#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা
ক্লাস শেষে নৈঋতা আর প্রতিদিনের মতো এসে বসেছে জব্বারের মোড়ের রেললাইন ঘেঁষে যে চায়ের দোকানটা আছে সেখানে। এখানকার মালাই চা রিহানের ভীষণ পছন্দের। নৈঋতার যদিও ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু হুট করে দূরত্ব তৈরি করলে অনেকগুলো প্রশ্ন চিহ্ন দাঁড়িয়ে যাবে। তাছাড়া মানুষটা রিহান, যার সাথে ওর অসম্ভব হৃদ্যতা। সেটা কি চাইলেও এক লহমায় মুছে ফেলা যায়!
“তুই মুড অফ করে আছিস কেন নীরু?”
“আমি তোর এসাইনমেন্ট করে দিলাম, খেলা ছিল পৌনে দুটোয়। এর আগে তুই কী কী করলি? যার জন্য কষ্ট করে আমাকে করে দিতে হলো?”
“কী আর করব! সাদির রুমে আড্ডা মেরেছি। এরপর হৃদি কল দিল। কথা বললাম। মাঝে একবার তুই কল দিলি। আমি পরে কলব্যাক করলাম, তুই ধরলি না। তারপর তো ম্যাচ দেখলাম। এই তো।”
কৈফিয়ত দিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রিহান বলে উঠল, “হঠাৎ এভাবে জেরা করছিস কেন?”
“এমনি। হৃদির সাথে কতদূর এগুলো? ভালোই তো কথাবার্তা চলছে।” না চাইতেই হৃদির ব্যাপারে প্রশ্ন করে ফেলল। মন যেন নেতিবাচক কথা শুনতে উৎসুক হয়ে আছে।
“খুব বেশি না। নর্মাল জানাশোনার ফেজে আছে এখনো। মেয়েটা ইন্টারেস্টেড আবার লাজুক কিছুটা। তবে আমার প্রতি এখন পর্যন্ত যারা ইন্টারেস্টেড ছিল, তাদের মধ্যে ও সবচেয়ে ভালো। এটুকু বুঝলাম।”
“কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত।” বলার সময় গলাটা ধরে আসছিল নৈঋতার।
“কীসের জন্য?”
“ফাইনালি কারো প্রতি তুই আগ্রহী হচ্ছিস। রিলেশনশিপে যাবি।”
“ধূর! কেবল কথাবার্তা চলছে। এখনি এত শিপ টিপ কীসের! পরে দেখা যাবে।”
কিছুক্ষণ নৈঋতা আর কোনো কথা বলল না। রিহান নিজের মনে বকবক করছিল। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলে আচমকা সে খানিকটা কেঁপে উঠল। অনেকেই রেললাইনে বসে ছিল, তাদের মধ্যে উঠার তাড়া দেখা গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশে গর্জন তুলে বিশালদেহী ট্রেনটা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
“চল উঠি।”
ওরা রাস্তা ধরে পাঁচতালার সামনের বারান্দা ধরে হেঁটে লাইব্রেরির সামনের রাস্তায় চলে এলো। আজকের বাতাসটা অন্যরকম। রোদ সহনীয় বলে বাতাসটা আরামদায়ক লাগছে।
আনমনে হাঁটছিল নৈঋতা, পাশে রিহান কী বলছে কিছুই যেন ওর কানে যাচ্ছে না। সহসা একটা ছোট্ট ভাঙা ইটের টুকরায় হোঁচট খেয়ে পা বেঁকে পড়ে গেল সে।
রিহান হহন্তদন্ত হয়ে বলল, “এভাবে উজবুকের মতো হাঁটছিলি কেন? দেখে চলতে পারিস না।”
হাত ধরে নৈঋতাকে তুলল সে, বলল, “তুই আমাকে কেয়ারলেস বলিস, আমাকে এভাবে উস্টা খেয়ে পড়তে দেখেছিস কখনো? কী যে করিস না তুই? হাঁটতে পারবি না তো, দাঁড়া রিকশা ডাকি। হাসপাতালে যেতে হবে, এক্সরে করতে হবে।”
সে সত্যিই ভীষণ ব্যথা পেয়েছে, পা ভেঙে গেলেও যেতে পারে। তাই আর আপত্তি করল না। ইউনিভার্সিটি থেকে চরপারা পর্যন্ত যেতে যেতে রিহান ওকে বকাবকি করেছে। অন্য সময় হলে সে ছাড় দিত না মোটেও। কিন্তু আজ সে কেবল দেখল এসবের আড়ালে ওর জন্য রিহানের উৎকণ্ঠা। হাসপাতালের সামনে রিকশা থেকে নামার আগে আগে কেবল বলল,
“এত চিন্তা করছিস কেন আমাকে নিয়ে?”
“চিন্তা হবে না? আমি ছাড়া আর কেউ আছে তোকে নিয়ে চিন্তা করার?”
নৈঋতা নিজের ভেতরের তোলপাড় আরেকবার উপলব্ধি করল।
“নীরু, তুই আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু। তুই আমাকে যতটা বুঝিস, আর কেউ এতটা বোঝে না। তুই কষ্ট পেলে আমার চিন্তা হবে না? এটা হয়?”
নৈঋতা জানে রিহান কেবলই ওকে বন্ধু বলে ভাবে, প্রাণের বন্ধু। যেই বন্ধুত্বে ছেলে-মেয়ে বিভেদ হয় না। ওর কাছে মনের আগল খুলে দেয় কিঞ্চিৎ পাগলাটে ছেলেটা। বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কোনো অনুভূতি সেখানে নেই। কিন্তু ও কেন পারল না একইভাবে রিহানকে শুধু বন্ধু ভাবতে! বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে কেন অন্য অনুভূতি ওর মধ্যে জন্মালো!
