#নভেম্বরের_শহরে
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৮
ঘড়ির কাটা ৩ টার ঘরে। দুপুর হলেও রোদের তেজ খুব একটা নেই। মনে হচ্ছে আর একটু পরেই রোদটা চলে যাবে। নুহা কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মাথার চুল আচড়ানো শেষ করে চিরুনিটা নিচে রাখতেই ফোনটা বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে বেশ বিরক্ত হলো। ফোনটা তুলবে কিনা ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল। সস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোনটা ব্যাগে ভরে নিয়ে রেডি হয়ে বের হলো। বাইরে বেরিয়ে এক ধাপ ফেলার আগেই আবার ফোন বেজে উঠলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে খুব বিরক্ত হয়েও ফোনটা ধরে ফেললো। কিন্তু কোন কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে গম্ভীর আওয়াজ আসলো।
— নুহা কথা বলছেন না কেনো?
হুট করেই মস্তিষ্ক অতি কাঙ্ক্ষিত কিছুর জানান দিলো। মন আনন্দে ছলকে উঠলো। মুচকি হেসে বলল
— আপনি?
— কেনো অন্য কেউ ভেবেছিলেন?
সামিন ফিচেল গলায় বলতেই নুহা মৃদু সরে বলল
— সেরকম কেউ নেই। তাই ভাবার প্রশ্ন আসে না।
সামিন চুপ হয়ে গেলো। একটু থেমে বলল
— আপনি কি বাইরে?
— বাড়ির সামনে। কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়েছি।
নুহার কথা শেষ হতেই সামিন ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
— বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন ১০ মিনিট।
নুহার ভ্রু কুঁচকে গেল। কৌতূহল নিয়ে বলল
— কেনো?
— আমাকে না বলে বের হওয়ার শাস্তি। একপাও নড়বেন না। একটুও যদি নড়েছেন তাহলে কিন্তু শাস্তি বেড়ে যাবে।
কথা শেষ করেই সামিন ফোন কেটে দিলো। নুহা চোখের পাতা পিটপিট করে এদিক সেদিক তাকাল। অস্থির দৃষ্টি তার। কি করবে বুঝতে পারছেনা। কেনো দাড়াতে বলল সামিন। কারণটা তো বলল না। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা টাও বাড়াতে পারছে না। কেনো জানি মনটাই টানছে না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দাড়িয়েই থাকলো কিন্তু ১০ মিনিট পেরিয়ে ১৩ মিনিট হয়ে গেলো। এবার নুহা বিরক্ত হয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটু হাঁটতেই ঠিক সামনে এসে একটা গাড়ি দাড়িয়ে গেলো। নুহা চমকে গেলো। সামিন মাথা বের করে বলল
— গাড়িতে উঠুন।
নুহা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো। সামিন গাড়ির হর্ন বাজাতেই নুহা চমকে উঠলো। পিছন ঘুরে বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। সামিন গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল
— কোথায় কোচিং আপনার?
নুহা মিনমিনে কণ্ঠে জবাব দিলো।
— যে রাস্তায় আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো সেখান থেকে একটু সামনেই।
সামিন সামনে তাকিয়েই বলল
— আপনি ঠিক কয় পা বাড়িয়েছেন সেটার হিসাব রেখেছেন তো?
নুহা বুঝতে না পেরে বলল
— জি?
— বলেছিলাম এক পাও বাড়ালে সেটার জন্য শাস্তি বেড়ে যাবে। কয় পা বাড়িয়েছেন? আপনি যদি হিসাব না রাখেন তাহলে আমি কিন্তু বেহিসাবী শাস্তি দিবো। মনে রাখবেন আমার কাছে শাস্তির কোন মাফ নেই।
নুহা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো। অবাক হয়ে বলল
— কি শাস্তি।
সামিন সামনে তাকিয়েই বলল
— আপনাকে প্রতিদিন আমার সাথে কোচিং এ যেতে হবে।
নুহা নড়েচড়ে বলল
— প্রতিদিন?
সামিন কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল
— কেনো প্রতিদিন যেতে কি সমস্যা?
নুহা মাথা নামিয়ে বলল
— কোন সমস্যা নেই তো।
— নুহা আমি কি আপনাকে বিরক্ত করছি?
সামিন এর কথা শুনে নুহা বেশ বিরক্ত হলো। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
— আপনি বারবার একই কথা কেন বলছেন বলুন তো?
সামিন গম্ভীর গলায় বলল
— আপনি কেনো বারবার সেরকম আচরণ করছেন। কেনো বারবার আমাকে বোঝাতে চাইছেন যে আমি আপনাকে জোর করছি। তাহলে আমার ভাবনাটা আমার দোষ হয় কি করে নুহা?
