#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা
মানুষের জীবন স্থবির হোক বা চলমান, ঋতু ঠিকই পরিবর্তন হয়, পাল্টে যায় প্রকৃতির রঙ। প্রত্যেক ঋতুর নিজস্ব রঙে ঢঙে সেজে উঠে প্রকৃতি। এই বহমান সময়েও কোথাও যেন নিশ্চল হয়ে আছে নৈঋতার জীবন। অথচ সমস্তই স্বাভাবিক নিয়মে, নিত্যকার মতোই ঘটে চলেছে, তবুও কোথাও একটা জায়গা যেন একই ঘূর্ণাবর্তে পাক খাচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের ছোঁয়া সেখানে লাগে না, মনের সেই কোণ যেন শীতঘুমে মগ্ন। সেই মগ্নতায় একটাই অস্তিত্ব বিরাজ করছে কেবল, রিহান৷ এই ঘূর্ণাবর্ত থেকে যেন নৈঋতার মুক্তি নেই। মন কেন মস্তিষ্কের কথা শোনে না, বারণ মানে না!
নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়েছে মাস দুয়েক। রিহান আগের মতোই আছে। ওদের নিত্য খুঁনসুটিও চলে। তবে কথা বলতে বলতে আচমকা থেমে যায় সে, রিহানের কথা শুনতে কোথাও যেন হারিয়ে যায়! ভেতরে একটা অসহ্য অস্থিরতা ওকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে।
“নীরু, এই নীরু…”
রিহানের ডাকে সম্বিত ফিরতেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিল নৈঋতা, “হুম, বল। শুনছিস।”
“ঘোড়ার ডিম শুনছিস। তোর সমস্যাটা কী বলবি? এইবার বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই দেখছি, তুই কেমন অন্যরকম বিহেভ করছিস। দুই মাস ধরে তোকে একটা প্রশ্নই করছি৷ কোনো উত্তরই দিচ্ছিস না।”
রিহানের গলায় রাগের ছাপ স্পষ্ট, “রিহান, কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিকঠাক। আচ্ছা, গিটার যেহেতু এনেছিস, একটা গান শোনা।”
“মুড নেই।” বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল রিহান।
“নামী সিঙ্গারদের মতো এক্সকিউজ দিচ্ছিস কেন?”
“তোর কথাবার্তায় মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”
নৈঋতার একবার মনে হয় অব্যক্ত কথা যা ওকে সারাক্ষণ জ্বালাতন করছে, তা প্রকাশ করে ফেলে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে নিরস্ত করে। রিহানের কাছে সে অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা, এভাবে নিজেকে প্রকাশ করে ওর চোখে নিতান্ত সাধারণ হতে সে কোনোদিনও পারবে না।
“আমি তো কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছি, তাও আমার কথায় তোর মেজাজ খারাপ হচ্ছে?” অবশেষে বলার মতো একটা কথা খুঁজে পেল নৈঋতা।
“তোর এমন গা-ছাড়া হাবভাবটাই বিরক্ত লাগছে।”
রিহান রাগলে নাকের পাঁটা ফুলে যায়, শিশুরা যখন খেলনা পছন্দ হলে কিনে দেবার জন্য জেদ করে সাড়া পায়না, তখন যেমন দেখায় ওকেও তেমন দেখাচ্ছে। নৈঋতা রিহানের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
“হয়েছে, হয়েছে। আর মেজাজ খারাপ করতে হবে না। গান শোনাবি নাকি চলে যাব?”
রিহান চুলগুলো পরিপাটি করে আবারও একই ভঙ্গিতে বসে রইল। এই ছেলে মারাত্মক জেদি, তবে জেদ নৈঋতারও কম নয়। সে উঠে দাঁড়ালো, দুই কদম এগুতেই গিটারের টুংটাং শোনা গেল। নৈঋতা মৃদু হেসে ঘুরে দাঁড়ালো, যাক মেঘ কেটেছে তবে!
“তুমি আমার পাশে বন্ধু হে, বসিয়া থাকো।
একটু বসিয়া থাকো..
আমি মেঘের দলে আছি, আমি ঘাসের দলে আছি।
তুমিও থাকো বন্ধু হে..!
বসিয়া থাকো.. একটু বসিয়া থাকো..
রোদের মধ্যে রোদ হয়ে যাই, জলের মধ্যে জল;
বুকের মধ্যে বন্ধু একটা নিঃশূন্য অঞ্চল।।
আমি পাতার দলে আছি, আমি ডানার দলে আছি।
তুমিও থাকো বন্ধু হে..!
মেঘের মধ্যে মেঘ হয়ে যাই, ঘাসের মধ্যে ঘাস;
বুকের মধ্যে হলুদ একটা পাতার দীর্ঘশ্বাস।।
তুমি আমার পাশে বন্ধু হে, বসিয়া থাকো।
একটু বসিয়া থাকো…
নৈঋতা তন্ময় হয়ে রিহানের গান শুনছিল, ওদের দুজনেরই ভীষণ প্রিয় গানটা। সে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে, এটা রিহান কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছে, কিন্তু কারণটা জানে না, তাই এভাবে রাগারাগি করে কারণ খুঁজতে চাইছে, বুঝতে পারছে নৈঋতা।
***
এর সপ্তাহখানেক পরে ক্যান্টিনে সকালের নাস্তা করে নৈঋতা সিঁড়িতে উঠছিল, হঠাৎ হৃদির সাথে দেখা হয়ে গেল। ওকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ?”
সেও হেসে উত্তর দিল, “ভালো। তুমি কেমন আছ?”