পায়ে কোনো ফ্র্যাকচার নেই, তবে মচকে গেছে ভালোমতো। ওকে বসিয়ে রেখে রিহান সমস্ত ওষুধ কিনে এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। ওর হলের সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে বলল, “কাউকে ডাক। একা একা যেতে পারবি না দোতলায়। পায়ে বাড়তি প্রেসার পড়বে।”
“আমি পারব রিহান।”
“এত প্যাকপ্যাক না করে কল দে তো৷ তুই সুপারওইম্যান না। রক্তমাংসের মানুষ।”
“দরকার নেই বললাম তো।”
“তোর রুমমেটদের নম্বর আমার কাছে নেই। হৃদিকে কল দেই, তোকে হেল্প করুক।”
“আমি সুমি আপুকে কল করছি।” হৃদির কথা শুনে নৈঋতা নিজেই কল দিতে রাজি হলো।
“এই তো ভালো মেয়ের মতো কাজ করলি।”
“ফাজলামো করবি না রিহান। গাট্টা খাবি মাথায়।”
সারাদিনে এই প্রথম নৈঋতা নিজের চেনা ফরমে ফিরল।
“এটা মিস করছিলাম। তোর বাজখাঁই গলার থ্রেট।”
ভাগ্যিস ওর পায়ে তীব্র ব্যথা, তাই আজকের মতো বেঁচে গেল রিহান।
***
এই বৃহস্পতিবার রিহান বাড়িতে গিয়েছিল। দুদিন থেকে আজ ফিরেছে। দুই সপ্তাহে নৈঋতার পা পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছে।
রিহানের কল পেয়ে রিসিভ করল নৈঋতা।
“কেআরে আয় তো নীরু।”
“কেন?”
“দরকার আছে।”
“তুই কখন এলি বাসা থেকে?”
“হলে ব্যাগ রেখেই বেরিয়েছি।”
“আচ্ছা, আসছি।”
নৈঋতা গায়ের পোশাক পাল্টে বেরিয়ে এলো। রিহানের হাতে একটা টিফিন বক্স। ওরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে চলে এলো। ওর দিকে বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মা দিয়েছে, তোর জন্য।”
“কী?”
“আমি জানি না। বলল, নীরুকে দিস।”
নৈঋতা খুলে দেখল একটায় পায়েস, অন্যটায় কিছু পিঠা।
“তুই নাকি একদিন মাকে বলেছিলি, তোর পায়েস খুব পছন্দ। তাই বানিয়ে দিলো।”
নৈঋতা যত কষ্টই পাক কখনো কাঁদে না৷ আজ কেন যেন চোখে পানি চলে আসছিল। ওর তো মা নেই, মায়ের হাতের পিঠা পায়েস ওর কখনো খাওয়া হয়নি। এই খাবারে যেন মা মা গন্ধ লেগে আছে! ভীষণ প্রশান্তিদায়ক গন্ধটা!
“ভীষণ মজা হয়েছে। আন্টিকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দিয়ে দিস।”
“তুই নিজেই দিস, আমি খাবারটা তোকে ডেলিভারি করে দিয়েছি। এখন কথাও ডেলিভারি করতে হবে?”
“তুই একটা মহা ফাজিল ছেলে।”
“আন্টির শরীর এখন কেমন? অসুস্থ শরীর নিয়ে উনি এতকিছু করেছেন।”
“এখন ভালো। আসলে বাড়িতে শুধু মা আর বাবা-ই তো থাকেন এখন। সময় কাটে না। ভাইয়া ভাবি তো ঢাকায় থাকেন কর্মসূত্রে। আমি এখানে। দুইজন বসে বসে শুধু টেনশন করে আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য। টেনশনের কী আছে তাই বুঝি না।”
“স্বাভাবিক। তুই তাদের জায়গায় থাকলে বুঝতি।”
“তুই যেন কয়টা বাচ্চা কাচ্চা পয়দা করেছিস!”
নৈঋতা পানির বোতল রিহানে পিঠে ঝপাঝপ নামিয়ে আনল কয়েকবার।
“নীরু, আরে, নীরু, তুই আমাকে এত মারিস কেন? এত বিধ্বংসী কেন তুই? আল্লাহ…”
এরকম কত অসংখ্য মুহূর্ত ওদের আছে! খুঁনসুটিতে ভরা।
হঠাৎ রিহানের মুঠোফোন বেজে উঠল। রিহান রিসিভ করে বলল, “হ্যালো হৃদি…”
সোনারঙা বিকেলটা নিমিষেই তামাটে বর্ণ ধারণ করল যেন! নদীতে ভেসে বেড়ানো অনেকগুলো নৌকা, ঘাটে বাঁধা আরও কয়েকটা। তবুও ওর চোখ চলে গেল অনতিদূরের একলা একটা পরিত্যাক্ত নৌকার দিকে। কী ভীষণ একা, সেই নৌকাটার যদি প্রাণ থাকত, তবে সেটাও বোধহয় ওর মতো কষ্ট পেত। ভাগ্যিস ওটা জড় পদার্থ, একজন মানুষ হয়ে জন্মানোর জন্যও দুঃখ হলো ওর।
……..
(ক্রমশ)
কেমন লাগছে গল্পটা?