বিপদের শেষ নেই। দরজা থেকে একটু সরে দাড়িয়ে কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–ভেতরে আসুন।

–আমি যেদিন ভেতরে আসবো সেদিন আপনার জন্য বিপদ নিয়ে আসবো নুহা। তৈরি থাকবেন। আমি চাইনা আজ সেই দিনটা আসুক।

বলেই সামিন আর অপেক্ষা করলো না। চলে গেলো। নুহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার কথা বা রাগের কারন কোনটাই আজ স্পষ্ট নয় তার কাছে। ছেলেটা কোনদিন স্পষ্ট করে কথা বলেনা। নুহার মন খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ করে ঘুরে দাড়াতেই মৌ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। নুহা তার দিকে তাকাল। মৌ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া চলে গেলো কেন? মা ভেতরে আসতে বলল তো।

–তুই মাকে বলেছিস ওনার কথা?

নুহা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলল। মৌ বিস্ময় নিয়ে তাকাল। বলল
–এটা কেমন কথা আপা? ভাইয়া এসেছে আর আমি মাকে বলবো না। আজব তো।

নুহা অপ্প্রস্তুত হয়ে গেলো। এখন মাকে কি বোঝাবে সে। মায়ের ঘরের দিকে গেলো সে। সালেহা তাকে দেখে বলল
–কি রে সামিন এসেছিলো নাকি? কই সে?

নুহা মাথা নামিয়ে তার কাজে ব্যস্ততা দেখিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–এমনিতেই মা। জানতে এসেছিলো সব ঠিক আছে কিনা।

নুহার মা তপ্ত শ্বাস ছাড়লেন। বেশ ভালো ছেলেটা। এই ছেলের হাতে নিঃসন্দেহে মেয়ে দেয়া যায়। এরকম ছেলে পেলে বাবা মায়ের আর কোন চিন্তা থাকে না। নুহা একটু হতাশ সুরে বলল
–মা আমার মনে হয় আমাদের বড় আব্বু আর চাচ্চুর সাথে কথা বলা উচিৎ। তাদেরকে সবটা জানান উচিৎ।

নুহার মা কোন কথা বললেন না। নুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে ফোনটা হাতে নিলো। গত দুইদিন ধরে এতসব চিন্তার মাঝে একবারও ফোনের কথা মনে ছিল না তার। চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফোনটা চার্জে দিলো। রান্না ঘরে চলে গেলো রান্না করতে।

————–
রেহানা ডাইনিং টেবিলে খাবার নিয়ে বসে আছে। আসিফ আজ অফিস যায় নি। অনেক বছর পর এরকম হল। কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করার মতো কোন কারন বা আগ্রহ কোনটাই রেহানার হচ্ছে না। সে চুপচাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আসিফ এক পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ল। সামনে থেকে রুটি আর ভাজি প্লেটে তুলে নিলো। রেহানা অনিচ্ছা সত্ত্বেও একবার চোখ তুলে তাকাল। আসিফকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–তোমার কি শরীর খারাপ আসিফ?

আসিফ চোখ তুলে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে হাসল। বলল
–কতদিন পর তোমার মুখে আমার নামটা শুনলাম রুহি। আজকাল বেশ ভালই খেয়াল করো দেখছি।

ক্লান্ত সরে বলল
–শরীরের আর কি দোষ বল। বয়স তো কম হয়নি।

রেহানা কিছুক্ষন তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। এর মাঝেই সামিন এসে টেবিলে বসলো। বাবাকে বাসায় দেখতে পেয়ে বলল
–বাবা তুমি আজ বাসায়?

রেহানা আসিফের দিকে তাকিয়েই বলল
–তোমার বাবার শরীর টা ভালো না সামিন।

আসিফ রেহানার দিকে তাকাল। বাকা হাসল। সেই হাসি রেহানার অসস্তি ধরিয়ে দিলো। সে চোখ নামিয়ে আবারো চায়ে চুমুক দিলো।

–কি হয়েছে বাবা?

সামিন প্রশ্ন করতেই আসিফ হেসে বলল
-তেমন কিছু না। এমনিতেই অফিসের কাজ সামলাতে গিয়ে একটু ধকল যাচ্ছে। খারাপ লাগছে তাই আর কি।

সামিন বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
–এবার তুমি রেস্ট নাও বাবা। আমি তো এসে গেছি। এখন আমি দায়িত্ব নিচ্ছি।

আসিফ হাসল। বলল
–তুমি আরও কিছুদিন রেস্ট নাও। এক সময় তোমাকেই তো দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। আমি এতো তাড়াতাড়ি এসব তোমার উপরে ছেড়ে দিতে চাইছি না। তোমার কিই বা বয়স হয়েছে।

সামিন মৃদু কণ্ঠে বলল
–ওকে।

—————-
দুপুরের সমস্ত কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো নুহা। মনটা ভীষণ খারাপ। শরীরটাও ভালো লাগছে না। আজও ভেবেছে কোচিং এ যাবেনা। ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পড়ল অনেক গুলো মেসেজ। ফোনটা বন্ধ ছিল তাই অনেক মেসেজ জমে গেছে। সেগুলা দেখার সময়ও হয়নি। মেসেজ বক্স খুলতেই সবার আগে চোখে পড়ল সামিনের মেসেজ। একের পর এক মেসেজ ওপেন করেই নুহা বুঝতে পারলো সামিনের এতো রাগের কারন। চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবল। তারপর কাপা কাপা হাতে সামিনের নাম্বারে কল দিলো। বেশ কয়েকবার রিং হতেই সামিন ফোন ধরে বিস্ময়ের ভঙ্গিতে বলল
–আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব?

