নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০৫

0
7

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা

সামনেই যেহেতু পরীক্ষা, নৈঋতা নিজেকে ব্যস্ত রাখার একটা সুযোগ পেল। রিহানের কোনোকিছুই গোছানো নেই।

সে বলল, “আমি শিট ফটোকপি করার সময় দুই কপি করে করেছিলাম। তুই বললি পরীক্ষার আগে নিবি। নে এগুলো।”

শিটগুলো নেড়েচেড়ে রিহান প্রশ্ন করল “এগুলো পড়া কমপ্লিট তোর?”

“আমি দিনের পড়া দিনেই শেষ করে ফেলি রিহান। তোর মতো একরাতে পড়ার জন্য জমাই না।”

“কষ্ট করলে একবারই করব, পুরো সেমিস্টার ধরে করতে পারব না। এত চাপ নাই।”

রিহান ক্লাসেও লেকচার নোট করে না, নৈঋতা ওর ক্লাস খাতারও ফটোকপি করে দিয়েছে।

রিহান সেটা দেখে বলল, “তুই তো আছিসই দোস্ত। তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট দোস্ত থাকলে এত কষ্ট করার কী দরকার!”

নৈঋতা অবচেতনেই বলে ফেলল, “আমি তো আর সবসময় থাকব না।”

“মানে?”

“এই যে অনার্সের আর একটা সেমিস্টার বাকি, প্রায় তো শেষই হয়ে আসছে। তাই বললাম।”

“এমএস আছে না?”

“হুম, তা আছে।”

প্রতিবার পরীক্ষার সময় রিহান রাত জেগে পড়তে চায়। রাত জাগায় সে অভ্যস্ত, রীতিমতো নিশাচর, কিন্তু পরীক্ষার সময় কোত্থেকে রাজ্যের ঘুম এসে চোখে জমা হয় কে জানে। নৈঋতাই ওকে কিছুক্ষণ পরপর কল দিয়ে জাগিয়ে দেয়। নিজে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেটা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না, ঘুমঘুম গলায় বলল,

“আমি পড়ছি তো নীরু।”

নৈঋতা কড়া স্বরে বলে, “এক্ষুণি চোখে পানি দিয়ে আয়, এরপর কফি খা। তারপর বোস।”

কিছুক্ষণ পরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এটা সব পরীক্ষায় ওদের নৈমিত্তিক রুটিন। পরে পরীক্ষার দিন এটা নিয়ে কথা শোনালে বলে,

“পরেরবার তোর মতো হয়ে যাব নীরু। দেখিস, পাক্কা। শুরু থেকেই পড়ব।”

কিন্তু পরেরবার আবার একই অবস্থা। নেড়া বেলতলায় একবার যায় প্রবাদবাক্যকে ভুল প্রমাণ করে এই ছেলে বারবার বেলতলায় গিয়ে মাথায় বেল পড়ার জন্য অপেক্ষা করে।

ওরা হাঁটছিল, রিহান হঠাৎ বলল, “হৃদি আমাকে ওর সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলেছে।”

“ডেট?”

“সেরকম না, ওর বার্থডে সেলিব্রেট করবে। ওর বন্ধুরাও থাকবে।”

“ও, ভালো।” নৈঋতার গলা নিষ্প্রভ শোনায়৷

রিহান থেমে হঠাৎ বলল, “তুই যাবি?”

“কোথায়?”

“হৃদির…”

পুরোটা শেষ করতে না দিয়েই নৈঋতা আশ্চর্য হয়ে বলে, “তুই পাগল রিহান! সেখানে আমি কীভাবে যাব?”

“সমস্যা কী গেলে?”

“তোর সমস্যা না থাকতে পারে, কিন্তু আমি অযাচিতভাবে কোথাও যেতে চাই না৷”

নৈঋতার বলতে ইচ্ছে করল, “তুই একটা মহা গবেট রিহান, কোনো মেয়েই তার ভালোলাগার মানুষের সাথে কোনো মেয়েকে দেখে খুশি হয় না, সে যতই প্রাণের বন্ধু হোক।”

এই ছেলে কেন বোঝে না! কিন্তু বলল না কথাটা। জিজ্ঞেস করল,

“গিফট কিনেছিস?”

“নাহ্!”