“ভালো। নৈঋতা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, ভীষণ জরুরি। একটু সময় দিতে পারবে? পাঁচ মিনিট?”
ক্লাসের তখনও আধাঘন্টা বাকি আছে।
“ঠিক আছে। বলো।”
“চলো, ওইদিকে বসি।”
ওরা হলের ওয়েটিং রুমে এসে বসল।
“কীভাবে জিজ্ঞেস করি বুঝতে পারছি না। কথাটা পার্সোনাল। কিছু মনে করবে না প্লিজ।”
নৈঋতা বুঝতে পারছে বিষয়টা রিহানকে নিয়ে। কথার এসব ভণিতা ওর ভীষণ বিরক্ত লাগে! কথা না শুনে সে কীভাবে বুঝবে মনে করবে কিনা!
“বলো, প্লিজ। আসলে ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে।”
“আচ্ছা, বলি। রিহানের সাথে তোমার সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্ব?”
নৈঋতার ভীষণ ইচ্ছে করছিল সুযোগ নিতে, বলতে যে ওর সাথে রিহানের গভীর প্রেম৷ তাহলেই ওর সমস্যার সমধান হয়ে যাবে। ওর মনের একটা সত্তা ওকে প্ররোচিত করছিল, “বল, বলে দে। একটা কথাই তো! কী এমন হবে!”
কিন্তু পারল না, ওর চির সংস্করাচ্ছান্ন মন, ওকে বাঁধা দিল। রিহান যদি সত্যিই হৃদিকে চায়, সে কেন মাঝখানে তৃতীয় পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে! সে পারল না, শান্ত স্বরে বলল,
“কথাটা রিহানকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল তোমার।”
“করেছিলাম। ও বলেছে তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু অনেকেই বলাবলি করছিল যে…”
“যেহেতু তুমি ওর সাথে একটা সম্পর্ক শুরু করতে চাইছ, ওকে বিশ্বাস করা উচিত ছিল তোমার। অল দ্যা বেস্ট, হৃদি৷ ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।”
বলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো নৈঋতা। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটা জগদ্দল পাথর যেন ওর বুকে চেপে বসছে, একটা দলা পাকানো কষ্ট বুক বেয়ে উপরে উঠতে চাইছে।
***
সমান্তরাল রেললাইনের দুই পাশে রিহান আর নৈঋতা মুখোমুখি বসে আছে।
“তোর রেজাল্টে আমি এত্ত খুশি হয়েছি নীরু। একটা আফসোস, ফিশারিজ টেকনোলজিতে আমার এমএসের পয়েন্ট হবে না মনে হয়। তুই তো এটাতেই এমএস করবি!”
নৈঋতা রিহানের পেছনে গাছের সাড়িতে বসা একটা স্যাঁতসেঁতে সবুজ রঙের পাখির দিকে চোখ রেখে বলল,
“আমি এমএস করব না।”
“কেন?” আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল রিহান।
“ভাবছি বিয়ে করব।”
এবার রিহান হেসে ফেলল, “হ্যাহ্! জোক মারিস না।”
“আমি সিরিয়াস রিহান৷ এবার বাসায় গেলে বাবা বিয়ের ব্যাপারে বলেছিল, রাজি হয়ে যাব ডিসিশন নিয়েছি।”
রিহান হাসি থামিয়ে নৈঋতাকে পর্যবেক্ষণ করল, নৈঋতার মুখাবয়বে কৌতুকের কোনো আভাস নেই।
“নীরু, এসব কী বলছিস? বিয়ে করবি? এখনি তোর বিয়ের এত তাড়া কীসের? আর বিয়ে করবি ভালো কথা, কর। কিন্তু এমএস কেন করবি না?”
নৈঋতার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না পেয়ে বলল, “নীরু, তোর কত স্বপ্নের কথা তুই আমার সাথে শেয়ার করেছিস! তোর এত্ত ভালো সিজিপিএ, এমএস করে ইজিলি লেকচারারের জন্য শর্টলিস্টে সিলেক্টেড হয়ে যাবি৷ পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাবি। এটায় না হলেও অন্য কোনো সেক্টরে তুই চোখ বন্ধ করে টিকে যাবি। এত কষ্ট করে, পরিশ্রম করে পড়াশোনা করিস। সবকিছু এভাবে ছেড়ে দিবি? আমি নাহয় খামখেয়ালি, তুই তো এমন না। হঠাৎ এসব পাগলামির মানে কী?”
“মানুষের ইচ্ছে পরিবর্তন হয় না? আমারও হয়েছে। আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।”
“এবসার্ড নীরু। আমি মানব না তোর ডিসিশন।”
“লাইফটা আমার রিহান, ডিসিশনটাও আমার।”
রিহানের মুখে একইসাথে বিস্ময় আর বিষাদ খেলে গেল, “হ্যাঁ, তোর লাইফ। স্যরি রে, তোর লাইফে ইন্টারফেয়ার করার জন্য। আমি ভুলে গিয়েছিলাম বন্ধুর জন্য ভালো কিছু চাওয়াটা অন্যায়৷ মাফ করে দিস।”
বলেই উঠে হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে রিহান, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে নৈঋতার। ওদের অগুণতিবার ঝগড়া হয়েছে, মান-অভিমান হয়েছে। কিন্তু কখনো আজকের মতো অবস্থায় পৌঁছেনি। চমৎকার সাজানো একটা জিনিস যেন নিজের হাতে শেষ করে দিল নৈঋতা! কখন চোখের কোল বেয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে, সে বুঝতেই পারেনি। কতক্ষণ ঠায় বসে রইল সে।
………..
(ক্রমশ)