নুহা রেগে গেলো। রাগী গলায় বলল
— দেখুন আমি সেরকম কিছুই বলিনি। আর বোঝাতেও চাইনি। আপনি নিজের মতো করে সব কিছু বুঝে নিচ্ছেন।
সামিন সাভাবিক ভাবে নুহার দিকে তাকাল। বলল
— আপনি রাগ করতে পারেন?
— কেনো আমাকে কি আপনার মানুষ মনে হয়না?
— হবে না কেনো। আপনি যে সাভাবিক মানুষ সেটা তো গতদিনেই বুঝতে পেরেছি। মেয়েলি অনুভূতি গুলো সবটাই আপনার মাঝে তীক্ষ্ণ।
নুহা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বলল
— তাহলে রাগ কেনো করতে পারবোনা?
— আমি আপনাকে রাগানোর জন্য বলিনি নুহা। আপনি এভাবে কেনো রেগে যাচ্ছেন?
নুহা একটু তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বলল
— আপনার সেদিনের মিস নভেম্বরী আর নুহার সাদৃশ্যের যুক্তিটা আমার পছন্দ হয়নি। আপনি আমাকে ভুল বুঝিয়েছেন।
গাড়ি থামলো। ইতিমধ্যেই তারা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেছে। সামিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— আপনি এখনো সেদিনের কথা নিয়েই পড়ে আছেন নুহা? আমি তো ভেবেছিলাম আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।
নুহা গাড়ি থেকে নামতে গেলে সামিন লক করে দিল। নুহা ঘুরে তাকাল। সামিন বলল
— শাস্তি দিতে চান? মাথা পেতে নিবো। তবে শাস্তির মেয়াদ ঠিক কতোদিন?
নুহা কথা বলল না। সামিন আবারও বলল
— মিস থেকে মিসেস হওয়া পর্যন্তই কিন্তু আপনার এসব শাস্তি সহ্য করবো তারপর আর না।
নুহা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল
— মিসেস হওয়ার পর আমাকে আর সহ্য করবেন না?
সামিন গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। কণ্ঠে মাদক মিশিয়ে বলল
— তার মানে আপনি মিসেস হতে ইচ্ছুক?
নুহার গলায় কথা আটকে গেলো। চোখ নামিয়ে নিলো। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— আপনি খুব বেশি প্রশ্ন করেন।
সামিন লক খুলে দিলো। নুহা নেমে গেলো গাড়ি থেকে। সামিন গলা তুলে বলল
— কোচিং শেষ হবে কখন?
নুহা ঘুরে কঠিন ভাবে তাকাল। সামিন মৃদু হাসলো। কারণ সে বুঝতে পারছে নুহা তার উপরে খুব বিরক্ত হচ্ছে। সে জানে কখন নুহার কোচিং শেষ হবে তবুও জিজ্ঞেস করলো ইচ্ছা করে নুহাকে একটু বিরক্ত করতে। নুহা বিরক্ত হয়ে চলে গেলো।
————–
গাঢ় কুয়াশা ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। সকালের মিষ্টি রোদটা সেই কুণ্ডলী ভেদ করে বেরিয়ে আসতে অক্ষম। সালেহা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রোদের অপেক্ষা করছে। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। তিনি এখন সুস্থ। কিন্তু পুরোপুরি ঠিক হয়ে উঠতে পারেন নি। নিজের অসুস্থতা আবার স্বামীর শোক। দুইটা মিলেই বেশ নাজেহাল অবস্থা। মানুষটা মরে গেলে হয়তো কয়দিন পরেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারত। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানুষের শোক কিভাবে কাটবে। মনের মধ্যে একটা সুপ্ত আশা সব সময় যে মানুষটা এই বুঝি ফিরে এলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। নুহা রান্না করছে। মৌ ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ছে। নুহার উপরে খুব চাপ হয়ে গেছে। সারা বাড়ির কাজ এক হাতে সামলানো। আবার নিজের পড়ালেখা। কিন্তু সব কিছুই সে নিখুঁত ভাবে সামলে নিচ্ছে। মাকে তো কাজ করতেই দেয়না। আবার মৌকেও বিরক্ত
করেনা। কারণ মেয়েটা পড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত। সামনে তার পরীক্ষা। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য বোনকে কাজে অনেক সাহায্য করে। তবুও নুহার উপরে চাপটা খুব বেশি। সালেহা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন মেয়েটার বিয়েও তো দিতে হবে। হঠাৎ করেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। নিমেষেই জীবনটা কত কঠিন হয়ে গেলো তার কাছে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। তিনি একটু চমকে উঠলেন। আজকাল খুব অল্পতেই চমকে জান। আর কলিং বেল বাজলেই মনের মধ্যে কেমন এক অজানা ভয় জাপটে ধরে। নুহা রান্না ঘর থেকে ওড়নার মাথায় হাত মুছতে মুছতে বের হয়ে এলো। ওড়নাটা ঠিক করে খুলে মাথায় দিয়ে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলেই বাইরে দাড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো।
চলবে…….