“একটা গিফট কিনিস।”

“সেটা তো কিনবই।”

“আচ্ছা।”

“কিন্তু আমি মেয়েদের জন্য কিছু কিনতে পারি না৷ মা’র জন্য তো তুই পছন্দ করে দিস।”

রিহান টাকা জমিয়ে মায়ের জন্য মাঝেমধ্যে এটা-সেটা কেনে। একবার টিউশন শুরু করেছিল, সেটার টাকা দিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছিল, নৈঋতা পছন্দ করে দিয়েছিল।

দুই মাস পড়ে পড়ানো ছেড়ে দেয়, ওর ভালো লাগে না, স্টুডেন্টের মা না-কি একদিন কী বলেছে, ওর ভীষণ গায়ে লেগেছিল কথাটা৷ সেজন্য আর যায়নি৷ পরের মাসের টাকাটাও নিতে যায়নি আর। এরপর আর কখনো ওই পথে যায়নি।

“ওর পছন্দের পারফিউম দিতে পারিস, বই পছন্দ করলে দিতে পারিস। এগুলো তোর বাজেটের মধ্যে হয়ে যাবে, সাথে ফুল।”

“ভালো লাগে না আমার।”

“কী ভালো লাগে না?”

“এই যে এত ভাবনাচিন্তা করে গিফট কেনা৷ তার উপর ওর পছন্দও আমি তেমন একটা জানি না। কাউকে গিফট দেবার পরে সেটার জাজমেন্ট হবে, এটাই আমার ভালো লাগে না।”

নৈঋতা জানে সেটা, ওর এই কথাবার্তা ভালো লাগছে না।

“জেনে নিস। আমার পড়তে হবে। যাই রে, তুই পড়তে বসিস। এখন এটা নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করতে হবে না।”

“এসব নিয়ে কেন চিন্তা করতে যাব। ধূর।”

নৈঋতা নিজের রুমে ফিরে এলো। পড়ার কথা বলে এসেছে৷ কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করল না এখন। মাথা ব্যথা করছে। সে আসার সময় বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল, খেতেও ইচ্ছে করল না। জামা বদলে শুয়ে পড়ল, কিছুক্ষণ ঘুমালে শরীর আর মনের দুই যন্ত্রণাই কমবে ভেবে৷ কিন্তু ঘুম এলো না। শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকল।

***
দেখতে দেখতে ওদের পরীক্ষা শেষ এলো। আজই শেষ পরীক্ষা। ভাইভা শেষ করে বেরিয়ে হেঁটে জব্বারের মোড়ের দিকে যাচ্ছিল ওরা। আজকের ভাইভা ততটা ভালো হয়নি কারোরই। সেজন্য মনটা তেতো হয়ে আছে নৈঋতার।

“মন খারাপ করে আছিস কেন? একটা ভাইভাই তো! এত সিরিয়াস হবার কী আছে? চিল নীরু।”

“গায়ে বাতাস লাগিয়ে এক্সাম দিলে তোর মতো চিল চিল বলাই যায়। কষ্ট করে পরীক্ষা দিলে এসব চিল টিল আসে না।”

আজ মেঘলা দিন। আকাশ থমথমে, কিন্তু বৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রিহান হৃদির জন্মদিনে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফেরার আগে আগে হৃদির এক বন্ধু নাকি ওকে বলেছে, সবাই ভেবেছিল সেদিন সে হয়তো হৃদিকে প্রপোজ করবে। ফিরে এসে নৈঋতাকে এটা বলেছিল রিহান৷ সে নাকি এখনো প্রপোজ করার কথা ভাবেনি।

শুনে নৈঋতা রিহানকে বলেছিল, “প্রপোজ করে ফেললেই পারিস। একটা কমিটমেন্ট ছাড়া মেয়েটা ঝুলে থাকবে নাকি!”

“তুই এটা বলছিস নীরু? কমিটমেন্টে যাবার জন্য আমি এখনো প্রস্তুত নই। আমি এটা হৃদিকে আগেই বলেছিলাম৷ সব জেনে যদি ও এক্সপেক্টেশন রাখে সেটা আমার দোষ? আমার যে ওকে খারাপ লাগে তা না, ভালোই লাগে, সেজন্যই কন্টিনিউ করছি কথাবার্তা। কিন্তু ওরও তো আমাকে বুঝতে হবে নাকি!”