সামিনের কথা বুঝতে না পেরে শুকনো ঢোক গিলে কাপা কাপা গলায় বলল
–জি?

–আপনি আমাকে ফোন করেছেন। এটা কি সত্যি নুহা?

সামিনের এমন অবান্তর প্রশ্নের কি উত্তর দিবে নুহা বুঝতে পারলো না। চুপ করেই থাকলো। খানিকবাদেই সামিন বলল
–কি মনে করে ফোন করলেন জানতে পারি?

নুহা মৃদু কণ্ঠে বলল
–এমনি।

–এমনি? স্ট্রেঞ্জ! আপনি আমাকে এমনিতেই ফোন দিয়েছেন। ভাবতেই অবাক লাগছে।

নুহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আসলেই তো। কেন ফোন দিয়েছে সেটাই তো সে জানে না। মেসেজ দেখে মনে হল সামিন রেগে আছে আর তাকে ফোন দেয়া উচিৎ। তাই ফোন দিয়েছে। নুহাকে চুপ করে থাকতে দেখে সামিন নরম কণ্ঠে বলল
-কেমন আছেন?

ভাবনার মাঝে ডুবে থাকায় নুহা হকচকিয়ে গেলো। কয়েকবার পলক ফেলে নরম কণ্ঠে বলল
–জি ভালো। আপনি?

সামিন মৃদু হাসল। বলল
–ভালো আছি। আপনার কি হয়েছে? কয়েকদিন ধরে কোচিং এ জাচ্ছেন না। আবার ফোনটাও অফ ছিল। সব ঠিক আছে তো?

নুহা একটু ভাবল। তার সমস্যার কথা সে সামিন কে জানাতে চায় না। এখনও সামিনের সাথে তার এমন কোন সম্পর্ক গড়ে উঠে নি যার ফলে সে সব কথা তাকে বলতে পারবে। তাই কণ্ঠে সাভাবিকতা এনে বলল
–তেমন কিছু না। বাড়ির কাজে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আর সেই কারনেই ফোনের দিকে তাকানো হয়নি। চার্জ ছিল না বলে ফোন অফ হয়ে গেছিলো।

সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–আমাকে একটা বার জানাতে পারতেন। জানেন আমার কত চিন্তা হচ্ছিলো। আমি কতবার ফোন দিয়েছি আপনাকে।

সামিনের কথা গুলো বেশ অসহায়ের মতো শোনালো। নুহা অবাক হল। এতো কিছুর মাঝে তার যে সামিনের কথা মনে পড়েনি তা না। পড়েছে। কিন্তু সামিনের অনুভুতির মতো এতো তীব্র ছিলনা সেটা। সামিনের অনুভুতি এতো তীব্র হওয়ার কারন কি? সে কি তাহলে নুহাকে ভালবেসে ফেলেছে? শত কষ্টের মাঝেও এক অজানা ভাললাগা গ্রাস করে নিলো মন মস্তিষ্কে। ঠোটের কোণের ক্ষীণ হাসি প্রশস্ত হয়ে গেলো। নুহাকে এভাবে হাসতে দেখে মৌ এগিয়ে এলো। ভ্রু কুচকে বলল
–আপা এভাবে হাসছ কেন একা একা?

সাথে সাথে নুহার মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো। মৃদু ধমক দিয়ে বলল
–কতবার বলেছি বড়দের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবি না। যা এখান থেকে।

মৌ ভেংচি কেটে চলে গেলো। সামিন ফোনের অপাশ থেকে বলল
–আপনি হাসছিলেন? আমি তো কোন হাসির কথা বলিনি? তাহলে কি ভেবে হাসছিলেন?

নুহা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ইতস্তত করে বলল
–এমনি হাসছিলাম।

–এমনি তো নয়। কিছু তো একটা লুকাচ্ছেন আপনি। এবার তো এই হাসির রহস্য আমাকে খুজে বের করতেই হবে।

নুহা আবারো হাসল। কিন্তু সেই হাসির শব্দ সামিনের কান পর্যন্ত পউছাল না। তবুও সামিন বুঝে গেলো। মৃদু কণ্ঠে বলল
–আপনি আবারো হাসছেন নুহা। আমার কথা তাহলে আপনাকে হাসতে বাধ্য করে। নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে। আমি আপনাকে হাসাতে পেরেছি।

এবার নুহা শব্দ করে হাসল। সামিন কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
–সরি নুহা। আপনার সাথে খারাপ ব্যাবহার করার জন্য অনেক সরি। আসলে খুব চিন্তা হচ্ছিলো আপনাকে নিয়ে। তাই না বুঝেই আপনাকে অনেক কিছু বলে ফেলেছি। আপনি আমাকে মাফ করবেন তো?

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে