#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা
কথা কাটাকাটির পরে কেউ কাউকে কল করেনি। রিহান ভেবেছে নৈঋতা কল দেবে। রাত দশটা পর্যন্ত মুঠোফোন হাতে নিয়ে বসেছিল, কিন্তু কোনো কল আসেনি। সে অনেকবার কল করতে চেয়েও করেনি। ভীষণ অভিমান হয়েছে ওর। মেয়েটার কত্ত সম্ভাবণা, সব পায়ে দলে এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নিতে চাইছে! কোনো মানে হয়!
নৈঋতা ওর সাথে নিজের স্বপ্নের কথা শেয়ার করত। ছোটবেলা থেকে মেয়েটা ভীষণ একা। বাবার সাথে অসীম দূরত্ব। নিজের ইচ্ছেগুলো কখনো কারোর কাছে প্রকাশ করেনি। ওর সাথে করেছিল। পরিবারে অসুখী হবার জন্যই বোধহয় নৈঋতা ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে চেয়েছিল। কারোর উপরে নির্ভর করা পছন্দ করে না। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে পরিশ্রম করে গেছে। এখন যখন অল্প কিছুটা পথ বাকি, তখন এসে কেন হাল ছেড়ে দিতে চাইছে, এটাই রিহানের বোধগম্য হচ্ছে না। সে ভাবল, এখন কল না দিলেও সকালে ওর ঘুম ভাঙানোর জন্য অবশ্যই কল করবে। গত তিন বছরে এমন বহুবার ওদের ঝগড়াঝাটি হয়েছে, ঝগড়ায় যার ইন্ধন ছিল, সেই কল করে অপরপক্ষের অভিমান ভাঙিয়েছে৷ এবারের ভুলটা তো ওর নয়, সে কেন আগেভাগে কল করবে!
সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেল। কিন্তু আড্ডাবাজ রিহানের আড্ডায় আজ কেন যেন অরুচি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ থেকে রুমে চলে এলো। হৃদি কল দিলেও কথা বলল না, সেভাবে। কিছুক্ষণ হ্যাঁ হু করে কল কেটে দিল।
ঘুমানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না। এপাশ-ওপাশ করে একটা রাত কাটিয়ে দিল কাঙ্খিত ফোনকলের অপেক্ষায়।
***
নৈঋতা অভ্যাসবশত পড়তে বসল, কিন্তু একটা অক্ষরও পড়তে পারল না। ফোনটা দূরে রেখে দিয়েছে অস্থির মনকে পথভ্রষ্ট করার জন্য। কিন্তু অবাধ্য মন ঘুরেফিরে সে-ই চোরাগলিতেই পাঁক খেতে লাগল।
রিহানকে কথাগুলো বলার আগেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বাবাকেও নিজের সম্মতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। আগামীকাল বিকেলে ছেলে দেখতে আসবে ওকে। সারিন্দায় দেখা হবে।
রিহান যদি ওর অনুভূতির খবর কোনোভাবে পেয়ে যায়, ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠবে নৈঋতা। এটা সে মানতে পারবে না। কোনো কারণ না দেখিয়ে রিহানের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করাও অসম্ভব। যোগাযোগ চলতে থাকলে একদিন ঠিকই ধরা পড়ে যাবে সে। আবার এমনি এমনি সরে গেলেও রিহান ঠিকই ওর সমস্ত হৃদয়ে থেকে যাবে। বিয়ে করে ফেললে নতুন সংসারের ব্যস্ততায় নৈঋতা হয়তো একসময় ভুলে যাবে, অন্তত চেষ্টা তো করতে পারবে! বিয়েটা ওর কাছে একটা কারণ দূরে যাবার, ভুলে যাবার চেষ্টা করবার! দ্রুততম সময়ে এরচাইতে সহজ সমাধান আর ওর মাথায় আসেনি। এতে হয়তো রিহানের রাগ হবে, অভিমান করবে, কিন্তু ওকে ভুল বুঝবে না!
রিহান যদি হৃদির সাথে ভালো থাকে, সে মাঝে আসবে না কখনো। হৃদি কী ভীষণ সুন্দর! পুতুলের মতো লাগে দেখতে। আর সে! বড্ড সাধারণ চেহারা ওর, দশজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে কখনোই ওকে আলাদা করে চোখে পড়ে না! রিহানের মতো ভীষণ সুদর্শন একজন ছেলের পাশে হৃদির মতো কাউকেই মানায়, সে ভীষণ বেমানান!
সবকিছু ভেবেই এই সিদ্ধান্ত ওর। কিন্তু এখন অসহ্য এক অস্থিরতা বারবার ওকে গ্রাস করছে। মনের সাথে যুদ্ধ করে এই সিদ্ধান্ত তো নিয়েছে, কিন্তু সে মানতে পারছে কই! রিহানকে কি সে কোনোদিন ভুলতে পারবে, নিজের অস্তিত্বের একটা অংশকে চাইলেও কি ভুলে যাওয়া যায়!
***
রিহানের আজ নির্ঘুম রাত কেটেছে৷ সময় দেখল আটটা ষোলো, এই সময় প্রতিদিন নৈঋতা কল করে ওকে৷ কিন্তু মিনিট দশেক শুয়ে থাকার পরেও কল এলো না। ছেলেমানুষি রোখ চেপে গেল রিহানের। সে শুয়ে রইল জেদ করে, উঠবে না সে। নৈঋতা ক্লাসে গিয়ে যখন ওকে পাবে না, তখন ওকে ক্লাসে নিয়ে যাবার জন্য অবশ্যই কল দেবে। কিন্তু ওর অপেক্ষা নিস্ফল হলো। সাড়ে দশটার দিকে উঠে ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা করল। আবার রুমে চলে এলো। সে জানে না আজ নৈঋতা নিজেই ক্লাসে যায়নি।
বিকেলে সে বেরিয়ে নৈঋতার হলের সামনে এসে দাঁড়াল। কল করতেই যাচ্ছিল, কিন্তু হলের গেটে নৈঋতাকে দেখে এগিয়ে গেল।
ওকে আজ কিছুটা অন্যরকম দেখাচ্ছে৷ সেজেগুজে বেরিয়েছে। রিহান জিজ্ঞেস করল, “কই যাস?”
নৈঋতা কিছুটা অপ্রস্তুত, তবে সামলে নিল দ্রুত, “আজ ছেলে দেখতে আসবে। শহরের দিকে যাচ্ছি।”
রিহানের মুখে মেঘের ছায়া গাঢ় হলো, “তার মানে তুই বিয়ে করবিই?”
“বললাম তো কাল।”
“যে আসছে, তাকে তুই আগে থেকে চিনিস?”
“নাহ্! বাবা চেনে।”
“অপরিচিত লোকের সাথে একা একা দেখা করতে চলে যাচ্ছিস?”
“সাথে নিয়ে যাব এমন কেউ নেই।”
“আমি যাই তোর সাথে?”
নৈঋতা থমকাল, স্বাভাবিক সখ্যতা ওর কয়েকজনের সাথে আছে বটে। তবে বিয়ের আলোচনা হবে, সেখানে সাথে নিয়ে যাবার মতো গভীর সখ্যতা কারোর সাথে নেই রিহান ছাড়া। আবার রিহানকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়াটাও কতটা শোভন হতে পারে সে বুঝতে পারছে না। শাফায়াতকেও সে চেনে না, অপরিচিত মানুষের সাথে একা একা যাবার রিস্ক নেয়াটাও ঠিক হবে না৷ অগত্যা রাজি হলো নৈঋতা,
“ঠিক আছে, কোনো ঝামেলা করার মতলব না থাকলে চল।”
“আমি শুধু ঝামেলা করি?”
নৈঋতা উত্তর দিল না, একটা রিকশায় উঠে পড়ল।
সত্যি বলতে রিহান সাথে যাচ্ছে বলে ওর ভেতরের অস্বস্তি অনেকটা হালকা হয়ে গেল।
***
ওরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসার কিছুক্ষণ পরে শাফায়াত এলো। প্রাণপণ চেষ্টা করে মৃদু একটা হাসি ঝুলিয়ে তাকে স্বাগত জানলো নৈঋতা।
“ইনি কে?” রিহানকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল শাফায়াত।
“ও রিহান। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”
“ও, আমি ভাবলাম বয়ফ্রেন্ড বুঝি। অবশ্য আক্ষরিক অর্থ তো ছেলেবন্ধুই। তাই না?” বলেই হো হো করে দেঁতো হাসি হাসল শাফায়াত৷ ভাবখানা এমন যেন বিশাল মজার কোনো কৌতুক করেছে।
প্রথম দেখাতেই একে রিহানের বিরক্ত লাগল।
“সব জায়গায় সব ধরনের বন্ধুদের নিয়ে যেতে নেই, এটুকু কমনসেন্স তোমার কাছ থেকে আশা করতেই পারি। তাই না নৈঋতা? নামটা ঠিক বললাম তো?”
নৈঋতা কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই রিহান বলল, “আমি যতদূর জানি আজই আপনারা ফার্স্ট মিট কিরলেন। প্রথম দেখাতেই আপনি একজন মেয়েকে তুমি করে বলছেন, আবার এমন ভাবে কথা বলছেন, যেন আপনাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আপনারও দেখছি কমনসেন্সের খানিকটা কমতি আছে।”
দপ করে জ্বলে উঠল শাফায়াত, “আমি সম্মানিত মানুষ নৈঋতা। তোমার বিয়েতে আপত্তি ছিল সেটা আগে বললেই পারতে। ডেকে এনে বয়ফ্রেন্ড দিয়ে এভাবে অপমান করলে কেন?”
এবারও নৈঋতা কিছু বলার সুযোগ পেল না, রিহান বলল, “দেখুন, শুরুটা আপনি করেছেন। একটা স্বাভাবিক বন্ধুত্বকে নিয়ে খুব বিশ্রী রসিকতা করেছেন।”
নৈঋতা উঠে বেরিয়ে এলো, ভীষণ বিরক্ত লাগছে ওর। আশেপাশে না তাকিয়ে একমনে হাঁটছিল, রিহান প্রায় দৌড়ে ওর কাছাকাছি চলে এলো।
“নীরু, শোন, তুই আমার উপরে রেগে গেছিস? দেখ, ওই ছোটলোক তোকে ডিজার্ভ করে না। তুই অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করিস।”
“যেমন?”
“যে তোকে বুঝবে, সম্মান করবে এমন কেউ।”
“সেটা তুই এক মিনিটে বুঝে ফেললি?”
“তুই ওর কথা শুনেছিস না? ওকে ডিফেন্ড করছিস!” একরাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল রিহান।
“রিহান, উনি যেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে একশোতে নিরাব্বই জন লোকই সেম রিয়েকশন দেবে। এটাই স্বাভাবিক।”
“স্বাভাবিক কীভাবে?”
“কোনো মানুষই তার হবু বউয়ের পাশে অন্য লোককে সহ্য করে না।”
“আমি অন্য লোক?”
“আমার কাছে না হলেও অন্যদের কাছে তো অবশ্যই।”
রিহান নিজের উদগত রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “তবুও, ওই লোক তোর জন্য না। বিয়েটা করিস না।”
“আমি যাকেই বিয়ে করি এটা হবেই। কেউই আমাদের বন্ধুত্বকে হাসিমুখে এক্সেপ্ট করবে না।”
“তাহলে বিয়ে করিস না।”
এবার নৈঋতা আর নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, “ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড থেকে বেরিয়ে রিয়্যালিটিতে আয় রিহান। তুই কী বলছিস তুই বুঝতে পারছিস? এটা হয় কখনো? কেন করব না বিয়ে?”
“তুই আজ সকালে আমার ঘুম ভাঙাসনি কেন?”
অপ্রাসঙ্গিক কথায় রাগের মাত্রা আরও বাড়ল ওর, “আমি কয়দিন পরে অন্য কারো ওয়াইফ হবো রিহান। হাজব্যান্ড যেই হোক, যত ভালো মানুষই হোক, অন্য লোকের ঘুম ভাঙাচ্ছে এটা কেউই মানবে না। তুইও বিয়ে করবি কাউকে। সে-ও মানবে না। এটা সম্ভব নয়।”
“আমাদের ফ্রেন্ডশিপ এখন অন্য লোকের ইচ্ছের উপরে ডিপেন্ড করবে? তোর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই?”
“এটাই সমাজের নিয়ম রিহান।”
“আমি মানি না।”
“আমি মানি।”
রিহান যদি বলত “অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে না, চল আমরা বিয়ে করি।”
তাহলেও সে ভেবে দেখত। কিন্তু এখন, বাস্তবতা বিবর্জিত কথাগুলো অসহ্য লাগল নৈঋতার।
নিজেকে শক্ত করল নৈঋতা, ওদের বন্ধুত্বের জন্য, রিহানের ভালোর জন্য, রিহানের চোখে নিজের জন্য অর্জিত সম্মানের জন্য, কড়া গলায় বলল,
“না মানলে নাই৷ যা খুশি কর।”
বলে এগিয়ে যাচ্ছিল, পেছনে ফিরে সে আবার বলল, “নিজের দায়িত্ব নিতে শেখ রিহান৷ এলার্ম সেট করে ঘুমাবি, আমার ডাকার অপেক্ষা করিস না।”
বলেই রিকশা ঠিক করে উঠে পড়ল। রিহান তখনও স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল। ওর হঠাৎ মনে হলো এক পৃথিবী শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরল৷ নৈঋতা যেন ওর সমস্ত ভালো লাগা সাথে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে! এমন অনুভূতি আগে কোনোদিন হয়নি ওর। আজ কেন এমন লাগছে!
নৈঋতার বন্ধুত্ব তো শুধু বন্ধুত্ব নয়! কবে সে এতটা নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে মেয়েটার প্রতি! জীবন কোনোদিন কোনোকিছুর পরোয়া করেনি রিহান, মা’য়ের পরে নৈঋতা একমাত্র নারী, যাকে সে নিজের বলে ভেবেছে, ওর একমাত্র প্রাণের বন্ধু। যার প্রতি পরম বিশ্বাসে নির্ভর করা যায়!
এটা এমন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যে পথ আলাদা হয়ে গেলে ওর জীবন কোথাও থমকে যাবে!
………
(আগামীকাল শেষ পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ, দুই পর্ব একসাথে এডিট করে পোস্ট করেছি এটা। বানান ভুল থাকলে কমেন্টে জানেবেন, আমি একটু বিশ্রাম নেই এবার। কিছুক্ষণ পরে এসে ঠিক করে দেব ইনশাআল্লাহ।)
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ প্রিয়া রহমান আপু।