“এই যে বললি ভালো লাগে, এটা যথেষ্ট না?”

“না। আমার সময় লাগবে জিনিসটার সাথে মানিয়ে নিতে। আমি অভ্যস্ত নই।”

“কাল বাসায় যাবি?”

রিহানের প্রশ্নে সম্বিতে ফিরে উত্তরে নৈঋতা বলল, “হুম। তুই গিয়ে রেডি হ। তোর ট্রেন কয়টায়?”

“আমি আজ যাচ্ছি না। কালই যাব।”

“তুই না বললি আজ যাবি?”

“তোকে বাসে তুলে দিয়ে তারপর যাব।”

নৈঋতা বুঝল ওর জন্যই রিহান নিজের যাওয়া একদিন পিছিয়েছে। কিন্তু কিছু বলল না। ভালো লাগল, সে কি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে! ওর হয়তো উচিত ছিল, রিহানকে বলা, সে একা বাসে উঠতে পারবে, ওর আজই যাওয়া উচিত। কিন্তু বলতে পারল না। মনে হলো, রিহান সাথে থাকলে ওর ভালো লাগবে। এই ভালোলাগাটুকু সে হারাতে চাইল না।

“আর একটা সেমিস্টার। দেখতে দেখতে কেমন করে সময়গুলো চলে গেল।” ভাবালুতা খেলে গেল নৈঋতার গলায়।

“আসলেই, সাড়ে তিন বছর। আমাদের তিন বছরের ফ্রেন্ডশিপ, তোর মনে আছে, আগে যা ভাব নিতি আমার সাথে?” রিহানকেও নস্টালজিয়া গ্রাস করেছে।

“ভাব দেখাইনি। তখন তোকে আমার খুব ইরিটেটিং ক্যারেক্টার মনে হতো।”

“তখন আমি যেমন ছিলাম, এখনো তাই আছি। তাহলে চেঞ্জটা কোথায় হলো?” রিহানের মুখে হাসি।

“চেনায়। তখন তোকে কাছ থেকে চিনতাম না, যখন চিনলাম, তোকে পড়লাম, তখন তোকে নিয়ে আমার পারসেপশন চেঞ্জ হলো। আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।”

রেহান হেসে বলল, “প্রাণের বন্ধু।”

নৈঋতা মনে মনে বলল, “তুই জানিস না রিহান, এই জঞ্জালে ভরা ধূলোর পৃথিবীতে তুই আমার একমাত্র শান্তি।”

কিন্তু মুখে বলতে পারল না কথাটা, যদি রিহান ওকে ভুল বোঝে! যদি বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়! এই বন্ধুত্বটা ওর কাছে অক্সিজেন, সঞ্জীবনী শক্তি। একটু ভুলে সেটাকে হারাতে পারবে না নৈঋতা! তাহলে শ্বাস নেবে কী করে!

সহসাই কোনো আগমনী বার্তা ছাড়াই উন্মত্ত বাতাস উঠল প্রকৃতিতে, ধূলো, ময়লা, উড়ছে, নৈঋতা চোখ বন্ধ করল শক্ত করে। গাছপালা ভয়াবহ ভাবে দুলছে। প্রকৃতি হঠাৎ যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। সে থমকে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়।

রিহান ওর হাত ধরে টেনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, “নীরু, দ্রুত পা চালা না। ওদিকে যেতে হবে।”

একটা নিরাপদ আশ্রয়ে এসে থামল। এই মধ্য জুনে যেন কালবৈশাখীর হানা! নৈঋতার মনেও একইরকম উন্মাতাল ঝড়!

ওদের পাশে আরও অনেকেই এসে দাঁড়াচ্ছে, পাগুলে প্রকৃতি একটু শান্ত হলেই যার যার গন্তব্যে ছুটবে। নৈঋতার একারই যেন কোনো গন্তব্য নেই। কোথাও যাবার তাড়া নেই।
…………
(ক্রমশ)
আর তিন-চার পর্ব বাকি ইনশাআল্লাহ। আবার এক-দুই পর্ব কম-বেশি হতে পারে। ডিটেইলিং করতে গিয়ে কিছুটা বড় হচ্ছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে